তুহিন খানের কলাম ‘ইডেন: কিছু কিছু পলিটিকাল মেয়ে’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২

ইডেন কলেজের একদল শিক্ষার্থী দেখলাম ব্যানার নিয়া গেটের সামনে দাঁড়াইছেন। তাদের কথা হলো, ইডেন নিয়া সাম্প্রতিক প্রচারণায় তাদের লাইফ হেল হয়ে গেছে। নানাভাবে তারা ক্ষতি ও বুলিংয়ের সম্মুখিন হইছেন। ইটিসি।

এখন আমি জানি না যে, এদের সাথে আশলেই এমন কিছু ঘটছে কিনা। উপায়ও নাই জানার। কিন্তু ‘এমন কিছু ঘটতে পারে’, সেই কনটেক্সট হাজির আছে। আবার, ছাত্রীরা হুট কইরা ব্যানার লইয়া দাঁড়ায় না। এমনও হইতে পারে যে, ছাত্রলীগই তাদের দাঁড় করাইছে, ইমেজ পুনরুদ্ধারের খাতিরে। যেহেতু এই ন্যারেটিভটা মাঠে থ্রো করার গ্রাউন্ড আমরা তৈরিই কইরা দিছি লীগরে, তারা এখন সেই তৈরি গ্রাউন্ডে ন্যারেটিভের বল থ্রো করতেছে। হইতেই পারে। হয়তো এ যাত্রায়, ‘সমাজে ইডেনের মেয়েদের বুলিংয়ের শিকার হওয়া’টারেই ছাত্রলীগ তাদের রক্ষাকবজ বানাবে; এই ইস্যু সামনে আইনা তাদের অপকর্ম ঢাকার ট্রাই করবে। অসম্ভব কিছু না।

ইডেনের নারীরা কেন জাবি/ঢাবি/বুয়েটের নারীদের মতো আন্দোলন করতে পারতেছে না? কেন তারা আগায়ে আইসা বলতে পারতেছে না যে, ‘আমরা সকলে ভিক্টিম?’ এই হেডমটা নাই কেন তাদের? এইটারে আপনি অনেকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

১. সরকাান কলেজগুলার ইন্টার্নাল পলিটিকাল সিচুয়েশন। সেখানে সরকরি দল ছাড়া আর কারুরই বিশেষ কার্যক্রম নাই। আন্দোলন খাড়া করবে, দেন সেইটারে চালাবে— এ ধরনের নেতৃত্বও নাই। এককথায়, ডাইভার্সিফাইড পলিটিকাল কর্তাসত্তা তৈয়ার হওয়ার কোন পরিবেশ নাই।

২. ঢাবি/জাবি/বুয়েটে যারা পড়েন, তাদেরই ম্যাক্সিমামের লাইফ গোল থাকে স্রেফ চাকুরি। তাইলে ভাবেন, যারা ইডেন বা সরকারি তিতুমীর কলেজে পড়ে, তাদের কী গোল থাকবে লাইফের? ঢাবি/জাবিটাইপের ইউনিভার্সিটি তবু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করা, প্রতিবাদ করার পরিবেশ বা মেন্টালিটিটা দেয়। ন্যাশনালিও তারা ‘জাতির মেধাবী মুখ’ হিশাবে ট্রিটেড হয়; এসব জায়গায় পলিটিক্স করার আউটকামও বেশ ভাল। দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মূল ফোকাস হইল এইসব প্রতিষ্ঠান; ফলে এইখানে এক ধরনের পলিটিকাল কর্তাসত্তা ক্লেইম করার সুযোগ থাকে।

ইডেন বা অন্য সরকারি কলেজের স্টুডেন্টরা সেগুলার কিছুই তো পায় না। অন্যসব বাদ দেন, সাত কলেজের পরীক্ষা সংক্রান্ত সমস্যাই তো আজতক সমাধান হয় নাই। সেশনজট লইয়া তাদের আন্দোলনও প্রতিবছর চলে আর ব্যর্থ হয়। ইভেন, আলাদাভাবে তাদের পলিটিকাল আইডেন্টিটিও দাঁড়ায় নাই; ‘ঢাবি ছাত্রলীগ’ কইলে যে ইমেজ দাঁড়ায়, ‘ইডেন ছাত্রলীগ’ কইলে সেরকম ইমেজ দাঁড়ায় না মোটেই; যে ইমেজ দাঁড়ায়, সেইটা মোস্টলি হাস্যরসাত্মকই। তো, সরকারি কলেজগুলায় আন্দোলন বা প্রতিবাদ করার মতো ভাইব্রেন্ট পলিটিকাল পরিবেশই নাই।

৩. ইডেনের ক্ষেত্রে যেটা ইউনিক সেটা হইল, ইডেনের ব্যাপারে নানা গালগপ্প, টিপ্পনি, জোক্স— এগুলা অনেক আগ থেকেই চলে। ফলে, এই ঘটনা চাউড় হওয়ার প্রায় সাথেসাথেই অনেকে এটারে লুফে নিছে, এবং ব্যাপারটা ‘ছাত্রলীগের ফোর্স প্রস্টিটিউশন’ থেকে ‘ইডেনের মেয়েদের কাজ কারবার’ শীর্ষক টপিকে পরিণত হইছে। জাবিতে সেঞ্চুরিয়ান মানিকের ব্যাপারটা অ্যাটলিস্ট ‘ধর্ষণ’ ছিল; সেখানে মেয়েদের তরফে কেউ কোনো দোষের কারণ খুঁইজা পায় নাই। সর্বোচ্চ এইটুকু যে, সে তার ভার্জিনিটি হারাইছে। বাট ইডেনের ক্ষেত্রে ওই ‘ধর্ষণ; ভাইবটা প্রায় নাই।

এখানে ছাত্রলীগের দোষের সাথে প্রায় সমানতালে উচ্চারিত হইছে ইডেনের মেয়েদের নানা খাসলত ইত্যাদি। এমন প্রেজেন্ট করা হইছে ইস্যুটা, বিশেষত ফেসবুকে ভাইরাল ইডেনের এক সাবেক শিক্ষার্থীর ফেক আইডির লেখাটায়, যেন ইডেনে ছাত্রলীগ, তাদের নেত্রী ও হলে অবস্থানরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক ধরনের মিউচুয়াল সম্মতির ভিতর দিয়াই, রহস্যময় এক পন্থায় এই ঘটনাগুলা ঘটতেছে; বাধ্য করা হইলেও, ব্যাপারটা ঠিক যেন বাধ্য করাও না আবার। এই ধরনের স্টিগমার মুখে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মোরাল ডাউন হওয়ারই কথা। আর ইডেনের মতো প্রতিষ্ঠানে তো ওই মোরাল উপস্থিতই নাই।

৪. নারীদের পলিটিকাল কর্তাসত্তা আমাদের দেশে মারাত্মক ভালনারেবল, এইটা তো জানা কথা। একটা ছেলে বা একদল ছেলে যেইভাবে একটা স্টাব্লিশমেন্টরে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, একটা/একদল মেয়ে ঠিক সেইভাবে পারে কী? পারে না। এমনকি ঢাবি/জাবির আন্দোলনেও দেখবেন, পুরুষবেষ্টিত হয়ে আন্দোলনে যান নারীরা। যে কোনো নারীবিষয়ক ইস্যুতে ওইসব প্রতিষ্ঠানে পোলারা আন্দোলন সংগঠিত করে। তাদের এগেইন্সটে গিয়া, ইন্ডিপেন্ডেন্টলি একটা ‘উইমেন ওনলি’[ মুভমেন্ট করা মেয়েদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, এইটাই বিদ্যমান বাস্তবতা। ইডেনের ইস্যুতে মেল স্টুডেন্টদের ইনভলবমেন্ট থাকা মুশকিল, এটাও একটা কারণ।

এগুলা কিছু কারণ, খুঁজলে আরো কারণ পাওয়া যাবে মেবি। মোদ্দাকথা, নানা কারণে ইডেন কলেজের নারীদের পলিটিকাল কর্তাসত্তা আমাদের সমাজের বিচারে এতটাই ভালনারেবল যে, ছাত্রলীগের মতো একটা স্টাব্লিশমেন্টরে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো আগ্রহ, পরিবেশ বা উদ্যম— কোনোটাই তাদের নাই। আবার এইটাও সত্য যে, অপরাধ, ভিক্টিম ও অপরাধীর একটা সুনির্দিষ্ট বিবরণ সামনে না আসলে, আন্দোলনের মোরাল গ্রাউন্ড দুর্বল থাকে, আন্দোলন ফলপ্রসূ হয় না। ধর্ষণ তো ছাত্রলীগ অনেক করছে; কিন্তু `সেঞ্চুরিয়ান মানিক`রে সিঙ্গেল আউট কইরা করা আন্দোলনটা, অন্তত রেটোরিক্যালি সফল কেন হইছিল? কারণ, সেখানে এজেন্ডা পরিষ্কার ছিল। ভিক্টিমদের ব্যাপারটাও পরিষ্কার ছিল। ইডেনের পরিস্থিতি এখনো সেইরকম না।

এসব কারণ মাথায় রাইখাও বলা লাগবে যে, ইডেনের এই সমস্যার সমাধান ইডেনের মেয়েদেরই করা লাগবে। তারা যদি ‘কিছু কিছু পলিটিকাল মেয়ে’র সাথে হওয়া অন্যায়রে মাথাব্যথার কারণ না ভাবে, তাইলে এই অন্যায় তাদের সাথেও হইতে পারে, যে কোনো সময়। ইভেন, এই `কিছু কিছু মেয়ে`র সাথে আশলে অন্যায় হইতেছে, না তারা নিজেরাই যাচ্ছে কোন স্বার্থের কারণে, ব্যাপারটা মিউচুয়াল নাকি জবরদস্তি— এ ব্যাপারেও ইডেনের এই প্ল্যাকার্ডধারী মেয়েরা পষ্ট কিছু জানাইতে পারতেছেন না। এই `কিছু কিছু পলিটিকাল মেয়ের কোন এক উপায়ে ভাইদের কাছে যাওয়া`র অস্পষ্ট রেটরিকটা ইডেনের মেয়েদের জন্য লাভজনক না, উলটা ক্ষতির কারণই হবে।

ইডেনের মেয়েদের জন্য ফলে এইটা একটা ঐতিহাসিক মোমেন্ট আমি মনে করি। তারা যদি রাইট ডিসিশন নিতে পারে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নিজেদের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পলিটিকাল এজেন্সি ক্লেইম করতে পারে, ক্যাম্পাসে লীগের সব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে পারে, তাইলে এইটা ইডেন তো বটেই, সামগ্রিকভাবে দেশের নারীদের পলিটিকাল কর্তাসত্তা বিনির্মাণের পথে একটা বড় অর্জন হিশাবে থাইকা যাবে। আর এর ভিতর দিয়াই, ইডেনের মেয়েরা তাদের বিরুদ্ধে চালু সোশাল স্টিগমাগুলারেও মোক্ষম উপায়ে প্রতিহত করতে পারবে।

ইডেনের মেয়েরা সেইটা করবে কিনা, এই সিদ্ধান্ত তাদেরই নেওয়া লাগবে। ‘সমাজে আমরা চলতে পারছি না’, ‘লোকে কটুকথা বলে, এই আলাপ দিয়া তারা নিজেদের দুঃখটা হয়তো শেয়ার করতে পারবেন, কিন্তু সমাজে বা নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চেঞ্জ আনতে পারবেন না। চেঞ্জ আনতে হইলে এমন কিছুই করা লাগবে, যাতে সমাজ মুখ বন্ধ করতে বাধ্য হয়। সমাজের মুখ এইভাবেই বন্ধ করা লাগে, ভিন্ন রাস্তা নাই আশলে। ইডেন বাঙলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। আজকের বাঙলাদেশ পার হইয়া যে অনাগত বাঙলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, ইডেন সেই বাঙলাদেশ বিনির্মাণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখবে— অন্তত আমি এইটুকু আশা ছাড়তেছি না।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট