তুহিন খানের কলাম ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’

প্রকাশিত : আগস্ট ২৯, ২০২২

আশির দশকে আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের সময়টা ছিল কোল্ড ওয়রের পিক টাইম। ওইসময় ইউএস খুব সফলভাবে পাকিস্তানের সাথে কোলাবরেট কইরা সোভিয়েতরে নেস্তনাবুদ করছে। আমেরিকার বহুমুখী সোভিয়েত বিরোধী প্রচারণার একটা ছিল এই যে, কম্যুনিস্টরা নাস্তিক। এই প্রচারণার রূপটা আশির দশকের বাঙলাদেশে কী ভয়াবহ ও প্রোপাগাণ্ডামূলক ছিল, তার কিছুটা ফিরিস্তি মাওলানা ইসহাক ওবায়দী সাহেব তুলে ধরছেন তার `সোভিয়েত মুসলমানদের সাথে` নামক সফরনামায়।

ইউএসের এই প্রচারণা অবশ্য মারাত্মক কাজে দিছে। বাঙলাদেশের অল্পবুদ্ধি বামেরা ওই প্রচারণার পক্ষেই কাজ করছে অবশ্য। ফলে মুসলিম দুনিয়ায় কম্যুনিস্ট ভাববলয়ের পতন ছিল অনিবার্য। বাঙলাদেশে ব্যাপারটা একটু ডায়নামিক ছিল অবশ্য সবসময়ই; তার কারণ ভারত-রাশা বলয়, এবং মুক্তিযুদ্ধ। সেটা অবশ্য আশির দশকে আফগান ওয়রের পর আর তেমন টেকে নাই।

এই সময় মুসলিম দুনিয়া আমেরিকার অনেক কাছাকাছি আসে। রাশা বা কম্যুনিস্ট বলয় তখন স্রেফ নাস্তিক হিশাবেই ব্রাত্য। বাঙলাদেশেও তার ছাপ খুঁজলে অনেক পাওয়া যাবে। ২০০১ সালের আফগান-ইউএস ওয়র ছিল এই সমীকরণে ডায়নামিক চেঞ্জ আসে।

ফরহাদ মজহার সেসময় `ক্রুসেড জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম` প্রবন্ধে আফগান তালেবানের যুদ্ধরে শ্রেণিসংগ্রাম ও পুঁজির বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুশের লড়াই হিশাবে বিশ্লেষণ করেন। এ নিয়া দেশের বামবলয়ে তুমুক তর্কবিতর্ক হয়। এর সাথে যোগ হয় ৯/১১ পরবর্তী ওয়র অন টেররের অভিজ্ঞতা।

ওয়র অন টেরর যখন শুরু হয়, দেশে তখন বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায়। ওইসময় বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী হিশাবে পরিচিত অনেকেই আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার বিরোধিতা করছেন। যেমন, প্রফেসর এমাজউদ্দীন। উনি সেসময় `আমেরিকা আক্রান্ত: আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমন করতে হবে` শিরোনামে একটা লেখা লেখছিলেন। এরকম আরো অনেকের লেখাই খুঁজলে পাওয়া যাবে।

সময়টা ছিল ইন্টারেস্টিং। দেশে বিএনপি-জামাত সরকার, যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের পোক্ত অভিযোগ। ওদিকে আফগান-আমেরিকা ওয়র। র‍্যাডিকাল বামপন্থীরা সেসময় আদাজল খেয়ে আমেরিকার বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন। সরকারের অবস্থান নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ছে। বাট জোট সরকার কী করবে তখন? তাদের নিজেদের মস্তকেই মৌলবাদের অভিযোগ। আমেরিকা তখন বিশ্বের একচ্ছত্র সুপার পাওয়ার। ফলে বিএনপি-জামাত আমেরিকাবিরোধী পলিসি নেয় নাই সেসময়।

ইসলাম জঙ্গিবাদ সাপোর্ট করে না, এটা শান্তির ধর্ম— এই মর্মে অনেক বই বের হইছে তখন। জামাতের অবস্থা ছিল আরো সংকটপূর্ণ। একদিকে তাদের ইসলামপন্থী কমিটমেন্ট, অন্যদিকে ইউএসের ব্ল্যাকলিস্ট থেকে বাঁচা। জামাত দুইটাই ভালভাবে সামলাইছিল তখন। দেশীয় পলিটিক্সে এমনিতেই জামাতের প্রতিপক্ষ সবসময় ছিল বামরা। ওই সময় এবং আগেপরে, জামাতপন্থী রাইটাররা সোভিয়েতবিরোধী অনেক লিটারেচার উৎপাদন করছেন, পপুলার ইসলামিস্ট লাইনে। সেগুলাও জামতরে ইউএসের এক ধরনের স্ট্রাটেজিক মিত্রে পরিণত করছে। পরে বাঙলা ভাইদের ফাঁসি দিয়া জোট সরকার নিজেদের ইমেজ আরো ক্লিয়ার করছে ইউএসের কাছে।

যাহোক, ২০ বছরে সিনারিও পাল্টাইছে। আমেরিকার যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় অতিষ্ট হইছে মুসলিম বিশ্ব। কম্যুনিস্ট নাস্তিক্যিতার জায়গা নিছে, ফলে, আমেরিকান লিবারেলিজম, সেক্যুলারিজম ইত্যাদি। এখন এই শব্দগুলারেই নাস্তিক্যবাদের সমর্থক হিশাবে ইউজ করেন দেশ-বিদেশের অনেক ইসলামি রাইটার। ওদিকে, চায়না-রাশা ইসলামের বিরুদ্ধে ফাইট বাদ দিয়া, ইকোনমিতে মনোযোগী হইছে। যদিও, সিরিয়ান সিভিল ওয়রের মধ্য দিয়া রাশা আবার মিডল ইস্টের পলিটিক্সে এন্টার করছে, এবং সেটা সুন্নি মুসলিমদের এগেন্সটেই। বাট আইএস যেহেতু মুসলিমদের কাছে বিতর্কিত হইছে, এবং পরে আফগান তালেবানের সাথে রাশা-চায়না-ইরানের এক ধরনের স্ট্রাটেজিক ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, তাই ওই ঘটনা তেমন প্রভাব ফেলে নাই মুসলিমদের কালেক্টিভ মানসে।

আশির দশকে কম্যুনিস্ট রাশার বিরুদ্ধে যে প্রচারণা ইউএস চালাইছে, সেই একই লাইনে ইউএস পরে বিপদে পড়ছে। ওয়র অন টেরর, ইসলামোফোবিয়া এসব মিলায়ে, আমেরিকাই হয়ে উঠছে একুশ শতকের নাস্তিক্যবাদ `লিবারেলিজম`র প্রতীক। রাশা বা কম্যুনিস্ট বলয় সরাসরি নাস্তিক্যবাদ বইলা ইউএসের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় নাই বটে, তবে ইউএসের প্রভাব খর্ব করতে তারা `ওয়েস্টার্ন-আমেরিকান কালচার`র বিরুদ্ধে নানা অবস্থান নিছে। সেগুলাও রাশা বা পুতিনরে মুসলিমদের চোখে একটা হিরোইক ইমেজ আইনা দিছে। সর্বশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ওয়েস্ট ওয়রের মধ্যে ঢুকছে, এবং এইটারে আমেরিকান আগ্রাসনে অতিষ্ট লোকেরা বেশ সেলিব্রেট করছে। এইভাবে, রাশা-চায়না বলয় দেশে দেশে আমেরিকা-ওয়েস্টবিরোধী ইসলামিস্টদের সাথে এক ধরনের স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক তৈরি করছে।

আশির দশকে আমেরিকা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যে খেলা খেলছিল, রাশা-চায়না এখন আমেরিকার বিরুদ্ধে সেই খেলাটা খেলতেছে বা খেলা শুরু করছে। এসবের কন্সিকোয়েন্সেস কী হবে? দেশের পলিটিক্সের দিকে ভাবলে, ওয়েস্ট থেকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় নানা বিরোধিতার মুখে পড়ছে লীগ, ভারতের ইন্টারেস্টের কারণে যদিও তারা সেগুলার তোয়াক্কা করে নাই। পরে লীগের চায়না-রাশামুখী পররাষ্ট্রনীতির কারণে হোক বা যেকারণেই হোক, আমেরিকা লীগরে নানা স্যাংশন দিচ্ছে, বিপদে ফালাইতেছে। বাতাসে জোরালো রিউমার, সরকারে যাওয়ার জন্য বিএনপি বা পরিষদ এখন খুব আমেরিকামুখী।

এই পরিস্থিতে, আমার ধারণা— দেশের কালচারাল ইসলামিস্টরা আমেরিকা ও ওয়েস্টবিরোধিতা, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম বা ডেমোক্রেসি বিরোধিতারে সামনে রাইখা, রাশা-চায়না বলয়ের দিকে ঝুঁকবে। অনেক র‍্যাডিকাল বামপন্থীও এইটা করবেন। এবং এই ব্যাপারটারে চাইতে না চাইতে, আওয়ামী লীগ ক্যাশ করার ট্রাই করবে; এবং ঠিকঠাক খেললে সফলও হবে। বিপরীতে, পলিটিকাল স্যাটেলমেন্টে আগ্রহীরা, পলিটিকালি অপ্রেসডরা ইউএস ও ওয়েস্টের আওয়ামীবিরোধী মুভগুলারে স্বাগত জানাবে।

এই জটিল পরিস্থিতি শেষমেশ আমাদের দেশের পলিটিক্সরে কোন বাস্তবতার মুখে আইনা দাঁড় করাবে, এইটা এখনো আমরা জানি না। রাশা-চায়না যদি ইসলামিস্টদের মিত্র হয়, ভারত সেইটা ভালভাবে নেবে না। ফলে মাঝে ভারতরেও ডিল করা লাগবে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ যদি ভারতরে ডিঙায়া ঘাস খাইতে যায়, তাইলে ভারতও হয়ত দেশে রেজিম চেঞ্জ চাইতে পারে, হু নৌজ!

বিশ্ব রাজনীতির খেলা সবসময়ই চলে। সুপার পাওয়ারের এইসব খেলায় আমাদের দেশ, মাটি ও মানুশের সার্বভৌমত্ব বা আমাদের পলিটিকাল গোলগুলা হুমকিতে পড়তেছে কিনা, সেদিকে নজর রাখাই জরুরি এখন। দক্ষিণ এশিয়ায় ইউএস-রাশার ঠাণ্ডা যুদ্ধ আমাদের জন্য ভাল হবে না খারাপ— তা আস্তে আস্তে আরো পষ্ট হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে, এই কোল্ড ওয়রের প্রেক্ষিতে আওয়ামীপন্থী বয়ানগুলারে ডকুমেন্ট কইরা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে ইতিহাস বিচারে তা কাজে লাগতে পারে।