
তৃষ্ণাকুমারী (২)
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : অক্টোবর ২৩, ২০১৭
দুপুরের দিকে মেঘ মেঘ ছিল আকাশ, আর বিকেলে মেঘ কেটে গিয়ে সোনার রঙের মতো আলো ছড়িয়ে রইল। প্রাসাদের ওপর পাথরের যে সিংহমূর্তি, চকচক করতে থাকে। আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রানির সিঁথির সিঁদুর। সিংহের পায়ের কাছে বেদিতে বসে তিনি মুঠো মুঠো গম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। প্রায় শ দুয়েক কবুতর, হুটোপুটি করে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। চারদিক মুখর করে তুলেছে তাদের ডাকাডাকি, বাক বাকুম বাক বাকুম। কোনও কোনোটা খাওয়া শেষ হয়ে এলে উড়ে গিয়ে বসছে খোপের মুখে। কোনোটা আবার ছোট্ট তুলতুলে বাচ্চার ঠোঁটে ঠোঁট ঘঁষছে। ছাদের একদিকে সার দেয়া কাঠের ছোট ছোট খোপ। উড়তে না শেখা বাচ্চারা মুখ বের করে দেখছে বাইরের আলোর জগত। এই এক আনন্দ রানির। বিকেলে নিজের হাতে এদের খাওয়ান তিনি। দাসী বিমলা বয়ে আনে এক ধামা গম। পুরোটা শেষ করে তারপর ওঠেন।
মাথার ওপর দিয়ে ফরফর শব্দ তুলে কয়েকটা কবুতর গিয়ে বসল কার্নিশে। বাক বাকুম বাক বাকুম। হাসলেন রানি, দেখেছিস কাণ্ড ।
কি রানিমা?
দ্যাখ না হতচ্ছারা করলটা কি।
যা দেখল দাসি তাতে নিজেও সে হাসি চাপতে পারল না। রানির ঘাড়ে নোংরা করে দিয়েছে কবুতর। দাঁড়ান একটু, বলে সে দৌড়ে গেল নিচে। ফিরে এলো একটু বাদেই, হাতে পাত্র ভরা জল আর এক টুকরো কাপড়। এক মুঠো গম ছড়িয়ে দিয়ে রানি বললেন, গোলাপের আড়ালেও কাঁটা থাকে, কথাটা জানিস তো?
তাতো জানিই, নোংরা মুছে দিতে দিতে বিমলার জবাব।
প্রতিদিন এই যে এদের যতœআত্তি করি, ভালোবাসি, কেন বল তো?
ভালো লাগে তাই, দার্শনিকের মতো জবাব দিল বিমলা।
এই তো, মাথা খুলেছে তোর। যে জিনিস ভালো লাগে, তার নোংরা অত ঘেন্না করলে চলবে কেন?
তা বটে।
দ্যাখতো এবার, কয়টা বাচ্চা ফুটেছে।
রানি ছড়াতে লাগলেন গম। বিমলা এক একটা খোপের মুখে উঁকি দিচ্ছে আর সদ্য ফোটা বাচ্চা দেখতে পেলে আওয়াজ দিচ্ছে, বারো রানিমা... এই যে, ষোলো... একটা মরে গেছে রানিমা, এটাও ধরব?
প্রায় দিনই একটা-দুটো বাচ্চা মারা যায়। এত এত কবুতরের মধ্যে এরকম মরতেই পারে। আজ তবু কী যেন শঙ্কা গ্রাস করল রানিকে। মেঘের কালো ছায়া এসে পড়ল তার মুখে। বিমলার দিকে চেয়ে তিনি দেখলেন, মরা বাচ্চাটাকে হাতে নিয়ে বিমলা চেয়ে আছে তার দিকে। রানির গলায় যেন শ্লে¬ষ্মা, বললেন, ফেলে দে, সরে আয় তুই ওখান থেকে। গুনতে হবে না আর।
হট্টগোল শোনা গেল নিচের থেকে। মরা বাচ্চাটা ফেলে দিয়ে বিমলা উঁকি দিলো নিচে। হট্টগোল বেড়েই চলেছে, আর চিৎকার। বিরক্ত হলেন রানি। জিগেশ করলেন, কি, হয়েছে কি বিমলা? এত হইচই কিসের?
বিমলা মুখ না ফিরিয়ে জবাব দিল, কাকে যেন বেদম পেটাচ্ছে কোতোয়াল। অনেক লোক রানিমা ফটকে।
রানির মুখে আবার মেঘের ছায়া। তিনি ভুলে গেলেন গম ছিটোতে। তার কানে আর ঢুকছে না তাকে ঘিরে শ্বেত কপোতের ডাকাডাকি। নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন তিনি।
মুখ ফেরালো বিমলা, ভিড়ে প্রজারাও রয়েছে রানিমা। দেখে আসব একটিবার?
রানি ঘাড় নাড়লেন, কোতোয়ালকে বলিস আমি ডেকেছি।
আজ্ঞে রানিমা, বিমলা নেমে গেল নিচে।
কিছু সময় পর কোতোয়াল আর বিমলা এসে দাঁড়ালো তার সামনে। হাঁপাচ্ছে কোতোয়াল। মাথা নোয়ালো সে, কুনির্শ হই রানিমা।
নিচে হইচই হচ্ছিল কিসের?
বেয়াদবি নেবেন না রানিমা, সে আমি বলতে পারব না।
সে কেমন কথা। শুনলাম তুমিই নাকি কাকে মারধর করছিলে।
আজ্ঞে রানিমা, সে ব্যাটার বড্ড দেমাগ।
কে সে?
আমাদেরই প্রজা।
মারলে কেন তাকে?
ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে রানিমা, আমায় ক্ষমা করবেন।
রানি তোমাকে আদেশ দিচ্ছে, তুমি বলো।
প্রাসাদের পেছন দিককার বাগানে গাছের ডালপালা বেশ বেড়ে গেছে। ছাঁটার জন্য একজন গাছিকে খবর দেয়া হয়েছিল। আজ দুপুরে তার আসবার কথা, কিন্তু আসেনি। দুবার লোক পাঠানো হয়েছে।
আসেনি কেন?
অবনত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে কোতোয়াল। মুখে যেন লাগাম।
কি হলো, জবাব দিচ্ছ না কেন? রানির গলায় বিরক্তি।
লোকটা এখন বলছে...
কি বলছে?
বউ নাকি ওকে বলেছে...
কি, পরিষ্কার করে বলো।
আজ্ঞে, লোকটার বউ নাকি বলেছে, আমাদের রাজা আঁটকুড়া। ঢোঁক গিলল কোতোয়াল। আরও অবনত মুখ করে রইল সে।
রানি জিগেশ করলেন, তাতে তার কাজের কি সম্পর্ক?
বউ ওকে বলেছে, আঁটকুড়া রাজার মুখ দর্শন করলে অমঙ্গল হয়। রাজ্যের সবাই নাকি এ রকম বলাবলি করছে। বউটা গ্রামের মহিলাদের কাছ থেকে শুনেছে। গ্রামের কে একজন রাজার মুখ দর্শন করলে ওইদিনই তার পুত্র মারা যায়।
থমথমে হয়ে উঠেছে রানির মুখ।
ঠোঁট কাঁপছে তার। হাত কাঁপছে।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। টলে উঠলেন একটু।
ছুটে এলো বিমলা, কি হলো রানিমা...
কাঁপছে কোতোয়াল। বুক ঢিবঢিব করছে তার। এখন কী হবে... কী হবে এখন? রানি সরিয়ে দিলেন বিমলাকে। সরে যা বিমলা, আমার কিছু হয়নি। এরপর কোতোয়ালকে বললেন, যাও, তোমার কাজে যাও। আর একটা কথা, রাজার কানে যেন এসব কিছু না যায়।
ধীর পায়ে তিনি নেমে এলেন নিচে। তার বুক তখনও কাঁপছে। ঠিকমতো যেন পায়ের পাতাও ফেলতে পারছেন না। পেছনে বিমলা। রানিকে ধরবে কী ধরবে না, এ ভাবনায় জড়োসড়ো।
চলবে...