
তৃষ্ণাকুমারী (৩)
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : নভেম্বর ০১, ২০১৭
অনেক দিনের পুরনো প্রাসাদ।
ভগ্ন অট্টালিকা। পলেস্তারা খসে পড়া হতশ্রী চেহারা। কান পাতলেই শোনা যায় ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে। খুব মিহি সেই পতন শব্দ। ভাঙাচোরা দেউড়ি পড়ে আছে এককোণে। চারদিকে উঁচু উঁচু দেয়ালগুলো কোথাও কোথাও ভেঙে পড়েছে। তার ভেতর জন্ম নিয়েছে লতানো ঝোপঝাড়। বারান্দার খোঁয়া বেরোনো মোটা এক একটা থাম ভূতের মতো নিঃশব্দে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যেন কারও অপেক্ষায়। নিচের চাতালের এখানে সেখানে শ্যাওলা-ধরা ইট-সুরকির স্তূপ। এসব জায়গা বিষাক্ত সব প্রাণীদের ডেরা। এককালে অন্দরমহলের দুধশাদা নারীদের কলহাস্য কিংবা নর্তকীর নূপুরের ঝংকার ঘরগুলোর ভেতর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো এখনও শোনা যাবে।
গা ছমছম অন্ধকার একটা ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন রানি। বাতাস এখানে ভারি। কলিচুনের গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা মেরে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। রানির মনে হলো, যেন কয়েক শতাব্দী এ ঘরে কোনও মানুষের নিঃশ্বাস পড়েনি। মাকড়শার বিস্তৃত ভারি জাল জড়িয়ে যাচ্ছে সারা গায়ে, মুখে। অদ্ভুত রকমের একটা থমথমে আওয়াজ হচ্ছে চারদিক থেকে। চিঁহি চিঁহি ডাক ছেড়ে ফরফর করে কী যেন সরে-সরে যাচ্ছে পায়ের ওপর দিয়ে। এখন দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। তবে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে রইলেন রানি। তার তেমন ভয় করছে না, তবে বিস্ময়ের মতো লাগছে সব কিছু। রহস্যময় মনে হচ্ছে।
ঘরটাতে পায়চারি করতে আরম্ভ করলেন তিনি। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝে। কী ঠাণ্ডা! দুপা পেঁচিয়ে ধরে সারা দেহে সাপের মতো উঠে আসছে যেন সেই শীতলতা। কোত্থেকে হঠাৎ এক ঝলক ফুরফুরে হাওয়া এসে ঢুকল ঘরের ভেতর। চারদিক চেয়ে ঘরটার কোনও জানলা-দরজা দেখতে তিনি পেলেন না। হাওয়া ঢুকল কোন পথ দিয়ে? আছে নিশ্চয়ই জানলা-দরজা কোথাও, তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। ঘরের কোনও জানলা-দরজা থাকবে না, এ রকম তো হবার কথা নয়।
পায়ে কী যেন একটা ঠেকল। না, শক্ত কিছু নয়। জিনিসটা তুলতুলে নরম, আর ভেজা-ভেজা। হাতে তুলে নিলেন তিনি। আর তক্ষুণি আশ্চর্য একটা সুঘ্রাণ এসে নাকে লাগল তার। একটা ফুল। এখানে ফুল আসবে কোত্থেকে! তাও বাসটে নয়, রীতিমতো সতেজ। যেন এইমাত্র গাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে কেউ। চারদিক অন্ধকার। কিছুই চোখে পড়ছে না তার। অবাক হলেন রানি। কে রেখে যাবে এখানে ফুল? আর কেউ যদি রেখে না যাবে, তবে এলো কোত্থেকে? নানা ভাবনায় থমথমে হয়ে গেল রানির মুখ।
তিনি গন্ধ নিলেন আশ্চর্য সেই ফুলের। ভুরভুর গন্ধ ছড়াচ্ছে। কী যে সম্মোহন এই গন্ধে, রানি মোহিত হয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদের বাগানে তো অনেক রকমের ফুলই রয়েছে, কই, কখনও তো এরকম গন্ধ তিনি পাননি। মিষ্টি এক রকম মৌতাত রয়েছে গন্ধটার মধ্যে।
ফুলটা হাতে ধরে আবার চারদিক তাকালেন তিনি। অন্ধকার। এবার যেন একটু একটু ভয়ের কাঁপুনি টের পাচ্ছেন বুকের মধ্যে। শিরশির এক ধরনের অনুভূতি। কয়েক পা সরে এলেন একদিকে। কপাল ঠুকে গেল শক্ত কিছু একটার সঙ্গে। উঁফ, ছোট্ট একটা আর্তনাদ তুলে আঙুল দিয়ে কপাল টিপে ধরলেন তিনি। কপালের একদিকে ফুলে গেছে। ব্যথা হচ্ছে খুব। হাত বাড়ালেন এবার সামনে, দেয়াল। হ্যাঁ, দেয়ালই তো। দেয়ালেই ঠুকে গেছে তার কপাল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তিনি দাঁড়ালেন। কপালে ব্যথা হচ্ছে, তারপরও তিনি নাকের কাছে ফুলটা ধরে গন্ধ নিলেন। আর ভাবলেন, এই ফুল কোথায় ফোটে? রাজাকে বলে রাজপ্রাসাদের বাগানে এর একটা চারা তিনি লাগাবেন।
হঠাৎ চমকে উঠলেন রানি। কেউ যেন নিশ্বাস ফেলছে। খুব কাছ থেকেই শব্দটা যেন তিনি শুনতে পেলেন। উৎকর্ণ হলেন। হ্যাঁ, দেয়াল ঘেঁষে তার খুব কাছেই কেউ একজন রয়েছে। নিঃশ্বাস ফেলছে ঘনঘন।
অস্ফুট আর ভাঙা-ভাঙা স্বরে রানি জিগেশ করলেন, কে? কে ওখানে?
কাঁপা-কাঁপা স্বর ভেসে এলো, আমি...
আমি কে?
কাঁপা কাঁপা স্বর এবার আরও কেঁপে উঠল, আমার খুব ভয় করছে।
আশ্চর্য হলেন রানি। লোকটা বলছে তার খুব ভয় করছে। ভয় তো তারও করছে। কিন্তু লোকটা এখানে এলো কীভাবে, তিনিই বা কীভাবে এলেন? গোলোকধাঁধা মনে হচ্ছে ব্যাপারটা। তিনি জিগেশ করলেন, কিন্তু আপনি এখানে এলেন কীভাবে?
কণ্ঠস্বর এবার তোতলাচ্ছে, তা-তা-তা তো জানি না।
আবার চমকে উঠলেন রানি। এবং কেঁপে উঠলেন। কে যেন তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, এই পুরুষটা তোমার স্বামী। একে নিয়ে পালিয়ে যাও। পেছনে শত্র“। তোমাদের মেরে ফেলবে। দাঁড়িয়ে থেকো না। পালাও।
বেশ তো কথা। স্বামী বললেই স্বামী, ছিঃ ছিঃ। রানি তেড়ে উঠলেন, বললেই হলো। আমার তো স্বামী রয়েছে। হিন্দু নারীদের এ কথা শুনলেও যে পাপ হয়।
কণ্ঠস্বর বলল, এই তোমার স্বামী, পালাও।
আচ্ছা বাগড়া তো। তার স্বামী আছে কী নেই, না জেনে হুকুম করলেই হলো? আর হুকুম করলেই বা তিনি মানবেন কেন?
কণ্ঠস্বর আবার বলল, মেনে নাও। উপায় নেই আর। পেছনে বিপদ, পালাও।
বিপদ, কীসের বিপদ? বুঝতে পারলেন না রানি। শুনতে পেলেন লোকটা তখন বলছে, আমার ভয় করছে।
বেশ তো বিপদে পড়া গেল। আবার কী রকম যেন মায়াও হলো লোকটার ওপর। কী অসহায় গলায় বলছে, আমার ভয় করছে। কী যে নিঃস্ব মানুষের মতো লোকটার বলার এই ভঙ্গি। কিছু সময় ভাবলেন রানি। মেনে নেয়া ছাড়া আর কীই বা পথ আছে এখান থেকে বেরোনোর। দ্বিধা আর সঙ্কোচ নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রানি এগিয়ে গেলেন লোকটার দিকে। গায়ে হাত পড়তেই ছিটকে সরে এলেন, যেন আগুনে ছেঁকা খেয়েছেন।
কী সব হচ্ছে, কী এসব... দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে ওঠেন তিনি। লোকটার শরীরে কোনও কাপড় নেই। একেবারে ন্যাংটো একটা পুরুষশরীর। আর আশ্চর্য, আশ্চর্য তো, রানি আবিষ্কার করলেন, তার শরীরেও কোনও আবরণ নেই। শিরশির একটা অনুভূতি রানির পিঠের ওপর দিয়ে দুই নিতম্বের মাঝখানে নেমে গেল। দুচোখ বন্ধ করে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন তিনি।
লোকটা বলছে, আমার ভয় করছে... ভয় করছে... ভাঙা-ভাঙা শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে একটার সঙ্গে আরেকটা। এরইমধ্যে সেই কণ্ঠস্বর বলে উঠল, এখানে লজ্জার কোনও আবরণ নেই। আর যেখানে আবরণ থাকে না সেখানে লজ্জাও পাবার কিছু নেই। যাও পালাও।
টের পেলেন রানি, কাঁপছেন তিনি।
আর কিছু না ভেবে এগিয়ে এসে রানি লোকটার একটা হাত ধরলেন। স্বামী যখন, হাত ধরতে তো আর অসুবিধে নেই। দৌড়োতে লাগলেন রানি। লোকটাও দৌড়োচ্ছে তার সঙ্গে সঙ্গে। কিছু দূর যাবার পর লোকটা বলে উঠল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
দৌড়োতে দৌড়োতে রানি জবাব দিলেন, জানি না।
তবে যাচ্ছি কেন?
তাও জানি না।
না জানলে দৌড়োচ্ছি কেন?
পেছনে শত্র“। আমাদের মেরে ফেলবে।
ও আচ্ছা, তাহলে দৌড়োনো যায়।
কিন্তু ভালো দৌড়োতে পারছে না লোকটি। বারবার পিছিয়ে পড়ছে। তার একটা হাত ধরে আগে-আগে দৌড়োচ্ছেন রানি। স্বামীটার ওপর হঠাৎ রাগ ধরে যায় তার। আচ্ছা লোক তো, পেছনে বিপদ জেনেও এভাবে দৌড়োচ্ছে কেন? দাঁড়িয়ে পড়লেন রানি। একটানে স্বামীটাকে কাঁধে তুলে নিলেন। আশ্চর্য, মোটেও ভারি মনে হলো না মানুষটাকে। তিনি যে আস্ত একটা মানুষ কাঁধে তুলে নিয়েছেন, টেরই পেলেন না। মানুষটা হাসছে। রানির কাঁধে চড়ে মনে হচ্ছে সে বেশ মজাই পাচ্ছে। দুহাত দিয়ে রানির গলা জড়িয়ে ধরে বেশ আরামে বসে রইল সে।
চলবে...