
তৃষ্ণাকুমারী
উপন্যাস পর্ব ১১
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : মার্চ ১০, ২০১৮
ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। নদীর তীর ধরে চলেছেন রাজা, আর রাজকুমারী। দুজনের পরনেই সাধারণ পোশাক। রাজার কাঁধে কাপড়ের একটি ঝোলা। তাতে শুকনো খাবার, আর পানি। দ্রুত পা চালান রাজা। আজ রাতের মধ্যেই তাদের পেরিয়ে যেতে হবে খাগড়া মুল্লুক। চলে যেতে হবে আরও উত্তরে। দু’দিনের পথ হাঁটলে তবেই পড়বে গভীর এক জঙ্গল। সেই জঙ্গলে রেখে আসতে হবে রাজকুমারীকে।
আকাশে ক্ষয়াটে চাঁদ। রাস্তাঘাটে ম্লান আলো। ডেকে যাচ্ছে রাতের পোকারা। নদীর ওপর দিয়ে থেকে থেকে ছুটে আসছে শিরশিরে হাওয়া। হাঁটতে হাঁটতে একটু ঝিমুনি মতো পাচ্ছিল তৃষ্ণার। রাজার চোখ এড়ালো না। তিনি রাজকুমারীকে তুলে নিলেন বুকে। এরপর হাঁটতে লাগলেন আরও দ্রুত পায়ে। ভোর হলো। পূবাকাশ গোলাপি আভায় রাঙা হয়ে উঠল। রাজা ক্লান্ত। পা দুটো যেন পাথরের চেয়েও ভারি হয়ে গেছে। শরীর আর চলতেই চায় না। তবে তিনি আশ্বস্ত হলেন, নিজের রাজ্য তিনি পার হয়ে এসেছেন। কাঁধের ওপর মাথা রেখে রাজকুমারী তখনও ঘুমোচ্ছে। শরীর আর ধরে রাখতে পারলেন না রাজা। বসে পড়লেন তীরের ঘাসে। জেগে উঠল তৃষ্ণা। চোখ মেলে সে চারদিকে তাকাতে লাগল। জিগেশ করল, আমরা কোথায় বাবা? জঙ্গল কোথায়?
রাজা বললেন, জঙ্গল তো আরও দূরে রাজকুমারী। সেখানে যেতেই যে আমাদের আরও দু’দিন লাগবে।
সে তো তবে অনেক দূর। আমরা রাজবাড়িতে ফিরব কবে?
রাজা জবাব দিলেন, ফিরব মা। আগে তো সন্যাসীর কাছে যাই। এখন আয়, নদীর জলে আমরা হাতমুখ ধুয়ে নিই।
হাতমুখ ধুয়ে ঝোলা নিয়ে তারা একটা গাছের নিচে গিয়ে বসল। এরপর খাবার খেল। পানি খেল। গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম নিলেন রাজা। রাজকুমারী উঠে গিয়ে ধারেকাছ দিয়ে একটু হেঁটে এলো। এরপর শুরু হলো আবারও হাঁটা। যেতে যেতে নানা কথা জিগেশ করছে তৃষ্ণা। রাজা ছোট ছোট বাক্যে সেসব কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছেন। তার বুক চিরে যাচ্ছে, তবু তাকে নীরবে মেনে নিতে হচ্ছে রাজকুমারীর বিচ্ছেদ। ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে!
দু’দিন দু’রাত পেরিয়ে তারা গিয়ে পৌঁছালেন গভীর এক জঙ্গলের সামনে। তখন সন্ধে। বনের পাশ দিয়ে ঝিরঝির ছন্দে বয়ে গেছে নদী। নদীর ওপর গোধূলির লালচে আভা। গাছপালায় পাখিদের হট্টগোল। বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছে নানা রকমের জন্তুর চিৎকার। নদীর ওপর দিয়ে শনশন হাওয়া বইছে। ভয়ে কাঁটা দিল রাজকুমারীর দেহে। নদীর ওপর যতদূর চোখ যায়, সে চেয়ে রইল। মনে হলো, বিরান কোনও প্রান্তরে গিয়ে যেন শেষ হয়েছে নদীটা। কোথাও আর কোনও মানুষজন নেই। ভয়ে ধড়াস ধড়াস বুক কেঁপে উঠল রাজকুমারীর। রাজার হাত ধরে সে বলল, বাবা বাবা, যদি বাঘ এসে আমাদের খেয়ে ফ্যালে? খাবে না। রাজা সান্ত্বনা দ্যান। তবে কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে তার। তিনি বললেন, পোড়ো মন্দিরে যে সন্যাসী থাকেন, জঙ্গলের সব জন্তু-জানোয়ার তার কথা মেনে চলে।
রাজকুমারী রাজার গায়ের সঙ্গে সেঁটে রইল। ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু আমার যে ভয় করছে খুব। ভয়ানক এই জঙ্গলে সন্যাসী থাকেন ক্যামনে, কে জানে!
বিষাদমুখে রাজা একটু হাসতে চেষ্টা করলেন। বললেন, ভয়ের কী আছে রে বোকা! আজকের রাতটা আমরা এখানেই কাটিয়ে দেব। সকাল হলে জঙ্গলে ঢুকব। পোড়ো মন্দিরে গিয়ে দ্যাখা করব সন্যাসীর সঙ্গে। এ কথায় রাজকুমারী একটু যেন আশ্বস্ত হলো। মাথা দুলিয়ে বলল, সে-ই ভালো। সকাল হলে তো সূর্যের আলো থাকবে। তখন আর এতটা ভয় করবে না। তাই না বাবা? রাজকুমারীর থুতনি ধরে নেড়ে দিলেন রাজা। বললেন, হ্যাঁরে মা। আলো থাকলে ভয় থাকে না। আয়, এখন আমরা শোয়ার ব্যবস্থা করি।
বেশ বড়সরো একটা গাছের নিচে তারা আশ্রয় নিল। সারাদিনের ক্লান্তি ভেঙে দুজন নিঃসাড় পড়ে রইল। বাবার বুকের ভেতর মাথা রেখে রাজকুমারী সহজেই ঘুমিয়ে পড়ল। বাবা থাকতে তার আর ভয় কী! ভোর হলো। আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল তৃষ্ণা। কিন্তু বাবা কোথায়? আতঙ্কিত চোখে চারপাশ দেখতে লাগল সে। তবে কী বাঘেই খেয়ে গেছে বাবাকে? কিন্তু তাকে খেলো না কেন? আর কিছু ভাবতে পারল না তৃষ্ণা। ভয়ের প্রবল এক দৈত্য তার ভেতর সেঁদিয়ে গেল। কাঠ হয়ে সে বসে রইল গাছের নিচে। নদীর জলে রোদের ঝিলমিল ঢেউ। দু’চোখ তুলে তৃষ্ণা যেদিকেই তাকায়, ভয়ের শিরশিরানি বুকে তুলে ফিরে আসে তার চোখ। কিছুই যেন সে ভাবতে পারে না। কোথায় গেলেন বাবা? চোখের সামনে ভেসে উঠল রানিমার মুখ। ছলছল জলে ভরে উঠল তার দু’চোখ। আর কি দ্যাখা হবে রানিমার সঙ্গে? তিনিও নিশ্চয়ই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন। কিন্তু বাবা গেলেন কোথায়? আর কিছু ভাবতে পারল না রাজকুমারী। তবে টের পেল, বুকের ওপর বিশাল এক পাথর চেপে বসেছে। কিছুতেই তা নামাতে সে পারছে না।
ধীরে ধীরে বেলা বাড়ল। পেটের খিদে চমমনিয়ে উঠল। ঝোলার ভেতর থেকে কিছু খাবার বের করে সে খেল। নদীতে নেমে গিয়ে পানি খেল। বিরান জঙ্গল। মানুষজনের কল্পনাও এখানে করা যায় না। আবারও তো রাত আসছে। অন্ধকারে ঢেকে যাবে চারপাশ। কত কত হিং¯্র জন্তু এই জঙ্গলে। এসব ভাবতে ভাবতে তৃষ্ণা বনের আশপাশটা একটু ঘুরে দেখে এলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। এরই মধ্যে ভয়ের শিহরণ তৃষ্ণার ভেতর অনেকটা কমে এসেছে। সে ঠিক করল, বনের ভেতর ঢুকবে। সেই পোড়ো মন্দিরে গিয়ে সন্যাসীর সাহায্যে আবার ফিরে যাবে খাগড়া মুল্লুকে। বনের ভেতর ঢুকল তৃষ্ণা। হাঁটছে তো হাঁটছেই। মোটা মোটা গাছপালা নানা লতাপাতায় জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে। সেসব মাড়িয়ে, ছিড়ে, সাবধানে পা ফেলে তৃষ্ণা সামনে এগোয়। কিন্তু কই, পোড়ো মন্দির তো কোত্থাও চোখে পড়ে না। তবে চোখে পড়ে বাঁদড়। হুতোম প্যাঁচা। শিয়াল। সাপ। এ রকমের আরও হিংস্র প্রাণি। আর তকখুনি দৌড়ে বন থেকে বেরিয়ে এলো সে। বুক ধড়ফড় করছে। ভয়ে আর জলতেষ্টায় বুক শুকিয়ে মরুপ্রান্তর হয়ে গেছে। নদীতে নেমে আজলা ভরে টলটলে জল তুলে সে খেল। আর দেখল নিজের মুখচ্ছবি। ঢ্যাব ঢ্যাব চোখে সে চেয়ে রইল আরেক আমির দিকে। বাবা হয়তো তাকে ফেলে পালিয়েছে। একটু একটু মনে হতে থাকে তৃষ্ণার। সে যে রাজপরিবারের কলঙ্ক বহন করে চলেছে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাজকুমারী উঠে এলো তীরে। ফিরে এলো আগের গাছটার নিচে। বুড়িয়ে যাওয়া একটা পাকুড় গাছ। নিচে ডালপালা ছড়িয়েছে। দু’দিকে মোটা হয়ে বেঁকে গেছে শেকড়। দু’শেকড়ের মাঝখানে ঝোলাটা রেখে বসল তৃষ্ণা। ঝোলার খাবার শেষ। এখন উপায়? উপায় আবার কি, যেন নিজেই সে নিজেকে জবাব দিল, দিনের আলো নিভে যাওয়ার আগেই কিছু ফলমূল ছিড়ে নিয়ে এসো। তৃষ্ণা কিন্তু উঠল না। তার আর এখন ভয়টয় কিছু করছে না। নিজের এ অবস্থা নিজেই বহন করার মানসিক এক শক্তি সে টের পাচ্ছে ভেতরে। আর টের পাচ্ছে, তার দেহের ভেতর বেড়ে ওঠা আরেক দেহের নড়াচড়া।
রাত নামল। গাঢ় অন্ধকার রাত। পুরো বনভূমি নিঃসাড়। তবে বুনো জন্তুদের হাঁকডাকে কম্পিত। তৃষ্ণাও নিঃসাড় হয়ে শুয়ে আছে। না, ভয় তার করছে না। তবে ঘুমও আসছে না। কী এক আশঙ্কা যেন ভেতরটা বিদ্ধ করে যাচ্ছে। তাকে এখনও যে কোনো জন্তু খেয়ে ফ্যালেনি, এটাই তার কাছে বিস্ময় লাগছে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল তৃষ্ণা। আবার উঠেও পড়ল দিনের নতুন সূর্য মুখে চুমু খেতেই। দিনের বেলা কত অন্যরকম এই জায়গা। আলো আর অন্ধকারের কী বিচিত্র দুই জগৎ। একেবারেই আলাদা। চেনাই যায় না। উঠল তৃষ্ণা। বনের আশপাশটা ঘুরে বেশকিছু ফল সে গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলো। সারাদিন তা দিয়েই চলল তার। দিন গিয়ে রাত এলো।
চলবে...