তৃষ্ণাকুমারী

উপন্যাস পর্ব ১২

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ১২, ২০১৮

রাত গিয়ে দিন। তৃষ্ণাকুমারী পড়ে রইল জঙ্গলের ধারে। সারাদিন জঙ্গল থেকে সে ফলমূল সংগ্রহ করে, খায়। আর রাত হলে এই গাছতলায় এসে ঘুমিয়ে পড়ে। একটু একটু করে বাড়ছে তার পেট। কখনও সখনও পেটের ভেতর নড়ানড়া টের পায় তৃষ্ণা। দিনের বেলা মাঝেসাঝে সে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়ে, সন্যাসী সন্যাসী বলে ডেকে ডেকে হয়রান হয়। কিন্তু মানুষের সাড়া পাওয়া যায় না। সাড়া মেলে জন্তু-জানোয়ারের। দ্রুত পায়ে সে বেরিয়ে আসে।

ঢিমেতালে এভাবেই সময় পেরিয়ে যায়।   
একদিন দুপুর। আকাশ থমথমে। ছেঁড়া ছেঁড়া কালো মেঘের আস্তরণ আকাশ ছেয়ে। সকাল থেকেই তলপেটে চিনচিনে ব্যথা টের পাচ্ছিল তৃষ্ণা। দুপুরের মধ্যে ব্যথা বাড়ল। কী করে এখন সে? ভয়ে দেহে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। কিন্তু বেলা বাড়ছে, সে সাথে বাড়ছে ব্যথা। রক্তে ভিজে গেছে তার ছেঁড়া-ময়লা ত্যানার মতো পাজামা। তীব্র ব্যথা সইতে না পেরে সে পা দিয়ে টেনে খুলে ফেলল পাজামাটি। একসময় তৃষ্ণা নিশ্চিত হলো, এ ব্যথা সে সইতে পারবে না। চিরে যাচ্ছে সারা দেহ। তলপেটের নিচে কেউ যেন ধারালো চাকু দিয়ে টান দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত কামড়ে গোঙাতে লাগল তৃষ্ণা। একসময় তার জ্ঞান হারালো।
জ্ঞান যখন ফিরল, তখন বিকেল। রোদ নরম হয়ে বিছিয়ে আছে চারদিক। তৃষ্ণা দেখল, তার দু’ঊরুর মাঝখানে রক্তে মাখা এক বাচ্চা। ট্যা ট্যা করে কাঁদছে। কান্নার শব্দে হাসির একটি রেখা উঠল তৃষ্ণার বিষণ্ণ মুখে। দুর্বল দেহেও অনেক কষ্টে সে উঠে বসল। রক্তমাখা পাজামা পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। এরপর টলতে টলতে গেল নদীর জলে। বাচ্চাটাকে স্নান করালো। নিজেও স্নান করল। রক্তমাখা পাজামা ধুয়ে পানি নিংড়ে মুছে দিল বাচ্চার গা। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, দূরে কী যেন একটা নৌকার মতো। যেন চোখের ভ্রম, আবার তাকালো তৃষ্ণা। হ্যাঁ, একটি নৌকাই তো। মুহূর্তে খুশির ঢেউ বয়ে গেল তার শরীরে। বাচ্চাটাকে বুকে চেপে দ্রুত পায়ে সে উঠে এলো তীরে। এক হাতে একটি লাঠি ওপরে তুলে সে নাড়াতে লাগল, আর চ্যাঁচাতে লাগল, বাঁচাও বাঁচাও... এখানে মানুষ... বাঁচাও...

একটু পরেই দ্যাখা গেল নৌকাটি এদিকেই আসছে। তীরে এসে ভিড়তেই তৃষ্ণা এগিয়ে গেল নৌকাটির দিকে। একটি সওদাগরি বজরা। পণ্যসামগ্রী বোঝাই। সওদাগর বসে আছেন বজরার ছাদে। অবাক চোখে সে চেয়ে আছে তৃষ্ণাকুমারীর দিকে। এত রূপ এই জঙ্গলের কোণে পড়ে ছিল, ভাবতেই পারছে না সওদাগর। একি মানুষী, নাকি পরি? চোখে ধন্দ লেগে যায়। সওদাগর নেমে এলো তীরে।
সওদাগরের চাউনি আর এগিয়ে আসার ভঙ্গি দেখে ধসে যায় তৃষ্ণার ভেতর। আবার বুঝি কোনও বিপন এগিয়ে আসছে, হা ভগবান!
সওদাগর জিগেশ করল, তুমি কে হে রূপসী? এই জঙ্গলে কী করো? বুকে কে? তোমার বাচ্চা বুঝি? তা কবে বিয়োলো?

তৃষ্ণার ভেজা চুল দিয়ে টপটপ ঝরে পড়ছে জল। গায়ের আবরণ তেমন কিছু নেই বললেই চলে। লজ্জায় মাথা তুলতে পারল না তৃষ্ণা। সে দেখেছে, লোকটার চোখে লোভ। কিন্তু এখন সে কী করবে? পালাবে? পালিয়ে কোথায় যাবে?
সওদাগর বলল, কী হলো রূপসী, উঠে এসো বজরায়। যাবে না আমার সাথে?
তৃষ্ণা কথা বলতে পারে না। লোকটার চোখ চকচক করছে। কী যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেহের ভেতর শিরশির করে ওঠে তৃষ্ণার।
মাঝিদের উদ্দেশে হাঁক দিল সওদাগর, এই তোরা নেমে আয়। মেয়েটাকে বজরায় তোল। আর কোলের শিশুটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখ।

বিপদ। বিপদ সামনে। কী করে এখন তৃষ্ণা? পালাবে? তার যে পা ওঠে না। কী রকম যেন অবশ লাগে দেহ। ধপ করে সে বসে পড়ল সওদাগরের পায়ের কাছে। চোখের জলে ভাসিয়ে দিল সওদাগরের পা। এমন নির্দয় আপনি হবেন না সদাগর, কৃপা করুণ শিশুটিকে। আমি না থাকলে নিষ্পাপ শিশুটি মারা যাবে। করুণা করুন...।
দুজন মাঝি নেমে এলো। তৃষ্ণাকে তুলে নিল তারা বজরায়। সওদাগর এসে ছিনিয়ে নিল শিশুটিকে। এরপর তীরের ঘাসে শুইয়ে দিয়ে বজরায় উঠে এলো। তৃষ্ণা তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ছেড়ে দিল বজরা।
বাচ্চাটা কাঁদছে। হাতপা ছুড়ছে, আর কাঁদছে। বজরা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে...। কেঁদেই চলেছে বাচ্চাটি। এইবার সে গড়াতে শুরু করেছে। পড়তে শুরু করেছে ঢাল বরাবর। কী হবে এখন?

সন্যাসী এসে দাঁড়ালেন। গড়াতে গড়াতে শিশুটি তার পায়ের ওপর আটকে গেল। দু’হাতে তাকে বুকে তুলে নিলেন সন্যাসী। হঠাৎ করেই কান্না থেমে গেল তার। যেন সে মায়ের কোল পেয়েছে। নিরাপদ আশ্রয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়ল। তাকে বুকে জড়িয়ে সন্যাসী হাঁটতে শুরু করলেন নদীর তীর ধরে। হাঁটতে হাঁটতে বনের শেষ মাথায় এসে তিনি পৌঁছোলেন। বেশ রাত হয়ে গেছে তখন। গোলগাল চাঁদ আকাশে। গাছপালার মাথায় আবছা অন্ধকার থাকলেও পথঘাট বেশ পরিষ্কার। কাছেই একটি গ্রাম দেখা যাচ্ছে। সেদিকে এগোলেন সন্যাসী। গ্রামে ঢোকার মুখে কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ ডাক ছেড়ে এগিয়ে এলো তার দিকে।

সন্যাসী হাতের লাঠি তুলে বললেন, চোপ! এরপর হাঁটা ধরলেন। থেমে গেল কুকুরের ডাক। তবে এবার তারা সন্যাসীর পিছু নিল। চুপচাপ। কেবল ঘন ঘন তাদের লেজ নড়তে থাকে। শনের চালা দেয়া মাটির একটি ঘর পেরিয়ে এলেন সন্যাসী। আর একটু এগোলেই চোখে পড়ল একটি পাতকুয়া। কুয়োর ওপর ঘাপটি মেরে বসে ছিল একটি হুলো। লাফ দিয়ে নেমে সে ঢুকে পড়ল পাশের খড়ের গাদার ভেতর। আর একটু এগোলে সন্যাসী দেখল পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা মাটির, আরেকটা বাঁশ আর পাটকাঠি দিয়ে ছাওয়া। মাটির ঘরটা থেকে ঘুমন্ত মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। সঙ্গে নাকডাকার ক্ষীণ আওয়াজ। আরেকটা ঘরে গাই-বাছুর। মাটির ঘরটার দাওয়ায় শিশুটিকে শুইয়ে দিলেন সন্যাসী। এরপর এগিয়ে গেলেন অন্ধকারে। এরপর মিলিয়ে গেলেন।

শেষরাতে একটু শীত শীত পড়ল। পায়ের কাছে দলা করা কাঁথাটা টেনে গায়ে জড়াতে জড়াতে কিনু গোয়ালা শুনল মানুষের বাচ্চার কান্না। ঘুমের আচ্ছন্নতার ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে আবারও সে শুনতে পেল কান্না। এরপরই ধড়ফড় করে সে উঠে বসল। হ্যাঁ, ওই তো, শিশুরই তো কান্না। যেন ঘরের দরজার ওদিক থেকেই... এই, বউরে উঠরে ওঠ... শিগগির ওঠ... কিনু ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল তার বউকে। ধড়ফড় করে বউটা উঠে বসল। চোখমুখে আতঙ্ক। কী হইছে? কী হইছে?

কিনু বলল, বাইরে একটা বাচ্চা কানতেছে।
কী কও? কান পাতল বউটা। হ্যাঁ, ঠিকই তো। একটা বাচ্চা কেঁদেই চলেছে। দ্রুত পায়ে চৌকি থেকে নেমে বউটা দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। পেছনে কিনু। দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে বুকে তুলে নিল বউটা। খুশির ঝিলিক খেলে গেল চোখমুখে। সে বলে উঠল, দেখেছো গো, ভগমান আছেন। আমার খালি বুক পূর্ণ করতেই তিনি বাচ্চাডারে আমার দুয়ারে রেখে গেছেন।

বাচ্চাকে পেয়ে নয়, বউয়ের আনন্দেই খুশি কিনু গোয়ালা। তাদের সংসারে অভাব তেমন ছিল না ঠিকই, কিন্তু তারা ছিল দুজন। তাদের ছেলেপুলে ছিল না। খালি জায়গা আজ ভগবান পূরণ করে দিলেন। এতেও খুশি কিনু। আর কি চাই! সেদিন আর বাড়ি বাড়ি দুধ বেচতে গেল না কিনু গোয়ালা। যা দুধ হলো, পায়েশ রেঁধে আশপাশের কয়েক ঘর খাওয়ালো। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ বাচ্চাটাকে দেখে বলল, এ যে রাজকপালে রে কিনু। এ ছেলে তোর ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে, দেখিস। তা, ভাগ্য ফেরানোর আশায় নয়, বুকের হাহাকার পূরণের আনন্দেই কিনু গোয়ালা খুশি। বউ খেদির সঙ্গে সে মেতে রইল বাচ্চাটাকে নিয়ে। খেদির আনন্দ দ্যাখে কে! চানটান করিয়ে বাচ্চাকে এখন গরুর দুধ খাওয়াচ্ছে। দু’পা মেলে বসে তার ওপর বাচ্চাটাকে শুইয়ে চামচে করে মুখে দুধ তুলে দিচ্ছে। বাচ্চাটি চুকচুক করে খাচ্ছে। কত্ত ছোটটো একটা মানুষ, অবাক চোখে চেয়ে থাকে কিনু। এরআগে এরকম বাচ্চা সে দেখেছে, কিন্তু কখনও এরকম তো অনুভূতি তার হয়নি! কী যেন এক মায়া আচ্ছন্ন করে ফেলছে ভেতরটা।
বউয়ের পাশে বসে কিনু বলল, বউরে, বাইচ্চাটার একটা নাম রাখো দেখি।

খেদি হাত না থামিয়ে জবাব দিল, সে ক্যামুন কথা? তুমি হইলা বাপ। নাম রাখবা তুমি, আমারে টানো ক্যান?
কিনু বাচ্চাটার দুধ খাওয়া দেখতে দেখতে বলল, তাইলে অর নাম রাখলাম আলোকনাথ।
দুধের বাটি রাখতে রাখতে খেদি বলে উঠল, ওমা দেখেছো গো, নাম শুনে কী রকম পা মোচড়ালো। এই ব্যাটা আলোকনাথ, দুধ খাওয়া শ্যাষ, এবার এট্টু ঘুম যা।
আলোকনাথকে তুলে পা জড়ো করে বুকের ভেতর নিল খেদি। এরপর ছড়া কাটল:

আয় রে আয় প্যাঁচা
মারব নাকে খোঁচা।
ঘুম দেবে রে আলোকনাথ
আজকে রাতে উঠুক চাঁদ।

রাতে সত্যি সত্যি চাঁদ উঠল আকাশে। ঝকঝকে একফালি চাঁদ। শাদা শাদা মেঘের মাঝখান দিয়ে ভেসে রইল চাঁদটা। বাঁশঝাড়ের দিক থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা কোনও পাখির ডাক। দূরে ডাকছে শেয়াল। নিঝ্ঝুম ঘুম ঘুম আলোয় ঘুমিয়ে পড়ল খেদি আর কিনু গোয়ালা। খেদির বুকের ভেতর আলোকনাথ। সেও অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

চলবে...