
তৃষ্ণাকুমারী
পর্ব ১৩
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০১৮
খেদির আদরে আর স্নেহে বড় হয়ে উঠতে থাকে আলোকচন্দ্র। সে চটপটে, তবে ছটফটে নয়। সারাদিন চারপাশটা কী রকম চোখে যেন দেখতে থাকে। আর থাকে মায়ের আঁচলের ছায়া দিয়ে। এরপর একটু যখন বড় হলো, হাতের টুকিটাকি কাজে সে মাকে সাহায্য করতে লাগল। যে বয়সে বাচ্চারা ঘরের বাইরে মাঠে কোথাও খেলতে পছন্দ করে, সে বয়সে আলোকচন্দ্র মাঠে গিয়ে একা একা বসে থাকে।
খেদির মনে ভয়। এ ক্যামন ধারা ছেলে গো? কারও সাথে মেলামেশা নেই, নিজের মনেই দিনটি কাটিয়ে দিচ্ছে। এ যে সোনার টুকরো! আহ্লাদে গলে পড়ে খেদির মাতৃপ্রেম। কিনু গোয়ালা দিনে বিভিন্ন জনের বাড়িতে দুধ ফেরি করে বেড়ায়। গরুগুলোর রাখালি ঠিকমতো করে উঠতে পারে না। এতদিনে গরুও হয়েছে ছ’সাতটি। তো, কিনু একদিন খেদিকে বলল, বউরে, আলোক তো এখন একটু বড় হইছে। ওরে তো এখন কামেকাইজে লাগানো দরকার।
খেদি পুঁইমাঁচা থেকে পাতা ছিড়তে ছিড়তে বলল, হ গো, আমিও তাই ভাবতেছি। ছাওয়াল দেখি সারাদিন চুপচাপ। কারও সাথে মেলামেশি নাই। এরচে রাখালি করুক। চোখ-কান খুলবো। সেদিন রাতে খেতে বসে কিনু বলল, বাবা আলোক, কাল থিকা তুমি গরুগুলা চরাইতে যাইবা। তুমি এখন বড় হইছ। কামকাইজ শিখতে হইব।
বাধ্য ছেলের মতো আলোক জবাব দিল, তাহলে বেশ হয় বাবা। মাঠে মাঠে সারাদিন আমি গরু চরিয়ে বেড়াব। একাজ খুবই পছন্দ আমার। খেদিও খুশি। আরেক হাতা ভাত আলোকচন্দ্রের থালায় দিতে দিতে সে বলল, তাইলে বিয়ানবেলা গরম ভাত রাইন্দা বাটিতে দিয়া দিবানি। দুফুরে কোনও গাছতলায় বইসা খায়া নিও। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তারা। বাইরে নির্জন রাত। দূরে শেয়ালের হক্কাহুয়া ডাক শোনা যাচ্ছে। আলোকচন্দ্রের মাথার কাছে জানলাটা খোলা। হু হু হাওয়া ঢুকছে। ঘুমোয়নি আলোকচন্দ্র। গাঁয়ের অনেক ছেলেই রাখালি করে। কতবার সে ওদেরকে গরু নিয়ে যেতে দেখেছে। কতবার তারও ইচ্ছে হয়েছে গরু নিয়ে ওরকম মাঠে যেতে। মাঠে মাঠে ঘুরে তার কতকিছু দ্যাখা হয়ে যেত। চেনা হতো কত পথ। সারাদিন শুয়ে-বসে এমনিতেও তার ভালো লাগতো না। মায়ের টুকিটাকি কাজ করে দেয়া ছাড়া তেমন কিছু তার করার ছিল না। এবার থেকে সে একটা কাজ পেল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আলোকচন্দ্র হঠাৎ আবিষ্কার করল, সে বড় হয়ে গেছে!
সকাল-সকাল খেয়েদেয়ে গরুগুলো নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল আলোকচন্দ্র। এরপর মাঠে মাঠে গরুগুলোর পিছু পিছু তার কেটে যায় দিন। গোধূলির রঙ যখন রাঙিয়ে তোলে পশ্চিমের আকাশ, আলোকচন্দ্র তখন বাড়ি ফেরে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে চোখে পড়ে রান্নার ধোঁয়া। মা রাঁধছেন। বাতাসে পাঁচফোড়নের গন্ধ। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে দেখতে পায় মায়ের হাসি। তার দিকে চেয়ে মা স্নেহের হাসি হাসে। এভাবেই তার ভালো লাগে। মাঠে মাঠে সারাদিন ঘুরে ঘুরে কত কত কিছু সে দ্যাখে। তার ভালো লাগে নদীর তীর। সেখানে লকলকে সবুজ ঘাস। গরুগুলো চুপচাপ খেতে থাকে। আর সেও ডুবে যেতে পারে তার মতো। আকাশে ছড়িয়ে থাকে নীল শাদা মেঘ। পাখির ঝাঁক উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। কিচিরমিচির ধ্বনি কী যে মিষ্টি শোনায় আলোকচন্দ্রের কানে।
কান খুলে সে শোনে পাখির ডাক।
বুক খুলে গ্রহণ করে প্রকৃতির প্রেম।
চোখ খুলে দ্যাখে জগৎটা।
গাঁয়ের রাখালদের সঙ্গে খুব একটা মেশা হয় না তার। একা একা সে গরুর পাল নিয়ে একদিকে চলে যায়, সেদিকে গাঁয়ের রাখালের কেউ যায়নি।
একদিন একটা গাছের নিচে শেকড়ে ঠেস দিয়ে বসে আছে আলোকচন্দ্র। গরুগুলো নিজেদের মতো চরে বেড়াচ্ছে। দুপুর, তবে তেতে ওঠা রোদ নেই। ধূসর মেঘ আকাশে। আলোকন্দ্র দেখল, নদীর তীর ধরে এক সন্যাসী হেঁটে আসছেন। এর আগেও সে সন্যাসী দেখেছে। তাদের গ্রামে প্রায়-প্রায়ই এরকম এক সন্যাসী আসে। ঝোলা নিয়ে আসে। বাড়ি বাড়ি চাল ভিক্ষে করে নিয়ে যায়। এসব যখন ভাবছে সে, সন্যাসী এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। জিগেশ করলেন, তোমার নাম তো আলোকচন্দ্র, তাই না?
হ্যাঁ। পষ্ট জবাব আলোকচন্দ্রের।
সন্যাসী আবারও জিগেশ করলেন, তুমি কে, তা কি তুমি জানো?
একটু অবাক হয়ে আলোকচন্দ্র জবাব দিল, জানি।
সন্যাসীর প্রশ্ন, বলো তো।
আলোকচন্দ্র বলল, কিনু গোয়ালা আমার বাবা। আর খেদি আমার মা। আমি রাখালি করি।
সন্যাসী বললেন, তুমি সত্যি বলছ বালক। কিন্তু এ পরিচয় তোমার এখনকার পরিচয়। তোমার অতীত আরেকটি পরিচয় আছে। তুমি আসলে একজন রাজপুত্র।
চলবে...