তৃষ্ণাকুমারী

পর্ব ২১

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : মার্চ ২১, ২০১৮

গুপ্তঘর। চারদিকে ছড়ানো-ছেটানো নরকঙ্কাল। রাজা তেপইয়ের পূর্ব-পুরুষের কেউ একজন এই অন্ধকুঠুরিটা বানিয়েছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়, রাজদ্রোহীদের ধরে এনে এই অন্ধকুঠুরিতে আটকে রাখা হতো। কোনও খাবার দেয়া হতো না। না খেতে পেয়ে এভাবে বন্দিদের মৃত্যু হতো। অসংখ্য কঙ্কাল ঘরটার মধ্যে। এরই একদিকে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন রাজা তেপই। পাশে চাটাইয়ের ওপর শুয়ে আছেন রানি চন্দ্রমালা। নিঃশ্বাসের ঘন শব্দ শোনা যাচ্ছে তার। একটু দূরে জ্বলছে মাটির একটি প্রদীপ। তবে তা প্রায় নিভু নিভু। আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে চারপাশ। প্রতিদিন দু’বেলা তাদের খাবার দেয়া হয়। আর রাতের বেলা প্রদীপের এই আলো। এটুকু দয়া তারা পাচ্ছেন মন্ত্রী বিশ্বনাথের কাছ থেকে।

রাজা-রানি চুপচাপ। কথাবার্তা খুব একটা হয় না তাদের। সারাক্ষণ কী যেন এক দুশ্চিন্তা তাড়া করে ফেরে। প্রথম যেদিন এই অন্ধকুঠুরিতে তাদের ঢোকানো হলো, রানি অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন। রাজাও কোনও সাড়া পাচ্ছিলেন না দেহে। রানিকে বুকের ভেতর নিয়ে নিঃসাড় বসে রইলেন। রানির জ্ঞান ফিরে এলে তিনি কঙ্কালগুলো এদিক-ওদিক করে সরিয়ে নিজেদের জন্যে জায়গা করে নিলেন। এরপর শুরু হলো তাদের বন্দি জীবন।

শোয়া অবস্থা থেকে চাটাইয়ে উঠে বসলেন রানি। বললেন, একটু জল খাব। রাজা উঠে মাটির কুঁজো থেকে গেলাশে জল ঢেলে এনে তাকে দিলেন। ঢকঢক শব্দে জল খেয়ে রানি গেলাশ ফিরিয়ে দিলেন রাজার হাতে। ঘরের কোণায় কুঁজোর ওপর গেলাশ রেখে রাজা এসে বসলেন রানির পাশে। বললেন, একটু ঘুমোও রানি। এই আমি তোমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি। রাজার বুকের ওপর ঝুঁকে এলো রানির মুখ। রাজার আঙুল বিলি কেটে দিতে লাগল তার চুলে। ঘরের কোথায় যেন ডেকে যাচ্ছে টিকটিকি। বাইরের কোনও শব্দ শোনা যায় না এখানে। বাইরের আলোও ঢোকে না। ঘরের একদিকের দেয়ালে অনেক উঁচুতে কেবল ছোট্ট ঘুলঘুলি আছে। ওদিকটায় কঙ্কালের স্তূপ। দিনের বেলা আলোর ক্ষীণ একটা ধারা চোখে পড়ে।

রাজার বুকের ভেতর উথাল-পাথাল ঢেউ। বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রীর মুখটা থেকে থেকে তিনি মনের ভেতর দেখতে পান। আর তখন ধিকিধিকি আগুন জ্বলতে থাকে বুকে। ব্যাটা কুচক্রী, আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল। রাজকুমারী তৃষ্ণাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে রাজা ফিরলেন রাজবাড়ি। রানিকে বললেন, রাজকুমারীকে বাঘে খেয়েছে। রানি মূর্ছা গেলেন। ছুটে এলেন মন্ত্রী। ছুটে এলেন সেনাপতি। সবাই নির্বাক। রানি বিছানা নিলেন। রাজা মনের শান্তি হারিয়ে ফেললেন। ঠিকমতো সভায় যান না। মন্ত্রীকে বলেন, মন্ত্রীমশাই, যা পারেন, আপনিই চালিয়ে নিন। বুঝতে পারছেন তো, আমার মনের অবস্থা। গুরুতর কোনও সমস্যায় না পড়লে আমাকে দূরে রাখুন। বাধ্য কর্মচারীর মতো মাথা নেড়ে মন্ত্রী জবাব দিয়েছিল, আজ্ঞে মহারাজ। আপনি রানিমাকে সময় দিন। এদিকটা আমি দেখছি। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।

রাজা তো নিশ্চিন্তেই ছিল। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, দরজার সামনে পাঁচজন সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্ত হলেন তিনি। ধমকের সুরে বললেন, কী ব্যাপার, তোমরা এখানে কেন? এরই মধ্যে তার সামনে এসে দাঁড়ালো মন্ত্রী। শেয়ালের হাসি তার মুখে। বলল, আপনাকে বন্দি করতেই ওরা এখানে দাঁড়িয়ে আছে রাজামশাই। আজ থেকে খাগড়া মুল্লুকের রাজা আমি, আপনি নন। রাজার স্বরে ক্রোধ ফুটে বেরোলো, নেমকহারাম! মন্ত্রীর মুখে হাসি, সে আপনি যা-ই বলুন, আমার তাকে কি? এই যা, বন্দি কর রাজা আর রানিকে। সৈন্যদের হাতে বন্দি হলেন রাজা-রানি।

প্রায়ই সময় রাজা ভাবেন, বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রীকে উচিত শাস্তি কীভাবে দেয়া যায়? আবার ভাবেন, তিনি যে বন্দি। কীভাবে বের হবেন অন্ধকার এই কারাকক্ষ থেকে? মুক্তির কোনও উপায় হাজার ভেবেও রাজা বের করতে পারেন না। রাজা ডাকলেন, রানি? ধরা গলায় রানি জবাব দিলেন, বলুন রাজা। দাদা প্রতাপচন্দ্র কি আমাদের দুর্দশার সংবাদ পাননি? অনেক দিনই তো পেরিয়ে গেল। বিমলাও যে ফিরল না। রানি বললেন, আমিও কয়েকদিন ধরে এটাই ভাবছি। এতদিনে দাদার কানে তো সংবাদ পৌঁছে যাওয়ার কথা। রাজা বললেন, কী জানি রানি! আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। দাদা যদি খবর পেতেন, এতদিনে নিশ্চয়ই তিনি এসে আমাদের উদ্ধার করতেন। কিন্তু তার তো কোনও আলামত পাচ্ছি না। এভাবেই বুঝি আমাদের মরে পড়ে থাকতে হবে অভিশপ্ত এই ঘরটাতে। রাজার কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে উঠল। চোখ গেল ভিজে। ভেজা চোখে তিনি চেয়ে রইলেন নিভু নিভু প্রদীপটার দিকে।

টিকটিকি ডেকে উঠল। রানি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। রাজা বললেন, ওই দ্যাখো, আবার শুরু হলো। কেঁদো না তো রানি। চোখের আলো তো হারিয়েই বসে আছো। ক্ষতির কি আর বাকি আছে কিছু? যা হবার তা হবেই, শুধু শুধু কেঁদো না।

চলবে...