
দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ মৃত্যুদিন
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২২
কবি, সংগীতকার, দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ মৃত্যুদিন। ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৪০ সালের ১১ মার্চ তার জন্ম। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।
বাংলা সাহিত্যে দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রথম অবদান ছিল ধ্রুপদি সংস্কৃত ভাষায় রচিত কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বঙ্গানুবাদ। ১৮৬০ সালে নোবেল পুরস্কার-বিজয়ী কনিষ্ঠ ভ্রাতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ঠিক এক বছর আগে, এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ প্রকাশকালে দ্বিজেন্দ্রনাথের বয়স ছিল মাত্র কুড়ি বছর। এই অনুবাদটিই ছিল মেঘদূতের প্রথম বাংলা অনুবাদ।
তার দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ সালে। এই গ্রন্থ প্রকাশকালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কিশোর মাত্র। এই কাব্যে এক যুবকের ভ্রমণবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থে বিভিন্ন ছন্দশৈলীর প্রয়োগের উপর তার আশ্চর্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থটি সেই যুগের বাংলা কাব্যের এক দিকনির্দেশক এবং সেই কারণে এর ঐতিহাসিক মূল্যও অনস্বীকার্য।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন কাব্যচর্চা শুরু করেন, তখন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন স্বীয় সাফল্যের শীর্ষদেশে। ১৮৫৬ সালে মাদ্রাজ (অধুনা চেন্নাই) থেকে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করার পর থেকে ইউরোপ যাত্রার পূর্বে ছয় বছর মাইকেল মধুসূদন একাগ্রতার সহিত তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য (১৮৫৯), পদ্মাবতী (১৮৬০), মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১), ব্রজাঙ্গনা কাব্য (১৮৬১), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১), বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২) ইত্যাদি কাব্য ও নাটকের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত করেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ‘এক সত্যকারের দার্শনিক’। তিনি ‘ন্যাশানাল সোসাইটি’ ও ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ নামে দুটি দর্শনচর্চাকারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সহায়তা করেছিলেন। গীতা-দর্শনের প্রতিও তার গভীর আগ্রহ ছিল। তার প্রধান দর্শনগ্রন্থ হল তত্ত্ববিদ্যা (তিন খণ্ডে, ১৮৬৬-৬৮)। এই বইটি বাংলা দর্শনচর্চার ইতিহাসে একটি পথপ্রদর্শক গ্রন্থ। বাংলা ভাষায় এই জাতীয় বই পূর্বে প্রকাশিত হয়নি। তার অপর দুটি দর্শন গ্রন্থ হলো, অদ্বৈত মতের সমালোচনা (১৮৯৬) ও আর্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের ঘাত-প্রতিঘাত (১৮৯৯)।
১৮৮৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ২৫ বছর তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি হিতবাদী পত্রিকাটিও প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার অপর ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতী নামে একটি নতুন পত্রিকা চালু করার প্রস্তাব দেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করলেও, পত্রিকাটি চালাতেন মূলত জ্যোতিরিন্দ্রনাথই।
বাংলা সাহিত্যে তার অনবদ্য অবদানের জন্য ১৮৯৭ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত মেয়াদে তাকে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯১৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশনে তিনিই পৌরোহিত্য করেন। ১৮৭৩ সালে পাবনা বিদ্রোহের সময় তার জমিদারির আয় হ্রাস পেলে, তিনি কৃষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ‘শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃসংস্থাপন’ করার সুপারিশ করেন।[৮]
দ্বিজেন্দ্রনাথ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। তিনি ছিলেন বাংলা সংকেত লিপি বা শর্ট হ্যান্ড প্রবর্তনের এক অগ্রপথিক। তিনি কবিতার আকারে সংকেত লিপিও চালু করেন। বাংলা গানে স্বরলিপির ব্যবহার প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেযুগে রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সহকারী ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী ছাড়া আর কেউ এই কাজ করেননি। ১৯১৩ সালে বাক্সের গঠন বিষয়ে বাক্সমিতি নামে একটি পুস্তকও রচনা করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ।
১৮৬৬ থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের পদ অলংকৃত করেন। ব্রজসুন্দর মিত্রের তত্ত্বাবধানে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের সূচনাপর্বে তিনি পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ঢাকা পরিভ্রমণ করেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ হিন্দুমেলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। হিন্দুমেলার জন্য তিনি দেশাত্মবোধক গানও রচনা করেছিলেন। গানরচনা ছিল তার স্বভাবগত। তার রচিত ব্রহ্মসংগীত করো তার নাম গান, যতদিন রহে দেহ প্রাণ বহু বছর ৭ পৌষের প্রার্থনায় গীত হয়েছিল।
ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ প্রার্থনাতেও তার রচিত ব্রহ্মসংগীতগুলি বহুলভাবে গীত হয়ে থাকে। হিন্দুমেলার জন্য লেখা তার একটি জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গান ছিল মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত তোমারি। জীবনের শেষ কুড়ি বছর দ্বিজেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির সাহচর্যে জ্ঞানচর্চা ও লেখালিখির মাধ্যমে অতিবাহিত করেন। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের নিয়ে তিনি হাস্যোদ্দীপক চতুষ্পদী ছড়া রচনা করতেন। এই ছড়াগুলি প্রকাশিত হত শান্তিনিকেতন পত্রিকায়। তার রসবোধ শান্তিনিকেতনে সকলের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল।
শান্তিনিকেতনে চড়াই পাখি, কাঠবিড়ালি আর কাকেদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল প্রবাদপ্রতীম। ঈশ্বরজ্ঞান লাভের পর মানুষের হৃদয় শিশুর তুল্য হইয়া যায়, উপনিষদ্ শাস্ত্রের এই শিক্ষা তিনি মেনে চলতেন। তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেছিলেন। তবে তার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল দর্শন। রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য বিদ্বান ব্যক্তিদের নিতে তিনি মজলিশ বসাতেন। এই মজলিশে তিনি তার রচনা পাঠ করে শোনাতেন। কোনো বিষয় বুঝতে না পারলে বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেনের সাহায্য নিতেন।