দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২৪

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

শৈশব থেকে বই পড়ার যে অবারিত সুযোগ পেয়েছি প্রধানত তার মূলে ছিল পারিবারিক পরিবেশ। বই সংগ্রহে এবং বই পড়ায় আমার পিতার ছিল নেশাগ্রস্ততুল্য আসক্তি। বই পড়ায় আমাকে তিনি বেজায় উৎসাহিত করতেন। তার একটি ঈর্ষণীয় ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল— মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

হামিদ কায়সার: আপনার বই পড়ার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা বলুন, কি কি বই পড়েছেন?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, আত্মস্মৃতি সমেত আর আর বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কিছু বই এরই মধ্যে পড়া গেছে। প্রসঙ্গত বলে রাখতে চাই যে, বই পড়ার ব্যাপারে তেমন খুব বাছবিচার আমার নেই। তবে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে পছন্দ-অপছন্দ অবশ্য রয়েছে। সাম্প্রতিককালের বইপড়ায় আমার অভিজ্ঞতা এই যে, প্রথমত আমাদের লেখকদের, বিশেষ করে তরুণতর লেখকদের আগ্রহ-অনুসন্ধিৎসা নানামুখী হয়েছে। দ্বিতীয়ত প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পটভূমি নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা নিয়ে এবং তৃতীয়ত সৃজনশীল রচনার ক্ষেত্রে বিষয়বস্তু নিয়ে, উপস্থাপনা নিয়ে নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্টের সাক্ষাৎ পাচ্ছি। পঠিত বইয়ের সমগ্র তালিকা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে গুটি কতক বইয়ের কথা বলছি: ‘বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ’, ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস’, ‘ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান’, ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’ এবং ‘বাঙালির কণ্ঠ’। এছাড়া দেশের বাইরে সম্প্রতি প্রকাশিত অরূন্ধতি রায়ের ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ (বেশ কিছুকাল আগে প্রকাশিত)।

হামিদ কায়সার: আপনি সাধারণত কি ধরনের বই বা কোন বিষয়ের বই পড়তে ভালোবাসেন।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই।

হামিদ কায়সার: এমন কোনো বই কি রয়েছে, যা আপনি সর্বক্ষণই কাছে রাখেন এবং বারবার পড়েন।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: সঞ্চয়িতা।

হামিদ কায়সার: আপনার প্রিয় বই এবং প্রিয় লেখকের কথা জানতে চাচ্ছি।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: বেছে বলাটা মুশকিলের। তবে ছেলেবেলায় ‘ঠাকুমার ঝুলি’র দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, আর হাসির গল্পের শিবরাম চক্রবর্তী। পরের কালে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম।

হামিদ কায়সার: দেশে আপনি কাদের লেখা পড়েছেন এবং পড়ে থাকেন?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: অনেকেরই তো পড়েছি। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনার লেখাই ভালো লাগে। এক্ষুণি চটজলদি যদি কারুর কারুর কথা বলতে হয় তা হলে নাম করব কথাসাহিত্যে শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, সত্যেন সেন, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, মঞ্জু সরকার, মঈনুল আহসান সাবের, নাসরীন জাহান; কবিতায় ফররুখ আহমদ, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ; নাটকে মুনীর চৌধুরী, আনিস চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদ্দিন আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, আত্মস্মৃতি রচনায় আবুল মনসুর আহমদ, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল ফজল এবং আবু জাফর শামসুদ্দীন; বলা বাহুল্য যে, এইখানে প্রধানত সৃজনশীল লেখকদেরই নামোল্লেখ করা গেল। সে দিক থেকে তালিকাটি অবশ্য সম্পূর্ণ নয়।

হামিদ কায়সার: বিদেশি ভাষায় সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলুন, কি বই এবং কার বই আপনার বেশি পড়া হয়েছে?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: বিদেশি ভাষার সাহিত্য পাঠ বলতে আমি মূল ইংরিজিতে রচিত, অথবা অপরাপর ভাষা থেকে ইংরিজিতে অনুদিত, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলায় ভাষান্তরিত এই ধরনের বই-এর কথাই বলছি। এবং গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ব্যতিত অন্য শাখার সাহিত্য— এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এখানে কেবলমাত্র আপন ভালো লাগার কয়েকজন মাত্র লেখকের নামোল্লেখ করা যাচ্ছে। যেমন— ইবসেন, ন্যুট হামসুন, পুশকিন, টলস্টয়, গোর্কি, এরেনবুগ, মায়াকভস্কি, পাস্তারনেক, রেমার্ক, রল্যাঁ, মার্ক টোয়াইন, সামারসেট মম, ও হেনরী, ও’নীল, হেমিংওয়ে, আর্থার মিলার, লাও চা অ, নাজিম হিকমত, প্রেমচান্দ, আর কে নারায়ণ, মূল্ক্ রাজ আনন্দ, অরুন্ধতী রায় প্রমুখ।

হামিদ কায়সার: প্রথম বই পাঠের স্মৃতি কি মনে পড়ে? অনুগ্রহপূর্ব জানান।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: আবছা খানিকটা মনে পড়ে। খুব ছেলেবেলায় পড়েছিলাম ‘ঠাকুমার ঝুলি’। আরেকটু যখন বয়সে বেড়েছে তখন রবিনহুডের গল্প, সিন্দাবাদের গল্প।

হামিদ কায়সার: শৈশবে আপনি বই পাঠের সুযোগ পেয়েছেন কেমন? বইপাঠের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতই বা কেমন ছিল।
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: বলব যে, সেদিক থেকে আমি ভাগ্যবান বটে। শৈশব থেকে বই পড়ার যে অবারিত সুযোগ পেয়েছি, প্রধানত তার মূলে ছিল পারিবারিক পরিবেশ। বই সংগ্রহে এবং বই পড়ায় আমার পিতার ছিল নেশাগ্রস্ততুল্য আসক্তি। বই পড়ায় আমাকে তিনি বেজায় উৎসাহিত করতেন। তার একটি ঈর্ষণীয় ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল। আবার বাড়ির বাইরে পাড়ায় পাড়ায় তখন লাইব্রেরি ছিল। সতীর্থ বন্ধুদের সাথে পাল্টাপাল্টি করে আমরা বই পড়তাম। আর, ইস্কুলে শিক্ষকরাও পাঠ্য তালিকার বাইরে নানান বিষয়ে, বিশেষ করে মহাপুরুষের জীবনী; জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই, আবিষ্কার অভিযানের বই, ভ্রমণকাহিনী পড়ার উৎসাহ দিতেন।

হামিদ কায়সার: শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণের সময়ে বইয়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কেমন ছিল— কি বই পড়া হতো তখন?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: এক কথায় বলতে গেলে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মেলাই সব বই পড়া গেছে সেই সময়ে। ইস্কুল পাঠ্য টেক্সটের বাইরের বই। কট্টর মুরুব্বিরা বলতেন আউট বই। মোটেই তারা পছন্দ করতেন না। আর নাটক নবেল? হারামতুল্য বর্জ্য বিবেচনা করতেন। বলতেন, তাতে করে নষ্ট হয়ে যাবে ছেলে-মেয়েরা। চরিত্র ভ্রুষ্ট হবে। এখনো ভুলিনি শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’, প্রবোধ সান্যালের ‘প্রিয় বান্ধবী’ পড়ার দায়ে বেদম প্রহার করেছিলেন বড়ো চাচা। যাই হোক। এখন বলি, শৈশব থেকে প্রাক্ যৌবনকালের দিনগুলিতে কেমন ধরনের বই পড়া হতো। যতটা মনে পড়ছে, শুরুটা হয়েছিল ছড়ার বই দিয়ে। পরপর রূপকথার বই, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদার ঝুলি’, আরেকটা ছিল ‘হারু ও চারু’। সেই সাথে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসিমউদ্দীনের ছোটদের কবিতা। আরো পড়া গেছে ঈশপের গল্প, জাতকের গল্প, হিতোপদেশ, ছোটদের রামায়ণ, ছোটদের আরব্য রজনীর গল্প; হাবিবুল্লাহ বাহারের একটা বই ছিল ‘ওমর ফারুক’। ইতিমধ্যে বয়েস বাড়ছে, কৈশোরের সড়কে পা দিয়েছি। বেজায় টানত তখন দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী, ডিটেকটিভ গল্প। যেমন— বাংলায় ভাষান্তরিত রবিনহুড, রবিনসন ক্রুশো, ট্রেজার আইল্যান্ড, ডন কুইটজোট, রবার্ট ব্লেকের কাহিনী, শার্লক হোমস এই সব। এদিকে পাঁচকড়ি দের ‘নীলবসনা সুন্দরী’, ‘হত্যাকারী কে’ তাও বাদ যায় নি। এবং ছিল ব্যোমকেশের গল্প, ‘কালো ভ্রমর’, ‘হিমালয়ে ভয়ংকর’, ‘যক্ষের ধন’ আর কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের কিশোর পাঠ্য বইগুলি। অতঃপর কৈশোরের মোহমুগ্ধতা পেরিয়ে প্রথম যৌবন— রাজনীতি নিয়ে দিনরাত প্রায় সার্বক্ষণিক ঘর করা। বইপড়ার আগ্রহের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছিল। ঐ সময় বিশেষ করে পড়া হতো কলকাতার ন্যাশনাল বুক এজেন্সি এবং বম্বের People’s Publishing House এর বামপন্থী প্রকাশনাসমূহ। তবে এইখানে অবশ্য বলে নিতে হবে যে, বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল ‘আধুনিক’, ‘অত্যাধুনিক’ ধারার গল্প উপন্যাস কবিতা নাটক পড়া। ঘোরের মতো পেয়ে বসেছিল, সংখ্যায় যে কতো তার শুমার নাই। তারো আগে, প্রথম দিককার অভিজ্ঞতা থেকে তিনটে বই-এর নাম বলি, রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’। কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম, কোন্ আরেক ভুবনের বাসিন্দা। তারপর আমাদের তরুণ বয়েসটা জুড়ে তারাশংকর-বিভূতিভূষণ-মানিক বন্দোপাধ্যায় থেকে গোলাম কুদ্দুস, ননী ভৌমিক-সমরেশ বসু- সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অবধি কে নন, কার বই নয়। বিভাজন যদি করতে চাই মোটা দাগে তিন ধরনের: রোমান্টিক, রিয়ালিস্টিক আর রাজনৈতিক।

হামিদ কায়সার: কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ভালো লাগতো কি ধরনের বই?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনেও ভালো লাগত পূর্বে যেমনটি বলা গেছে তেমনি ধরনের সব বই। তবে ইতিমধ্যে পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং রাজনীতি বিষয়ক বই।

হামিদ কায়সার: আমরা জানি, অধ্যাপনা করেই কেটেছে আপনার কর্মজীবন— বই পাঠে এ প্রফেশনটিকে আপনি উপভোগ করেছেন?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: সহজ, স্বাভাবিক ব্যাপার যে, একেক প্রফেশনের জন্য একেক প্রকারের প্রাসঙ্গিক এবং আবশ্যিক দাবি থেকে থাকে। অধ্যাপনার বেলাতেও তেমনি নিশ্চয়ই বইপড়া। তবে বিশেষ এই ক্ষেত্রে তার বাইরেও কথা রয়েছে। কেবল বই পড়ার জন্যেই এমন প্রচুর অবকাশ এবং প্রায় অনুকূল পরিবেশ আর কোথায়? জানি না আর কিভাবে কথাটাকে অধিকতর ব্যাখ্যা করা সম্ভব। নিবেদন করি, বই পড়ায় আমার প্রফেশনটিকে সর্বপ্রকারে এবং বর্ণনাতীত তৃপ্তিতে উপভোগ করেছি।

হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর গবেষণার সূত্রে এ বিষয়ক যে সমস্ত বই আপনি পাঠ করেছেন, তারমধ্যে কোন্ কোন্ বইগুলো আমাদের জাতি, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের জন্য আপনার কাছে দারুণ মূল্যবান মনে হয়েছে?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: ‘মূল্যবান’ কথাটা আপেক্ষিক। আমাদের জাতি, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস বিষয়ে বেশ কিছু সংখ্যক রেকর্ড-রিপোর্ট, আকর, উৎস এবং বিবরণধর্মী, বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থাদি রয়েছে। এইখানে আমার পঠিত গ্রন্থগুলির মধ্যে আপাতত কয়েকটির উল্লেখ করা যাচ্ছে। দীনেশচন্দ্র সেন— বৃহৎ বঙ্গ, রমেশচন্দ্র মজুমদার— বাংলাদেশের ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়—বাঙালির ইতিহাস, অতুল সুর— বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন, সুকুমার সেন— প্রাচীন বাংলা ও বাঙালী, আবদুল করিম— বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল), আবদুর রহিম—বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ— বাংলা সাহিত্যের কথা, সুকুমার সেন— বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, হুমায়ুন কবির— বাংলার কাব্য, অরবিন্দ পোদ্দার— মানব ধর্ম ও বাংলা কাব্যে মধ্যযুগ, মুহম্মদ এনামুল হক— মুসলিম বাংলা সাহিত্য, আনিসুজ্জামান— মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য—বাংলার বাউল ও বাউল গান, আশুতোষ ভট্টাচার্য— বাংলার লোক সাহিত্য, গোপাল হালদার— বাঙালী সংস্কৃতির রূপ, বিনয় ঘোষ— বাংলার নবজাগৃতি, কাজী আবদুল ওদুদ— বাংলার জাগরণ, শাশ্বত বঙ্গ, আবু মহামেদ হাবিবুল্লাহ— সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস, নরহরি কবিরাজ— স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলা, Jadunath Sarkar (ed)- History of Bengal. A.C. Gupta- Studies in the Bengal Renaissance. Amit Sen- Notes on the Bengal Renaissance. W.W. Hunter-The Indian Mussalmans. Khondkar Fuzli Rubbi- The Origin of the Mussalmans of Bengal. A.F.S. Ahmed- Social ideas and Social Changes in Bengal.
 
হামিদ কায়সার: বর্তমানের বইপাঠের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: আমার নিজেরও ধারণা যে, অবশ্য তা অনুকূলেই রয়েছে। মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে বটে, কী বলব, অতি তীব্র সে ব্যস্ততা। তার চোখ কান খুলছেও তেমনি। কৌতূহল, ঔৎসুক্য; আগ্রহ বাড়ছে প্রভূত পরিমাণে। মনে নানান প্রশ্ন। এই সমুদয় ক্ষেত্রে রয়েছে বই-এর সব চাইতে কার্যকর ভূমিকা। সেই জন্যেই ত’ সত্যটা যে, বই পড়ার বিকল্প নাই। মনে করি, আমাদের সমাজে অতি দ্রুত সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অতএব নিশ্চয়ই বই পড়ার সামাজিক পরিবেশও সেই কার্যকারণেই নির্মিত হয়ে উঠেছে।

হামিদ কায়সার: ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার দাপটের কারণে বইপড়ার যুগ কি ফুরিয়ে এলো?
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম: মনে হয় না। বিশ্বাসও করি না। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দাপট, ‘দাপট’ বলাটা কী যথার্থ? অবশ্য মানি যে, এই মিডিয়া অতি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, এবং এর ব্যাপক প্রসার ঘটছে। সময়ের বাস্তব প্রয়োজনেই যে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের উদ্ভব-বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে, নতুন করে তা জানানো বাহুল্যমাত্র। তবে বইপড়ার সাথে তার সম্পর্কটা কোথায়, কী? বইপড়ার বিকল্প কেন হবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া, আমার বুঝ্-এ তা আসে না। আমরা বই পড়ে থাকি আপন মন-মননের তাগিদে। অন্তরজাত কৌতূহল, জগৎজীবন বিষয়ে নানান জিজ্ঞাসা, বই পড়ে এই সমস্ত মেটাবার প্রয়াস পাই। ইলেকট্রনিক মিডিয়াও অবশ্য কিয়দংশে কৌতূহল মেটায়, অনেক নতুন কিছুর সন্ধান দেয়, মুহূর্তে বহির্বিশ্বকে অন্দরে পৌঁছে দেয়; এমন কী মহাশূন্যের ভুবনকেও। প্রধানত নানাবিধ ‘কেজো’ তাৎক্ষণিক কর্মকা-সমূহ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ঐ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মারফত। আর, বই পড়ার এনাম, মনে করি যে, একেবারেই অন্যতর। সেইখানে আমি আমার সাথে। প্রসঙ্গত আরেকটা কথা। নিছক হিসেবের অংকও যদি বিবেচনায় আনা যায়, বিচিত্র থেকে বিচিত্রতার বিষয়ে বই-এর প্রকাশনা তো ক্রমেই বাড়ছে। বিক্রির পরিমাণ, ক্রেতার সংখ্যাও তেমনি বেড়ে চলেছে। এই ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমীতে গেল বই মেলা। একটা হিসেবে জানানো হয়েছে যে, বাইশ দিনের মেলাতে বই বিক্রি হয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকার মতো। এক বাংলা একাডেমী  প্রকাশনাই বাইশ লাখ টাকার। এত এমনি এমনি নয়। অবশ্যই পড়বার জন্য। তা হলে কেন প্রশ্ন, ‘বই পড়ার যুগ কী ফুরিয়ে এলো?’ হলোই বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিস্ময়কর ছড়িয়ে পড়া।

২৩ এপ্রিল ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী, দৈনিক সংবাদ