দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২৫

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মার্চ ১১, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

যেসব পড়া বারণ সেসবের প্রতিই আমার ঝোঁক ছিল বেশি, অনেকটা নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের মতো— বেলাল চৌধুরী

বেলাল চৌধুরী মানেই বই। কথাটি প্রচলিত আছে তার সুহৃদ মহলে। তিনি যত না লেখেন, পড়েন তারচেয়ে অনেক অনেকগুণ বেশি। এবং পড়েন হৃদয়ের তাড়নায়। বই পড়ার ব্যাপারে তিনি এক কথায় সর্বভূক। ঠোঙা থেকে শুরু করে সদ্য প্রকাশিত বিদেশি সাহিত্যের বইটিও তিনি পাওয়ামাত্রই গোগ্রাসে পড়ে ফেলেন। এমনও হতে পারে, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চোখ বুলোতে ভালো লাগলো তো তক্ষণি পড়ায় লেগে গেলেন। আবার উল্টোটাও হতে পারে, অর্থাৎ দু’মাস পড়েই রইল। তাই, স্বাভাবিকভাবে তার সুবিশাল ড্রয়িং রুমের পুরো উত্তর প্রান্তের দেয়াল ঢেকে রয়েছে বইয়ে। শেল্ফের পর শেল্ফে। আর সেই সব শেল্ফ জুড়ে রয়েছে পুরনো-নতুন দেশি সাহিত্যের, বিদেশি সাহিত্যের রকমারি সব বই। সাদামাটা টেবিলটিও ডুবে আছে বইয়ের সমুদ্রে। শুধুই কি বই? পাঁচমিশালির ভিড়ও নেহাৎ কম নয়। বোঝা যায়, এই বইগুলি এখন তার পড়ার আওতাভুক্ত। সামনে মেলে রাখা বইটি নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধ করে পাশে রাখতে রাখতে বললেন, ‘বইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই শৈশব থেকেই। তবে এসবই তো হৃদি রত্নাকরের অথৈ জলে ঝাঁপ দেয়ার মতো।’

হামিদ কায়সার: মনে পড়ে, কোন বই দিয়ে বর্ণ পরিচয় হয়েছিল?
বেলাল চৌধুরী: সেভাবে ঠিক বলা সম্ভব নয়। তবে যদ্দুর মনে পড়ে, রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা দিয়ে ‘অজ অথ আম আর ইট’। মদনমোহন তর্কালংকারের ‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল’র ভিজুয়ালটা এখনো চোখে ভাসে। এরপর ‘নবনীত সুধা’। পাশাপাশি বাসার অদূরে থাকতেন পটিয়ার শ্রী যোগেশচন্দ্র পাঠক, গৃহশিক্ষক। তার স্ত্রী ছিলেন জন্মান্ধ। তার কাছ থেকে কিনা শিখেছি। পড়েছি ‘টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার...”— এর লেখককে মাত্র কয়েক বছর আগে আবিষ্কার করেছি।

হামিদ কায়সার: কে সেই লেখক?
বেলাল চৌধুরী: এরা ছিলেন দুই বোন, অ্যান ও জেন টেইলর। বাবা রেভারেন্ত আইজাক ছাপচিত্রের খোদাইকার এবং লেখক। বড় বোন অ্যানও লিখতেন। একমাত্র ভাই আইজাক লেখালিখি ছাড়াও জনপ্রিয় বিয়রের পিপার ছিপি আবিষ্কার হিসেবেও খ্যাতি কুড়িয়েছিল। ২০ পঙ্‌ক্তির সহজ সরল কবিতাটির প্রথম চার লাইন ছাড়া বাকি ১৬ লাইন খুব কম লোকই জানেন। প্রথম চার লাইন হচ্ছে—

টুইংকল, টুইংকল লিটল স্টার
হাও আই ওয়ান্ডর হোয়াট য়্যু আর!
আপ এবাভ দ্য ওয়ার্লড সো হাই
লাইক আ ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই।

ছোটো বোন জেন টেইলর তার ছোট্ট চিলেকোঠায় বসে তারকাখচিত আকাশ দেখা প্রসঙ্গ বলেছিলেন, ‘রাতের দিকে আমি যেন নক্ষত্র খচিত আকাশে ঘুরে বেড়াতাম’ আর রাতের পরিবর্তিত ঐশ্বর্য চোখ ভরে দেখতে দেখতে ‘নক্ষত্র’ কবিতাটি লিখেছিলেন। যাহোক, শৈশবে আমি সন্দ্বীপে চলে গিয়েছিলাম।

হামিদ কায়সার: কোথা থেকে যেন গেলেন?
বেলাল চৌধুরী: আমার জন্মস্থান সবুজ-শস্য-শ্যামলা গ্রামের বাড়ি শরিশাদি থেকে। সন্দ্বীপের স্মৃতির মধ্যে আছে জাহাজ-সমুদ্র নীল দরিয়া-দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে। দুর্ভিক্ষের কথা আবছা মনে পড়ে। সন্দ্বীপের অনেক স্মৃতি। তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অন্যতম। মাঝে মাঝে নৌকাডুবির খবর মনে আতঙ্ক জাগাত, যুদ্ধের ভয়টা আকালের ভয়টা সেই যে মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, সে ভয় এখনো বর্তমান।

হামিদ কায়সার: তো সেই সময় কি বই পড়ার আগ্রহ ছিল?
বেলাল চৌধুরী: সে তো ভাই চেতনা-উন্মেষের কাল। পড়া মানেই তো ভয়। তবে বই দেখলেই, আমার ঠোকরানো অভ্যাস। এ পর্যায়ে আমার বছর চার সন্দ্বীপে কেটেছে। পরে গেলাম কুমিল্লায়। কুমিল্লা তখন জমজমাট মফস্বল শহর। পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল, লাইব্রেরি ছিল। সেখানে ঢের ঢের বই পাওয়া যেত। আর ছিল অনেক কমলা রঙের রোদ। আর যেসব পড়া বারণ সেসবের প্রতিই আমার ঝোঁক ছিল বেশি। অনেকটা নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের মতো। একদিনের কথা মনে আছে, স্কুল থেকে এসে এক দৌড়ে ঝড়-তুফান মাথায় করে জামতলার পড়ার ঘরে কানুদার কাছে ছুটে গিয়েছিলাম বইয়ের জন্য।

হামিদ কায়সার: কোনো আকর্ষণীয় বইয়ের টানে...।
বেলাল চৌধুরী : সে বয়সে যা ভালো লাগে আর কী। নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কিরীটি’র নেশা তখন। খুব পড়তাম কালো ভ্রমর। তো, সেদিন সেই ঝড় জলের অপরাহ্নে ৩টা বই সংগ্রহ করতে প্রবল বৃষ্টি, ঘরে হ্যারিকেনের ম্লান, হলুদ আলোর ‘হল অ্যান্ড স্টিভেনসের’ ক্রাউন সাইজের ‘জিওমেট্রি’ বইয়ের নিচে রেখে লুকিয়ে পড়েছি কিরীটি। কাঞ্চনজংঘা সিরিজ, দস্যু মোহন সিরিজের বইগুলো খুব পড়েছি। এই সিরিজের বইগুলো লিখতেন হেমেন্দ্রকুমার রায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, শশধর দত্ত, এমনকি বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো লেখকরাও লিখতেন। পঞ্চাশের শেষাশেষি থেকে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় পরে জেনেছি ইনি ছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম সুচিত্রা মিত্রের বাবা; আমাদের কৈশোর থেকে এ ধারাটি আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে থাকল, পড়ার তখন আরেকটি ধারা তৈরি হলো।

হামিদ কায়সার: কী রকম?
বেলাল চৌধুরী: তখন দেখা যেত, অধিকাংশ লাইব্রেরিয়ান এবং শিক্ষকরাই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই আদর্শবাদী। লেখাপড়ার প্রতি তাদের ঝোঁকটা ছিল ভিন্ন রকমের। আমার পঠন-পাঠনের সঙ্গে তাদের অনেকেই গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন বলে, আজও অনেক শিক্ষক, গৃহশিক্ষককে ভুলতে পারি না। এদের মধ্যে কুমিল্লা ইউসুফ স্কুলের হেড মাস্টার সুবর্ণ চৌধুরী, রবিবাবু স্যার, শ্রীকান্ত বাবু স্যার, নবযুগ বাবু স্যার, অঙ্কের স্যার গাট্টাগোট্টা সুধাংশু বাবু, দু-আঙ্গুলে পেটের চামড়া ধরে চিমটি কাটা গোবিন্দ বাবু স্যার, নওয়াব আলি স্যাররা নমস্য।

হামিদ কায়সার: এই সময়ে সাধারণত কী ধরনের বই আপনার বেশি পড়া হয়েছে?
বেলাল চৌধুরী : হাতের কাছে যা পেতাম, তাই পড়তাম। রহস্যকাহিনির কথাতো বলেছিই। তাছাড়া প্রচুর জীবনীও পড়া হয়েছে তখন। ঈসা, মূসা, হজরত মোহাম্মদ (দ.), ওমর, লিংকন, বুদ্ধ, ওমর খৈয়াম পড়েছি। সব ছাপিয়ে অবশ্য ডিটেকটিভের প্রতিই আসক্তিটা ছিল বেশি। এত বেশি যে, সম্ভব অসম্ভব ডিটেকটিভ কাহিনি লেখার চিন্তা মাথায় গিজগিজ করত। আর নোয়াখালীতে ‘এঁড়ে’ বলে একটা শব্দ আছে। যার অর্থ করলে দাঁড়ায়, একরোখা। আমিও তাই হয়ে উঠেছিলাম। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি টানটা স্বভাবতই বেশি থাকে।

হামিদ কায়সার: বিধিনিষেধ ছিল না?
বেলাল চৌধুরী: তাতো ছিলই। সবকিছুই পড়েছি লুকিয়ে, লুকিয়ে-চুরিয়ে আড়ালে-আবডালে।

হামিদ কায়সার: শৈশব-কৈশোরের পর আপনার যৌবনের দিনগুলোর কথা জানতে চাচ্ছি— আবডালের।
বেলাল চৌধুরী: কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম কিশোর বয়সেই। সেই সময়ের ফ্যাশন বলো ঝোঁক বলো ছাত্র যুবকরা কমিউনিস্ট পার্টি করত। আমিও ঝুঁকেছিলাম। সেই সূত্রে ফেনী কলেজের লাইব্রেরিয়ান সিরাজুল ইসলাম সাহেব, ছিলেন প্রগতিপন্থী লোক। শুনেছি গোপনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। এই ফেনী কলেজেই ছোটবেলায় পড়াশুনো করেছিলেন হুমায়ুন কবির সাহেব।

হামিদ কায়সার: কোন হুমায়ূন কবির?
বেলাল চৌধুরী: ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার। পরে ভারতের মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। উনি খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ওর সম্পর্কে একটা মিথ আছে যে, উনি ফেনী কলেজ লাইব্রেরির যত বই আছে সব পড়ে ফেলেছিলেন। এটা কতদূর সত্য কত দূর মিথ্যা বলতে পারব না। হয় না, কিছু কথা ধীরে ধীরে প্রবাদে পরিণত হয়ে যায়। এনি ওয়ে, সিরাজুল ইসলাম সাহেব সাহিত্যের বই-ই হোক, রাজনীতির বই-ই হোক— আমার হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, ‘এটা পড়ে দেখ।’ তা, কলেজে থাকতে থাকতেই কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। বাইরে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের ইলেকশনের কাজে জড়িয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে পার্টির হয়ে কাজ করেছিলাম। তখন একটা জিনিস দেখেছি, পার্টিতে খুব পড়াশুনো ছিল। মার্কসিজমের ক্লাস ছিল এবং অবশ্য পাঠ্য কিছু বই ছিল। যেমন নীহাররঞ্জন সরকারের ‘ছোটদের অর্থনীতি’, ডায়ালেকটিক্যাল মেটারিয়ালিজমের ওপর তাত্ত্বিক বই, রালফ ফক্সের বই ছিল। তারপরে, দর্শনের কিছু বই। এসব অবশ্য পাঠ্য ছিল। কডওয়েল সাহেবের ইলিউশন অ্যান্ড রিয়ালিটি সাহিত্য আলোচনার ওপর—এটাও পড়তে হতো। তখন সাহিত্যে কয়েকটি নাম ছিল যারা আমাদের দেশে জনপ্রিয় হয়েছিল। তাদের বইগুলো এত ভালোভাবে অনূদিত হয়েছিল যে, মনে হতো বাংলা ভাষার মৌলিক বই। যেমন, এরিখ মারিয়া রেমার্ক-এর থ্রি কমরেডস। পরবর্তীকালে এই বইটি আমার কাছ থেকে পড়তে চেয়েছিলেন আমাদের খালাম্মা, শহীদজননী জাহানারা ইমাম। দুর্ভাগ্য এবং দুঃখ শেষাবধি বইটি আমি তাকে পড়াতে পারিনি! কিংবা ধরো, রেমার্ক-এরই অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। যেমন বই তেমনই দুরন্ত অনুবাদ। অসাধারণ প্রিয় ছিল তখন। তারপর লাও চাওয়ের রিক্সাওয়ালা।

হামিদ কায়সার : লাও চাও তো চীনের?
বেলাল চৌধুরী: হ্যাঁ চীনের। সাধারণ খেটে খাওয়া রিক্সাওয়ালাদের জীবন। ছোটো গল্পকার লু সুনও ছিলেন চীনের। আর কিছু বই, তখনকার দিনে সাহিত্য রুচি, সাহিত্যবোধের কারণে খুব জনপ্রিয় ছিল—গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দার বই। এইগুলি পড়েছি, পড়তে হতো। পরে পড়ে দেখেছি, এসব বই এমন কিছু আহামরি নয়। ওহ্, হ্যাঁ, ন্যুট হামসনও পড়েছি। রাজনৈতিক বই ছাড়া এই-সমস্ত বই পড়েছি। অই একটা জীবন গেছে। তারপর জেলখানার জীবনে গিয়ে দেখলাম...

হামিদ কায়সার: জেলখানায় কখন গেলেন?
বেলাল চৌধুরী: হঠাৎ দেশব্যাপী ৯২ ক ধারা জারি হওয়ার পর। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন নতুন নতুন তারকাদের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করেছে, সব সামরিক জাহাবাজরা। প্রথমে ইস্কান্দার মীর্জা, তারপর আয়ুব খাঁ, আজম খান। ঐ সময়েই, সবে স্কুল পাশ করে বেরিয়েছি, কলেজে পড়ছি। তখনই রাজনৈতিক কারণে পাকড়াও হয়ে সোজা জেলে। ফেনী থেকে নোয়াখালী হয়ে কুমিল্লা জেল থেকে ঘুরতে ঘুরতে আমি ঢাকার জেলখানায় এসে একাটা বিরাট জগতের মধ্যে পড়লাম— যেখানে জ্ঞান চক্রবর্তী, ‘সাম্যবাদের ভূমিকা’র লেখক অনিল মুখার্জী, সরদার ফজলুল করিম, ড. জ্ঞান কাঞ্জিলাল, ফণী চক্রবর্তী, কালুসিং, দীনেশ লাহিড়ি, লালবিহারি সাহা, প্রশান্ত পাল, শিবশঙ্কর চক্রবর্তী, অমল সেন, ধনওয়ে দাস রওশন আলি, আরও অনেক অনেক জ্ঞানীগুণীরা রতন সেন, আমার রতনদা, নলিনী দাশের মতো ডাকসাইটে সব প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতাদেরকে একসঙ্গে পেলাম এবং তাদের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য অকৃত্রিম স্নেহ পাওয়ারও সৌভাগ্য হলো। সেখানে আমাদের সঙ্গে বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলও ছিলেন। জেলখানার শিশুর মতন সরল সাদাসিধে এই মানুষটাকে অতি কাছ থেকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। মুখে মুখে গুনগুন করতেন, সর্বক্ষণই গানের পদ বাঁধছেন। সেখানে সন্তোষ গুপ্ত, আমাদের সন্তোষদাকেও পেয়েছিলাম। এই আদর্শবান নিবেদিতজনদের কারণে জেলখানাকে আমার কখনো জেলখানা মনে হয়নি— মনে হয়েছিল স্কুল, কলেজ-এর কোনও হোস্টেলে আছি। এদেরকে দেখেছি জেল জীবনে প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিজের মতো লেখালেখি করছেন— পড়াশুনো করছেন আর সহমর্মিতাবোধ কাকে বলে! সবাই যেন একই সূত্রে বাঁধা।

হামিদ কায়সার: আপনিও নিশ্চয়ই পড়াশোনা করেছেন?
বেলাল চৌধুরী: আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি বলে আমাকে সরদার ভাই, সরদার ফজলুল করিম লজিক পড়াতেন বা উনি পড়ে যাচ্ছেন আমি শুনছি। সরদার ভাই কত বড় পণ্ডিতলোক! সেই বয়সের মূঢ়তার কথা ভেবে এখনো লজ্জায় মরে যাই।

হামিদ কায়সার: উনি কি পলিটিক্যাল বই পড়ে শোনাতেন?
বেলাল চৌধুরী : আরে না না। তা কেন। পাঠ্যবই। আমরা যেহেতু ছাত্র— কাজেই তারা দায়িত্ব নিয়ে আমাদেরকে পড়িয়েছেন। যাতে আমরা ইন্টারমিডিট পাশ করি। আলী আকসাদ, মুস্তফা সরোয়ার এরাও আমার সঙ্গে একত্রে জেলখানা থেকে ইন্টামিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমাকে গ্রামের বাড়িতে অন্তরীণ করা হয়। সাত মাইল দূরবর্তী থানাতে প্রতি সপ্তাহে হাজিরা দিতে হতো। তোমাকে তো আগেই বলেছি বাড়িতে আমার বাবা এবং মা দুজনেই পড়তেন, অর্থাৎ পড়াশুনার চল ছিল বলা যায়। সুতরাং, পড়াশোনা নেশা হয়ে দাঁড়ায়। জেলখানা থেকে বেরিয়েও যেখানেই যা পেতাম, তা গোগ্রাসে গিলতাম। এ সময়েরই একটি ঘটনা, কলকাতার ‘পরিচয়’ পত্রিকা হঠাৎ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তো, ‘পরিচয়’ পত্রিকা কেন বন্ধ হয়েছে? জানা গেল একটি গল্পের কারণে। গল্পটি লিখেছেন সোমনাথ লাহিড়ী। যিনি পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রীও হয়েছিলেন।

হামিদ কায়সার: কী এমন গল্প ছিল, যার কারণে ‘পরিচয়’ পত্রিকাকে নিষিদ্ধ করা হলো?
বেলাল চৌধুরী : ‘কামরু আর জোহরা’ নামের একটি গল্প। সে গল্পের পটভূমি ছিল নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ। যে বিদ্রোহের পটভূমিতে কামরু আর জোহরা’র উপর পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত অত্যাচারের কাহিনি বিধৃত ছিল এবং সর্বোপরি ছিল ইলা মিত্রের চরিত্র। ননী ভৌমিক এ সময় আমাকে বিষমভাবে আকর্ষণ করেছিল। সে সময় তিনিই সম্পাদনা করতেন ‘পরিচয়’। আমি ননী দা’র লেখার এতই মুগ্ধ ছিলাম যে, তখন তাকে দুঃসাহসে ভর করে কাঁচা হাতে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে অবশ্য তার সঙ্গে আমার কলকাতায় দেখা হয়েছে। তো, ননীদার ‘ধানকানা’ গল্পগ্রন্থটি পড়ে তাকে চিঠি লিখেছিলাম। ননী দা’ পোস্ট কার্ডে আমার চিঠির উত্তরও পাঠিয়েছিলেন। এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘আপনারাই একদিন আমাদের উপহার দেবেন এক উজ্জ্বল সাহিত্য।’ অন্যান্য অনেক বইপত্র-র মতো সেই চিঠিটিও হারিয়ে ফেলেছি।

হামিদ কায়সার: তখনো কি রুশ সাহিত্যের বই পড়া হয়নি?
বেলাল চৌধুরী : রুশ সাহিত্যিকদের বই আরো, আরো অনেক আগে থেকেই পড়তে শুরু করেছিলাম। এ ব্যাপারে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রফেসর আসহাবউদ্দিন আহমদ-এর কাছে আমি ঋণী। ’৫২-র পর থেকেই। রুশ সাহিত্যের রেফারেন্স পেয়েছি সবসময়, রুশ সাহিত্যের প্রথম বই পড়ি ম্যাক্সিম গোর্কির। গোর্কিরও আগে পড়েছি শেখভকে। অনেক বড় লেখক। জীবনগভীরে টান দেন। শুধু পড়িনি। অনুবাদও করেছিলাম একবার একটি গল্প, ইংরেজি থেকে। শেখভ, তোলস্তোয় শলোকভ; এরেনবুর্গ... এ পর্যায়ে ফোন এলে, বেলাল চৌধুরী কথা থামিয়ে রিসিভার তুলে নিলেন হাতে। বইয়ের সঙ্গে তার জীবনটা যে কি রকম আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা, তা আরো একবার উজ্জ্বলভাবে বাঙ্ময় হয়ে উঠলো তাঁর টেলিফোন কথোপকথনে। বলছিলে— পড়াশোনা যে কোন্ পর্যায় চলে গেছে! পশ্চিমের সাহিত্য! প্রচুর আজে বাজে আছে সেখানে। হ্যারল্ড রবিন্স আছে, অথচ নেই একজন হেমিংওয়ে। হ্যারল্ড রবিন্স—অপাঠ্য, তৃতীয় শ্রেণির কতগুলো ফরমুলার সম্মিলন। রগরগে যত কথা...

হামিদ কায়সার: তো, বলছিলেন কলেজ জীবনের বই পড়ার কথা...
বেলাল চৌধুরী : তখন যে কেবল বিদেশি সাহিত্য পড়েছি তা না। পাশাপাশি আমাদের দেশের ডিটেকটিভ বইও খুব পড়ছিলাম—হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, শশধর দত্তের দস্যু মোহন সিরিজ, প্রহেলিকা সিরিজ, কাঞ্চনজংঘা সিরিজ— বারো আনা দামের ‘ছায়া কালো কালো’ এসব বই। প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই।

হামিদ কায়সার: এসব সিরিজের বই নাকি বিখ্যাত লেখকগণই লিখেছেন?
বেলাল চৌধুরী: হ্যাঁ, বুদ্ধদেব বসু আর প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিয়েতো এ বিষয়ে একটি চমকপ্রদ ঘটনাই আছে। বুদ্ধদেব বসুর একটি বই ছায়া কালো কালো আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি বইটি কী যেন নামটা... এটা নিয়ে তখন একটা বিতর্ক হয়ে গেল যে, একই গল্প। তারপর, দুজনের মধ্যে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক— কে আগে লিখেছেন কে পরে লিখেছেন, এসব। তখন প্রেমেন্দ্র মিত্র শেষে একটা সুন্দর করে একটা চিঠি দিলেন পত্রিকায়, আসল কথাটা বলেই ফেলি, আমরা দু’জন একই জায়গার ‘অমুক’ বই থেকে নিয়েছি।’ এই যে ধরো, রাজশেখর বসু, উনারও কিন্তু, অরিজিন্যাল লেখার সংখ্যা খুবই কম। ওর ভাষার কারিগরীটা  শিক্ষণীয়। এত সুন্দর ভাষা! কিন্তু, উনি বেশির ভাগ গল্পই নিয়েছেন বিদেশ থেকে। এটা আগে জানতাম না, পরে টের পাচ্ছি। তখন কি করে জানবো? তখন তো আমার বিচার-বিবেচনা বলতে তেমন কিছুই দানা বাধে নি, না ছিল পড়াশুনা বলতে কিছু।

হামিদ কায়সার: কলকাতায় চলে গেলেন কখন?
বেলাল চৌধুরী : জেল থেকে বেরিয়ে নানান কিছু করার চেষ্টা করছি— এমনকি মাছ ধরার জাহাজে পর্যন্ত চাকরি করেছি। তখনই কলকাতায় নোঙর ফেলেছিলাম।

হামিদ কায়সার: ওই সময়ে কী পড়তেন?
বেলাল চৌধুরী : যা পেতাম তাই-ই পড়তাম। আগেই বলেছি বইয়ের ব্যাপারে আমি সব সময়ই উভচর, সর্বভূক ও সম্পূর্ণ বাছবিচারহীন। যখন যে অবস্থায় যা পেয়েছি গোগ্রাসে তাই গলাধঃকরণে মনোনিবেশ করেছি। আমার কাছে কোনো বই-ই অস্পৃশ্য নয়। তা সে ধর্মগ্রন্থই হোক আর সচিত্র রন্ধনপ্রণালীই হোক। শক্ত খোলের পর্নোগ্রাফিক দাঁতে কাটতে আমার যেমন উৎসাহ তেমন কচি নরম তাল শাঁসে ফুড়ুৎ করে টান মারতেও আমার আপত্তি নেই।

হামিদ কায়সার: নির্দিষ্ট করে যদি কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করতেন...
বেলাল চৌধুরী : তৎকালীন সময়ের যেসব লেখা, বিশেষ করে আমেরিকান পেপারব্যাক প্রচুর পড়েছি। যেমন এরস্কিন কল্ডওয়েল, উইলিয়াম ফকনার, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, হাওয়ার্ড ফাস্ট, আপটন সিনক্লেয়ার। খুব পড়েছি এডগার এ্যালান পো, ইওজিন ও নীল, কামু, কাফকা, স্তাঁদাল, অস্কার ওয়াইল্ড, সার্ত্র প্রমুখ। আর বাংলা সাহিত্যে প্রিয় ছিলেন সুবোধ ঘোষ। সুবোধ ঘোষের ‘শতকিয়া’ তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এখন এই বইয়ের নাম কেউ জানে না। তার সুজাতা, কোনো একটি বইয়ের চরিত্র হোমিও হিমুকে কিছুতেই ভুলতে পারি না আজ এতকাল পরেও; পলাশের নেশা, ভারত প্রেমকথা, জতুগৃহ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সমরেশ দা’র লেখাতো ঐ সময় থেকেই পড়ছি সেই বি.টি রোডের ধারে, নয়নপুরের মাটি, শ্রীমতী কাফে, ত্রিধারা গঙ্গা। সমরেশ বসু’র লেখা একটু আলাদা মনে হতো সবসময়। তারপর, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শিলালিপি, উপনিবেশ ইত্যাদি বই তখনকার সময়ে সবাই পড়ত। এইতো, সুলেখা সান্যাল, অমরেন্দ্র...

হামিদ কায়সার : অমরেন্দ্র ঘোষ?
বেলাল চৌধুরী : হ্যাঁ অমরেন্দ্র ঘোষ। ঐ ‘চরকাশেম’-এর লেখক। তো, এদের বই তখন খুব চলত। এখানে একটা খুব মজার কাহিনি বলি। এই সময় আমি একটা বই পড়েছিলাম কাজী বাড়ির পুকুর। বইটার লেখক হচ্ছে নীহাররঞ্জন ঘোষাল। বইটি গ্রামীণ মুসলমান সমাজের পটভূমিকায় লেখা। তখন মুসলমান সমাজে বইয়ের যে অবস্থা দেখেছি তা হলো—বিয়েশাদী উপলক্ষে কয়েকটি বই উপহার দেয়াটা ছিল কমন। এসবের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের আনোয়ারা, ছিল মনোয়ারা, গরীবের মেয়ে, আর মকসুদুল মোমেনীন, নেয়ামুল কোরান—এইসব বই। কাজী বাড়ির পুকুরকে আমি এ রকমই এক বিয়ে বাড়িতে আবিষ্কার করি এবং তখন পড়ে অন্যরকম মনে হয়েছিল। এসময় আরেকটা বই বেরিয়েছিল, দেশভাগের ঠিক পরে পরেই। বোরখা নামের একটা বই। সেটার লেখক ছিলেন জনৈকা নেশাদ বানু। তখন খুব হইচই পড়ে যায় কে এই নেশাদ বানু? এরকম একটা পাওয়ারফুল লেখা, বলিষ্ঠ লেখা। তাও একজন মুসলিম মেয়ে। বহুকাল পরে, কলকাতায় গিয়ে আমি আবিষ্কার করি, এই একই লোক দীপক চৌধুরী নামে পাতালে এক ঋতু বলে এক বই লিখেছেন। কমিউনিস্টদের গোষ্ঠির শ্রাদ্ধ করে। পাতালে এক ঋতুর লেখকই প্রথম জীবনে ছিলেন নীহাররঞ্জন ঘোষাল, ওটা তার আসল নাম। ঢাকায় থাকতেন। লোকটাকে আমার খুব ‘ইন্টারেস্টিং’ মনে হয়েছিল। উনি বিচিত্র ধরনের লেখা লিখতেন, এবং লিখতেন এই ধরনের নাম পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে। আরো কোনো নামে লিখতেন কিনা, কে জানে? নকশাল আন্দোলন নিয়েও লিখেছিলেন পশু ও প্রেমিক। অপাঠ্য এক বই। জীবিকা সূত্রে বইটির প্রকাশনার সঙ্গে আমি যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। সুদর্শন দীপক চৌধুরী মানুষটি ছিলেন দারুণ মজার। স্কচ হুইস্কি আর ক্লাডেন এ সিগারেট ছাড়া খেতেন না। থাকতেন স্ত্রীর চাকরির সুবাদে দার্জিলিং-এ।

হামিদ কায়সার: এবার আপনার প্রিয় লেখক, প্রিয় বই সম্পর্কে বলুন।
বেলাল চৌধুরী : এইভাবে বলাটা খুব মুশকিলের ব্যাপার। এই মুহূর্তে কাকে ছেড়ে কার নাম বলবো! নাম শুরু করতে গেলে তো সেই রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই শুরু করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মানস জগতটা গড়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল মহীরূহ। যেখানেই গেছি রবীন্দ্রনাথের গান, রবীন্দ্রনাথের যে কোনো কবিতা আমাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে আমি চমকে গেছি। এছাড়া ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ— তার লে লুল্লু, তারপরে, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পড়েছি। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি বইতো তখন আমাদেরকে খুব আলোড়িত করেছিল, ছদ্মবেশী। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরোত। উপেন্দ্রনাথ ছিলেন ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক।

হামিদ কায়সার: শরৎচন্দ্রের মামা—
বেলাল চৌধুরী : হ্যাঁ, আসলে পড়াশোনার ব্যাপারটা হচ্ছে কী— এর যেমন শেষ নেই, শুরুও নেই। এ ক্ষেত্রে আমার কোনো বাছ-বিচার কোনোকালেই ছিল না। এরপরে ধরো, আমাকে আকৃষ্ট করেছে জীবনানন্দ দাশ। প্রথম থেকেই। আবার প্রেমেন্দ্র মিত্রও কিছু সময় আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যেহেতু ‘প্রথমা’র প্রেমেন্দ্র মিত্রকে আমি বাড়িতে আমার বাবার সংগ্রহে পেয়েছিলাম। ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’সহ বুদ্ধদেব বসুকেও ঐভাবেই পেয়েছিলাম। যে কারণে আমি এগুলো পড়েছি। সে সময় হাতের কাছে যদি এসব বই না পেতাম, তাহলে হয়ত এগুলোর সাক্ষাৎ পেতে আরো বহু বছর লেগে যেত। মজাটা হচ্ছে, বুদ্ধদেব বসুর শিক্ষায় আমি আবার কতগুলো বই পড়েছি। বুদ্ধদেব বসু যেহেতু আমার প্রিয় লেখকদের একজন, বা ওঁকে আমি প্রথম বয়সেই পেয়ে গেছি, তাই শিক্ষক হিসেবে উনি আমার জন্যে কাজ করেছেন— উনি আমার রুচি গড়ে তুলেছেন। বুদ্ধদেব বসুর লেখায় যখনই যে বইয়ের সন্ধান পেয়েছি, সে বইটি আমি সংগ্রহ করেছি, পড়ে লাভবান হয়েছি। এভাবেই অনেকের লেখা পড়ে উপকৃত হয়েছি। যেমন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, গৌর কিশোর ঘোষ, সন্তোষ কুমার ঘোষ, নবেন্দু ঘোষ, রূপদর্শী....

হামিদ কায়সার: আসলে, আপনি বই পড়ার একটি সামাজিক এবং পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছিলেন।
বেলাল চৌধুরী:  হ্যাঁ, ছোটবেলায় পাড়ার লাইব্রেরি, শহরের মধ্যে দশটা লাইব্রেরি ছিল—এসবের কারণে বিস্তর পড়াশুনোর সুযোগ পেয়েছি। একটা সুন্দর পরিবেশ দেখেছি— যা দেশ বিভাগের পর আস্তে আস্তে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেল। তখনকার ধারাটাই ছিল পড়াশুনোর। আব্বার বইয়ের সংগ্রহ ছিল। আব্বা আম্মা দু’জনেই ছিলেন পড়ুয়া। ওঁদেরকে নামাজের দোয়াতেও রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতা ব্যবহার করে কাঁদতে দেখেছি। তখনকার দিনে প্রগতিশীল যাঁরা যাদের লেখার ভঙ্গি-মানসিকতা ছিল যেমন মুক্ত, উদার তেমনই অগ্রসর, যার ফলে তাদের প্রায় সব লেখাই ভালো লেগেছে। যেমন মানিক বন্দ্যেপাধ্যায়ের লেখা। প্রথম পাঠ থেকেই মুগ্ধ। একসময় প্রবোধ সান্যাল পড়েছি। প্রবোধ সান্যালও কিছু কিছু ভালো লেগেছিল। এখন যদি বাছাই করে নাম বলতে হয়, তাহলে আমাকে বলতে হবেজ্জতিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর এবং মানিক। তারাশঙ্করকে আমি অসম্ভব শক্তিশালী লেখক বলে মনে করি। তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তিনজনই অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক। এঁদের পাশাপাশি আলাদা আরেকটা জগত পেয়ে গেলাম, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’- এ।

হামিদ কায়সার: সতীনাথ ভাদুড়ীর।
বেলাল চৌধুরী : সতীনাথ ভাদুড়ী ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ ‘জাগরী’— ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ কমলকুমার মজুমদারের, আমি প্রথম ঢাকা নিউমার্কেট থেকে কিনে পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। অত্যাশ্চর্য এক ভাষা রীতি কাহিনির ধ্রুপদী বুনট। কলকাতা গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ এবং সান্নিধ্য লাভ আমার জন্য এক পরম সৌভাগ্য। ওঁর সঙ্গে আমার সৌহার্দ্যময় প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। এমন ‘খর’ ব্যক্তিত্বের মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তাঁর ‘সুহাসিনীর পমেটম’-এর লেখা আর ছাপার সঙ্গে বিস্ময়করভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সে আর এক কাহিনি। কৃত্তিবাসে ছাপা হয়েছিল। এখন আর সে রকম নেই।

হামিদ কায়সার: বলছেন, এখন আর সেরকম নেই?
বেলাল চৌধুরী: এখন আর সেরকম মাপের লেখক কই। এখন আছেন হয়ত দু’একজন, বন্ধুবান্ধবরা আছেন যাদের চিনি। তারা কী লিখছেন অন্তত তা দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু, আগের মতো সেরকম টানে না।

হামিদ কায়সার: টানে না বলতে কী বোঝাতে চাইছেন?
বেলাল চৌধুরী: এর মধ্যেও দু’একজন আছেন, যেমন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা পেলেই আমি পড়তে চেষ্টা করি। নিজের জীবন ছাড়া যিনি কিছু লেখেনও না।

হামিদ কায়সার: মানে, তাঁর জীবনে অভিজ্ঞতা।
বেলাল চৌধুরী: নিজের জীবন-টীবন নিয়ে, ইতিহাস-টিতিহাস নিয়ে সে অনেক বিস্তৃত ব্যাপার থাকে। আমার মনে হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে বড় লেখক হওয়ার জন্যে যতগুলো চারিত্র্যলক্ষণ থাকা প্রয়োজন তার সবই আছে। কিন্তু, কথা হচ্ছে যে, বিষয় বৈচিত্র্যে, আঙ্গিকে আমাদের দেশে একজন লেখক কতদূর যেতে পারে। সেই হিসেবে, আমার কাছে মনে হয়েছে ওখানে প্রচুর বইয়ের উনি প্রশংসা করেছেন তাঁর কলামে। নিজের খুব কম বইয়েরই আছে। উনি আসলে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন সে কলামে। আমারও মনে হয়েছে, একজন পাঠক বুঝতে পারেন যে, কি আমি লিখছি সেটা আমি বুঝতে পারি কিনা পাঠক বুঝতে পারে কিনা। তখনই ট্র্যাকটা আমূল বদলে ফেললেন— লিখলেন ‘সেই সময়’। ধরলেন একটা বিরাট পটভূমি। ‘সেই সময়ে’র চরিত্রটা মানে... নবীনচন্দ্র...না...ঐ যে তোমার ...হুতোম প্যাঁচার নকশা কার লেখা যেন...

হামিদ কায়সার: কালীপ্রসন্ন...
বেলাল চৌধুরী: কালীপ্রসন্ন সিংহ। কালীপ্রসন্ন মডেল টডেল নিয়ে ঐসব নিজে উনি লিখলেন—ওর ভাষাটা যেহেতু অসাধারণ, তুমি হয়ত বলতে পারো, ভাষা কি একটি উপন্যাসের জন্যে বড় কথা— চরিত্র চিত্রণ, বর্ণনা, কাহিনির বিন্যাস আঙ্গিক এগুলি সবই আসে— সুনীল অসম্ভব সুন্দর করে লিখতে পারেন। ওঁর গদ্য পাঠককে তর তর করে টেনে নিয়ে যায়। অসাধারণ কথকতা, সমসাময়িকাল নিয়ে, বেশি দূর-ও নয় অতীতও নয়, কিছু ঘটনাকে চরিত্রকে বিধৃত করে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন। ‘পূর্ব পশ্চিম’-এও তাঁর এই শক্তির-ধারাবাহিক সাফল্য বিস্তৃত হয়েছে। সে সাফল্যের শেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে— সাম্প্রতিক প্রথম আলো উপন্যাসেও। আর পড়ি মহাশ্বেতা দেবী, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, শৈবাল মিত্র, জয় গোস্বামী, জয়দেব বসু, জ্যোতির্ময় দত্ত প্রমুখের অপ্রতিরোধ্য গদ্যপদ্য। পূর্ণেন্দু পত্রী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখালিখি যে অবশ্য পড়তে হত তা বোধ হয় না বললেও চলে। মতি নন্দী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজও।

হামিদ কায়সার: বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে ভালো লাগে কার লেখা?
বেলাল চৌধুরী: সৈয়দ শামসুল হক, রশীদ করীম, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ ছফা, শওকত আলী, রাহাত খান, ইমদাদুল হক মিলন, হাসনাত আবদুল হাই, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন এবং আখতারুজ্জামন ইলিয়াসের লেখার আমি নিবিষ্ট পাঠক। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের লেখক। কেবল বাংলা ভাষায় লেখেন বলে বিশ্বসাহিত্যে তাদের তেমন পরিচিতি নেই।

হামিদ কায়সার: আপনার সংগ্রহে বিশ্ব সাহিত্যের একেবারে সাম্প্রতিক বইয়েরও সমাহার ঘটেছে— এসব বই আপনি কীভাবে এবং কোথা থেকে পান?
বেলাল চৌধুরী: বই ভালোবাসি বলে যারা আমাকে ভালোবাসেন, তারা যে যেখানেই থাকেন না কেন, ভালো বই হলে সুযোগ পেলে সেগুলো তারা আমাকে পাঠান। স্নেহভাজন সৈয়দ শহীদ আছে আমেরিকায়, হাসান ফেরদৌস আছে আমেরিকায়, ওখান থেকেই ওরা আমার জন্যে বই পাঠায়, সুমন রহমান থাকে জাপানে— সে পাঠায়। ভাইপো শ্রীমান রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী আছে লন্ডনে, সেও পাঠায়। তারপর, জীবনানন্দ গবেষক ক্লিন্টন বুথ সিলি থাকেন মার্কিন মুল্লুকে। ওঁর আমার পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়। একসময় ও পিস কোরের সদস্য হয়ে কাজ করেছিল বরিশালে। তখন আমি অবশ্য কলকাতায়। ওঁর সঙ্গে আমার বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে দেখা। সেই সময়ে আমার চিঠিপত্র নিয়ে সে বাংলাদেশে এসেছিল। আমার দেশের বাড়িতে গিয়েছিল। ক্লিন্টন-এর সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতা। সে আমাকে মাঝে মাঝেই বই পাঠায়। আমাকে পাঠানো বইগুলোর ওপর ক্লিন্ট পরিষ্কার ঝরঝরে বাংলায় লিখে দেয় ‘এই বইগুলো বেলাল চৌধুরীর জন্য পাঠানো, কেউ যদি চুরি করে নিজের লাভের উদ্দেশ্যে বেচে দেয়, সে লোকটা এবং তার চৌদ্দ পুরুষ সুদ্ধ চুলোয় (দোজখ) যাক।’ আরও পাঠান শ্রীমতী রুথ ব্রাইন, প্যারির মিরিয়াম ও ব্লয়। মুম্বাইতে থাকে বন্ধু গুলান; বেরুনো মাত্রই ও পাঠিয়েছিল অরুন্ধতী রায়ের গড অব স্মল থিঙ্কস। এমনকি আমাদের সকলেরই স্নেহাস্পদ আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে একটি বই পাঠিয়েছিল আমার জন্য।

হামিদ কায়সার: বই নিশ্চয় মার-টারও গিয়েছে।
বেলাল চৌধুরী: মার-এর কী আর শেষ আছে রে ভাই। বইয়ের শত্রু যদি হয় কীট— যা বই থেকেই জন্মায়, গ্রন্থকীট বলে একধরনের কীট আছে। কিন্তু এর চেয়ে মারাত্মক হলো, কীভাবে বলবো, আমার নিজের হাতকেও হয়ত বিশ্বাস নেই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যাঁকে ‘ভাষাচার্য’ বলেছিলেন সেই ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, “বাঙালির স্বভাব জানো তো, ঘটনাচক্রে তোমার ঘরে একগাদা বই দেখলেই বলবে, আরে, এইটেইতো আমি খুঁজছিলাম।” সুনীতিকুমারের কাছে কেউ গেলে তিনি বিদায়ের সময় ‘আবার এসো’ বলে সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে ঝাড়াই করে নিতেন। কারণ, উনি আমাকে বলেছেন, ও সি টা আমার বহু বই গাইব করে দিয়েছে। ও সি গাঙ্গুলি তৎসময়ে একজন নামকরা চিত্রকর ও চিত্র সমালোচক ছিলেন। আমার কথা হলো যে, যে বইটি আমি নিজে পড়ে আনন্দ পাই, তা অন্যকেও পড়াতে আগ্রহী। এবং এই বইটা আমি কাকে দিতে পারি...কোনো লেখক, কবি অথবা আমার কোনো আগ্রহী পরিচিত জন বইটা পড়ুক তা আমি আন্তরিকভাবে চাই। কিন্তু, অনেকেই আছেন বই নিয়ে যান ঠিকই, কিন্তু নিজেও পড়েন না আবার ফেরতও দেন না। এভাবে আরেকজনের বই পড়ার সুযোগকেও নষ্ট করে দিল। এই ধরনের লোক আমাদের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রচুর আছে। সেজন্যেই প্রবাদটা খুব খাঁটি মনে হয় ‘বই আর বউ কাউকে ধার দিতে নেই।’ যারা বই আত্মসাৎ করে, তারা কখনওই প্রকৃত বন্ধু নয়। বন্ধুতা জিনিসটা এতো সহজ নয়। বন্ধুতা জিনিসটা যে কি তা বোঝা যায় মার্সেল প্রুস্ত পড়লে। মার্সেল প্রুস্ত-এর পিঙ্গস অভ রিমেমবারেন্স পাস্ট তেরো খণ্ডের এই বইটি যদি তুমি পড়ো, তাহলে বুঝতে পারবে, বিপুল এই জগৎটাকে তিনি কীভাবে আত্মস্থ করে আবার কেউ হয়ত ঘরে বসেই, উপলব্ধির মাধ্যমে বইয়ের মাধ্যমে পড়াশুনোর ভেতর দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ কিছুকে শুষে নিতে পারে। এই ইন্দ্রিয়ানুভূতির কোনও তুলনা আছে?

হামিদ কায়সার: বই আমাদেরকে অনেক কিছু শেখায়, অনেক অজানা জগৎ খুলে দেয়।
বেলাল চৌধুরী: বাউলদের একটা গান আছে। গানটিকে আমি খুব মূল্যবান মনে করি। ‘আমার অঠিক গুরু, বেঠিক গুরু, গুরু অগণন’। এটার আবার দুটো বানান পদ্ধতি আছে— আরেকটি থ দিয়ে লেখে ‘আমার অথিক গুরু, বেথিক গুরু, গুরু অগণন’। যাই হোক, মূল জিনিসটাতো বুঝতে পারছো। এটা কিন্তু সমরেশদা গঙ্গা উপন্যাসের শুরুতে লিখেছিলেন। আমি বাউলদের কণ্ঠে গানও শুনেছি। আমি মনে করি প্রত্যেকটি জিনিস থেকেই প্রত্যেক মানুষের কাছ থেকেই শিক্ষণীয় কিছু থাকে। আবার সবসময়ে তুমি জ্ঞানের জন্যে শুধু পড়ছো, তোমার অমরত্ব পেয়ে যাবে এটাও আমি আবার মানতে পারি না।

হামিদ কায়সার: আচ্ছা বেলাল ভাই, কবিতার প্রতি আপনার আকর্ষণটা কীভাবে জন্মালো?
বেলাল চৌধুরী: কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি আমার আম্মাকে দেখে। উনি ছিলেন সবার ছোট মেয়ে। ওরা ছিলেন চার বোন। অতি শৈশবেই তিনি তার বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন। এবং মানুষ হয়েছিলেন মামা বাড়িতে। অশীতিপর নানীর কাছে। মামারা অসম্ভব আদর যত্ন করতেন। তো, আমার আম্মার পড়াশোনা ছিল অবাক করার মতো, আশ্চর্য হওয়ার মতো। অসম্ভব ছিল তার স্মৃতিশক্তি, আম্মা ভারতচন্দ্র থেকে নবীনচন্দ্র সেন তৎকালীন অন্যান্য কবি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— চিন্তা করতে পারবে না যে, কীভাবে মুখস্থ বলতে পারতেন। অবিশ্বাস্য!

হামিদ কায়সার: ঐ সময়ের একজন মহিলা, কম কথা নয়— লেখাপড়া...
বেলাল চৌধুরী: কত আর, বড় জোর ক্লাস থ্রি-ফোর পর্যন্ত পড়েছেন। বাড়িতে বই ছিল, বইয়ের বড় সংগ্রহ ছিল। আমার বড় নানা বই-টই পড়তেন। অসম্ভব ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। বাড়িতে লাইব্রেরির মতো করেছিলেন। আমার মামা, খালারাও নির্বিচারে বই পত্রপত্রিকা পড়তেন দেখেছি। আমার এক খালা ছিলেন, মুখে মুখে একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছিলেন—

হামিদ কায়সার: মুখে মুখে উপন্যাস?
বেলাল চৌধুরী: বিশাল উপন্যাস। দুর্ভাগ্য যে, এটা কেউ লিখে রাখেনি। খালাম্মা বসলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গল্প করতেন। ওনাকে ঘিরে সবাই বসে থাকতেন। ওনারও তিন মেয়ে, এক ছেলে— বদরুল ভাই। বদরুল হুদা চৌধুরী তার ছোটোবেলা কেটেছিল সিরাজগঞ্জে, খালুর চাকরির সুবাদে। বদরুল ভাই ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কবিতাও লিখতেন এক আধটু। এককালে আজাদ-এ সম্পাদনা বিভাগে কাজ করেছেন। নিজের গ্রাম পরাগলপুরের অদূরবর্তী সোনাপাহাড়ে এক ‘কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ’ দেখে মজেছিলেন বদরুল ভাই। শেষমেশ মধুরেণ সমাপায়েৎ। সে বিয়েতে বেরিয়েছিল একটি বিয়ের পদ্য জাতীয় বই হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায়। আমাদের সে ভাবি এবং বদরুল ভাই এখন থাকেন চট্টগ্রামে পাথরঘাটায়।

হামিদ কায়সার: হাসান হাফিজুর রহমান! জাত সম্পাদক তো!
বেলাল চৌধুরী ; শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে দাউদ খান মজলিশসহ তৎকালীন ঢাকার সাহিত্যজগতের প্রায় সবারই এক আধ লাইনের কাব্যপঙ্‌ক্তি কিংবা টুকরো গদ্য ছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট বেস্ট কবিতা ছিল নুরুদ্দিন ভাইয়েরজ্জ

হামিদ কায়সার: সৈয়দ নুরুদ্দিন!
বেলাল চৌধুরী : হ্যাঁ, সৈয়দ নুরুদ্দিনজ্— দুর্ভাগ্য আমার কবিতাংশটি মনে নেই আর।

হামিদ কায়সার: সংবাদ-এর?
বেলাল চৌধুরী: হ্যাঁ, সেই বইটা থাকলে একটা মজার বই দেখা যেত—

হামিদ কায়সার: একটা ডকুমেন্টও তো...
বেলাল চৌধুরী: ছোট্ট একটা বই, চটি। দাউদ খান মজলিশের পঙ্‌ক্তিটি খুব ভালো লেগেছিল— ‘বন্দরের আরেকটি নৌকা ছাড়া পেল।’ না, সেটা ছিল বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের, দাউদ খান মজলিশ লিখেছিলেন, ‘সাংবাদিক যিনি বিয়ে করেন তিনি সাহসী আর সাংবাদিকেকে যিনি বিয়ে করেন তিনি দুঃসাহসী’। রওশন ইয়াজদানীর কবিতা ছিল, ‘খায় নি যারা তারাই ভাবে/ না জানি কী মজা/ অরণা হাতী পড়ুক খাদে/ দেখবো কেমন মজা।’ বলা বাহুল্য শামসুর রাহমানের সমসাময়িক অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিরই কিছু না কিছু ছিল বইটিতে। তবে ওদের অনেকেই আবার এখন পরলোকগত। এই গেল, আমার সিরাজগঞ্জের খালার কাহিনি, আমি আমার আম্মার কথায় ফিরে আসি।

হামিদ কায়সার:  হ্যাঁ, আপনার আম্মার কথা বলুন, তার বই পড়ার কাহিনি।
বেলাল চৌধুরী : আম্মা বঙ্কিমচন্দ্রের বইও পড়েছিলেন। তবে মুসলমানদের প্রতি বঙ্কিমের বঙ্কিম মনোভাব পছন্দ করতেন না। তৎকালীন সময়ের হেন বই নেই তিনি পড়েন নি। সব বই-ই পড়েছেন! শুধু পড়তেনই না, আম্মা বেশ কিছু কবিতাও লিখেছেন। হাতে যা লিখেছেন তা অধিকাংশ হারিয়ে গেছে। ওঁর মুখ থেকে শুনে আমার ভাই জিয়াউদ্দিন যেসব কবিতা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। সেটা দিয়ে একটা বইও হয়েছে। আম্মার শেষ দিককার বেশির ভাগ কবিতাই কিন্তু আমাকে নিয়ে।

হামিদ কায়সার: আপনাকে নিয়ে?
বেলাল চৌধুরী: লিখেছেন, ঐ যখন আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যেতাম। এক নাগাড়ে চোদ্দ বছর উনি আমাকে দেখেনই নি। সেই সময় কান্নাকাটি করতেন চিরন্তন মাতৃহৃদয়! যার ফলে হয়েছে কি খানিকটা ধর্মবোধ, খানিকটা এটা সেটা..সবকিছু মিলিয়ে কাইয়ুম ভাই বইটির একটি অনিন্দ্যসুন্দর প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন, উনি কিন্তু আমাদের ঘনিষ্ট আত্মীয়। আম্মা তাকে খুব স্নেহ করতেন।

হামিদ কায়সার: আত্মীয়?
বেলাল চৌধুরী: একই গ্রামে আমাদের বাড়ি। বইটির নাম হচ্ছে চিরসুমধুর। তো, আম্মার বই পড়াটাও আমকে বই পড়ায় অনুপ্রাণিত করেছে। এসব থাক এবার। বড্ড বেশি নিজেদের কথা হয়ে যাচ্ছে। বইপড়া নিয়ে অবশ্য আমি অল্প বিস্তর কিছু লেখা লিখেছি। যেমন একবার, মুসোলিনির বন্ধু দান্নুৎসিওর কবিতা নিয়ে লিখেছিলাম। দান্নুৎসিও হচ্ছেন সেই লোক, যে কিনা জ্যান্ত হাঁসের পাখা থেকে পালক ছাড়িয়ে সেটাকে দিয়ে কলম বানিয়ে মানুষের রক্তে চুবিয়ে তারপর লিখতেন।

হামিদ কায়সার: মানুষের রক্ত, বলেন কি?
বেলাল চৌধুরী: হয়ত নিজেরই আঙুল চিরে রক্ত নিয়ে নিল।

হামিদ কায়সার: মুসোলিনির একেবারে যোগ্য বন্ধু!
বেলাল চৌধুরী : অদ্ভুত ধরনের লোক ছিল। দান্নুৎসিওর লেখা থেকেও তার যা পরিচয় পাওয়া যায়, তা হলো, পৃথিবীর শান্তিপূর্ণ সুসময় ওঁর কাছে ‘স্টিংকিং’ মানে দুর্গন্ধময়, রণরক্ত, উন্মাদনা, যুদ্ধোন্মত্ততা, হিংস্রতা, উগ্রতা, হত্যা, নিষ্ঠুরতা এইসব— এইসবই তাঁর ভালো লাগাতো। বই সংক্রান্ত এসব টুকরো-টাকরা লেখা নিয়ে ‘কাগজ-কলমে’ নামে আমার একটি আর্ট ফর্মার পা-ুলিপি হারিয়ে ফেলেছেন পল্লব পাবলিশার্স। এ ব্যাপারে বহু চেষ্টা করেও স্বত্বাধিকারী গোলাম আলির কাছে কোনো সদুত্তর পাইনি। তার দেখা পাওয়াটাই ভাগ্যের ব্যাপার। ব্যাপারটা আমাকে কাছে দিনে দুপুরে রাহাজানির সামিল। কাফকার আঁকা একটি দুর্লভ স্কেচ দিয়ে বইটির একটি দুর্দান্ত প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন তরুণ শিল্পী ইউসুফ হাসান। বলা বাহুল্য সেটিও হারিয়ে গিয়েছে।

হামিদ কায়সার: ব্যাপারটা খুব দুঃখের। তা সম্প্রতি কী বই পড়লেন?
বেলাল চৌধুরী: তো এখানে সর্বগ্রে আরেকটি কথা বলে নেয়া ভালো। আমার পড়াশুনোর মধ্যে কবিতা এবং নাটকের কথা আর আলাদা করে বলছি না। কবিতার আমি একনিষ্ঠ পাঠক। বিশ্বে তো বটেই এমন কি আমাদের দেশের তরুণতমদের কবিতাও নিয়মিতভাবে আমি অন্তত চোখ বুলোই। প্রতিদিনই আমি অন্তত একবার জীবনানন্দ অবগাহন করি। কী বই পড়লাম, তা বললে তুমি তা লিখবে তো?

হামিদ কায়সার: লিখবো না মানে! কী বলছেন? কেন লিখবো না।
বেলাল চৌধুরী: সম্প্রতি একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম তো, সেইজন্যেই দ্বিধা।

হামিদ কায়সার: বই বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন? বিষয়টা কেমন ধন্ধ লাগছে।
বেলাল চৌধুরী : তাহলে, বলি শোন। টেলিভিশনে ‘বইপত্র’ বলে একটা অনুষ্ঠান হয়, জানো তো?

হামিদ কায়সার: হ্যাঁ, জানি।
বেলাল চৌধুরী : অনুজপ্রতিম কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল-এর অনেক অনুরোধে সে অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হয়েছিল কী লিখছি কী পড়ছি তা বলার জন্যে। তো, নিজের লেখালেখি নিয়ে বলা শেষ হলে আমার উল্লেখ করার কথা ছিল সম্প্রতি আমি যে তিনটি বই পড়েছি সেগুলি নিয়ে। প্রথমে যে বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি, সে বইটার নাম হোটেল মহেঞ্জোদারো। ৭১ তলা একটা হোটেল। স্থান করাচি, পাকিস্তান। সেখানে দেখানো হচ্ছে, বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থনীতিতে, পাকিস্তানের বিস্ময়কর অগ্রগতি। তখন হঠাৎ একদিন শোনা গেল, একটি লোক চাঁদে পৌঁছে গেছে এবং সে একজন পাকিস্তানি। তো চতুর্দিকে একটা আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। গোটা পাকিস্তান জুড়ে আমোদ আহলাদের ঢেউ ভেসে গেল। এ ধরনের একটি ঘটনায় প্রমাণিত হলো যে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পাকিস্তান কত উন্নত। তো, চাঁদে যাওয়ার পরে, সেই চন্দ্রবিজয়ীকে তারা কীভাবে অভ্যর্থনা জানাবে এবং বিজয়ী-বীরের এই সাফল্যকে তারা কীভাবে উদ্যাপন করবে। এ নিয়ে চলতে লাগলো জোর প্রস্তুতি। কিন্তু বিধি বাম! হঠাৎ এক মোল্লা সাহেব বলে উঠলেন, ‘আরে এটাতো আল্লার কিতাবে নাই, মানুষ কী করে চাঁদে যায়? এটাতো হতে পারে না। এটাতো বেশরিয়তি আল্লা লানৎ নজদিগ’। এও বলা হলো যে, এটা বেদাতি কাজ, এটা হতে পারে না। সবাই একটু চমকে গেল। যে আনন্দের বন্যাটা বইছিল তা ক্রমে স্তিমিত হয়ে এল। এদিকে মোল্লারা পলিটিশিয়ানদের গালাগাল দিতে শুরু করে বললো যে, পলিটিশিয়ানরা ধর্মের সুরক্ষা দিতে পারছে না। সুতরাং, এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী রাজনৈতিক দল। এইসব নিয়ে মহা হৈ হল্লা। রাজনৈতিক দলগুলিও থমকে গিয়ে মোল্লাদের সঙ্গে তাল মেলালো। তখন মোল্লারা ফতোয়া দিতে শুরু করল। প্রথম ফতোয়া, ‘ইংরেজি নাছারা ভাষা, এটাকে নিষিদ্ধ করতে হবে।’ করল নিষিদ্ধ। দ্বিতীয় ফতোয়া, ‘জুমা মসজিদের উচ্চতার উপরে নতুন কোনো বিল্ডিং নির্মাণ হতে পারবে না’, এটারও সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হলো। বোম্বিং-এ ঐ ৭১ তলা হোটেল মহেঞ্জোদারো উড়ে গেল। উড়ে টুড়ে যাবার পরেখুব সুন্দর এই জায়গার বর্ণনাটাসে জায়গাটা হচ্ছে, বিদেশ থেকে প্রচুর ট্যুরিস্ট এসেছে পাকিস্তানে। তারা এই ভগ্নস্তূপ যখন দেখছে, তখন গাইডরা তাদেরকে বলছে ‘এক সময় এখানে ৭১ তলা একটা হোটেল ছিল। এই হয়েছে, সেই হয়েছে’ তারপর আবার এক গাইড ৩ জনৈক ট্যুরিস্টকে একটু আড়ালে নিয়ে বলছে, ‘আসলে এখানে কোনোদিন কোনো হোটেলই ছিল না, পাকিস্তানে ৭১ তলা হোটেল কখনোই হবে না’। আসলে এটাও প্রতীকী একটা ব্যাপার। পাকিস্তানের চিত্র। ফান্ডামেন্টালিজমের উপরে এরকম উঁচু মানের স্যাটায়ার আমি আর কখনও পড়িনি।

হামিদ কায়সার: চমৎকার লেখা তো বইটি?
বেলাল চৌধুরী: শোনোই না। এরপরের চমকটা ছিল এরকম। বইটির লেখক হচ্ছেন একজন পাকিস্তানি। পাকিস্তানে বসেই বইটি তিনি লিখেছিলেন। নাম গোলাম আব্বাস। আরও মজা হচ্ছে, এই লোকটা আজ থেকে বারো বছর আগে মারা গেছেন। দ্বিতীয় চমক হচ্ছে, চাঁদে মানুষ যাওয়ার অর্থাৎ চন্দ্র-বিজয়ের অন্তত দু’বছর আগে গোলাম আব্বাস এ বইটি লিখেছিলেন।

হামিদ কায়সার: আশ্চর্য!
বেলাল চৌধুরী: চিন্তা করো। ভাগ্যিস এই বইটি সম্পর্কে আমি কিছু বলার সুযোগই পাইনি সময়াভাবে।

হামিদ কায়সার: বইটা কি এতদিন অনাবিষ্কৃত ছিল— হোটেল মহেঞ্জোদারো?
বেলাল চৌধুরী: না না, বইটা অনেক আগেই বেরিয়েছে। আমি বলছি ওঁর লেখার সময়ের কথা। পাকিস্তানি লেখক। এটাতো সাফিসিয়েন্ট। তবে পড়ে শেষ করতে না করতে স্নেহাস্পদ স্বদেশ রায় তার ৭৪ পৃষ্ঠার কৃশকায় মাছিমপুরের চৌরাস্তা বইটি উপহার দিলেন। হাতে তেমন কোনও কাজ না থাকাতে প্রায় এক বসাতেই রুদ্ধশ্বাসে বইটি পড়া শেষ হয়ে গেল। উপন্যাস না বলে বড় গল্প বলাই শ্রেয়। তবে বেশ ক’টি চরিত্রের আনাগোনা। বলার ভঙ্গিটি বেশ তির্যক আর চোখা। সেই লোভী ধর্মব্যবসায়ীদের নানান ফন্দি-ফিকির। ধর্মান্ধদের কারসাজি। মাছিমপুরের চৌরাস্তার প্রশংসা করায় সে আমাকে আহমদ ছফার একটি বই এনে পড়তে দিল একজন আলি কেনানের উত্থানপতন। অসাধারণ বই। খুবই ভালো একটি লেখা আহমদ ছফা-র। বানানো মনে হলেও তাঁর ‘ওংকার’ আমার ভালো লেগেছিল। আর যদ্যপি আমার গুরু তো একটি তুলনাহীন কাজ। অবশ্য সেটি সম্পর্কে খুব সামান্য হলেও বলা সম্ভব হয়েছিল। ধর্ম ব্যবসায়ী আর ধর্মান্ধদের নিয়ে দু’চার কথা বলেছিলাম তাও আলটপকা ‘বইপত্র’র রেকর্ডিং-এ সবকিছু কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছেন বিচক্ষণ প্রযোজক মহোদয়া।

হামিদ কায়সার: কেন?
বেলাল চৌধুরী: ধর্ম নিয়ে কোনও কথা নাকি টিভিতে বলা যাবে না। আচ্ছা, তুমিই বলো, এসব কি ধর্ম বিরোধী কথা?

হামিদ কায়সার: হায় সেলুকাস!
বেলাল চৌধুরী: রবীন্দ্রনাথ দিয়েই বলি ‘সুধা দিয়ে মাতান মাতি। ধন্য হরি! ধন্য হরি।’
 
হামিদ কায়সার: ঢাকার কারুর তেমন উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের কথা আপনার জানা আছে কি?
বেলাল চৌধুরী: ঢাকার লেখকদের অনেকেরই কমবেশি বেশ ভালো বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। এরা পড়াশুনোও করেন বিস্তর। যেমন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ। এদের মধ্যে আবার সর্বজন পরিচিত এমন দু’জন কবি আছেন যাদের সংগ্রহ দেখলে বারংবার জিভ কাটার অবকাশ থেকে যায় এবং তাদের সংগ্রহ যক্ষের ধন হিসেবেই সংরক্ষিত আছে। আমার দেখা ভালো সংগ্রহের মধ্যে সুসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই’র সংগ্রহটি যেমন সমৃদ্ধ তেমনই লোভনীয়। আর একজন সাহিত্যপ্রেমী যিনি বিখ্যাত দেলদুয়ার পরিবারের মান্যবর ফরহাত গজনবী যার সংগ্রহটি অন্তত আমার বিবেচনায় আধুনিক সাহিত্যের এক দুর্লভ খনি। বিশেষ করে কবিতার বইয়ের এমন সংগ্রহ দেখলেও জীবন ধন্য হয়ে যায়। ঘরের গৃহিনী শ্রমতী রুবি গজনবীও সুরুচিসম্পন্না লেখক এবং সমাজকর্মী হিসেবে সুখ্যাত। ওরা বই ধার দেন কিনা জানা নেই।
এবার বই প্রসঙ্গে মহামতি আনাতোল ফ্রাঁসের কথা দিয়ে পরিসমাপ্তি টানা যাক।‘ কখনও বই ধার দেবে না। কেন না, বই কেউ ফেরৎ দেন না : আমার লাইব্রেরিতে যৎসামান্য যে বইগুলো আছে সেগুলো অন্যদের কাছ থেকে আমার ধার করা।’

১২ ও ১৯ নভেম্বর ১৯৯৮, সংবাদ সাময়িকী