দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২৭

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : মার্চ ২৫, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

বাঙালি ছেলে বাঙালি মেয়ে কেন বাংলা বলতে পারবে না এবং কেন খুব গর্বের সঙ্গে বলবে না যে, আমি বাঙালি— ইকবাল আহমেদ

আজকের প্রজন্মের অনেকেই ইকবাল আহমেদের নামটুকুও জানে না, এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের সংস্কৃতিজীবী তরুণও। সম্প্রতি প্রবাসী ইকবাল আহমেদ এসেছিলেন ঢাকায়। সুদূর বিদেশে থেকেও তিনি যে কিভাবে বাংলা সংস্কৃতিকে নিজের ভেতর বাঁচিয়ে রেখেছেন, তা তার কাছে যারা গিয়েছেন কিংবা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দু’ঘণ্টাব্যাপী তার রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান দেখেছেন, তারাই তা অনুভব করতে পারবেন। স্বার্থপর সংস্কৃতিজীবীরা ইকবাল আহমেদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন: তার দুটি মেয়ে শৈশব থেকে বিদেশে থাকার কারণে ইংরেজি, হিস্পানি এবং ফ্রেঞ্চ ভাষায় পরম ব্যুৎপত্তি অর্জনের পরও বাংলা ভাষাকেই আত্মার ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ওরা দুজন, তৃণা আর শালিনী, শুধু ভালো বাংলায় কথাই বলতে পারেন না, দুজনই রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ শিল্পী। বিদেশভুঁইয়ে থেকেও বাংলা ভাষা, বাংলা গানকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বে মর্যাদার আসনে। যারা শুধু মুক্তিযুদ্ধের জন্য মায়াকান্না কাঁদতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করার মানসিক ঐশ্বর্য যাদের নেই, তারা ইকবাল আহমেদের মতো সুদীর্ঘ আট মাস পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর হাতে বন্দি থাকেননি, দিনের পর দিন ভোগ করেননি অমানুষিক শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন। মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী অথবা সেলিনা পারভীনের মতো বুদ্ধিজীবীদেরকে মীরপুর ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে মাথায় শরীরে লোহার রডের আঘাতে আঘাতে মেরে ফেলা হয়েছিল আর ইকবাল আহমেদের মতো শিল্পীকে না মেরে আরো ভয়াবহ মৃত্যুযন্ত্রণা উপহার দিয়েছিল অসভ্য বর্বর পাক বাহিনী— যার স্মৃতিচারণ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের অনুষ্ঠানে নিজেই করেছেন ইকবাল আহমেদ।

কেন ইকবাল আহমেদ বর্বর পাক-বাহিনীর নির্মম অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, কেন তাকে দিনের পর দিন বর্বররা বন্দি করে রেখে নিজেদের জিঘাংসার রোষ ঝেড়েছেন? তার কারণ একটিই, ইকবাল আহমেদ স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে বেড়িয়েছেন রাজপথে, ’৬৯-এর গণআন্দোলনে ইকবাল আহমেদের গাওয়া গণসঙ্গীত ছিল এক প্রধান প্রেরণা। তখন মানে সেই ষাটের দশকের শেষভাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কৃতী ছাত্র ইকবাল আহমেদ ছিলেন সঙ্গীতানুরাগীদের কাছে প্রিয় এক নাম। প্রাণবন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত ও গণসঙ্গীত গেয়ে তিনি সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। ছায়ানটের শিক্ষার্থী হিসেবে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন, জাহিদুর রহিমের কাছে, গণসঙ্গীতের দীক্ষা নিয়েছিলেন শেখ লুৎফর রহমানের কাছে। তরুণ বয়সেই শিল্পী এবং সংগ্রামী হিসেবে পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী সাফল্য। ১৯৭০ সালে এইচ. এম. ভি প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুটিকয় ডিস্ক রেকর্ড, তার মধ্যে ইকবালের গাওয়া গানের রেকর্ড দীর্ঘকাল ধরে ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। HMV এর টপ টেন চার্টে নূরজাহান, লতা মঙ্গেশকরসহ সব বিখ্যাত শিল্পীদের ছাপিয়ে ইকবাল আহমেদের গাওয়া ‘জানি জানি গো’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি দীর্ঘকাল প্রথম আসনে ছিল। বিক্রির দিক থেকে রেকর্ড করেছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতে শুধু আত্মনিবেদন নয় অন্যদিকে ছায়ানটে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের ছত্রছায়ায় গণসঙ্গীত গেয়ে গেয়ে জনতার রক্তে জাগিয়ে তুলেছিলেন উদ্দীপনা। শিল্পী এবং সংগ্রামী ছাত্রনেতা হিসেবে ইকবাল আহমেদের জনপ্রিয়তা তখন এতটাই বিপুল হয়েছিল যে, ১৯৭০-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে একমাত্র তিনিই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ‘সংস্কৃতি সম্পাদক’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাদ বাকী সব পদগুলোই লাভ করেছিল ছাত্রলীগ।

ইকবাল আহমেদ জেনেভা থেকে এবার খুব স্বল্পকালীন সময়ের জন্য দেশে এসেছিলেন এবং প্রতিদিনই কাটিয়েছেন কর্মব্যস্ততায়। এর মধ্যেও পাওয়া গেল তার মূল্যবান সময়। ক্যাসেটবন্দি হলো সেই আলাপচারিতা। এখানে পত্রস্থ হলো তারই চুম্বক অংশ:

ইকবাল আহমেদ: আসলে আমি কী বলব, এই যে দেশে এসে যেমন শুনলাম মাইল্স্ নামের একটি ভালো ব্যান্ড দল, আমি শুধু শুনলামই মাইলসের কথা। কিন্তু আমি তো ওদের গান শুনিনি, এখন কী করে মন্তব্য করবো মাইলস ভালো কী খারাপ। সে জন্য আমার পক্ষে আসলে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করাটা খুব ডিফিকাল্ট আর কি!

হামিদ কায়সার: না, মানে আমি জানতে চাচ্ছিলাম, দীর্ঘদিন বাদে দেশে আসার পর আমাদের সংস্কৃতির ধারাটাকে আপনার কেমন লাগছে? আপনি কী কী পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন? আমরা কি আমাদের শেকড়ে আছি, না শেকড়চ্যুত হয়েছি?
ইকবাল আহমেদ: আমি তো বাইরে থাকি এবং নেহায়েতই একেবারে কম সময়ের জন্য আসি— এত কম দেখেশুনে কিছু বলাটা কিন্তু ভীষণ বিপজ্জনক। ধরুন, টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখে আমার হয়তো মনে হলো যে, অনুষ্ঠানটা বোধহয় ঠিক হলো না। আমি টেলিভিশন অফ করে দিলাম। কিন্তু তারপরই হয়তো এমন একটা অনুষ্ঠান ছিল, যেটা দেখলে আমি প্রথম অনুষ্ঠান দেখে যে-মন্তব্য করেছিলাম তা হয়তো করতাম না। তাই এভাবে কিছু বলাটা ভীষণ মুশকিল-ই। আমার যেটা লেগেছে, এখন ঘরে ঘরে তো হয় ডিশ আছে নয়তো কেব্ল্ নেটওয়ার্ক— বিভিন্ন চ্যানেল আছে এবং ঘরে ঘরে দেখি তো, বিটিভি ছাড়া যে সমস্ত চ্যানেল আছে— সে সমস্ত চ্যানেল তো সরাসরি হচ্ছে। এটা আমাদের সময়ে ছিল না। আমাদের সময়ে যদি দশ-পনেরো-পঞ্চাশটা চ্যানেল পাওয়া যেত, তাহলে আমরা কি ঐ চ্যানেলের মধ্যে, অতগুলো চ্যানেল পাওয়া গেলে আমি হয়তো ঐ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলটা দেখতাম, ডিসকোভারি চ্যানেলটা দেখতাম, বিবিসি, সিএনএন— এগুলো দেখতাম— যেগুলো এখন দেখি এবং অনেক চ্যানেল ঘরে ঘরে হয়তো টেলিভিশনে চলছে— ১০০ জনের নাচ একটি গানের সঙ্গে, ছবিরই তো অংশ। আগে কি আর ছবিতে গান ছিল না? নিশ্চয়ই গান ছিল— গানটা মনে হতো যে স্বভাবতই আসে এখানে-

হামিদ কায়সার: স্বতস্ফূর্তভাবে...
ইকবাল আহমেদ: হ্যাঁ, গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে— এখানেও, যে সমস্ত চ্যানেলের কথা বলছি, ওরকম, নায়ক-নায়িকা গান আরম্ভ করল— কোনো পাহাড় অঞ্চলে বা কোনো নির্জন এক জায়গায়— গান আরম্ভ করার পরে হঠাৎ পঞ্চাশ থেকে দুশো জন কোথা থেকে হাজির হয়ে পেছনে নাচ আরম্ভ করল সঙ্গে।

হামিদ কায়সার: অদ্ভুত একটা ব্যাপার।
ইকবাল আহমেদ: এটা যারা দেখে দেখে অভ্যস্ত তাদের কাছে হয়তো খারাপ লাগে না, কিন্তু হঠাৎ করে এটা আমাদের কাছে একটু কী-রকম লাগে— মনে হলো, এটা একটা নতুন ধরনের জিনিস দেখলাম— কিন্তু, লোকের সঙ্গে কথা বলে আমার যে অভিজ্ঞতা— অল্প সময়ে দেখার ফলে তো নিজের জানা হয় না; আমাদের এক গুরুজন, তিনি বলছিলেন দুঃখ করে যে, নজরুলগীতি বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের যদি কোনো অনুষ্ঠান হয়—তাহলে কি রকম লোক আসে! সামান্য পয়সার টিকেট হলেও নাকি লোকে এ ধরনের অনুষ্ঠান দেখতে চায় না। সঙ্গে সঙ্গে বললেন যে, ব্যান্ডের কোনো অনুষ্ঠান হলে বড়ো হোটেলে হয় বড়ো জায়গায় হয়— যেমন, শোনা কথা, দু’ হাজার, আড়াই হাজার টাকা দামের এসব অনুষ্ঠানের টিকেট বিক্রি হয়— এবং একেবারে হাউজফুল, লোকে যায়।

হামিদ কায়সার: এরকম হওয়ার পেছনে, কি কারণ?
ইকবাল আহমেদ: হয়তো যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত নজরুলগীতি শুনতে চায়, পুরনো দিনের গান শুনতে চায়— হয়তো তারা ঐ গ্রুপের মধ্যে পড়ে না। কিংবা এমনও হতে পারে, হয়তো অন্যেরা ‘মুভ’ করে গেছে এমনভাবে, আমরা পিছিয়ে পড়ে আছি। আমরা বুঝছি না জিনিসটা। খারাপ ভালো কিছুই বুঝছি না— কিন্তু, আমি বুঝি, আমার পক্ষে— আমি আগেই সুইফ্ট্! তা ছাড়া কালচার তো একটা ডায়নামিক জিনিস, যদি আমরা সেই দু’হাজার বা দু’শ বছর বা একশ’ বছর আগে থেকে বিশ্লেষণ করে দেখি, তো দেখব কালচার জিনিসটা একেবারে ডায়নামিক। তা ডায়নামিজ্মের মধ্যেও একটা ফ্রেমওয়ার্ক থাকে— সে ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই বোধহয় ডায়নামিজ্ম্ হয়। তার বাইরে যখন হয়, তখন আমরা যারা পুরনোপন্থী, আমাদের পক্ষে বোধহয় বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু আবার একই সঙ্গে বলব, শোনা কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আত্মীয়-স্বজন আছে, বন্ধুবান্ধব আছে। ওদের কাছেই শুনেছি, যতই ব্যা- হোক না কেন, যতই স্যাটেলাইট দেখুক না কেন, ভোরবেলা নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা যায়, বেশকিছু বাসা থেকে সন্ধ্যাবেলা গলা সাধার আওয়াজ পাওয়া যায়, ভোরবেলা গলা সাধার আওয়াজ পাওয়া যায়—

হামিদ কায়সার: হ্যাঁ, হ্যাঁ... এটা সত্যি
ইকবাল আহমেদ: খুব চিৎকার  করে সন্ধেবেলা কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে, এগুলোও শোনা যায়। তার মানে জিনিসটা এখনো আছে। নিশ্চয়ই আছে।

হামিদ কায়সার: এখনো পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে জনতার যে-ঢল নামে, তা কোনো কনসার্টেই লক্ষ্য করা যায় না। ছায়ানটে এই রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে সব বয়সী মানুষই আসে। কিন্তু কনসার্টগুলোতে কিন্তু তা হয় না। সেখানে দেখা যায়, টিন-এজদেরই প্রাধান্য—
ইকবাল আহমেদ: এটা কিন্তু দুনিয়ার সব জায়গাতেই হয়— স্পাইস গার্ল্স্দের অনুষ্ঠান বলেন, মাইকেল জ্যাকসনের অনুষ্ঠান বলেন, বা বিট্ল্স্দের কথাই বলেন— একটু আগে চলে যান, আর কি এইট-নাইন-টেন- যে গ্রুপের কথা বলছেন, একেবারে তরুণ টিন-এজার্স— ওরাই কিন্তু এগুলো স্পন্সর করে— এটা ঠিক।

হামিদ কায়সার: ক্যাম্পাসে আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা গণসঙ্গীত পরিবেশিত হতো যে-কোনো ছাত্র দলের অনুষ্ঠানে। সেই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা জায়গা থেকে এসেই তরুণ-তরুণীরা চেতনামূলক গানের সঙ্গে পরিচিত হতো। এখন কিন্তু সে ধারা নেই— ক্যাম্পাসে এখন শুধু ব্যান্ড সঙ্গীতের আসর হয়— এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ইকবাল আহমেদ: তা হলে একটু পেছন ফিরেই বলি। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসঙ্গে একথা আমরা বারবার বলি। ছায়ানট যখন প্রথম তৈরি হলো, ছায়ানটের মূল উদ্দেশ্য কোনো সময় ছিল না যে, গায়ক-গায়িকা তৈরি করবে। এবং এটা যে কোনো দেশেই হোক না কেন, যে-কোনো ভাষাতেই হোক না কেন, ক্লাসিক্যাল বেইজ্ড্ এই সিম্ফনিগুলো এমন যে, এগুলো কিন্তু হঠাৎ করে কেউ গিয়ে তিন ঘণ্টা বসে শুনলে ভালো লাগবে না। এগুলো শুনে এপ্রিশিয়েট করতে গেলে, এ থেকে রসটা পেতে গেলে, এর ভেতরে থাকতে হয় অনেক দিন, শিখতে হয়, জানতে হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে বলি, রবীন্দ্রসঙ্গীত তো ঐ পর্যায়ের না হলেও ক্লাসিক্যালের মতোই।

হামিদ কায়সার: ক্লাসিক্যাল-ই।
ইকবাল আহমেদ: ক্লাসিক্যালগুলো যে-রকম, যে কোনোদিন ক্লাসিক্যাল শোনেনি, বা বোঝেনি তার কাছে হয়তো ভালো লাগবে, শ্রুতিমধুর একটা জিনিস হয়তো মনে হবে, কিন্তু গভীরে সে কখনো যেতে পারবে না।  কিন্তু যে রাগগুলো চেনে, সে কিন্তু এপ্রিশিয়েট করবে অন্য জায়গায়, যে এ রাগটায় এপর্দাগুলো লাগে। এই যিনি গাইছেন বা বাজাচ্ছেন পর্দাগুলো এভাবেই লাগিয়েছেন, নাকি নতুন একটা কায়দা করে লাগাবার চেষ্টা করেছেন— তা ভালো লেগেছে অথবা ভালো লাগেনি— এই এপ্রিসিয়েশনটা  ঐ সময়েই হবে, যখন যিনি শুনছেন সেই শ্রোতা সে-রাগটা চেনেন বলে। পরবর্তী পর্যায়ে তানের ব্যাপারটা। তান যে বোঝে সে বুঝবে যে এটা পরিষ্কার হচ্ছে কি পরিষ্কার হচ্ছে না আর যে একেবারে বোঝে না, সে বলবে যে, গানের শেষে কি যেন বলে! তো, শ্রোতা তৈরির ব্যাপার— এটা মনে হয় কিছুটা দরকার। রবীন্দ্রসঙ্গীতেও একই ব্যাপার— রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিছু গান আছে তালের গান, অনেক গানই আছে তালের, টপ্পা অঙ্গের গান, নানান ধরনের গান আছে। তা হঠাৎ করে বাজালে কানটা তৈরি না থাকলে, প্রস্তুতি না থাকলে হঠাৎ করে বোধহয় গানটা ভালো নাও লাগতে পারে। কিন্তু ব্যান্ডের গান হলো বিটপ্রধান—এবং অনেক ব্যান্ডের গানই বিদেশে ডিস্কো মিউজিক— যেগুলোর রেকর্ডও ভীষণভাবে বিক্রি হয়, পপুলার। কিন্তু এ গানগুলো বিটপ্রধান, কথাপ্রধান নয়। তরুণ-তরুণীরা হয়তো কথাগুলো বোঝে, আমি তো বুঝি না।

হামিদ কায়সার: গণসঙ্গীত প্রসঙ্গ...
ইকবাল আহমেদ: হ্যাঁ, বলছি— বলা ঠিক হবে না। আমরা যে গণসঙ্গীতগুলি গাইতাম— সেটা, সব সময়ই যে-রকম হয়, একটা পরিস্থিতির কারণে, একটি উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হয়, লেখা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের সময় প্রচুর গান লেখা হয়েছে। তখন কিন্তু স্বাধীনতার জন্য, গণ-অভ্যুত্থানের গান, তারপরে, লেফটিস্ট মুভমেণ্টের সময় যে গানগুলি ছিল— সে গানগুলোর প্রত্যেকটির কিন্তু একটা বাণী ছিল—

হামিদ কায়সার: উদ্দেশ্য ছিল—
ইকবাল আহমেদ: উদ্দেশ্য ছিল— এখন এইখানে, যেহেতু নতুন কোনো গান জানা নেই, আমি সেই আগের গণসঙ্গীতগুলিই গাই, এবং আমার বন্ধুবান্ধব এবং পুরনো দিনের যারা তারা ঐ গানগুলিই শোনে, তাদের ভালোই লাগে— তারা পুরনো দিনে ফিরে যায়। কিন্তু, এখনকার জন্য— যাদের কথা আপনি বললেন, গণসঙ্গীত শোনে না, তাদের জন্য তো— যদি আপনি মনে করেন গণসঙ্গীত একটি ভালো ব্যাপার— তা ঐ রকম গণসঙ্গীত কি লেখা হচ্ছে? সুর করা হচ্ছে? যদি লেখা হয়, সুর করা হয়— তবুও কেউ গ্রহণ না করে, তা হলে একটা কথা। আর যদি—লেখা হচ্ছে না, সুর করা হচ্ছে না, সে জন্য বাজানো হচ্ছে না— এবং এখন ঐ পুরনো অনেক গানই আছে, যা স্বাধীনতার সময়ে লেখা— সেগুলো বুঝি এখন আর প্রযোজ্য নয়। আমি আর এর বেশি কিছু বলতে পারছি না, কারণ আমি জানিই না কী ধরনের গান এখন...

হামিদ কায়সার: এখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেই রেওয়াজটাই নেই— গণসঙ্গীত অথবা চেতনামূলক অথবা দেশপ্রেমমূলক কোনো গানেরই চর্চা নেই, সেখানে এখন ব্যান্ড সঙ্গীতের স্রোতে সব কিছুই ভেসে গিয়েছে। এখন একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে গণসঙ্গীতের ক্ষেত্রে—
ইকবাল আহমেদ: শূন্যতা যদি চলে আসে, তা পূরণ করা কিন্তু খুব অসুবিধে।

হামিদ কায়সার: জ্বী।
ইকবাল আহমেদ: গ্যাপ হয়ে যায়। গ্যাপ হলে কণ্টিনিউটিটা ব্রেক হয়ে যায়— ব্রেক হলে সেটা খুব অসুবিধাজনক।

হামিদ কায়সার: এবার এবটু অন্য দিকে আলোকপাত করা যাক। ‘৭১ সালে আপনি তো গান গাওয়ার জন্যই বর্বর পাক-বাহিনীর রোষানালে পড়েছিলেন। তাই না?
ইকবাল আহমেদ: তখন আমি নানান কিছুর সঙ্গে জড়িয়েছিলাম। আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলেছে। আমাকে এক সময় বলল যে, আমার সবচেয়ে বড়ো অপরাধ হলো, আমি এক্সাইটিং পিপল উইথ রবীন্দ্রসঙ্গীত সং— ন্যাশনালিজমের চরম একজন— এরকম নানা কিছু বলত আর কি— আর, তখন আমি এমএ ক্লাশের ছাত্র, অর্থনীতি বিভাগে। তখন আমাকে কাগজে-কলমে ওরা বলল— তোমার ইনভল্ব্মেণ্ট এখানে আছে, ওখানে আছে। সংস্কৃতি-সংসদের ভাইস প্রেসিডেণ্ট ছিলাম। ইউনিভার্সিটি ইকনমিক্স এসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেণ্ট ছিলাম— ওখানে যা কার্যকলাপ হতো তা ঠিক গানভিত্তিক নয়। টিভি অনুষ্ঠান কিছু করেছিলাম আমি। ইউনিভার্সিটি অনুষ্ঠান কনডাক্ট করতাম, ‘নবীনের আলোকে’ অনুষ্ঠান করেছিলাম। রিপিট করল কয়েকবার— পুরো আলোচনা সভা। মনে হয়, ওটা বোধহয় জাতীয়তাবাদ যুব সমাজেরও কিছু একটা দান, তখন আমরা পরিকল্পনা করেছি যে, যুব সমাজের ভূমিকা কী হবে— এ ধরনের আলোচনা, ইকনমিক ডিস্পারিটি নিয়ে আলোচনা— এগুলো একটা দিক ছিলো, তাছাড়া ছায়ানট ছিল, যেটা পাকিস্তান আর্মিদের কাছে খুব ভালো একটা ব্যাপার ছিল না।

হামিদ কায়সার: যেহেতু রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘেঁষা?
ইকবাল আহমেদ: যেহেতু রবীন্দ্রসঙ্গীত, যেহেতু ন্যাশনালিজমের একটা ব্যাপার ছিল ওখানে। সেটা ওরা পছন্দ করত না একেবারেই। আমি ছায়ানটের ছাত্র ছিলাম, ছায়ানটে শিক্ষকতা করতাম— এগুলো আরেকটা দিক ছিল। তখন আমি ডাকসু-র কালচারাল সেক্রেটারি ছিলাম—

হামিদ কায়সার: ছাত্র ইউনিয়ন থেকে তো একমাত্র আপনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন?
ইকবাল আহমেদ: হ্যাঁ, এগুলো তো ছিল-ই, তারপরে আবার গান গেয়ে বেড়াতাম বিভিন্ন জায়গায়— নারায়ণগঞ্জ তো কাছেই, রাজশাহীসহ দূরেও ছুটে বেড়িয়েছি গণসঙ্গীত গাওয়ার জন্য। সব মিলিয়ে ওদের কাছে আমি ভীষণ এক অপরাধী ছিলাম—

হামিদ কায়সার: এবং আপনার এই কণ্ঠ তো ওরা চরম নির্যাতন করেও বন্ধ করতে পারেনি, বন্দি শিবিরেও নাকি গণসঙ্গীত এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে উঠেছিলেন? এই সাহস ভেতর থেকে আপনার কিভাবে জেগেছিল?
ইকবাল আহমেদ: ওখানে আসলে একটা ব্যাপার আছে। গৌতম বাবু— যে লিখেছেন, সরকারী কর্মচারীরা দেখেছিলেন— একজন তরুণ, কেউ আবার আমাকে চিনেওছিলেন, আমাকে, মারতে মারতে নিয়ে এল এবং মারতে মারতে একেবারে আধমরা অবস্থা, তারপর ভেতরে কোথায় নিয়ে গেল। আধঘণ্টা পরে আমার কণ্ঠে ঐ ‘আমার সোনার বাংলা’ বেজে ওঠেছে এবং করিডোর একেবারে গম গম করে উঠেছে, এমন বলিষ্ঠ গলা এবং উদার গলা— তারা  যা যা বলেছিলেন আর কি গৌতম বাবুকে, সাংঘাতিক একটা ব্যাপার— তখন ওরা বলেছে যে, তাহলে আমরা কেন ভেঙে পড়েছি? এই তরুণকে এরকম মারধোর করতে দেখলাম, তবু এই ছেলেটি এরকমভাবে দেশের গান গাইছে, তা হলে আমরা কেন এত ভেঙে পড়ছি? এ ছেলেটি এ অবস্থায়ও গান গাইতে পারছে। তা হলে আমাদের ভয় কিসের? কিন্তু, ঘটনাটা ঠিক এরকম নয়। ঘটনাটি হলো, আমাকে গান গাইয়েছে ঠিকই, আমাকে তারা জিগ্যেস করেছিল— তুমি কি কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলে বল? রেভিউলিশনের কি কি গান গেয়েছ, বল?

হামিদ কায়সার: ও আচ্ছা!
ইকবাল আহমেদ: তো আমাকে বলতে লাগল, তুমি এটা করো ওটা করো— আমাকে গাইয়েছে আর কি! আমি তো গাইনি— গেয়েছি তখন ঐ মারধোর খাবার পরে। দুর্বল গলায়-ই গেয়েছি আমি, কিন্তু ওরা প্লেব্যাক করল সে গান। এবং যখন প্লেব্যাক করল, যে-কোনো হাইফাই যে-কোনো বড়ো টেপরেকর্ডারে প্লেব্যাকে আপনি ভলিউমটা বাড়িয়ে দেন, ভীষণ জোরে আওয়াজটা  হবে। তো  আমার রেকর্ড করা গান ভীষণ জোরে আওয়াজটা বাড়িয়ে দিয়ে ওরা  শুনছে। এবং ঐ যে সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা তারা আমাকে প্রথম পর্যায়ে দেখেছে, তারপর গলা শুনেছে ঐ জিনিসটা থেকে। তারা গৌতম বাবুকে বলেছেন, যেটা গৌতম বাবু লিখেছেন আর কি যে ‘আমরা এরকম দেখলাম, একজন তরুণকে পেটাতে পেটাতে নিয়ে এলো, তারপর সে একেবারে বলিষ্ঠ গলায় এভাবে গান গাইল— এখানে যখন অসম্ভব অত্যাচার হচ্ছে বেয়নেট হাতে নিয়ে টর্চার করছে, কখন যে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেবে ঠিক নেই, কাউকে তো আর জবাবদিহি করতে হচ্ছে না এ জন্য। অনেকবারই তো এরকম করেছে— ঐ অবস্থায় এরকমভাবে ‘ডিফাই’ করাটা একেবারেই অসম্ভব, সম্ভব না।

হামিদ কায়সার: সেটাই।
ইকবাল আহমেদ: ডিফাই করা একেবারেই সম্ভব নয়। কিন্তু, জিনিসটা প্রত্যেকটাই সত্যি। ওরা আমাকে আনতেও দেখেছে এবং গানও শুনেছে— কিন্তু দুইয়ে দুইয়ে চার জোড়া দিয়েছে আর কি।

হামিদ কায়সার: তা হলে ওরা আপনাকে দিয়ে গাইয়েছিল কেন?
ইকবাল আহমেদ: আমি জানি না, ওদের কী স্বার্থ আছে। ওরা হয়তো পরে কেস খাড়া করত, যে এরা আলাদা হতে চাইছে, গান শনাক্ত করলেই তা বোঝা যাবে— ঠিক জানি না, ওদের কী উদ্দেশ্য ছিল।

হামিদ কায়সার: এবার একটু অন্য রকম প্রশ্ন, রবীন্দ্রসঙ্গীতে কিভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন?
ইকবাল আহমেদ: মা-র কাছে মূল প্রেরণা পেয়েছি। মা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন, নজরুলগীতি গাইতেন, বাবা-ও রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করতেন, গাইতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড নিয়মিত সংগ্রহ করতেন শুনতেন। বাসায় পারিবারিকভাবেই গান চর্চার সুযোগ পেয়েছি। তারপর ছায়ানটে যখন যোগ দিলাম, ভালোভাবে গান শেখার সুযোগ পেলাম, সেই থেকে গান শিখেই যাচ্ছি—

হামিদ কায়সার: এখনো তো, রবীন্দ্রসঙ্গীত-ই গেয়ে যাচ্ছেন?
ইকবাল আহমেদ: রবীন্দ্রসঙ্গীত-ই গাইতাম। তাছাড়া, ছায়ানটে নজরুলগীতিও শিখেছিলাম— যেগুলো গলায় ভালো আসে, সব ধরনের গান তো আসে না— আমার গলায়, নিজের ধারণায় যে গান ভালো আসে, তাই গাইবার চেষ্টা করি। নজরুল ইসলামের ‘বল বীর’টা আমি খুব আনন্দের সঙ্গে বলিষ্ঠভাবে গাইবার চেষ্টা করি। নজরুল ইসলামের অনেক গান-ই গেয়ে থাকি। তবে, আমি মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত-ই বেশি গেয়ে থাকি।

হামিদ কায়সার: নজরুলের ‘বল বীর’টা আপনি কার সুরে গান? শেখ লুৎফর রহমানের?
ইকবাল আহমেদ: লুৎফর ভাই সুর করেছিলেন। কিন্তু, আমি যেটা গাই সেটা আলতাফ ভাইয়ের (শহীদ আলতাফ মাহমুদ) সুর। অসাধারণ সুর দিয়েছিলেন। একটা নাচের জন্য করেছিলেন।

হামিদ কায়সার: আপনার এ গানটি কি ক্যাসেটবন্দি আছে?
ইকবাল আহমেদ: না, ক্যাসেটবন্দি নেই। টিভিতে এক অনুষ্ঠান করেছিলাম, টিভিতে গেয়েছিলাম আর কি। পাব্লিক্লি গাওয়া বুঝি ঐ একবার-ই হয়েছিল—

হামিদ কায়সার: আপনি বিদেশে থাকেন, তাই এ প্রজন্মের কেউ আপনার গান সেভাবে শোনার সুযোগ পায় না। জাহেদুর রহিম আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। তার নামের সঙ্গেও— দুঃখজনক হলেও সত্য— অল্পসংখ্যক তরুণ-তরুণী ছাড়া এ প্রজন্ম প্রায় সবাই অপরিচিত। অথচ ইন্ডিয়াতে HMV এর মতো একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা নতুন-পুরাতন গুণী শিল্পীদের গান নিয়মিতভাবে বের করে থাকে— সব যুগের শ্রোতারাও সে গান শোনার সুযোগ পায় অথচ এদেশের রেডিও-টেলিভিশন অথবা অন্যান্য মিডিয়া জাহেদুর রহিমকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারেনি। এ ব্যাপারে আপনার কি বক্তব্য? উত্তরণের পথ কি?

ইকবাল আহমেদ: বাবু ভাইয়ের (জাহেদুর রহিম) গান সেভাবে আছে কী না জানি না। রেডিওতে খোঁজ করলে হয়তো তার কিছু গান পাওয়া যাবে। আরেকটা জিনিস, আগে রেডিওতে যেভাবে রেকর্ডিং হতো, তখন তো টেকনোলজি অত ডেভেলপ করেনি— তা ছাড়া, অনেক সময় আমরা রেকর্ডিং করেছি ওখানে, বিশেষ করে লাইভ্ রেকর্ডিং যেগুলো— আমার কিছু গান ওরকম বাজে, বাজানো হয় রেডিওতে। যখন কেমব্রিজ চলে যাচ্ছি, তখন বলেছিলাম, চলে যাচ্ছি। তখন আমার লাইভ প্রোগ্রাম, যেগুলো শোনা যায়— সে প্রোগ্রামগুলোর রিহার্সেল একেবারেই হতো না। অনেক সময় ভোরবেলায়, যেহেতু প্রথম অনুষ্ঠান ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের— ভোরবেলায় হয়তো পৌঁছালাম, কিন্তু দেখা গেল হয়তো যন্ত্রসঙ্গীত-শিল্পীরা এসে কেউ পৌঁছায়নি। অনুষ্ঠান আরম্ভ হওয়ার পাঁচ দশ মিনিট আগে হয়তো একজন দুজন করে পৌঁছাল। যারা শেষে এসে পৌঁছাল হয়তো বলতে লাগল, ‘সুরটা কি, সুরটা কি, দেখি সুরটা মিলিয়ে নিই’। বলা হলো যে, ‘গান তো তিনটা।’ তখন হয়তো শশ্যব্যস্ত হয়ে তারা নিজেরা বলতে থাকল, ‘তিনটি গান করো।’ দশ মিনিটের মধ্যে, কি গান গাব তা শুনেটুনে নিয়ে— আমি গান আরম্ভ করলাম আর তারা বাজালেন। এটা একেবারেই উচিত না—এভাবে অনুষ্ঠান করা। কিন্তু উপায় ছিল না, এটাই ছিল তখন রেওয়াজ, এভাবেই হতো— তো, ঐভাবে গানটা গাওয়া হলো। ঐরকম কিন্তু আমার প্রোগ্রাম রেডিওতে রেকর্ড করে রেখেছিল। তখন লাইভই যেত, রেকর্ড করে রাখার কথা না, কিন্তু ওরা রেকর্ড করে রেখেছে, ওটা এখনো বাজায়।

হামিদ কায়সার: বাজায়? এখনো?
ইকবাল আহমেদ: হ্যাঁ, বাজায় রেডিও থেকে। আমি একবার বলেছিলাম যে, ওগুলো একেবারে রেকর্ডিং কিছু হয়নি— ওগুলো বাজানো কি দরকার। ওদেরও দোষ নেই। ওরা বলে যে, ‘হ্যাঁ গান তো নেই। আপনি  এসে নতুন কিছু গান করে দেন, ওগুলো মুছে ফেলি, ওগুলো আর বাজাব না।’ তো, আমি সময় দিতে পারি না। সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন বাবু ভাইয়ের (জাহেদুর রহিম) কথায় ফিরে আসি। আমার তো ধারণা, বাবু ভাইয়ের যে-গানগুলো রেডিওতে রেকর্ড করা আছে, ঐ গানগুলোর কোনোটাই কিন্তু এখন যে-যত্ন নিয়ে রেকর্ডিং হয়, ক্যাসেট বেরোয়— এরকম অবস্থায় রেকর্ড করা হয়নি। বাবু ভাইয়ের গলাটা পাবেন— ঐ গানগুলো উদ্ধার করে, হয়তো অনেক কাজ করে, বোধহয় টেকনোলজি দিয়ে গানগুলোকে উপযোগী করা যায় কিনা— রেডিওতে ছাড়া মনে হয় না আর কোথাও তার গান রয়েছে।

হামিদ কায়সার: এখন তো রেডিও ঐভাবে কেউ শোনে না। যদি জাহিদুর রহিমের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট বা সিডি পাওয়া যেত তাহলে হয়তো তার ভক্ত-অনুরক্তসহ এ প্রজন্মের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্তরাও তার গান শোনার সুযোগ পেত।
ইকবাল আহমেদ: আমি যেটা বলতে চাইছি আর কি, ওঁর গান যদি নাই-ই থেকে থাকে এবং ওঁর কথা ছেড়ে দিন, আমার নিজের কথা বলি। আমার নিজের কোনো গানই ভালো হয়নি। এবং ঐগুলিই যদি শুধু থেকে থাকে এবং ঐ গানগুলি সংগ্রহ করে যদি আপনি একটি ক্যাসেট বের করেন এবং তা বাজারে ছাড়েন, ঐ ক্যাসেট যে শুনবে তার তো আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হবে। আমি যে ভাবে গাইতে পারি, সেভাবেই তো আপনি আমাকে ক্যাসেটে উপস্থাপন করবেন— তাই বাবু ভাইয়ের ক্ষেত্রে এ জিনিসটা যেহেতু নেই—

হামিদ কায়সার: রেকর্ডিং ভালোভাবে হয়নি।
ইকবাল আহমেদ: হ্যাঁ, রেকর্ডিং তখন এভয়লেব্ল্ ছিল না, তখন রেকর্ডিং খারাপ হতো। জিনিসও ছিল না। আমার কাছে ঘরোয়াভাবে বাবুভাইয়ের কিছু রেকর্ড আছে। উনি বাসায় গাইছেন, আমি রেকর্ড করে রাখছি। জাস্ট আনন্দ। হারমোনিয়াম জোরে জোরে বাজছে। বুঝতেই পারছেন কেমন কোয়ালিটি হবে। অসাধারণ গলা, অপূর্ব গান। কিন্তু, আমার রেকর্ডিংয়ের দোষে, যেটা তুলেছি আমি সেটা যদি আপনাকে দিই, তা হলে তো বাবু ভাইয়ের ক্ষতি করছি আমি। তাই না?

হামিদ কায়সার: জ্বী।
ইকবাল আহমেদ: আমি জানি না, বাবু ভাইকে কিভাবে নতুনভাবে উপস্থাপন করা যায়। নতুন নতুন টেকনোলজি এসেছে— সেটার সাহায্য নেয়া যাবে কিনা। আমার বক্তব্য এটাই, বাবু ভাই অত্যন্ত ভালো গাইতেন, ভীষণ সুন্দর গলা ছিল ওঁর। আমরা যদি বাজারে ওঁর কিছু ছাড়ি, তা হলে ওঁর ভালো জিনিসটাই যেন ছাড়তে পারি; ওটার চেয়ে কম যদি কিছু হয় তা হলে বাবু ভাইয়ের অমর্যাদা করা হবে এবং লোকের কাছে তার ভুল পরিচয় দেয়া হবে।

হামিদ কায়সার: যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশনা এবং উপস্থাপনায় কি নতুনত্ব আনা যায় না? এ বিষয়ে আপনার কী অভিমত।
ইকবাল আহমেদ: নিশ্চয়ই। এটাতে তো বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। প্রেজেণ্টশনটা একটা মস্ত বড়ো জিনিস। এ প্রসঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে ওয়াহিদ ভাই একবার একটি গান গেয়েছিলেন ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’। পুরো গানটিতে ওয়াহিদ ভাইয়ের চেহারা একবারও দেখানো হয়নি। পুরো গানটিই উনি নেপথ্যে গেয়ে গেলেন। টিভি স্ক্রিনে সারাক্ষণই একটা বর্ষার ছবি আসছে, একটা বড়ো নদীতে পাল তুলে নৌকা ছুটে যাচ্ছে। পুরোটাই বর্ষার ছবি। গানটা যখন শেষ হলো, অনেকের বক্তব্য যে, এ গানটিই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে ভালো গান হয়েছে। আপনি ঠিক বলেছেন, প্রেজেণ্টেশন নিশ্চয়ই সুন্দর করে করতে হবে, আর কি। এটা তো একটা দিক। মানে আশেপাশের জিনিস নিয়ে প্রেজেণ্টেশন। আরেকটা বোধহয়, আপনি ইঙ্গিত করছেন— যদিও প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেননি, যেটা বোধহয়, যিনি গান গাইছেন তার প্রেজেণ্টেশনের ব্যাপারটা— একেবারে শক্ত হয়ে কাঠের মতো বসে থেকে—

হামিদ কায়সার: একেবারে গম্ভীর, অটুট গাম্ভীর্য নিয়ে....
ইকবাল আহমেদ: এমন না থেকে একটু ফ্রিলি গাওয়া আর কি, সেটা কি আর আগের মতো আছে? আমি যে দু’চার জনকে এখন দেখছি তারা তো দেখছি অনেক ফ্রিলি গায়, কথাবার্তা বলে গায়। তারপরে, আপনি অবশ্য অনেক দেখেছেন— আমি তো মাত্র দু’তিনটি অনুষ্ঠান দেখেছি। এর মধ্যে- আগের মতো কি ‘স্টিফ্’ হয়ে গায় এখনো?

হামিদ কায়সার: হাঃ...হাঃ... (হাসি)
ইকবাল আহমেদ: তাই-ই! আচ্ছা আচ্ছা।

হামিদ কায়সার: এখন জানতে চাচ্ছি, নতুন-পুরনো মিলিয়ে কারা আপনার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। যাদের গান আপনার অন্তত ভালো লাগে।
ইকবাল আহমেদ: দু’বছর পরপর তো আসি এখানে, এখানকার কিছু খবরের কাগজ নেবার চেষ্টা করি। কিছু পত্রিকা ম্যাগাজিন নেবার চেষ্টা করি। আবার এখান থেকেও কেউ কেউ পাঠায়— ক্যাসেট কি বেরোচ্ছে, কার বেরোচ্ছে, ঐ পর্যন্তই দেখা তো, নতুন, খুব বেশি কিছু বলতে পারব না কারা খুব ভালো গাইছেন। আমার এখনো যাদের সঙ্গীত ভালো লাগে, এখনো— তো বন্যার গান ভালো লাগে, সাদী খুব সুন্দর গাইছে। মিতার গানের মধ্যে সব আছে। এক্সপ্রেশন আছে, দরদ দিয়ে সুরে গায়। পার্থ-র গানও ভালো লাগে। ময়নার গান শুনেছেন?

হামিদ কায়সার: হ্যাঁ , শুনেছি।
ইকবাল আহমেদ: কেমন লেগেছে? ভালো লেগেছে?
হামিদ কায়সার ভালো।
ইকবাল আহমেদ: দেশে না থাকার ফলে একেবারে তরুণ কারো নাম বলতে পারছি না, যাদের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা আছে। বেশ কয়েকদিন দেশে থাকতে পারলে হয়তো বলা যেত—  

হামিদ কায়সার: সিনিয়র শিল্পীদের কথা কিন্তু বলেন নি!
ইকবাল আহমেদ: সনজীদা আপা, ফাহমিদা আপা। সনজীদা আপার কাছে তো গানই শিখেছি আমরা— তিনি তো এখন আর গান না। ওঁর কাছে যে এক্সপ্রেশনগুলো পেয়েছি— এখনো উনি যখন গান, মনে হয় অনেক কিছু শেখার আছে। খুব ভালো লাগে। ফাহমিদা আপার গান অনেক দিন শুনিনি। তা ছাড়া, ইফ্ফাত-ও ভালো গায়। সেলিনা মালিকের গানও অনেক দিন শোনা হয় না। কাদেরী কিবরিয়াও তো চলে গেল। আমেরিকায়। ফাহিম এখন গাইছে কী না! ওহ্ পাপিয়া সারোয়ারও কিন্তু ভালো গায়—ওর নামটা উল্লেখই করা হয়নি।

হামিদ কায়সার: তো, জেনেভাতে গান গাওয়ার পরিবেশটা কেমন? সেখানে তো নিশ্চয়ই একটা বাঙালি সমাজ রয়েছে—
ইকবাল আহমেদ: আছে, জেনেভাতে বাঙালি সমাজ আছে, ছোট। বেশি বড়ো নয়। ফলে... আমরা বসি, ঘরোয়াভাবে প্রায়ই বসি। আর নিজেরাও বাসায় গান করি। চর্চা রাখি, মেয়েদের গান শিখাই। বাসায় গান করি, ঘরোয়াভাবে এখানে ওখানে গাওয়া হয়। কিন্তু, অনুষ্ঠান ঠিক খুব একটা করা হয় না। হয়, অনুষ্ঠান হয়— ঐ ২৬ মার্চ বা জাতীয় দিবসে করা হয়, বর্ষা উৎসব, ২২ শ্রাবণ ইত্যাদি দিনে অনুষ্ঠানে গান করি। সে সব অনুষ্ঠানে গান গাওয়া— বেশি লোক না থাকলে যা হয় আর কি! আর ব্যস্ততা সব জায়গায়ই এখানেও ওখানেও। ব্যস্ততা থাকেই আর কি!

হামিদ কায়সার: এই যে বর্ষার সময়, শ্রাবণে দেশের জন্য নস্টালজিয়া কাজ করে না?
ইকবাল আহমেদ: সব সময়ই। সব সময় দেশের কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে।

হামিদ কায়সার: একটু আগে কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, মেয়েদের গান শেখান। রবীন্দ্রসঙ্গীত? বাংলা গান?
ইকবাল আহমেদ: অবশ্যই। যতই বিদেশে থাকে, বাংলা-ই তো আমার অস্তিত্ব, আমার প্রাণ, নাকি?

হামিদ কায়সার: কিন্তু, এদেশের একটা অভিজাত শ্রেণি, এমনকি উপরে উপরে যারা বাংলা সংস্কৃতির জন্য মায়াকান্না করে, তারা কিন্তু ছেলেমেয়েদেরকে ভিন্ন ভাষা ভিন্ন সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেয়।
ইকবাল আহমেদ: আপনি কাদের কথা বলছেন আমি জানি না। আমি নিজের কথাই বলছি, মনে হয় ইংরেজি শেখায় কোনো দোষ নেই। ইংরেজি শিখুক ফরাসি শিখুক— আজকাল গ্লোবালাইজেশন যেভাবে হচ্ছে, যে দু’-তিনটা ভাষা জানে তার জন্য তো সেটা ‘এ্যাসেট’। বিদেশে মনে করেন প্রত্যেকটা স্কুলে তিন-চারটা ভাষা শেখায়। আমার নিজের মেয়েরা— এ প্রসঙ্গে একটু বলে নিই, আমার মেয়েরা, দুজনই কিন্তু বিদেশে জন্মেছে, দুজনই কিন্তু ওরা বাংলা লেখে, বাংলা পড়ে, বাংলায় গান গায় এবং দাদা-দাদী, নানীকে বাংলায় চিঠি লেখে।

হামিদ কায়সার: এটা সম্ভব হয়েছে আপনার সচেতনতার জন্য।
ইকবাল আহমেদ: আমার শুধু নয়। আমার স্ত্রী ওদেরকে সময় দিয়েছে। শেখাবার চেষ্টা করেছে। আমরা পরিবেশটা এমনভাবে গড়েছি যাতে ওরা বাংলা শিখতে পারে। তা ছাড়া, আমরা যে সব জায়গায় থেকেছি যে সমস্ত জায়গায় সুযোগ ছিল— ভালো একটা বাংলা কমিউনিটি ছিল— জাম্বিয়াতে একটা ভালো কমিউনিটি ছিল, জেনেভাতেও বাঙালি যারা আছে একসঙ্গে বসা হয়। সব মিলিয়ে...আর কি। তো, আমার মেয়েরা ইংরেজি জানে, ফরাসী জানে, স্প্যানিশ জানে—এটা তো মনে হয় একটা ভালো ব্যাপার। এখানেও যদি কেউ জানে ফরাসি জানে ভালো— যত ভাষা জানে ততই ভালো; ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নতি— সব দিক থেকেই ভালো।

হামিদ কায়সার: কিন্তু তাই বলে কি, এরা বাংলাকে উপেক্ষা করবে? এই ঢাকাতেই তো একটি অভিজাত শ্রেণি ভালোভাবে বাংলায় কথা বলতে পারে না, অথবা পারলেও ফ্যাশন করে ভালোভাবে বাংলা বলতে চায় না— নিজেদের কৌলিন্যকে প্রকাশের জন্য।
ইকবাল আহমেদ: এটা যদি হয়, আমি যা বলব, আমি তো ইমোশনালি বলব, যে, বাঙালি ছেলেমেয়ে কেন বাংলা বলতে পারবে না এবং কেন খুব গর্বের সঙ্গে বলবে না যে ‘আমি বাঙালি’! যদি আমি বাঙালি হই, তা হলে তো আমার বাংলায় কথা বলা উচিত, বাংলা লিখতে পারা উচিত। সেটা তো আমি ইমোশনালি বলব যে, প্রত্যেকেই যেন গর্বের সঙ্গে বলে, ‘আমি বাঙালি।’  কিন্তু আপনি যে-সব কথা বলছেন, সেগুলো কেন যে হচ্ছে...

২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮, পাক্ষিক প্রণোদনা