দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২৮

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : এপ্রিল ০১, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

প্রেরণা কী, জানি না— রশীদ করীম

আশি ছুঁইছুঁই বয়সে এসেও রশীদ করীম— সত্য বটে, অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে সেই ১৯৯২ সাল থেকে গৃহবন্দি, হারিয়েছেন বই পড়ার ক্ষমতা, লেখার শক্তি— তারচেয়েও গভীর সত্য, তিনি এখনো জীবনমুখী; জীবনকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। তার ইন্দ্রিয় এখনো যথেষ্ট সচল, উপলব্ধি গভীর, পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ। ধানমন্ডির বাসায় সময়গুলো তার একেবারে নিষ্ফলা কাটে না। বন্ধু-অনুরাগীদের সঙ্গে ফোনে আলাপচারিতার, কখনো অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে সময় দিব্যি কেটে যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার উপন্যাসসমগ্র— যেটিতে ধারণ করা আছে উত্তম পুরুষ, প্রসণ্ন পাষাণ, আমার যত গ্লানি, প্রেম একটি লাল গোলাপ, সাধারণ লোকের কাহিনী, একালের রূপকথা, শ্যামা, বড়ই নিঃসঙ্গ, মায়ের কাছে যাচ্ছি, চিনি না, পদতলে রক্ত ও লাঞ্চবক্সের মতো বাংলা সাহিত্যের এক-একটা হিরে-জহরত-মণি। প্রকাশিত হয়েছে আর এক দৃষ্টিকোণ, অতীত হয় নতুন পুরনায়, মনের গহনে তোমরা মুরতিখানির মতো ঋদ্ধ প্রবন্ধগ্রন্থগুলো নিযে প্রবন্ধসমগ্র। এই যে এক মলাটের ভেতর গ্রন্থিত হয়েছে তার উপন্যাসসমগ্র কিংবা প্রবন্ধমালা— আমাদের কথোপকথন শুরু হয় এ-প্রসঙ্গ নিয়েই।

হামিদ কায়সার: আপনার উপন্যাসসমগ্র বেরিয়েছে, প্রবন্ধসমগ্র বেরিয়েছে— এই মুহূর্তে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
রশীদ করীম: পাঠকরা আমাকে একসঙ্গে মূল্যায়ন করার একটা সুযোগ পেল। আমি এতদিন যা কিছু লিখেছি, তা কেমন হয়েছে তা একসঙ্গে এখন পাঠকরা পড়ূক। আমার কাজের বিচার করার ভার এখন পাঠকদের।

হামিদ কায়সার: উপন্যাস এবং প্রবন্ধ যেমন দু’হাত ভরে লিখেছেন, সে তুলনায় কিন্তু ছোটগল্পের পরিমাণ অনেক কম। অথচ শুরুটা হয়েছিল ছোটগল্প দিয়েই।
রশীদ করীম: হ্যাঁ, ছোটগল্প দিয়ে।

হামিদ কায়সার: শেষপর্যন্ত ছোটগল্পের চর্চাটা অব্যাহত রইলো না...
রশীদ করীম: দেখো, আমার লেখক জীবনটা শুরু হয়েছিল ছোটগল্প দিয়ে। সেই শুরুর কালটাকে বলতে পারো আমার লেখক জীবনের প্রথম পর্ব। কারণ, সে-পর্বে আমার লেখার মেয়াদটা ছিল চার বছরের।

হামিদ কায়সার: কত সালের কথা সেটা?
রশীদ করীম: ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫। দুর্বিনীত শোনালেও বলতেই হচ্ছে, ওই চার বছরের মধ্যেই, অর্থাৎ ১৬ থেকে ২০ বছরের মধ্যে আমি যে গল্পগুলো লিখেছি, তা বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথম গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল সওগাতে। গল্পের নাম ছিল ‘আয়েশা’। সওগাত সম্পাদনার দায়িত্ব ছিলেন আহসান হাবীব। প্রথম দিন থেকেই আহসান হাবীব প্রচুর উৎসাহ দিলেন। ফররুখ আহমদ তো পিঠ চাপড়ে দিলেন। তখন আমার বয়স মাত্র ষোলো। সেই থেকে শুরু হলো যাত্রা। একে একে প্রকাশ পেল জিজ্ঞাসা, মনস্তত্ত্ব, ডায়েরি, একটি মেয়ের আত্মকাহিনী, অল্প স্বল্প গল্প, ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই, মুহূর্ত, তাইতো, চিঠি, কাহিনী নয় ইত্যাদি। একটি মেয়ের আত্মকাহিনী পাঠ করে বুদ্ধদেব বসু অবাক হয়েছিলেন। মাত্র ষোলো-সতেরো বছর বয়সের এক ছেলের কৃতিত্বের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য তার পূর্ব্বাশায় চেয়ে নিয়ে আমার গল্প ছাপান। এখানে আমি একটা শঠতা করি। ডায়েরি নামে আমার একটি গল্প প্রকাশিত হয় আগেই। পূর্ব্বাশায় নাম বেরুবার লোভে সেই গল্পটিকেই আমি অভিভাবক বলে চালিয়ে দিই।

হামিদ কায়সার: কিন্তু আপনি যেসব গল্পের নাম উল্লেখ করেলেন, তার প্রায় কোনোটাই তো আপনার একমাত্র গল্পের বই প্রথম প্রেম-এ সংকলন করেননি, একমাত্র চিঠি এবং কাহিনী নয় ছাড়া।
রশীদ করীম: আমার সেই প্রথম জীবনের গল্পগুলো প্রায় হারিয়ে গেছে, যে-দুটোর উল্লেখ করলে, মাত্র ও-দুটো উদ্ধার করতে পেরেছি।

হামিদ কায়সার: এই যে এত জোরেশোরে গল্প লিখতে শুরু করেছিলেন, প্রশংসাও ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে, তাতে হঠাৎ রাশ টেনে নিলেন কেন?
রশীদ করীম: সেও এক গল্প, বুঝলে! আমার এক বাল্যসখী ছিল— বয়সে দু’বছরের ছোট, কিন্তু মাথায় অনেক বুদ্ধি রাখত। কাছাকাছি একটি বাড়িতেই তারা থাকত এবং মেয়েটির আর একটি গুণ ছিল— যে গুণটি আমাদের অনেকের জন্য বিপজ্জনক প্রমাণিত হয়েছিল। সে দেখতে ছিল সুন্দরী। সেই বয়সেই আমরা অনেকগুলো ছেলে একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু সে নিজে যে কার এমনকি আদৌ কারো প্রেমে পড়েছে কিনা, একেবারেই বোঝা যেত না। অন্য স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকার জন্য লেখা আমার গল্পের খাতাটি যে কী করে একদিন সেই হৃদয়হীন মেয়েটির কাছে পৌঁছল, তা জানি না। সে বললো, লেখাটি যে ফেলে রেখে দিয়েছো। আমি বললাম, ক্লাসের হাতে-লেখা পত্রিকার জন্য লিখেছিলাম। কী করে যে শেষ করতে হবে, বুঝতে পারছি না। সে বললো, গল্পটি তো শেষ হয়েই গেছে। আমি দ্বিতীয়বারের মতো লেখাটি পড়লাম। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে! এভাবেও তো শেষ হতে পারে। সেই শুরু হলো আমার গল্প লেখা। তারপর তো গল্প লেখা চললোই, থামলো গিয়ে ১৯৪৫ সালে।

হামিদ কায়সার: কারণ?
রশীদ করীম: কারণ সেই মেয়েটাই। তখন ওর বিয়ে হয়ে গেল। আমারও গল্প লেখার প্রয়োজন ফুরালো।

হামিদ কায়সার: তারপর আর কোনো গল্পই লিখলেন না?
রশীদ করীম: মাঝে পঞ্চাশের গোড়ার দিকে  সৈয়দ নুরুদ্দীনের অনুরোধে সংবাদ-এর জন্য একটি গল্প লিখি এবং ঢাকা থেকে প্রকাশত মাসিক মোহাম্মদীতে আরেকটি। ১৯৬১ সালের আগে আর কোনো গল্প উপন্যাসই লিখিনি। ১৯৬১ সাল থেকে, বলতে পারো, শুরু হলো আমার সাহিত্যজীবনের নতুন অধ্যায়।

হামিদ কায়সার: সে সময়ে তো আপনি ঢাকায়। কলকাতা থেকে অনেক আগেই চলে এসেছেন।
রশীদ করীম: হ্যাঁ। কলকাতা থেকে তো চলে এসেছি তারও দশ বছর আগে। ১৯৫০ সালের ১৫ মার্চ স্থায়ীভাবে ঢাকায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) চলে এলাম ক্যালটেক্সের চাকরি নিয়ে।

হামিদ কায়সার: আমরা বলছিলাম ১৯৬১ সালের কথা, আপনার সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো।
রশীদ করীম: আমার প্রথম উপন্যাস উত্তম পুরুষ প্রকাশিত হলো।

হামিদ কায়সার: প্রায় ১৬ বছর পর। কেন এই নীরবতা?
রশীদ করীম: কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েছিলাম। মাঝখানে কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসা। গল্পের উপাদানও চট করে আসে না। সাহিত্যের প্রতি মনোযোগও কমে গেল। এসব কারণেই হবে।

হামিদ কায়সার: এই ১৬ বছরে সাহিত্য থেকে নিশ্চয়ই একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেননি?
রশীদ করীম: সেটা কখনো হয়নি। ঘুমের মধ্যেও সাহিত্যবোধ কাজ     করে। সাহিত্যবোধ সর্বক্ষণ ফল্গুধারার মতো মনের কোণে  আনাগোনা করে।

হামিদ কায়সার: তাহলে এই দীর্ঘ নীরবতা মধ্যেই উত্তম পুরুষ লেখা হলো?
রশীদ করীম: উত্তম পুরুষ লিখতে আমার অনেক সময় লেগেছে। কিছুদূর লিখে অসমাপ্ত পড়ে থাকে। ধীরে ধীরে লেখা হয়েছে। অনেকদিন ধরে। আর যদ্দুর মনে পড়ে, প্রথম বয়সে আমি যেসব গল্প লিখি, তার দু-একটি উত্তম পুরুষ-এ অনুপ্রবেশ করে।

হামিদ কায়সার: লেখা হওয়ার পরই কি গ্রন্থাকারে বেরিয়েছিল?
রশীদ করীম: না। সিকানদার আবু জাফরকে কলকাতায় থাকতেই জানতাম। তিনি আমার গল্পের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ঢাকায় এসে, যাই হোক, তিনি যখন শুনলেন, আমি একটা উপন্যাস শেষ করেছি, বললেন, দেরি করছো কেন? আমাদের দিয়ে দাও, সমকালের জন্য এক কিস্তি করে লেখা পাঠাতে লাগলাম। এভাবে কয়েকটা ইনস্টলমেন্ট ছাপা হওয়ার পর উত্তম পুরুষ প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল।

হামিদ কায়সার: কারণ?
রশীদ করীম: সমকাল সম্পাদক বললেন, লেখাটা বড্ড কম্যুনাল। যাই হোক, ১৯৬১ সালে আনিস ব্রাদার্স উত্তম পুরুষ প্রকাশ করল।

হামিদ কায়সার: উত্তম পুরুষ পড়লে মনে হয় আপনার নিজস্ব জীবনাভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে আছে উপন্যাসটি।
রশীদ করীম: উত্তম পুরুষ বহুলাংশে আত্মজৈবনিক। তবে লেখকের কল্পনার সংযোগও আছে। আমার শৈশব-কৈশোরের দেখা কলকাতাকে আমি বিশ্বস্তভাবে আঁকতে চেষ্টা করেছি।

হামিদ কায়সার: অন্তরঙ্গ আলেখ্য বলেই কিনা উত্তম পুরুষ সেই সময়ের কলকাতার মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে।
রশীদ করীম: সেটা বিচারের ভার পাঠকদের।

হামিদ কায়সার: বিশাল ক্যানভাসে রচিত মায়ের কাছে যাচ্ছিতেও কি আপনার পারিবারিক অভিজ্ঞতার ছোঁয়া আছে?
রশীদ করীম: আছে, আছে।

হামিদ কায়সার: এ উপন্যাস কি আপনি ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে লিখেছেন?
রশীদ করীম: না। সবগুলো উপন্যাসই আমার একইভাবে লেখা, আর যা লিখেছি চেনা-জানা জগৎ নিয়েই লিখেছি। যা জানি না, চিনি না, সেদিকে পা বাড়ানোর চেষ্টাও করিনি।

হামিদ কায়সার: সম্ভবত সে কারণেই নগর জীবনকেন্দ্রিক আপনার উপন্যাস...
রশীদ করীম: সারা জীবন তো নগরে নগরে কেটেছে। গ্রামে থাকার     সুযোগ আসেনি। একেবারে যে জানি না তা নয়। যাওয়া-আসা হয়েছে কিন্তু ভাসা-ভাসা অভিজ্ঞতা নিয়ে  কি উপন্যাস লেখা সমীচীন?

হামিদ কায়সার: ১২ টি উপন্যাসের মধ্যে আপনার সবচেয়ে প্রিয় কোনটি?
রশীদ করীম: ফেভারিট উপন্যাস যেটাকে বলে থাকে, সেরকম কোনো ফেভারিট আমার নেই। আমি অপরকে বলতে শুনেছি অমুক উপন্যাসটি আমার পছন্দ হয়েছে এবং আরেক দল পাঠককে দেখেছি আরেকটা উপন্যাসের কথা উল্লেখ করতে— এই রকম। তবে আমার মনে হয়, উপন্যাসগুলোর মধ্যে পদতলে রক্ত সেরকম মনে হয়নি কারো। হয়তো এটি অপেক্ষাকৃত মন্দ। শোনো আরেকটি কথা, আমাকে সবাই বলে বিরলপ্রজ ঔপন্যাসিক। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মাত্র ৩টি উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তাকে কেউ বিরলপ্রজ বলে না। বিরলপ্রজ কী? বহু বিশিষ্ট ঔপন্যাসিকের উপন্যাস সংখ্যা এখানে ভেবে দেখতে পারি। জেন অস্টেন, এমিলি ব্রন্ট, শার্লোট ব্রন্ট, ই এম  ফরস্টার, ভার্জিনিয়া উল্ফ। আর কত দৃষ্টান্ত দেবো। আমেরিকাতেও বহু বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ছিলেন যারা হাতেগোনা উপন্যাস লিখেছেন।

হামিদ কায়সার: উত্তম পুরুষ দিয়েই আপনার সাহিত্যিক জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হলো...
রশীদ করীম: এরপর থেকে নিয়মিত লিখেছি। ওই যে, একবার তো     বলেইছি, সহিত্যবোধ আমার মনের কোণে সর্বক্ষণই ফল্গধারার মতো বয়ে চলেছে। উত্তম পুরুষ-এর সাফল্য হয়তো নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করে থাকবে। বইটি প্রকাশ হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন কাগজে লেখালেখি হয়। অনেক সমঝদারই প্রশংসা করেন।  একই সঙ্গে বইটি তখনকার সময়ের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ‘আদমজী পুরস্কার’ লাভ করে।

হামিদ কায়সার: উত্তম পুরুষ-এর পর লিখলেন প্রসন্ন পাষাণ...
রশীদ করীম: প্রসন্ন পাষাণ পাকিস্তান আমলে লেখা। উত্তম পুরুষও তাই। তখন আমার স্বাধীনভাবে লেখার বাধা ছিল। ক্যালেটেক্স পাকিস্তান-বিরোধী কোনো লেখা কর্মচারীদের কাছ থেকে আশা করত না। কারণ, তাদেরকে পাকিস্তানে থেকেই ব্যবসা করতে হতো। উত্তম পুরুষ এবং প্রসন্ন পাষাণ পাকিস্তান আমলে লেখা, এ দুটো বই আমি লিখি কলকাতার পটভূমিতে এবং দেশ স্বাধীন হবার আগের পরিবেশ।

হামিদ কায়সার: তাহলে, দেশ স্বাধীন হবার পর নতুন চেতনায় উজ্জ্বীবিত হলেন?
রশীদ করীম: বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমার আগেকার বাধা চলে গেল। লিখলাম আমার যত গ্লানি। ক্যালটেক্স হলে তাদেরকে বাংলাদেশকে স্বীকার করতেই হলো। কারণ, তখন তারা বাংলাদেশেই ব্যবসা করবে। প্রথম দুটি উপন্যাস সহজভাবেই লিখেছি কলকাতার পটভূমিতে, কিন্তু পরোপুরি সৎ থাকতে পারিনি। আমার যত গ্লানি থেকে যা কিছুই লিখেছি, নিঃসংকোচ লিখেছি, মনের মধ্যে কোনোরকমের বাধা আসেনি।

হামিদ কায়সার: চিনি না স্বাধীনতার পটভূমিতেই লেখা।
রশীদ করীম: চিনি না স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। কিন্তু লেখা হয়েছে স্বাধীনতার অনেক পর।

হামিদ কায়সার: মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কী করে চাকরির জন্যে নিজের বিরুদ্ধে নিজেকেই এক ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়— চিনি না সেই জায়গাটিকেই চিনিয়েছে।
রশীদ করীম: লাঞ্চবক্স কেমন লেগেছে তোমার?

হামিদ কায়সার: ভালো। আপনার বর্ণনার রহস্যময়তা, চরিত্রগুলোকে নিয়ে কৌতুককর বর্ণনা এবং রোমাঞ্চের অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়ার দক্ষতা— খুবই আধুনিক একটি উপন্যাস। এবার একটু জানতে চাচ্ছি, আপনি কীভাবে লেখালেখিতে এলেন, কোন প্রেরণায়?
রশীদ করীম: প্রেরণা কী জানি না। লিখবার ইচ্ছে সর্বক্ষণ মনের মধ্যে ছিল। সে-তাগিদেই লিখেছি। কেউ প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করেনি। কিন্তু লেখার পরিবেশ আমাদের বাড়িতেই ছিল। প্রথমত আবু রুশদ ছিলেন। তিনি ১৯৪০ সাল থেকেই লিখতে আরম্ভ করেন। সেগুলো পড়তাম। তাছাড়া আমার এক দাদা আবদুস সালাম মূল ফারসি থেকে ইংরেজিতে রিয়াজুস সালাতীন অনুবাদ করেন। সেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে পাঠ্য ছিল। তিনি ছিলেন আমার আপন দাদার সহোদর, তৎকালীন কলকাতা অ্যাডিশনাল চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি আমাকে ডেকে বসিয়ে অনেক গল্প শোনাতেন। আমার আপন দাদা খান সাহেব আবদুর রহিমও  ছিলেন সমাজের  বিশিষ্ট মানুষ, পেশায় ছিলেন ক্যালকাটা পুলিশর চিফ ইনস্পেক্টর। সেটা বড় ব্যাপার না। বড় ব্যাপার হলো, তাঁদের দু’জনের সংগ্রহে বহু দুর্লভ বই ছিল।

হামিদ কায়সার: বই তো মানস-গঠনে ভূমিকা রাখে, আপনি তাহলে শৈশব থেকেই বই পড়ার সুযোগ পান?
রশীদ করীম: হ্যাঁ, হ্যাঁ। বই পড়ার অভ্যাস সেই ছোটবেলা থেকেই।

হামিদ কায়সার: বইয়ের সঙ্গে আপনার সখ্য কীভাবে হলো, কীভাবে বইয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন, জানতে কৌতূহল হচ্ছে।
রশীদ করীম: আমার প্রথম বই পড়ার ঘটনাটা খুব আকস্মিকভাবেই ঘটে যায়। তখন আমি স্কুলে পড়ি। কোন ক্লাসে মনে নেই।  মনে আছে সেটা রোজার মাস, অর্থাৎ রমজান। বোধহয় তখন শীতকালও ছিল। আমি রোজকার মতো সেদিনও আমার চাচা এবং চাচির বাড়ি বেড়াতে যাই। আমার চাচা সৈয়দ আবুল ফিদাহ এবং চাচি রওশন আরা বেগম।  রওশন আরা বেগম ছিলেন অধ্যাপক হুমায়ুন করিরের আপন বোন।

হামিদ কায়সার: হুমায়ুন কবির? চতুরঙ্গের?
রশীদ করীম: চতুরঙ্গের। অত্যন্ত নামকরা ছাত্র ছিলেন, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। তদুপরি ছিলেন লেখকও। যাই হোক, চাচা-চাচির বাড়ি এসে আমি ঘুরঘুর করছি। হঠাৎ দেখি, আলমারির উপরে চরিত্রহীন বইটি রাখা আছে। দেখলাম, লেখকের নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বেশ মোটাসোটা বই। এ বইটি বোধকরি আমাদের— ছোটদের পড়া নিষেধ ছিল। তবে আমি চুপ করে সেটি নিয়ে আঙিনায় রাখা একটি চেয়ারে এসে বসলাম। কখন যে বইটির মধ্যে একেবারে ডুবে গেছি সে হুঁশ নেই। সকাল গেল, দুপুর গেল, অপরাহ্ন গেল, মাগরেবের নামাজের সময় হয়— হয়, কিন্তু আমি তখনো বইটি একবারে উন্মাদের মতো পড়ছি। চাচা ও চাচাতো ভাইবোনেরা ইফতারের জন্য ডাকলেন। শুধু তখনই আমি উঠলাম। এইভাবে, বোধকরি তিন দিনে আমি চরিত্রহীন শেষ করি। মনে হলো, এমন আশ্চর্য সুন্দর বই আগে কখনো পড়িনি। তখন থেকে খুঁজে পেতে আমি শরৎচন্দ্রের সবকটি বই পড়ে ফেললাম। শরৎচন্দ্র সম্বন্ধে পরে আমি আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে শুনেছি যে, তাঁর ছোট উপন্যাস বা বড়গল্প নিষ্কৃতি ও মেজদিদি ভালো। বড় উপন্যাস সম্পর্কে তিনি চুপ থাকেন। আইয়ুবের প্রতি কোনো অসম্মান না দেখিয়েই বলতে পারি যে, শরৎচন্দ্রকে উপেক্ষা করা একটা ফ্যাশন। আমি বুঝি না, কেন এই উপেক্ষা করার ট্র্যাডিশন। আমার মতে, শরৎচন্দ্রই বাংলা সাহিত্যের শেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। রোমাঁ রোলাঁ শ্রীকান্তর ইংরেজি অনুাবদের ফরাসি অনুবাদ পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, যিনি এই বই লিখতে পারেন, তাঁর নোবেল প্রাইজ পাওয়া উচিত।

হামিদ কায়সার: শরৎচন্দ্র ছাড়া প্রথমদিকে আর কারো উপন্যাস...
রশীদ করীম: হ্যাঁ। পড়েছি। সেই সময়ে আমি বাংলা বই সম্বন্ধে সচেতন হলাম। সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে পেতে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো শেষ করলাম। তারপরই প্রথম চৌধুরীর ছোটগল্পগুলো নিজে পড়লাম এবং অপরকে পড়ালাম। পরবর্তীকালে আমার সবচাইতে প্রিয় লেখকের স্থান নেন দস্তয়েভস্কি। তাঁর ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ব্রাদার্স কারামাজভ এবং দি ইডিয়ট— এই বড় তিনটি গ্রন্থ তো আছেই, কিন্তু তিনি যে কত বড় লেখক তা বুঝতে পারি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের দুটি ছোট হাস্যরসাত্মক উপন্যাস পাঠ করে। যে দু’টি উপন্যাস হলো মাই আংকল্স ড্রিম এবং দি গ্যামব্লার। বোধকরি, একটি তৃতীয় হাস্যরসাত্মক ছোট উপন্যাসও আছে, কিন্তু সেটার নাম ভুলে গেছি। দস্তয়েভস্কি কয়েক বছর সাইবেরিয়ায় ছিলেন। সেখানে তিনি মানুষের পীড়ন ও দুঃখ-দুর্দশার কথা অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে জানতে পারেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। আঁদ্রে জিদ বলেছিলেন, সাহিত্যে শেক্সপিয়রের পরেই দস্তয়েভস্কির নাম। দস্তয়েভস্কি, তলস্তয় ও তুর্গেনিভ যে উপন্যাসের ব্যূহ সৃষ্টি করেছেন, সেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। উপন্যাসে তাঁরাই শ্রেষ্ঠ।

হামিদ কায়সার: বাংলা ভাষায় কাদের উপন্যাস আপনি পড়েছেন— আপনার এ বিষয়ে পাঠ-অভিজ্ঞতা জানতে চাচ্ছি।
রশীদ করীম: বঙ্কিমচন্দ্র তো বাংলা উপন্যাসের জনক। তাঁর কথা ছেড়ে দিলাম। রবীন্দ্রনাথের গোরা এবং যোগাযোগ খুবই উচ্চাঙ্গের উপন্যাস। শরৎচন্দ্রের কথা বলেছি। বিভূতিভূষণের আরণ্যক এবং আদর্শ হিন্দু হোটেল আমার ভালো লাগে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসটি আমার প্রিয়। তাছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি উৎকৃষ্ট ছোটগল্প লিখেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আমার ভালো লাগে না। তাঁর পদ্মানদীর মাঝি এবং পুতুলনাচের ইতিকথা বই দুটিকে কিছুটা বানোয়াট মনে হয়। এ দুটি উপন্যাসের নায়িকা অবিকল এক রকম। আমার প্রিয় লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র। তাঁর দ্বীপপুঞ্জ এবং চেনামহল উৎকৃষ্ট উপন্যাস। তাছাড়া তিনি গল্প লিখেছেন অতিশয় চমৎকার। গল্প লেখক হিসেবে অবশ্য প্রেমেন্দ্র মিত্রেরও নাম করতে হয়। তিনি খুব সুন্দর গল্প লিখেছেন। আরেকজন ঔপন্যাসিকের নাম করবো, তিনি গৌরকিশোর ঘোষ, তাঁর জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেই, আরেকটি যেন কী নাম— এই ট্রিলজি স্মরণ করিয়ে দেয় ইংরেজি উপন্যাসের মানদণ্ড। তিনি খুব উঁচুদরের লেখক, যদিও তাঁর প্রেম নেই উপন্যাসে একটি পরিচ্ছেদ আছে, সেটা হেমিংওয়ের দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি গ্রন্থটির কথা মনে করিয়ে দেয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ভালো লেখেন, অবশ্য এখনকার উপন্যাসের আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমরা, যারা  আগেকার আমলের লোক, তারা ঠিকমতো তাঁদেরকে অনুধাবন করতে পারব না। আজকালকার উপন্যাস ‘সেরিব্রাল’ হয়, হৃদয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকটা কম। যেমন, অবুন্ধতী রায়ের ইংরেজি উপন্যাস দি গড অফ স্মল থিংস বইটির কথা বলা যায়। বইটি আমি পড়িনি আমার চোখের কারণে। কিন্তু বিশ্বময় অনেকেই পড়েছেন।

হামিদ কায়সার: এবার বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের কথা বলূন, কার কার লেখা পড়েছেন, কেমন লেগেছে।
রশীদ করীম: বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে আমি আবু রুশদ,     শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আহমদ ছফা, মঈনুল আহসান সাবের প্রমুখের লেখা পড়েছি। আবু রুশ্দের একটি গুন আছে যা ঐতিহাসিক, কেউ কেড়ে নিতে পারবে না তাঁর কাছ থেকে। তিনি সর্বপ্রথম মুসলিম নাগরিক মধ্যবিত্তদের নিয়ে উপন্যাস ও গল্প লেখেন। শওকত ওসামানের জননীর একটি পরিচ্ছেদ আছে যেটি এপিক গ্র্যানজার লাভ করেছে। আমি আমার প্রবন্ধ সংকলন আর এক দৃষ্টিকোণ গ্রন্থে আবু রুশ্দ এবং শওকত ওসমান সম্পর্কে লিখেছি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং তাঁর লালসালু সম্পর্কেও লিখেছি। আমার মনে হয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে একটু বাড়াবাড়ি করা হয়। তবে তাঁর চাঁদের অমাবস্যা একটি স্মরণীয় উপন্যাস। শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা একটি ভালো উপন্যাস। তাছাড়া তিনি ভালো কিছু গল্পও লিখেছেন। তাঁর গল্প কেরায়া নায়ের মাঝি মনে পড়ে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের দ্বিতীয় উপন্যাসটি আমার পাঠ করা হয়নি চোখের কারণে। সকলেই এই উপন্যাসটির খুব প্রশংসা করেন। কিন্তু, তাঁর প্রথম উপন্যাস চিলেকোঠার সেপাই আমি পড়েছি। আমার ভালো লাগেনি। হুমায়ূন আহমেদ নন্দিত নরকে লিখে বেশ চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর শংখনীল কারাগারও মন্দ নয়। কিন্তু তিনি এত লিখছেন কেন? ইমদাদুল হক মিলনের নূরজাহান উপন্যাসটি আমার পড়া হয়নি চোখের কারণে। মঈনুল আহসান সাবে রের পরের দিকের কোনো বইই আর হাতে আসেনি। তবে উপরোক্ত তিনজন সম্পর্কে আমার সেই একই কথা, এত লেখেন কনে? পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো বিশ্ববিখ্যাত লেখক এত বেশি উপন্যাস লেখেননি। আমাদের মধ্যে এই যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, সেটি কি পশ্চিমবঙ্গের প্রভাব। উপন্যাস পণ্যবস্তু নয়। একই উপন্যাসের পুনরাবৃত্তি করে কী লাভ? আমাদের কয়েকজন লেখিকা আছেন, যাঁরা পুরুষদের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারেন। আসলে পুরুষ লেখক আর নারী লেখিকা বলে আলাদা কিছু নেই। শামস রশীদ, রাজিয়া খান, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন প্রমুখ আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। সৈয়দ শামসুল হক আমাদের একজন বিশিষ্ট লেখক এবং রাহাত খানও উল্লেখযোগ্য। হাসান আজিজুল হক খুব ভালো গল্প লিখেছেন। যদিও আমি শারীরিক কারণে তাঁর লেখা সম্প্রতি পড়তে পারিনি, তবে আমার মনে হয়, দশ-পনেরো বছর ধরে হাসান আজিজুল হক কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেছেন। হাসনাত আবদুল হাই আরেকটি উজ্জ্বল নাম। তিনি অনেকগুলো সুন্দর গল্প লিখেছেন। একেবারে শেষে বলছি মাহমুদুল হকের কথা। কিন্তু শেষ মানেই তিনি উপক্ষেণীয় নন। বরং তিনি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক। যদিও এখন তিনি বোধহয় আর লিখছেন না। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক। তাঁর নিরাপদ তন্দ্রা ঈদসংখ্যা বিচিত্রায় পড়ে আমিই সর্বাগ্রে আলোচনা করছি, তখন তাঁর কোনো বই বেরোয়নি।

হামিদ কায়সার: আপনার মধ্যে এ ব্যাপারটি বেশ দেখা গেছে, আপনার সমসায়িক কালে বা আপনার আগে-পরে যাঁরা ভালো লিখেছেন আপনি তাঁদের নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখেছেন।
রশীদ করীম: সেটা একরকম কর্তব্য মনে করেই লিখেছি। মাহমুদুল হক এত অসাধারণ উপন্যাস লেখেন, অথচ তখনো তাঁর কোনো বই ছিল না। তাই আমি লিখলাম তাঁর সম্পর্কে। তাঁর সম্পর্কে সম্ভবত সেটাই প্রথম মূল্যায়ন। আহমদ ছফা সম্পর্কেও আমিই প্রথম লিখেছি। এই তোমার সম্পর্কেও তো আমিই একমাত্র লিখেছি, আর কেউ লিখেছে?

হামিদ কায়সার: আমার প্রসঙ্গ থাক।
রশীদ করীম: এমনকি, শামসুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক তখন রীতিমতো নাম করেছেন। আমি তাঁদের সম্পর্কেও মর্নিং নিউজ পত্রিকায় দুটি পৃথক প্রবন্ধ লিখি। আমি, এ ব্যাপারে, বলতে পারো, অকুষ্ঠ। আমার যতদূর মনে পড়ে এ দুটিই ছিল তাঁদের নামে প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ।

হামিদ কায়সার: এই স্বতঃস্ফূর্ততা, ঔদার্য, এখন লক্ষ্য করা যায় না।
রশীদ করীম: আমি সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে কারো চাইতে বড় মনে করি না। ছোট-বড় চিন্তা আমার মস্তিষ্কেই আসে না। সংসারের কাজ, স্ত্রী-কন্যার চিন্তা, এমনকি রাত্রিবেলা শয়ন করবার সময়ে যেসব চিন্তা ফল্গুধারার মতো আমার মনের মধ্যে আনাগোনা করে, তাই-ই সম্পূর্ণ চেতন অবস্থায় আমি লিখেছি। সেগুলোর ভালোমন্দ সম্পর্কে কোনো চিন্তাই করিনি। পুরস্কার পেলেও আমি মোটামুটি নির্বিকার থাকি এবং পুরস্কার না পেলেও তাই।

হামিদ কায়সার: পুরস্কার সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
রশীদ করীম: পুরস্কার লাভের যোগ্য মনে করলে তারা আমাকে পুরস্কার দেবেন। সেজন্য আমি মাত্রাতিরিক্ত উদ্গ্রীব নই। এখন বয়স হয়ে গেছে। তবে, পুরস্কারের সঙ্গে যে অর্থ সংলগ্ন থাকে, সেটা খুবই স্বাগতম।

হামিদ কায়সার: এবার একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন, শামসুর রাহমানের সঙ্গে আপনার একটা নিখাঁদ বন্ধুত্ব আছে, যা দীর্ঘ যুগ পর এখনো অটুট। তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রপাতটা হয়েছিল কীভাবে?
রশীদ করীম: শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কবে হয়, সেটা আমি একবারেই জানি না এবং শামসুর রাহমান লিখেছেন, তিনিও বোধহয় সঠিক জানেন না। তবে সাবের রেজা করিমের সঙ্গে সিনেমা দেখবার সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয় বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। সাবের রেজা করিম পরে সিএসপি হন। তাঁকে আমি ছাত্রাবস্থাতেই কলকাতা দেখি। তবে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আসল পরিচয় হয় কবি আবুল হোসেনের বাড়িতে, যখন আমি কবি আবুল হোসেনের সঙ্গে একত্রে বাস করি।

হামিদ কায়সার: তাই নাকি! কবে সেটা, কখন?
রশীদ করীম: আবুল হোসেনের সঙ্গে তো আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের— সেই কলকাতা থেকে, বোধকরি ১৯৩৭ সাল থেকে। তিনি ছিলেন আবু রুশ্দের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্র ধরেই ঢাকায় আসার পর আবারো ঘনঘন যোগাযোগ হতে থাকে। ১৯৫২ বা ১৯৫৩ সালে এক বছরের জন্য বোধহয় আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। তখন থেকেই শামসুর রাহমানের সঙ্গে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং আমি আবিষ্কার করি, তাঁর সঙ্গে আমার সাহিত্যিক চিন্তার মিল অনেকখানিই। অবশ্য কোনো কোনো অমিলও আছে। তারপর, ঢাকায় একে একে শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, খান সারওয়ার মুরশিদ, হাসনাত আবদুল হাই, বেলাল চৌধুরী, এখলাসউদ্দিন আহমেদ, কায়সুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় থেকে ধীরে ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব, যাই বলি, গড়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কলকাতায় থাকার সময়ে শওকত ওসমন, ফররুখ আহমদ এবং আহসান হাবীবের সঙ্গে আমার পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাছাড়া আরো একজনের কথা বলতেই হয়— তিনি আতাউর রহমান, চতুরঙ্গে সম্পাদকীয়তে কাজ করতেন, একই সঙ্গে নবযুগ পত্রিকাতেও কাজ করতেন। একটা কথা বলি, জীবনে যাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে, তা এখনো অটুট রয়েছে।

হামিদ কায়সার: ঠিক আপনার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্কের মতোই, যা সময়কে জয় করে যুগোত্তীর্ণ হতে চলেছে। আপনি দীর্ঘজীবী হোন।
রশীদ করীম: আচ্ছা। ধন্যবাদ।

জানুয়ারি ২০০৪, কালি ও কলম