দিন যায় কথা থাকে

পর্ব ২৯

হামিদ কায়সার

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৮, ২০১৯

তারা কেউ গান শুনিয়েছেন। কেউ লিখেছেন হিরন্ময় কবিতা। কেউ আবার গল্প-উপন্যাসের মালা গেঁথে সাজিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের ঢালি। কেউ বা নিরলস জ্ঞানচর্চায় যোগ করেছেন বুদ্ধিবৃত্তির নতুন মাত্রা। তাদের সেই দিন আজ আর নেই, কেউ হারিয়ে গেছেন মহাকালে, কেউ বা এক পা বাড়িয়ে রেখেছেন সেই পথে। তবে তাদের কথা আছে; তাদের কর্মে আর সৃজনশীলতায় তো বটেই, আমার কাছেও— কাগজের ভাঁজে ভাঁজে, শব্দগুচ্ছের আড়ালে, বিভিন্ন সময়ে গৃহীত সাক্ষাৎকারে। হয়তো সেই কথাগুলো আবারো জেগে ওঠতে পারে আপনার মননস্পর্শ পেলে। চলুন পাঠ নেয়া যাক

আমাদের জাতীয় জীবনের মহান দুটি ঘটনাই শিল্পচর্চায় আমার প্রেরণার মূল উৎস বলে আমি মনে করি— রিজিয়া রহমান

এমএ পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে আগে হঠাৎ মাথায় একটা উপন্যাস লেখার প্লট ভর করল তার। যদিও তিনি খুব মনোযোগী ছাত্র, ভালো ফল করে একটা ভালো ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন তখন, কিন্তু উপন্যাস লেখার ভেতরকার আমন্ত্রণ কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারলেন না। শুরু হয়ে গেল লেখা। মাঝখানে পরীক্ষাটা দিয়ে, পুরো উপন্যাসটিই সমাপ্ত করে ফেললেন পরীক্ষার পরপরই। এইভাবেই লেখা হয়ে গেল প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ভাঙা ঘর’। আর যিনি লিখলেন সেই রিজিয়া রহমান আজ বাংলাদেশের সেরা কথাশিল্পীদের একজন। খুব কমসংখ্যক ঔপন্যাসিকই পেরেছেন প্রথম উপন্যাসে নিজের জীবনের ছায়াকে এড়িয়ে যেতে, রিজিয়া রহমান সেই বিরলপ্রজদেরই একজন। ভেতরের তীব্র তাগিদে যে ঘর ভাঙা ঘর উপন্যাসটি লিখলেন তার বিষয় ছিন্নমূল মানুষের জীবনসংগ্রাম। সর্বগ্রাসী নদীর ভাঙনে ঘর-হারানো, ভিটে-হারানো মানুষগুলোর বস্তি-জীবনকে তিনি এমন বিশ্বস্তভাবে এঁকে ফেললেন, তা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কারো বুঝতে অসুবিধে হলো না, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে এক শক্তিশালী লেখকের আবির্ভাব ঘটলো। ঘর ভাঙা ঘর থেকে সর্বশেষ আবে রওয়াঁ পর্যন্ত তিরিশটার বেশি গল্প-উপন্যাস গ্রন্থ তিনি লিখেছেন, তার সহজাত সহজ সরল স্বচ্ছ সুন্দর ভাষার নিপুণ অলঙ্কারে, যার প্রতিটিতেই রয়েছে জীবনকে দেখার গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি, বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, নিরীক্ষা-প্রবণতা আর নিজেকে ক্রমশ উত্তরণের অভীপ্সা। লেখালেখির প্রতি তিনি এতটাই অন্বিষ্ট যে, বড় চাকরির প্রলোভন এড়িয়েছেন, ছেড়ে দিয়েছেন কলেজের অধ্যাপনা। ধ্যানীর মতোই নিমগ্নতা নিয়ে ডুবে রয়েছেন সৃষ্টিশীলতার অলৌকিক আনন্দ-বেদনার জগতে। তার সঙ্গে কথোপকথন চললো তার সৃষ্টিসম্ভার ও তার প্রক্রিয়া নিয়ে।

হামিদ কায়সার: আপনার লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল তো ছোটগল্পই দিয়েই...
রিজিয়া রহমান: না। আমার জীবনের প্রথম লেখা শুরু করেছিলাম কবিতা দিয়ে। অবশ্য তার কিছুদিন পরেই গল্প লিখেছি।

হামিদ কায়সার: ’ক বছর বয়সে সেটা?
রিজিয়া রহমান: তখন বোধহয় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, বয়স আট-টাট হবে। হোমওয়ার্কের খাতায় হাতের লেখা লিখতে লিখতে, হঠাৎ লিখে বসলাম একেবারে অন্যরকম, নতুন কিছু। তখনো বুঝিনি, সেটা গল্প না কবিতা, শুধু বুঝেছিলাম, অন্যরকম একটা লেখা ভেতর থেকে আসছে। সেই প্রথম বুঝলাম যে, নিজে বানিয়ে কিছু লেখার মধ্যে একটা অনাস্বাদিত আশ্চর্য আনন্দ রয়েছে। এর ক’দিন পরে, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া সেই বালিকাটি অর্থাৎ আমি লিখে ফেললাম পূর্ণাঙ্গ একটি ছন্দের কবিতা। পরে আরেকটি গল্প। আশ্চর্য ব্যাপার, তখনকার লেখা কবিতার কিছু পঙ্‌ক্তি আজো রয়ে গেছে আমার স্মৃতিতে।

হামিদ কায়সার: স্মৃতি থেকে কিছু তুলে আনবেন কি পাঠকদের জন্যে?
রিজিয়া রহমান: চেষ্টা করে দেখি। ‘ঘুমপরি, ঘুমপরি শাদা পাখা উড়িয়ে/খোকা-খুকুদের চোখ ঘুমে দাও জুড়িয়ে/ তারাভরা নীল আকাশ পার হয়ে সাঁতরে/নেমে এসো সব চোখে ঘুম ভরা রাত্ররে’... তবে বলে রাখি, জীবনের প্রথম গল্পটি লিখেছিলাম স্কুলে বসে। টিফিন পিরিয়ডের অবসরে।

হামিদ কায়সার: সেসব লেখা কি প্রকাশিত হয়েছিল? পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ কবে?
রিজিয়া রহমান: না, কোথাও প্রকাশিত হয়নি, আমার স্মৃতিতে কিছু ছাপ রেখে ছেলেবেলার সেই লেখার খাতাটির সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক বছর আগেই। কলকাতার সত্যযুগ পত্রিকায় আমার লেখা যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন পড়ি পঞ্চম শ্রেণিতে। সত্যযুগে ছোটদের পাতায় ছাপার জন্যে একটি কবিতা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ডাকে। আমাকে ভীষণরকম অবাক করে, সেটি ছাপার অক্ষরে এসে গেল, সেই সঙ্গে চিঠিপত্রের কলামে ছোটদের পাতার পরিচালকের চিঠি, ‘রিজিয়া, তোমার কবিতা ভালো হয়েছে, আরো ভালো লিখতে চেষ্টা করো।’ উৎসাহী হয়ে তারপর লিখে পাঠালাম একটি গল্প। সেটিও ছাপা হলো।

হামিদ কায়সার: ওই সত্যযুগেই?
রিজিয়া রহমান: হ্যাঁ। এবারও দাদু লিখলেন, ‘খুব ভালো লেখার হাত তোমার, আরো ভালো লিখতে চেষ্টা করো।’ ছোটদের পাতার পরিচালক এই দাদুই যে খ্যাতনামা লেখক গৌরকিশোর ঘোষ, সেটা জেনেছিলাম অনেক পরে, ১৯৭৪ সনে, যখন তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। এক অনুষ্ঠানে আমার ছেলেবেলার লেখার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি সকৌতুকে বললেন, ‘রিজিয়া, তুমি কি জানো সেই দাদু কে? এই ইনি, যিনি এখন তোমার পাশে বসে আছেন, তোমার গৌরকিশোর দাদা।’ ব্যাপারটায় নাটকীয়তা অবশ্যই ছিল। তবে আজো স্বীকার করি, তার সেই প্রাথমিক চিঠির অনুপ্রেরণা আমার লেখক-জীবন তৈরিতে ছিল অপরিসীম গুরুত্ববহ।

হামিদ কায়সার: এ তো গেল শৈশবের ঘটনা। পরিণত বয়সের লেখালেখিটা শুরু হলো কখন, কিভাবে?
রিজিয়া রহমান: সত্যযুগের পর ঢাকার দৈনিক সংবাদে আমার একটি কবিতা বেরিয়েছিল। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। এরপর ছোটদের পাতা থেকে বিদায়। হয়তো তৈরি হতে থাকলাম বড়দের পাতার জন্যে।

হামিদ কায়সার: কীভাবে সেটা, মানে আপনার এই তৈরি হওয়াটা...
রিজিয়া রহমান: স্কুলের সীমানা পেরিয়েছি, তখন কলেজে গল্প ও কবিতা দুটোই লিখছি, বারবার কেটেছেঁটে নতুন করছি, তবু যেন মনের মতো হয় না। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বইপত্তর পড়ছি প্রচুর... নিজের লেখাকে সেই স্তরে তুলবার আপ্রাণ চেষ্টা আমার। চেষ্টা করেও হয় না মনের মতো, নিজের লেখার সমালোচক তখন আমি নিজেই। মনের গভীরে আকাঙ্ক্ষা, তারাশঙ্কর, মানিক, বুদ্ধদেব বসুর লেখার মতো লিখব... এই সময়ে আমার নানির বাড়ি শাইনপুকুর থেকে বের হতো একটি হাতে লেখা পত্রিকা। নাম যেহেতু। বিশাল লম্বা-চওড়া এবং দশ ইঞ্চি থান ইট সাইজের এই পত্রিকাটির প্রকাশনার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আমার মামা আবদুর রহমান ভুঁইয়া, মায়ের চাচাতো ভাই, বয়সে তরুণ, ঢাকার আর্ট কলেজের ছাত্র। পত্রিকাটির আগাগোড়া চাইনিজ ইংকে লেখা ও ছবি আঁকা এবং প্রচ্ছদ, সূচিপত্র অন্যান্য অঙ্গসজ্জা সবই করতেন আমার এই মামা। এই পত্রিকাতেই তিনি আমাকে একটা গল্প লিখতে বললেন। লিখলাম। সবাই গল্পটার প্রশংসা করল যথেষ্ট।

হামিদ কায়সার: তাহলে ছোটবেলা থেকেই আপনি পেয়েছিলেন একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল।
রিজিয়া রহমান: সম্ভবত। দাদার বাড়ি বিদেশ হয়েছে ’৪৭-এর পর। দাদা গত হয়েছেন তারও আগে। বাবা তখন সবে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছেন। তবে দাদার কথা বড়দের কাছে শুনেছি, তিনি ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় বিস্তর লেখালেখি করতেন। দুর্ভাগ্য আমার, তার লেখা সম্পর্কে জানবার সুযোগ আমার হয়নি। ছেলেবেলায় দেখেছি, দাদার ঘরে দেয়াল-আলমারিতে তার লেখা কাগজ আর বইপত্তর থরে থরে সাজানো। কৌতূহলী হতাম, কিন্তু পড়তে শিখিনি তখনো। পরে আর পড়া হয়ে ওঠেনি। নানার বাড়িতে প্রতি বছর বিশাল অনুষ্ঠান হতো, ঢাকা থেকে অনেক শিল্পী আসত, বয়াতীদেরও আনা হতো। কবিগান, জারি-সারি-ভাটিয়ালিও নানারকম গানের আসর বসতো।

হামিদ কায়সার: এসব আপনাকে প্রভাবিত করেছিল নিশ্চয়ই!
রিজিয়া রহমান: হয়তো। তবে আমার নিজের পারিবারিক পরিমণ্ডলও ছিল লেখক-তৈরির অনুকূল। অর্থাৎ শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা ছিল সেখানে। বাড়িতে ছিল প্রচুর বই। মা ছিলেন বাংলা উপন্যাসের একনিষ্ঠ পাঠিকা। হলে গিয়ে সিনেমা দেখা আর চৌরঙ্গীতে মঞ্চের থিয়েটার দেখা ছিল তার নেশা। গান শুনতেও পছন্দ করতেন— বাড়িতে একটা গ্রামোফোন ছিল। জগন্ময় মিত্রের আধুনিক গান আর নজরুল-সংগীতের রেকর্ড নিজেই কিনে আনতেন। বাবার ছিল কবিতা পড়ার নেশা। ডাক্তারি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কবিতা পড়তেন। বেশ মনে আছে, বাবা মাকে কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন। এস্রাজ বাজাতেন বাবা। বাঁশি বাজাবার দক্ষতাও ছিল। তিনি ছিলেন সংগীতপ্রিয়। কমলা ঝরিয়ার উচ্চাঙ্গ সংগীতের রেকর্ড বাজিয়ে শুনতেন অবসরে। পছন্দের ইংরেজি ফক্সট্রট আর ওয়াল্জ বাজনার রেকর্ড বাজাতেন অনেক রাতে। এই পরিবেশে আমরা ভাইবোনেরা আঁকতাম ছবি, লিখতাম ছড়া, পড়ুয়া ছিলাম প্রায় সবাই। আমার বড়ভাই যিনি এখন একজন নামকরা ডাক্তার— ডাক্তারি পড়ার সময়ে লিখেছিলেন খুব চমৎকার কয়েকটি ছোটগল্প। খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আমার মেজ বোনেরও ছিল ভালো লেখার হাত। মেজভাই ও সেজভাই দুজনই ভালো গিটার বাজাতেন।

হামিদ কায়সার: এই পরিবেশে নিশ্চয়ই আপনাকে লেখক হয়ে ওঠার প্রেরণা জুগিয়েছে। এখন বলুন, পুরোপুরি লেখক হয়ে পাঠকসমাজে আত্মপ্রকাশ ঘটল কখন, কীভাবে?
রিজিয়া রহমান: আমার ছাপা গল্পের প্রথম পাঠক আমার কলেজের ছাত্রী এবং শিক্ষকেরা। আমি তখন ইডেন ডিগ্রি কলেজ ছাত্রী সংসদের সাধারণ সম্পাদিকার পদটি অলঙ্কৃত করছি, অবশ্য নির্বাচনে বিজয়ী হয়েই। সেই সময়েই একদিন, যখন কালচারাল উইকের ব্যবস্থাপনার কাজে ভীষণ ব্যস্ত, আমার সহপাঠী বন্ধু ইউনিয়নের ভিপি হাসনা বলল, ‘ভীষণ ভুল হয়ে গেছে, নাটক প্রতিযোগিতায় ভালো নাটক হাতে নেই। যেটা মঞ্চস্থ হতে চলেছে সেটা একেবারেই সাদামাটা, একঘেয়ে। এখন কী করা যায়! হাতে সময়ও নেই।’ দুঃসাহসী এক কাণ্ড করে বসলাম। ওপর তলায় খালি হলরুমে গিয়ে বসে গেলাম নাটক লিখতে। ক্লাসের রাফ খাতায় লিখে ফেললাম এক হাসির নাটক। হাসনাকে শোনালাম। বললো, ‘চলবে’। মঞ্চস্থ হওয়ার পর ঘটলো অভাবনীয় ঘটনা। প্রশংসার ঝড় বয়ে গেল। পুরস্কারও পেলাম। পরদিন কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় সে নাটকের দৃশ্যের ছবিও ছাপা হলো। এরপরই এলো গল্প-লেখার পালা। কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশের আয়োজন চলছে। সাহিত্য সম্পাদিকা বললেন, নাটক তো খুব ভালো হয়েছে, এবার গল্প লিখতে হবে ম্যাগাজিনের জন্য। নাটকের সাফল্যে আত্মবিশ্বাসী আমি লিখে ফেললাম উপন্যাসের আদলে একটি বড় গল্প,‘অগ্নিস্বাক্ষরা’। সেই প্রথম আমার বড়দের গল্প লেখা। প্রচুর প্রশংসা পেলাম ছাত্রী ও শিক্ষকদের। শুরু হলো কবিতা থেকে গল্পে উত্তরণ। এর পরের সাড়া-জাগানো এবং বিতর্কিত গল্পটি লিখলাম স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে, রোকেয়া হল ম্যাগাজিনে। এ গল্পটি নিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল।

হামিদ কায়সার: কী রকম?
রিজিয়া রহমান: গল্পটিকে অশ্লীলতার অভিযোগে বিতর্কের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল।

হামিদ কায়সার: গল্পটি কি অশ্লীল ছিল?
রিজিয়া রহমান: না, আমার সেটা মনে হয়নি। গল্পটা তুমিও হয়তো পড়েছো, আমার প্রথম বই অগ্নিস্বাক্ষরায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম পরে। নাম ‘লালটিলার আকাশ’।

হামিদ কায়সার: পড়েছি। একটি অ্যাংলো পরিবারের গল্প তো?
রিজিয়া রহমান: হ্যাঁ। এটিও ছিল উপন্যাসের আঙ্গিকে বড় গল্প। কাহিনীটা ছিল অ্যাংলো পরিবারের অবৈধ সন্তান রোজানার জীবনকেন্দ্রিক। এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা ছিল তার জন্মদাতা। তার দেশীয় খ্রিস্টান বাবা তাকে ঘৃণা করত, চাইতো সে ক্যাবারের নর্তকী হবে। কিন্তু রোজানার ইচ্ছা সে মিশনে গিয়ে ‘নান’ হয়ে যিশুর পদতলে জীবন কাটাবে। এই নিয়েই ছিল বিরোধ। সৎ বাবা নাথানিয়েল একদিন রোজানাকে জোর করে হুইস্কি খাইয়ে দেয়। ‘নানের’ পোশাক ও ক্রস চিহ্নিত মালা ছিঁড়ে ফেলে। মানসিক ভারসাম্য হারায় রোজানা— এটুকুর জন্যেই অশ্লীল লেখার অপবাদ এসেছিল আমার প্রতি। রোকেয়া হল ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান আতিকুজ্জামান সাহেব একদিন ডেকে পাঠালেন আমাকে। তিনিই জানালেন আমার ‘লালটিলার আকাশ’ গল্পটি নিয়ে উপদেষ্টা বোর্ডে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। রোকেয়া হলের প্রভোস্টের প্রবল আপত্তি এটি ম্যাগাজিনে দেবার ক্ষেত্রে, তিনি মনে করছেন গল্পটি অশ্লীল এবং নীতি-বিবর্জিত। অথচ গল্পটি অন্য সবার খুব পছন্দ, আতিকুজ্জামান সাহেবের নিজেরও। তিনি পরামর্শ দিলেন, আপত্তিজনক অংশগুলো কেটে বাদ দাও অথবা বদলে দাও। অবাক হলাম। গল্পটি অত্যন্ত শালীন ভাষায় লিখেছি— এর কোথায় অশ্লীলতা আছে, বুঝে উঠলাম না। তিনি বললেন, দেখো, প্রভোস্ট মনে করছেন এ গল্পটি পড়লে হলের মেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে। অবাক হওয়ার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছিল। শুধু বললাম, ‘স্যার, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেবার জন্যে এসেছে, যেখানে ছাত্রছাত্রীদেরকে জীবনের অনেক জৈবিক গভীর বিষয় নিয়ে পড়তে হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের গীতিকবিতায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাও পড়তে হয়— তারা কি এতে খারাপ পথে যাচ্ছে?’ আতিকুজ্জামান সাহেব হাসলেন, বললেন না কিছু। বললাম, ‘আমাকে বলে দিন কোথায় অশ্লীলতা?’ তিনি আমার সঙ্গে একমত, তবু বললেন, ‘তুমি হুইস্কি শব্দটা বদলে দাও’। এটাতেও প্রভোস্টের আপত্তি। বললাম, ‘এর বদলে কোন শব্দ লিখব বলে দিন আপনি।’ আতিকুজ্জামান সাহেব বললেন, ‘লাল পানি লিখলে কেমন হয়!’ হেসে ফেললাম, ‘এ শব্দটাই বরং আমার কাছে বেশি অশ্লীল মনে হচ্ছে।’ চিন্তিত হলেন তিনি। একটু ভেবে বললেন, ‘ইঙ্গিতে লিখলে কেমন হয়! যেমন শরৎচন্দ্র লিখতেন, তিনি অশ্লীল শব্দ সম্পূর্ণ লিখতেন না। শালা লিখতে গিয়ে ‘শ’ লিখে পাশে একটা ড্যাশ দিতেন।’ ভীষণ ঝামেলায় পড়লাম। বললাম, ‘সেটা কি সম্ভব! থাক স্যার, বোর্ডে যখন গল্পটা এতই বিতর্কিত, এটা বরং বাদ দিন।’ জবাব দিলেন না আতিকুজ্জামান সাহেব।বুঝলাম গল্পটি বাদ দিতে মন চাইছে না তার। অমীমাংসিতভাবেই তার সঙ্গে মিটিং আমার শেষ হলো। গল্পটা ছাপা হবে না বলে মনটা বেশ খারাপ হলো।

হামিদ কায়সার: গল্পটা শেষ পর্যন্ত ছাপাই হলো না?
রিজিয়া রহমান: ছাপা হলো, আমাকে অবাক করেই এবং কোনো অংশ এডিট না করেই। বোর্ডের কোনো সদস্যই এতে কলম ছোঁয়াননি। কয়েক দিন পরেই বাংলা বিভাগের এক ছাত্রী এসে খবর দিয়ে গেল, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আমাকে দেখা করতে বলেছেন। গেলাম। তিনি ‘লালটিলার আকাশ’ গল্পটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। জানলাম, তার একান্ত ইচ্ছা ও দৃঢ় পক্ষ সমর্থনের কারণে আমার অশ্লীল-কথিত বিতর্কিত গল্পটি অবিকৃতভাবেই হল ম্যাগাজিনে ঠাঁই পেয়েছে। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বললেন, ‘লেখার হাত তোমার অত্যন্ত বলিষ্ঠ। লেখা ছাড়বে না কিন্তু।’ কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির হল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গল্প দুটিই আমাকে পাঠক-তৈরির সাফল্যের পথ দেখিয়ে দিল। এরপর ইত্তেফাকে ও সাপ্তাহিক ললনায় প্রকাশিত হতে থাকল আমার গল্প। এইসব গল্প নিয়েই প্রকাশিত হলো আমার প্রথম বই অগ্নিস্বাক্ষরা। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়, বইয়ের একটি কপি দিতে গিয়েছিলাম বাংলা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ আবদুল হাইকে। তিনি বললেন, ‘রোকেয়া হল ম্যাগাজিনের গল্পটা তো তুমিই লিখেছ! খুব ভালো লেখার হাত তোমার।’ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’র প্রথম রিভিউ করেছিলেন তিনিই, প্রচারিত হয়েছিল রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে। পরের রিভিউটি করেছিলেন মুনীর চৌধুরী, টিভিতে। প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রতিটি গল্পের ওপর আলোকপাত করে লিখেছিলেন একটি চিঠি। ‘লালটিলার আকাশ’ গল্পটিকে তিনি বলেছিলেন, উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। তার মত ছিল, ‘আপনার হাত থেকে ভবিষ্যতে আমরা হয়তো ভালো উপন্যাস পাবো।’

হামিদ কায়সার: আপনার সাহিত্যজীবনের সূচনালগ্নে দেখছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
রিজিয়া রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞ এই শিক্ষকদের আমার লেখা সম্পর্কে উৎসাহব্যঞ্জক অভিমত আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল নিঃসন্দেহে। তখনই উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা মনে ঝাপটা দিল। এমএ পরীক্ষার আগেই লিখতে শুরু করলাম আমার প্রথম উপন্যাস ঘর ভাঙা ঘর। পরীক্ষার পড়াশোনার চাপে লেখাটি স্থগিত রাখতে হলো। পরীক্ষা শেষ হতেই আবার শুরু করলাম। পরীক্ষার ফল বের হবার আগেই লিখে শেষ করে ফেললাম সেটা। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকল। সাপ্তাহিক ললনায়। আমার জন্য বয়ে আনতে থাকল খ্যাতি আর পাঠকপ্রিয়তা।

হামিদ কায়সার: প্রথম উপন্যাসের এই সাফল্য নিশ্চয়ই লেখালেখিতে আপনাকে নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল, লেখক হবার পরিকল্পনা তখনই নিয়েছিলেন নিশ্চয়ই?
রিজিয়া রহমান: আসলে খুব শখ ছিল অর্থনীতিবিদ হওয়ার। তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মান নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও ভর্তি হয়েছিলাম অর্থনীতিতে। আত্মীয়-স্বজনসহ সবাই তখন বাংলা পড়ার জন্যেই আমাকে চাপ দিচ্ছিল, কারণ ডিগ্রি পরীক্ষায় আমি বাংলা সাহিত্য বিষয়ে রেকর্ড মার্ক পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন মাথায় চেপে আছে অর্থনীতির ভূত। খুব ইচ্ছে, অর্থনীতিতে পাশ করে ডেভেলপিং ইকোনমিক্সের বিষয়ে পিএইচ ডি করব, রিসার্চে যাব। অর্থনীতিতেই সসম্মানে পাশ করে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু, তখন কে জানতো, বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনেই আবার ফিরে আসতে হবে। অথচ বাংলা সাহিত্যের একজন হয়ে ওঠার পরিকল্পনা তখন বিন্দুমাত্র ছিল না। সরকারি কলেজের চাকরির অপেক্ষায় রয়েছি। লেখক হিসেবে নয়, অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলবার প্রস্তুতি তখন আমার চেতনায়—

হামিদ কায়সার: কিন্তু লেখালেখি তো পুরোদমে চলছিল?
রিজিয়া রহমান: হ্যাঁ, তা চলছিল। ঘর ভাঙা ঘর ছাপা শেষ হবার আগেই লিখে ফেললাম দ্বিতীয় উপন্যাস উত্তর পুরুষ। চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিদের নিয়ে। গল্পও লিখছি প্রচুর। প্রশংসাও পাচ্ছি। কিন্তু মনের মধ্যে তখন একটি দ্বন্দ্ব কাজ করতে শুরু করেছে, কোন দিকে যাব! সাহিত্যে, না অর্থনীতির মতো দুরূহ বিষয়ে! এই সময়ে হঠাৎ করে একটি চাকরির দরখাস্ত দিয়ে বসলাম। পাকিস্তান টেলিভিশনে সিনিয়র স্ক্রিপ্ট প্রডিউসারের চাকরি। চাকরিটি হয়েও গেল। কিন্তু আবার সেই দ্বন্দ্ব। কোন দিকে যাব? এ চাকরিতে যোগ দিলে প্রশিক্ষণের জন্যে ছ’ মাস রাওয়ালপিন্ডিতে আর দশ মাস জাপানে গিয়ে থাকতে হবে। ছেলেটি আমার একেবারেই ছোট। ওকে ছেড়ে কেমন করে থাকব, হয়তো সাহিত্যিক হওয়ার অভ্যন্তরীণ শক্তিটিই আসলে ভেতরে ভেতরে আমাকে নিয়ন্ত্রিত করছিল। আর সেটাই ছিল আমার ভবিতব্য। যে কারণে ব্যাংকের চাকরি, প্ল্যানিং কমিশনের চাকরি, টোকিও ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতিতে এমএস করবার স্কলারশিপ— একের পর এক নাকচ করতে থাকলাম। একদিন কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপনার কাজটিও বোঝা হয়ে দাঁড়াল।

হামিদ কায়সার: কবে সেটা?
রিজিয়া রহমান: বং থেকে বাংলা লেখার সময়।

হামিদ কায়সার: তখন লেখালেখিটাই সম্ভবত মুখ্য হয়ে উঠেছে আপনার জীবনে—
রিজিয়া রহমান: হ্যাঁ, সেটা হয়েছে অনেকটা অবধারিতভাবেই। আসলে, এ উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম! মুক্তিযুদ্ধের বিজয়-উদ্দীপনায় স্বপ্নের বাংলাদেশ তখন আমাদের সামনে। বাংলাদেশও বাঙালি জাতির অভ্যুত্থান নিয়ে নতুন চিন্তায় ডুবে থাকি। জাতিসত্তার ঠিকানার অনুসন্ধান এবং কী করে, কেন এবং কতদিনে একটি জাতি ধীরে ধীরে গঠিত হয়েছে, একটি পরিপূর্ণ জাতির মর্যাদায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, সংঘটিত হয়েছে একটি মুক্তিযুদ্ধ— এই তথ্য-অনুসন্ধানে প্রচুর পরিশ্রম ছিল। অবিরাম পড়তে হয়েছে। অর্থনীতিবিদ আমার সত্তাকে বিদায় জানিয়ে সেখানে অধিষ্ঠান হলো একজন সৃজনশীল লেখকের।

হামিদ কায়সার: আগের প্রসঙ্গে একটু ফিরে যাই। প্রায় ক্ষেত্রেই প্রথম উপন্যাসে লেখক নিজের উপস্থিতিকে এড়াতে পারেন না। কখনো প্রবল, কখনো প্রচ্ছন্নভাবে, তার একটি উপস্থিতি থেকেই যায়। কিন্তু আপনার প্রথম উপন্যাস ঘর ভাঙা ঘরে দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ উঠে এসেছে। তারাই সেখানে মুখ্য। আপনি একেবারেই অনুপস্থিত— এটা কেমন করে হলো?
রিজিয়া রহমান: সম্ভবত এটা আমার অর্থনীতি পড়ার কারণেই। অর্থনীতিতে ‘হিস্ট্রি অফ ইকোনমিক থট’ বিষয়টি আমার পাঠ্য ছিল। এর মধ্যে ইউটোপিয়ান সোসালিজম থেকে শুরু করে মার্কসিয়ান সোসালিজমও পড়তে হয়েছিল, কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল আমাদের পাঠ্য ছিল। মার্কসের ক্লাস স্ট্রাগল আমাকে খুবই প্রভাবিত করেছিল। বৈষম্যমূলক সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার কুফল— এগুলো আমাকে আলোড়িত করত। তারই ফলে সম্ভবত দরিদ্র বিত্তহীন বস্তিবাসী মানুষগুলো আমাকে আকৃষ্ট করেছিল এবং তাদেরকে নিয়েই আমি উপন্যাসটি লিখেছি। কিন্তু তুমি যে বলছো, এখানে আমার উপস্থিতি নেই, এটা আমি মানছি না। যে-কোনো লেখার মধ্যেই পরোক্ষে বা প্রত্যক্ষে লেখক উপস্থিত থাকেন।

হামিদ কায়সার: প্রথম উপন্যাসটিই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে আপনাকে একটা বলিষ্ঠ জায়গা করে দিল— এটাকে ঘিরে আপনার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তখন?
রিজিয়া রহমান: আমি যখন এই উপন্যাস লিখি, তখন বয়স কম, অত বুঝে উঠিনি। এটা যে ভালো লেখা, বুঝলাম পরে। যদিও পাঠক সমাজে এটি সমাদৃত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বিশেষ একটি ঘটনার উল্লেখ বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সম্ভবত ’৭৫ সালে বিখ্যাত ভাষাত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ঢাকায় এলেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে তার সম্মানে আয়োজিত এক সভায় তিনি শুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা বলছিলেন। সম্ভবত তিনি বলেছিলেন লেখকেরা অনেক সময় শুদ্ধ ও আঞ্চলিক গদ্যের ব্যবহারের যথাযোগ্য সীমানাটি রক্ষা করতে পারেন না। কিছু কিছু দৃষ্টান্তও তিনি তুলে ধরেছিলেন। তার ধারণাটি ঠিক মেনে নিতে পারিনি (সম্ভবত নিজের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অর্বাচীনতার কারণে)। সভাশেষে তাকে আমার একমাত্র উপন্যাসটি উপহার দিয়ে বললাম, ‘এতে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ‘ডায়ালেক্ট’ ব্যবহার করেছি, সংলাপের বাস্তবতার জন্যেই। কিন্তু লেখকের নিজস্ব গদ্যটিকে আঞ্চলিকতামুক্ত রাখতে চেষ্টা করেছি।’ বইটি তিনি আগ্রহ সহকারেই নিলেন।

হামিদ কায়সার: তারপর?
রিজিয়া রহমান: সাতদিন পরেই পেলাম তার দীর্ঘ চিঠি। পড়ে তো আমি অভিভূত। তিনি শুধু উচ্ছ্বসিত প্রশংসাই করেননি, এর সত্যনিষ্ঠ আবেগঘন একটি বিশ্লেষণও দিয়েছেন। নিজের লেখার এমন অকল্পনীয় মূল্যায়ন, এ যেন কেবল স্বপ্নেই সম্ভব! তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। তবে নানাভাবেই খবর পেতাম তিনি কলকাতায় সবার কাছে আমার লেখার প্রশংসা করছেন, আমার লেখা আরো পড়তে চান। কিন্তু আমি আর বই পাঠাতে পারিনি।

হামিদ কায়সার: বই পাঠানোতে সমস্যা কী ছিল?
রিজিয়া রহমান: বাংলাদেশে প্রকাশনার ক্ষেত্রটি তখনো খুব একটা মজবুত নয়। প্রচণ্ড পরিশ্রমে লেখা বং থেকে বাংলার প্রকাশক খুঁজতে বেগ পেতে হয়েছে। কারণ একটিই, এত মোটা বই পাঠক কেনে না। সুতরাং কি করে পাঠাবো ড. চ্যাটার্জিকে আমার বই?

হামিদ কায়সার: বই প্রকাশের বিড়ম্বনা থেকে সম্ভবত কোনো কালের কোনো লেখকই রেহাই পাননি।
রিজিয়া রহমান: হবে হয়তো। তবে সুযোগটা এসেছিল কলকাতা থেকেই। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কলকাতা থেকে এসেছিলেন অন্নদাশংকর রায়, তার স্ত্রী লীলা রায়। কাকতালীয়ভাবে লীলা রায়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। লীলাদিই বলেছিলেন, ‘ড, চ্যাটার্জি তোমার কথা এত বলছেন, ওঁকে তুমি একটু বলো, কলকাতার নাম করা পাবলিশাররা তোমার বই ছাপাতে ছুটে আসবে।’ রাজি হলাম না।

হামিদ কায়সার: কেন?
রিজিয়া রহমান: কী জানি, বয়স কম ছিল বলেই হয়তো, বৈষয়িক জ্ঞান কম ছিল (অবশ্য এখনো কমই)। তাছাড়া বং থেকে বাংলা নিয়ে আবেগও ছিল যথেষ্ট। লীলাদিকে বললাম, থাক, লীলাদি। না হয় দেরিতেই বেরুলো বই, আমি চাই আমার বই বাংলাদেশ থেকেই প্রথম প্রকাশিত হোক।

হামিদ কায়সার: আমার যতদূর মনে পড়ে, বইটা মুক্তধারা থেকে বেরিয়েছিল।
রিজিয়া রহমান: হ্যাঁ। শেষপর্যন্ত মুক্তধারা বইটি প্রকাশ করতে রাজি হয়েছিল, তবে অনেক অঙ্গহানি ঘটিয়ে।

হামিদ কায়সার: কীরকম?
রিজিয়া রহমান: তাদের প্রথম শর্ত ছিল, বইটিকে কেটে ছোট করতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত মুক্তিযুদ্ধের অধ্যায়টি থেকে অনেক নাম, অনেক ঘটনা বাদ দিতে হবে।

হামিদ কায়সার: দিয়েছিলেন বাদ?
রিজিয়া রহমান: বলেছি তো, দিতে হলো। সেটা একটা সময় ছিল। ১৯৭৮ সাল বুঝতেই পারছো। দুঃখ লাগছিল যখন বিজয়ের গৌরব নিয়ে কোন কোন সেক্টরের যোদ্ধারা কোন কোন পথে প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন, সে-অংশ কাটবার সময়ে। ৭ মার্চের পর থেকে ১৬ ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ঘটনার অনেক কিছু নিরুপায় হাতে কেটে ফেলতে হলো। ব্যাপারটি আজো আমার জীবনের স্মৃতিতে এক বেদনাবহ ঘটনা।

হামিদ কায়সার: খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
রিজিয়া রহমান: কিন্তু ভালো কিছু ঘটনাও ঘটছিল। ড. চ্যাটার্জি তো নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেনই, একদিন এলো গোপাল হালদার ও তার স্ত্রী অরুণ হালদারের চিঠি। পেলাম অনিলকুমার কাঞ্জিলালের চিঠি। তিনি ও গোপাল হালদার পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের দ্রুতপঠনের জন্যে একটি সংকলন প্রকাশ করতে চলেছেন। এতে তারা ঘর ভাঙা ঘর-এর কিছু অংশ ‘শিল্পী’ নামে অন্তর্ভুক্ত করতে চান। আমার অনুমতি প্রয়োজন। চিঠিতে জানান হলো, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ ইচ্ছা, তারা আমার লেখা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেন।

হামিদ কায়সার: অনুমতি দিলেন?
রিজিয়া রহমান: না দেবার তো কোনো কারণ ছিল না। মাসখানেক পরেই সংকলনটি এসে গেল হাতে। দেখলাম, বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে কবি জসীমউদ্দীন ও আমার লেখা নির্বাচিত হয়েছে।

হামিদ কায়সার: আপনার  প্রথম উপন্যাসে এসেছিল ছিন্নমূল মানুষ। দ্বিতীয় উপন্যাস উত্তর পুরুষে এলো চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গিদের জীবন। বিষয়বস্তুতে এই অভিনবত্ব কীভাবে এলো, সেইসঙ্গে লেখার অভিজ্ঞতাটাও জানতে চাচ্ছি।
রিজিয়া রহমান: উত্তর পুরুষ উপন্যাসটি লিখেছিলাম এমএ পরীক্ষার পরপরই। ঈদসংখ্যা সাপ্তাহিক ললনায় প্রকাশিত হয়েছিল। থাকি তখন চট্টগ্রামে। একদিন সেখানে ললনা থেকে আখতার সাহেবের জরুরি টেলিগ্রাম এলো, ঈদসংখ্যার জন্যে উপন্যাস চাই। আমার স্বামী তখন চট্টগ্রাম সিমেন্ট কারখানার জেনারেল ম্যানেজার, কারখানাটি কর্ণফুলী নদীর পারে। পাশেই নৌবাহিনীর ঘাঁটি। সি-মেন্স হোটেল সেখান থেকে খুব দূরে নয়। চট্টগ্রাম বন্দরও কাছাকাছি। সেখানে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতাম। দেখতাম নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নানা দেশের জাহাজের আসা-যাওয়া। কর্ণফুলীর পারে বিভিন্ন দেশের নাবিকদের পদচারণায় কৌতূহলী হতাম। চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহ্য খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেলাম অতীতের প্রতাপশালী বন্দর, পর্তুগিজদের ‘পোর্টগ্রান্ডি’কে। পেয়ে গেলাম দ্বিতীয় উপন্যাসের প্লট। অতীতের পোর্টগ্রান্ডি আর চট্টগ্রামের পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজারে বসবাসকারী পর্তুগিজদের উত্তর পুরুষ আধুনিক ফিরিঙ্গিদের নিয়ে মাত্র পনেরো দিনে লিখে ফেললাম উত্তর পুরুষ। পাঠকদের সাড়া পেলাম। এ বইয়ের প্রকাশক পেতেও সময় লাগলো। বই আকারে এটি বের হলো। লেখার প্রায় আট নয় বছর পরে। এ উপন্যাসে দেশের বাইরেও সুখ্যাতি পেল।

হামিদ কায়সার: তাই নাকি? আমরা কিন্তু জানি না।
রিজিয়া রহমান: আশির দশকের প্রথমার্ধে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডিমক ও অধ্যাপক ক্লিন্ট সিলি উত্তর পুরুষ উপন্যাসটির ওপর একটি নিবন্ধ তৈরি করেন। সেটি পঠিত হয় আমেরিকার সেলেসবেরিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে। নিবন্ধের কপি আমাকে পাঠানো হয়। আমার নিজের দেশ থেকে অনেক দূরের এক আমেরিকান অধ্যাপক আমার উত্তর পুরুষ ও বং থেকে বাংলা উপন্যাস দুটি নিয়ে গভীর বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন এবং দুটো উপন্যাসকেই বাঙালির আত্মপরিচয়-অনুসন্ধানী উপন্যাস হিসেবে পরিগণিত করেছেন। সত্যি অভিভূত হয়েছিলাম।

হামিদ কায়সার: এই মূল্যায়ন নিশ্চয়ই আপনাকে আরো অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
রিজিয়া রহমান: হবে হয়তো! তবে একটু ক্ষোভও রয়ে গেছে। আমার প্রথম দিকের তিনটি উপন্যাসেরই মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ বিদেশে হয়েছে, দেশে নয়। আমার নিজের দেশের সাহিত্যবিশ্লেষক প্রাজ্ঞজনেরা এর যথাযথ মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করেননি, বা করতে পারেননি।

হামিদ কায়সার: সাম্প্রতিক কালের কয়েকজন তরুণ লেখকও কিন্তু এই একই অভিযোগ করতে পারেন— এই উপেক্ষার কারণটি কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
রিজিয়া রহমান: হতে পারে অজ্ঞতা কিংবা উদাসীনতা অথবা এক ধরনের হীনম্মন্যতা, অর্থাৎ দেশীয় সৃজনশীলতার প্রতি অবমূল্যায়নের প্রবণতা। যেটাকে সরাসরি দায়িত্বহীনতাও বলা যায়।

হামিদ কায়সার: উত্তর পুরুষের পরই তো আপনি লিখলেন সেই সাড়া জাগানো রক্তের অক্ষর, যা পাঠকদের আলোড়িত করেছিল। অনেকে মনে করেন আপনার মতো একজন মননশীল লেখককে এ উপন্যাসটি একজন জনপ্রিয় লেখক করে তুললো। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?
রিজিয়া রহমান: এই উপন্যাসটি কীভাবে লেখা হলো, বছর দেড়েক আগে  দৈনিক প্রথম আলোয় সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা লিখেছিলাম। লেখার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে অনেকের মতো আমিও ভাবতাম, জনপ্রিয় লেখা হচ্ছে সেই লেখা যে-লেখা তরল, সরল, আবেগছোঁয়া, অগভীর বিষয়-বর্ণনা, যা কেবল অপরিপক্ব সাধারণমানের পাঠকদেরই প্রিয় হয়। আমার রক্তের অক্ষর উপন্যাসটির বিপুল জনপ্রিয়তা, যা আমাকে প্রচুর খ্যাতি এনে দিয়েছে, এটা স্বীকার করেও বলছি, আমার এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু মোটেই তরল, সরল, অগভীর, সাধারণমানের পাঠকদের আলোড়িত করার মতো কাহিনী নয়। জানো নিশ্চয়ই, এ উপন্যাস নিষিদ্ধ এলাকার মেয়েদের জীবনের কাহিনী। এমন বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে আমাকে বারবার নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং নিজেকে দুঃসাহসী হিসেবেও প্রমাণ দিতে হয়েছে। তবু আমি থেমে যাইনি। কারণ একটাই, আমার কমিটমেণ্ট। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক সভ্য পৃথিবীতে মানবাধিকারের এই চরম লঙ্ঘন এবং মানবসমাজের ঘৃণিত পূঁতিগন্ধময় ক্ষতকে বিবেকসম্পন্ন মানুষের দৃষ্টিতে তুলে ধরা। প্রতিবাদী উচ্চারণে মানুষের ঘুমন্ত নিষ্ক্রিয় বিবেককে জাগিয়ে তোলা। উদ্দেশ্য ছিল পাঠককে আবেগের মরফিন দিয়ে ঘুম পাড়ানো নয়, আবেগের তীব্র কশাঘাতে প্রচণ্ডভাবে জাগিয়ে দেয়া।

হামিদ কায়সার: এটাকে কি তাহলে আমরা স্লোগানধর্মী উপন্যাস বলবো?
রিজিয়া রহমান: আমিও তো তাই বলেছি। অবশ্য অনেক সাহিত্য-বিশেষজ্ঞের ধারণা, আমার রক্তের অক্ষর শিল্পের সীমানা লঙ্ঘন করেছে। তাদের মতে, ‘প্রাক-পরিগৃহীত’ উদ্দেশে চালিত লেখা শিল্প হয়ে ওঠে না। তবে আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, এ উপন্যাস-রচনায় যত না আমার শিল্পীসত্তা কাজ করেছে, তারচেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছে আমার সামাজিক দায়বদ্ধতা। আমি মনে করি, একজন শিল্পীর কাছে মানুষের ও সমাজের মহৎ কল্যাণের দিকটি শিল্পের চেয়ে অনেক সময় বড় হয়ে ওঠে। সাহিত্য বিশেষজ্ঞ, তত্ত্ববিশারদদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও আমি বলি, ‘শিল্পের জন্যেই শিল্প’ এই কলাকৈবল্যবাদী তত্ত্বকে আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই উপেক্ষা করেছি এবং প্রাক-পরিগৃহীত উদ্দেশে চালিত হয়েই লিখেছি।

হামিদ কায়সার: কিন্তু জনপ্রিয়তা তো পেয়েছেন, সুতরাং এই উপন্যাসের পাঠককে আপনি কোন শ্রেণিতে আখ্যায়িত করবেন?
রিজিয়া রহমান: এখানে প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। পাঠক লেখককে তৈরি করেন, নাকি লেখকই পাঠককে তৈরি করেন— এই বিতর্কসাপেক্ষ দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে আমি বলবো, পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যের সমকালীন আধুনিকতার পথে উত্তরণের শুরু। এবং ষাটের দশকে আমরা যে এক ঝাঁক প্রতিভাদীপ্ত তরুণ লেখক ও কবি এদেশের সাহিত্য-অঙ্গনে আবির্ভূত হয়েছিলাম— আমরা প্রায় সবাই ছিলাম বাংলাদেশের প্রতি প্রতিশ্রুত সন্তান অর্থাৎ দেশ, মানুষ, মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি কমিটেড। একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যকে শক্তিশালী করে তোলার প্রতি একান্ত নিবেদিত। ফলে একটি সচেতন ও উচ্চমানের পাঠকশ্রেণী আমরা প্রত্যেকে গড়ে তুলছিলাম। ষাট-সত্তর থেকে প্রায় আশির দশক পর্যন্ত এই সচেতন শিল্পবোধ-সম্পন্ন পাঠকদের কলরবে এদেশের লেখকের ভুবন ছিল মুখরিত। স্বীকার করবে নিশ্চয়ই, একটি আধুনিক জাতি গড়ে তোলার জন্যে দেশে সাহিত্য- সচেতনতা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কিন্তু তখন অটোগ্রাফ-উন্মত্ত পাঠক দ্বারা পরিবৃত মোহাচ্ছন্ন লেখক ছিলাম না, ছিলাম সচেতন, বিবেকসম্পন্ন, বুদ্ধিদীপ্ত পাঠকশ্রেণী গড়ে তোলার কারিগর, ছিলাম নতুন আলোচিত বাংলাদেশের দিশারি। সুতরাং তখনকার পাঠকদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জন আর এখনকার এই বাজার-অর্থনীতির আগ্রাসনের কালে, যখন লেখকও এক তাৎক্ষণিক শোভা-প্রদর্শিত সুরম্য পণ্য হতে চলেছে, তখন খাদক-স্বভাব বিশিষ্ট মুখরোচক, ভোক্তা চরিত্রের পাঠক দ্বারা তার জনপ্রিয়তাকে সেই প্রতিশ্রুতিময় সময়ের জনপ্রিয়তার সঙ্গে এক পাল্লায় তুলে পরিমাপ করা বোধহয় সম্ভব নয়। রক্তের অক্ষরকে যে-পাঠকেরা জনপ্রিয় করেছিলেন, তাদের আমি অবশ্যই সম্মান করি। তারা খাদক ছিলেন না, ছিলেন উপলব্ধিকারক এবং অগ্রগতির প্রতিভু।

হামিদ কায়সার: এরপর আপনি নানা পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন, সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, আরো অনেক জনপ্রিয় অথচ ভালো উপন্যাস সে-সময়ের পাঠকেরা আপনার কাছ থেকে পেয়েছে— এসব উপন্যাসেও কি আপনি একই কমিটমেন্টে আবদ্ধ ছিলেন?
রিজিয়া রহমান: সম্ভবত ছিলাম। প্রথমে বলে নিই একজন লেখকের স্বীকৃতির প্রয়োজন যে নেই, তা নয়। তবে পুরস্কারকে আমি লেখকের পরম স্বীকৃতি বলে ইদানীং আর ভাবতে পারি না। কারণ, পুরস্কারের জন্য যে-ধরনের লবিং বা তদবিরের প্রবণতা দেখি, তাতে লজ্জিতই হতে হয়। বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কারই আমি পেয়েছি, তবে এগুলো আমার কাছে অর্থহীনই মনে হয় মাঝে মাঝে, মনে হয় এসবের তো প্রয়োজন ছিল না। পুরস্কৃত হওয়ার উদ্দীপনা নিয়ে কিন্তু আমার পরের উপন্যাসগুলো লিখিনি। বরং ভেতরে কাজ করেছিল বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারের উদ্যম,  প্রেরণা ছিল সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের নগরকেন্দ্রিক অতিমাত্রায় পাশ্চাত্য ভাবধারা-প্রভাবিত বাংলা সাহিত্যের পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের জন্য নিজস্ব সাহিত্যধারা সৃষ্টি করা। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ নদীমাতৃক বাংলাদেশের রয়েছে অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। রয়েছে নদী, সমুদ্র, অরণ্যবেষ্টিত প্রকৃতিভিত্তিক জনপদের বিচিত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জীবন। রয়েছে হাজার বছর ধরে শোষিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুঃখ, দারিদ্র্য আর বঞ্চনার ইতিহাস। সেই বিচিত্র জীবনকে তুলে আনবার জন্যেই ঘুরে বেড়িয়েছি অগম্যক্ষেত্রে, বঙ্গোপসাগর থেকে চট্টগ্রামের গভীর অরণ্যে, দক্ষিণ বাংলার ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে উত্তর বঙ্গের আদিবাসী সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায়। নিবেদিত হয়েছি হাঙ্গর-শিকারিদের জীবনের কথা, রাবার-বাগানের অনিশ্চিত সবুজ অন্ধকার থেকে সুন্দরবনের গভীর অরণ্যের গাথা-রচনায়। ঘুরেছি সিলেটের চা-বাগানের অজানা কাহিনীর খোঁজে। আমার ধবল জ্যোৎস্না, অলিখিত উপাখ্যান, সূর্য-সবুজ-রক্ত, একাল চিরকাল প্রভৃতি উপন্যাস নগর-সভ্যতার বাইরে বিচরণকারী বাংলাদেশের সেইসব মানুষের জীবনালেখ্য, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গড়ে উঠেছে এই দেশ। আমি তাদেরকেই সাহিত্যে তুলে আনতে চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি আমার দেশ ও সাহিত্যের প্রতি কমিটমেন্ট পূর্ণ করতে। একে সাহিত্যতত্ত্ববিদেরা ‘রিজিওনালিজম‘ আখ্যায় আখ্যায়িত করতে পারেন, তবে আমি বলি, এটা সামগ্রিক এক বাংলাদেশ।

হামিদ কায়সার: আপনার কিছু চমৎকার রোমান্টিক উপন্যাসও রয়েছে। যেমন, ভারতের মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের পটভূমিতে সবুজ পাহাড়, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির পটভুমিতে প্রেম আমার প্রেম, ফ্রান্সের প্যারিস নগরীর পটভূমিতে আউ ভোয়া বেলামী, পার্বত্য চট্টগ্রামের মুরং উপজাতীয় জীবনের প্রেক্ষাপটে হে মানব মানবী। রোমান্টিকতাকে আপনার উপন্যাসে কিভাবে প্রয়োগ করেছেন, বলুন।
রিজিয়া রহমান: একজন লেখকের সব লেখাতেই কিন্তু রোমান্টিকতা একটি মূল উপাদান। এটার প্রভাবমুক্ত হয়তো আমিও নই। তবে আমরা সাধারণত প্রেমের উপন্যাসগুলোকেই রোমান্টিক উপন্যাস বলে থাকি। এদিক দিয়ে বিচার করলে আমার এই উপন্যাসগুলোকে রোমান্টিক উপন্যাসই বলতে হয়। প্রেমই এর প্রধান উপজীব্য বিষয়। তবে এ উপন্যাসগুলোতে প্রেমকে আমি একটু ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করেছি। মূলত প্রেমের সঙ্গে দেহজ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকে। আমি মনে করি, প্রেম যতক্ষণ একটি অশরীরী চমৎকার আবেগের মধ্যে বসবাস করে, ততক্ষণই তার মাঝে শিল্প প্রাধান্য পায়, সেটি ভিন্ন স্বাদের রোমান্টিকতার জন্ম দেয়। দেহজ প্রেমে জৈবিকতা বা প্রাণী-প্রবৃত্তি যতটুকু প্রাধান্য পায়, শিল্প বা রোমান্টিকতা ততটুকু নয়। আমার লেখা প্রেমের উপন্যাসগুলোতে ওই শিল্পিত আবেগটির ওপরই আমি গুরুত্ব দিয়েছি, হয়তো এটাই প্রেমের ক্ষেত্রে শিল্পিত রোমান্টিকতা। যে-কারণে আমার এই উপন্যাসগুলোকে  রোমান্টিক উপন্যাস বলছো।

হামিদ কায়সার: আপনি কি তাহলে দেহজ প্রেম-বিষয়ক উপন্যাসকে রোমান্টিক উপন্যাস বলেন না? সেখানে কি শিল্প নেই?
রিজিয়া রহমান: অবশ্যই বলি, শিল্প সেখানে নিশ্চয়ই আছে। তা নাহলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দেহজ প্রেমের বর্ণনায় রসজ্ঞ শিল্প-বিশ্লেষকেরা শিল্পরস খুঁজে পেতেন না। প্রেমের পরিপূর্ণতা দেহের সম্মিলনেই ঘটে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। কিন্তু আমার উপন্যাসগুলোকে সেই পরিণতি পর্যন্ত আমি যেতে দেইনি। চেষ্টা করেছি প্রাক-দৈহিক সম্মিলনের রোমান্টিকতাটুকুকে শিল্প-আঙ্গিকে তুলে আনতে। যেমন প্রেম আমার প্রেম উপন্যাসটি প্রথম প্রেমের অনুভূতি নিয়ে লেখা। এ উপন্যাসের নায়িকা তার বয়ঃসন্ধিকালে প্রেমে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, আজীবন এটি তার অবচেতনে লালিত ছিল, পরিণত বয়সে শাহজাদপুরে রবি ঠাকুরের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সেই প্রেমকে তিনি আবিষ্কার করলেন। এবং সে এক আশ্চর্য প্রেমের অনুভূতি। উপন্যাসটি যদি পড়ে থাকো, তবে নিশ্চয়ই অনুভব করেছ।

হামিদ কায়সার: ঐতিহাসিক উপন্যাস-রচনাতেও আপনার দক্ষ হাতের ছোঁয়া পাই। কটা ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন?
রিজিয়া রহমান: খুব বেশি নয়। মাত্র দুটি। অলিখিত উপাখ্যান ও সম্প্রতি ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত আবে রওয়াঁ।

হামিদ কায়সার: কেন বং থেকে বাংলা?
রিজিয়া রহমান: অনেকে এই উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিক উপন্যাসের শ্রেণিতে ফেললেও এটিকে সর্বতোভাবে ঐতিহাসিক উপন্যাস আমি বলি না। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিজয়গৌরব অর্জন পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার বছরের এই প্রবহমান ইতিহাস আসলে একটি বিবর্জিত জাতির উত্থানেরই কাহিনী, জাতিসত্তার মূলটি খুঁজে আনা। আমার মতে, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। তবে অলিখিত উপাখ্যান পরিপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক কাহিনী আশ্রয়ী উপন্যাস— ১৮৬০ সনের ঘটনা, বাংলাদেশের কৃষক বিপ্লবের একটি খণ্ডচিত্র। আর আবে রওয়াঁ মসলিনকে কেন্দ্র করে ঢাকা নগরের প্রতিষ্ঠার কাহিনী। এই উপন্যাসের কাহিনীর শুরু প্রায় চারশ বছর আগের ঢাকার জীবন নিয়ে।

হামিদ কায়সার: এসব লিখতে আপনাকে নিশ্চয়ই প্রচুর পড়তে হয়েছে?
রিজিয়া রহমান: পড়তে হয়েছে, এবং এখনো হচ্ছে। একে তো পড়ার অভ্যেসটি আমার সারাজীবনের সঙ্গী। তার ওপর কোনো লেখা শুরু করলে তার প্রয়োজনেও পড়তে হয় প্রচুর। বং থেকে বাংলা লিখবার সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে পড়তে হয়েছে অ্যানথ্রোপোলজি, জিওলজি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, চর্যাপদ, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, প্রাচীন পুঁথি, লোককাহিনী, বাংলাদেশের আদিবাসীদের ইতিহাস— কী নয়? তৃণভূমির বাইসন, শুধু তোমাদের জন্য এবং লালমানুষ ও পবিত্র নারীরা— এই নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস-তিনটি লিখবার প্রয়োজনে আধুনিক নৃতত্ত্ব-বিজ্ঞান এত বেশি পড়তে হয়েছে যে অনায়াসে অ্যানথ্রোপলজির ডিগ্রি নিতে পারতাম। চাবাগান নিয়ে সূর্য-সবুজ-রক্ত লিখতে গিয়ে পড়তে হয়েছে চা ও চা-বাগানের ইতিহাস। কিশোর উপন্যাস বাবলুর অভিযান লিখতে গিয়ে মাসের পর মাস পড়েছি হিস্টোরিকাল জিওলজি ও প্যালিওন্টোলজি।

হামিদ কায়সার: নৃতত্ত্ব নিয়ে কিন্তু খুব বেশি কাজ হয়নি আমাদের উপন্যাসে। এ বিষয়েও দেখছি আপনার উৎসাহ রয়েছে।
রিজিয়া রহমান: উৎসাহী না হলে কি আর তিন তিনটি নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস লেখা হতো! এই বিষয়টি বাংলা সাহিত্যে খুব অবহেলিতই মনে হয়। একমাত্র বনফুলের জঙ্গম উপন্যাস ছাড়া নৃতত্ত্বভিত্তিক কাজ তেমন একটা হয়নি। আর বাংলাদেশের সাহিত্যে তো নয়ই। আসলে আমার মনে হয়, একজন আধুনিক লেখককে মানবজীবনের সর্বত্রই বিচরণ করতে হয়। আর এই কারণে লেখককে লেখার বিষয়ভিত্তিক পড়া ছাড়াও সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান সবই পড়তে হয়।

হামিদ কায়সার: পড়ার কোনো বিকল্প নেই।
রিজিয়া রহমান: এই বিশাল পৃথিবী জুড়ে যে-অনন্ত মহাজীবন বয়ে চলেছে, তাকে খণ্ড খণ্ড করে শিল্পের আঙ্গিকে তুলে আনার গুরুদায়িত্ব একজন লেখকের। জীবন ও পৃথিবী-সম্পৃক্ত জ্ঞান অর্জন করা ছাড়া সে-দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করা কি সম্ভব?

হামিদ কায়সার: আশির দশক পর্যন্ত আপনি আপনার খ্যাতনামা উপন্যাসগুলো রচনা করেন, তারপর কয়েক বছর লেখার জগতে প্রায় নীরব ছিলেন। কারণটা কী?
রিজিয়া রহমান: সে এক দুঃসহ সময় আমার জীবনে। সাঁওতালদের নিয়ে একাল চিরকাল উপন্যাস লেখা শেষ করে তৈরি হচ্ছি আরেকটি বড় লেখার জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধ বিহারগুলোকে কেন্দ্র করে। এক সময়ে এদেশে যে স্বর্ণোজ্জ্বল বৌদ্ধ যুগের সূচনা হয়েছিল, তার উত্থান ও পতন নিয়ে একটি উপন্যাসের ছক তৈরি করে ফেলেছি, লেখার কাজও শুরু করেছি, সেই সময়ে এক দুর্ঘটনায় প্রায় অন্ধই হয়ে বসলাম। দুর্ঘটনায় চোখের কর্নিয়া ও নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, নাকের একটি হাড় ভাঙল, মস্তিষ্কেও আঘাত লাগল। দীর্ঘ সাত মাস ভীষণ কষ্ট পেলাম। অবশেষে ইংল্যান্ড যেতে হলো। সেখানকার নিওরোসার্জন দেখে বললেন, মাথার মগজটি আঘাতে কুঁচকে গেছে। ঠিক হতে সময় লাগবে। চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে ফিরলাম। তারপর কাটলো দুঃস্বপ্নের মতো যন্ত্রণাময় সময়। লেখাপড়ার ক্ষমতা ছিল না। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার ঘরে বসে থাকতাম। অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রায় পাঁচটি বছর যে কেমন করে কাটিয়ে উঠলাম, এখন ভাবতেও অবাক লাগে। পাঁচ বছর পর সম্পূর্ণ নিরাময় হলাম। শুরু করলাম স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। লিখতেও শুরু করলাম। এই সময়েই লিখেছিলাম আমেরিকায় বাঙালি ইমিগ্রান্টেদের নিয়ে উপন্যাস ডাইম নিকেল আলোর বিকেল। তারপর শুরু হলো আবার বড় কাজের প্রস্তুতি। লিখতে শুরু করলাম, বাংলাদেশের কিংবদন্তি বিশাল নদী পদ্মাকে নিয়ে উপন্যাস পদ্মা। নদীনির্ভর বা নদীভিত্তিক মানুষের জীবন ও জনপদের কাহিনী। একটি নদীর স্রোতের বিশীর্ণতা কেমন করে বদলে দেয় এর দু’ পাড়ের মানুষের জীবন ও পেশা— সেটাই আকর্ষণ করেছিল আমাকে। দুর্ভাগ্য আমার। আবার বিপর্যয় এলো। এবারের বিপর্যয় পরিবারের আর্থিক বিপর্যয়।... থাক, এ প্রসঙ্গ।

হামিদ কায়সার: জীবনকে যে কত বিপর্যয় অতিক্রম করে যেতে হয়, হয়তো ব্যাহত হয় সৃজনশীলতা!
রিজিয়া রহমান: বাধ্য হয়ে লেখার কলম বন্ধ করলাম। লেখা হলো না পদ্মা। নেমে এলাম অচল সংসারকে ঠেলে সচল করতে। এ সময়ে নানা ধরনের কাজ করতে হয়েছে আমাকে। তখন হয়তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমি সেই রিজিয়া রহমান, বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্যে তারপর থেকেই যেন ধূর্ত এক কালহাওয়ার ঝড় একজন লেখকের সৎ জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে অবিরত। হয়তো পৃথিবীতে এমনই হয়, একজন সত্যনিষ্ঠ শিল্পীকে ক্রমাগত বিপর্যয়ের ঝড়ে বিপর্যস্ত হতে হয়, যুদ্ধ করতে হয়। অন্যায় আর অসত্যের সঙ্গে সে-যুদ্ধ কেবলমাত্র কলম দিয়ে নয়, জীবন দিয়েও। সংগ্রামই তার আজীবন সঙ্গী।

হামিদ কায়সার: যত বিপর্যয় আর আর্থিক টানাপোড়ন শুধু শিল্পী-সাহিত্যিকদের জীবনেই ঘটে। কেন?
রিজিয়া রহমান: কারণটা কি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে! একজন সত্য প্রকাশের অকুণ্ঠ সৈনিককে বিরুদ্ধাচারী শক্তি কি কখনো রেহাই দেয়! এটা যেন এক ‘ইউনির্ভাসাল ট্রুথ’ এ পৃথিবীতে। তবে আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আকারের বিপদ-আপদ ও বিপর্যয় নাকি এসেছে নবি-রসুলদের ওপরে। তারপরে আউলিয়া-দরবেশ অর্থাৎ আল্লাহর প্রিয় সৎ বান্দাদের ওপরে। তারপর কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের ওপরে। কথাটার সারবত্তা মর্মমূলে প্রবেশ করেছে কিনা জানি না, তবে অন্তত পাবার মতো যুক্তি খুঁজে পেয়েছি...

হামিদ কায়সার: আপনার জীবনের ধারাটি যেমন হঠাৎ করেই পালটে গেল, আপনার গল্প এবং উপন্যাসেও কিন্তু তেমন একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। ইদানীং আপনি নিরীক্ষাপ্রবণ।
রিজিয়া রহমান: একজন লেখকের লেখার ধারা বদলাতেই পারে, এ পৃথিবীর সবকিছু নিয়তই পরিবর্তিত-বিবর্তিত হচ্ছে, দেশ-কাল, মানুষ-মানুষের জীবনের ধ্যান-ধারণা, সবই। সেইসঙ্গে বদলে যাচ্ছে লেখকের মনের জগতটিও। পরিবর্তিত সময়ের বাস্তবতায় আমাদের সাহিত্য-প্রকরণের শিল্প-ধারণাটির পরিবর্তনও তাই অনিবার্য— এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন শিল্পধারা সৃষ্টি ও আঙ্গিক-পরিবর্তনে আগ্রহী হতে বাধ্য হয়েছি। বছর দেড়েক আগে ‘দূরে কোথাও’ নামে পরিবর্তিত আঙ্গিকে একটি নিরীক্ষাধর্মী গল্প লেখার প্রথম প্রয়াস আমার। এরপরই ‘অপেক্ষা সেই কালবৈশাখী’ নামের প্রকৃত নিরীক্ষাধর্মী গল্পটি লিখলাম জনকণ্ঠের বিশেষ সংখ্যায়। বলা যায় নতুন শিল্প-প্রকরণ উদ্ভাবনের এটাই প্রকৃত প্রথম চেষ্টা আমার। দেশীয় রূপকথা, লোকজ ধারা ও মিথের নির্যাসের সঙ্গে গদ্যভঙ্গির সংগীতময়তা এবং রোমান্টিক আবহে প্রতীকের ব্যবহার করে নিজস্ব একটি শিল্প-প্রকরণের আদল গড়তে চেষ্টা করেছি এ গল্পে। ইউরোপীয় শিল্প-প্রকরণ থেকে বেরিয়ে প্রাচ্যদেশীয় শিল্প-প্রকরণ সৃষ্টির অসংলগ্ন প্রয়াসই বলা যায় একে। ভয় ছিল, হয়তো শুনতে হবে, ‘কিছুই হয়নি এটা।’ কিন্তু অনেক শিল্পবোদ্ধা সাহিত্য-রসজ্ঞ ব্যক্তিই যখন গল্পটির জন্য অভিনন্দিত করলেন, আত্মবিশ্বাস বাড়লো আমার। শতাব্দীর পুরনো আমদানিকৃত ইউরোপীয় সুররিয়্যালিজম, যুদ্ধোত্তর কালের বাস্তবতার আধুনিকোত্তর শিল্প-প্রকরণকে উপেক্ষা করে নতুন আঙ্গিকে ও প্রকরণ, উদ্ভাবনের চেষ্টায় লিখলাম আরো তিনটি গল্প— ‘অন্ধ-রাতের রেলগাড়ি’, ‘বেহেশতী খাঁচা’ ও ‘জামিলা হাসানের পতন’। এই গল্প তিনটির প্রকরণ-নির্ধারণে লাতিন আমেরিকায় উদ্ভাবিত ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ বা জাদু বাস্তবতার কথা বলেছেন কেউ কেউ আমাকে। কিন্তু আমি নিজে আমার এই শিল্প-প্রকরণে জাদু বাস্তবতার পূর্ণ অনুসরণ বলে মনে করি না।

হামিদ কায়সার: আপনি সচেতনভাবেই বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসের পুরনো ছক ভাঙতে চাইছেন!
রিজিয়া রহমান: আর কত! সমগ্র বাংলা গল্প-উপন্যাসের বয়স তো কম হলো না। দেড়শ বছর আগে যে ‘র্ফম’টি নির্ধারিত হয়েছিল, সেটি আমার কাছে এখন কখনো কখনো পুরনো এবং আবেদনহীন মনে হয়। আধুনিক সময়ের জটিল জীবন ও মানুষের উন্মূল অস্থিরতার ঢেউ এখন সর্বত্র। যখন সবকিছুই ভাঙছে, লেখকের পক্ষে কি সেই ‘স্ট্যাগন্যান্ট’ পুরনো ছকে উত্তাল চিন্তাধারা প্রকাশ করা সম্ভব? গল্প-উপন্যাসের ‘র্ফম’ বা আঙ্গিক লেখকরাই তৈরি করেন, আবার তারাই ভাঙেন। তাছাড়া একটি নতুন শিল্প-প্রকরণের দাবি আমার চেতনায় ক্রমাগতই সোচ্চার হচ্ছে। একে তো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।

হামিদ কায়সার: তিরিশ বা তিরিশোত্তর কালের কবিরা অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ বাংলার উল্লেখযোগ্য কবিরা ইউরোপীয় প্রভাবকে প্রবলভাবে ধারণ করে ইউরোপীয় যুদ্ধোত্তর কালের শিল্পচেতনায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের অনুসৃত ধারাই এ যাবৎ বাংলা সাহিত্যকে  নিয়ন্ত্রিত করেছে— আপনি কি সে ধারাকে আর যথাযথ ভাবছেন না?
রিজিয়া রহমান: তাদের এই পাশ্চাত্য সাহিত্যমুখীনতা নিঃসন্দেহে আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও শাণিত করেছে। বাংলা গদ্য সাহিত্যে, বিশেষ করে কাব্যে এই শিল্পিত গ্রহণ, আধুনিকোত্তর সাহিত্যে গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়াটি একটি অপ্রতিরোধ্য ব্যাপার। সময় ও প্রয়োজনের কারণেই এটি যথার্থ হয়ে ওঠে। যেমন হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের কবিদের পাশ্চাত্য ভাবধারার গ্রহণ-প্রবণতার ক্ষেত্রে। তবু ভুলে গেলে চলে না, আমরা দু শ বছর এক দুর্বল পাশ্চাত্য শক্তির উপনিবেশ হয়ে কাল কাটিয়েছি। উপনিবেশীয় মনস্তত্ব এখনো ঘাঁটি পেতে আছে আমাদের অন্তর ও বহির্জগতে। ফলে, পাশ্চাত্যের সবকিছু চোখ বুজে উদরস্থ করার প্রবণতা মিশে আছে আমাদের মজ্জায়, পশ্চিম এখনো নিয়ন্ত্রণের অদৃশ্য শাসনদ- তুলে আছে আমাদের সমাজচেতনা, সংস্কৃতি ও চিন্তাশীলতার ওপরে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসপ্রসূত শিল্পধারণা ও পরবর্তী রিয়ালিজম, ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম বা কিউবিজম আমাদের শিল্প-সাহিত্যে আধুনিকতা আনলেও যুদ্ধোত্তর কালের পশ্চিমি বাস্তবতায় ‘ওয়েস্ট ল্যান্ডে’র মতো নির্জন শূন্যতা সেই সময়ে আমাদের প্রাচ্যের চিন্তাজগতের জন্য কতটুকু বাস্তব হতে পেরেছিল, সেটা বিবেচনা-সাপেক্ষ। আমি মনে করি, এই বাস্তবতা কখনোই আমাদের দেশজ বাস্তবতার সঙ্গে হাত মেলাতে পারেনি। পরাধীন ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার দমিত স্পৃহা ও শৃঙ্খলিত যন্ত্রণার ভিন্ন বাস্তবতা নিঃসন্দেহে ছিল ইউরোপীয় বাস্তবতাবোধ থেকে ভিন্ন চরিত্রের, যে-বাস্তবতার চিহ্নকে বাংলা সাহিত্যের শিল্প-প্রকরণ-সৃষ্টিতে অপারগ হয়েছে কেবল সেই উপনিবেশীয় মননশীলতায় আবদ্ধ হয়ে থাকার কারণেই। সুতরাং দারিদ্রপীড়িত দেশে, দুর্বল গণতন্ত্রের চর্চায়, স্বৈরাচারী অনাচারে, অনুন্নত অর্থনীতির বোঝা-টানা বিবর্ণ মানুষের প্রকৃত জীবনের আবেগটি প্রায় উপেক্ষিতই থেকে গেছে শিল্পের ভুবনে। সেই কারণেই আমি মনে করি, আমাদের শিল্প-প্রকরণটির উঠে আসা উচিত এ দেশের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত থেকে, পাশ্চাত্যের ভিন্নধর্মী শিল্প-প্রকরণ থেকে নয়।

হামিদ কায়সার: আপনার দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যচর্চার মূল প্রেরণার উৎসটি কোথায়?
রিজিয়া রহমান: আমি বিশ্বাস করি, কেবলমাত্র আমার ক্ষেত্রেই নয়, পঞ্চাশ দশক থেকে ষাট দশকের সব লেখকেরই মূল প্রেরণার উৎসটি ছিল বাহান্নর ভাষা-আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলে মাতৃভাষা বাংলা ও সাহিত্যের চর্চায় নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম আমরা— কবি ও লেখকেরা। নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্যকে আমরা নতুন করে ভালবাসতে শিখেছিলাম, শিখেছিলাম সাহিত্যচর্চায় সততার সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে। তারপর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ড ও স্বাধীন জাতির গৌরব দান করেছে। এই গৌরবের আবেগই আমাদের সৎ সাহিত্য-নির্মাণের প্রেরণা দিয়েছে, নিঃসন্দেহে। আমাদের জাতীয় জীবনের মহান এই দুটি ঘটনাই শিল্পচর্চায় আমার প্রেরণার মূল উৎস বলে আমি মনে করি।

কালি ও কলম, ফেব্রুয়ারি ২০০৪