দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন পরিবার থেকেই শুরু হতে হবে

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৭, ২০২০

সম্প্রতি একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারীরা বিভিন্ন সংগঠনে পরিচালনাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে, তারা অন্যান্য নারী কর্মীদের তুলনায় বেশি যৌন হয়রানির মুখোমুখি হয়। তাদের কাজের প্রশংসা খুব কম হয়, বরং তাদের ‘সমস্যা প্রস্তুতকারী’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইডিশ ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর একটি প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন এবং জাপানের কাজের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, নেতৃত্বের পদে থাকা নারীরা কর্মক্ষেত্রে অন্যান্য নারীর তুলনায় ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।

সুইডিশ ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চ-এর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জোহানা রিকন বলছেন, “এই নারীরা তার অধস্তনদের কাছ থেকে এবং সংস্থার উচ্চ-স্তরের কর্তৃপক্ষ উভয়ের থেকেই হয়রানির শিকার হতে পারে।” গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, টিম ম্যানেজারের ভূমিকায় থাকা নারীরা বেশি যৌন দুর্ব্যবহার সহ্য করতে বাধ্য হয়, যখন তাদের নিচে কর্মরত কর্মীরা মূলত বেশিরভাগই পুরুষ।

সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ওলে ফোলক বলেছেন, “এক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অর্থ হলো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীদের কেরিয়ারের অগ্রগতি পুরুষদের চেয়ে কম হওয়া, বিশেষত পুরুষ-অধ্যুষিত কর্মক্ষেত্রে।” কর্মক্ষেত্রের কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের যৌন হয়রানির ফ্রিকোয়েন্সি মূল্যায়নের জন্য সুইডিশ ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল রিসার্চ এবং আমেরিকান এবং জাপানি শিক্ষাবিদদের গবেষকরা তিনটি সমীক্ষার প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করেছে।

নারীদের যৌন হয়রানির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং তাদের দুষ্কৃতকারীদের সম্পর্কে তদন্ত করা হয়েছিল, পাশাপাশি তাদের অসদাচরণের প্রতি তাদের নিজস্ব প্রতিক্রিয়া এবং তাদের খারাপ ব্যবহারের সামাজিক ও পেশাদারিক বিপর্যয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। কর্মক্ষেত্র এবং লিঙ্গ নিদর্শনগুলিতে প্রতিটি দেশে লিঙ্গ সমতার বিভিন্ন স্তরের হওয়া সত্ত্বেও ফলাফল মার্কিন, জাপান এবং সুইডেনে প্রায় একই ছিল।

এখন আসি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। আমি নিজে দীর্ঘদিন এইরকম পজিশনে কাজ করে, কি কি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সেটা বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। সবচেয়ে কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছে যখন দেখেছি, নারী সহকর্মীরাই এসবের সাথে জড়িত বা তারাই এসব পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ব্যতিক্রমও আছে, যেমন আমার বর্তমান কর্মস্থলে এই ধরনের আচরণ তুলনামূলকভাবে একদমই কম। কিছু ব্যক্তি সব জায়গাতেই আছে যারা মানুষের সমালোচনা করতে পছন্দ করে। তারা আমার এই হিসেবের বাইরে।

আজ অফিস নিয়ে আলাপ করতে চাচ্ছি না। আজ বলতে চাচ্ছি যেসব নারী উচ্চপদে কাজ করে, তারা বাড়িতে কেমন ব্যবহারের শিকার হয়। আমার পরিচিত এক নারীর মা তার টাকা নেন না। কারণ ভদ্রমহিলা বিশ্বাস করতে পারেন না, তার কন্যা নিজ যোগ্যতায় হালাল উপায়ে এত টাকা আয় করেন। উনি নিজেই নিজের কন্যার যোগ্যতা নিয়ে সংশয়বাদী।

আরেক নারীর স্বামী তার দ্রুত উন্নতি নিয়ে গর্ব করলেও, অফিসের কাজে বাইরে যাওয়া বা দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে বিভিন্ন টিপ্পনী কাটতে ছাড়ে না। অনেক সময়, বাচ্চাদের যত্ন নিয়েও কথা শুনতে হয়, যেন এটা কেবলমাত্র মায়ের একার দায়িত্ব। আমার এক সাবেক সহকর্মীর অভিজ্ঞতা আরো ভয়াবহ। শ্বশুরবাড়ির দিকের কয়েকজন দেবর সম্পর্কীয় লোকজন তার আয় নিয়ে সন্দিহান। তারা আকারে ইঙ্গিতে তাকে নানা প্রলোভন দিয়ে বাজিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে, তার এই অর্জন কোন পথে এসেছে।

আমার পরিচিত একজন প্রসঙ্গক্রমে তার বয়ফ্রেন্ডকে একবার বলেছিল, এরকম পজিশনে থাকতে গেলে অনেককে ম্যানেজ করে চলতে হয়। বিষয়টা গ্রুপ বা একটা সিন্ডিকেট মেনটেইন করার কথা ছিল। কিন্তু তাকে এই একটা কথার জেরে বহুদিন ধরে ভুগতে হয়েছিল। তাকে ভুল বুঝা হয়েছিল। বিষয়টা এমন যেন, কর্মক্ষেত্রে পুরুষরা কাউকেই ম্যানেজ না করে চলে। আমি নিজেও জানি কত মানুষের কত বাজে মন্তব্য সহ্য করে সাহসী নারীরা নিজেদের পথচলা অব্যাহত রাখে।

হঠাৎ করে কর্মস্থল থেকে পারিবারিক আবহ নিয়ে আলাপে গিয়েছিলাম একটাই বিষয় পরিষ্কার করতে। সেটা হলো, যারা আমাদের সহকর্মী তারা কারো না কারো মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী বা খুব কাছের কেউ— তারা যদি নিজেদের পরিবারের নারীদের না বোঝে, সহকর্মী নারীদের বুঝবে কিভাবে? দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রথমে পরিবার থেকেই শুরু হতে হবে, নাহলে নারীদের হয়রানি কোথাও বন্ধ হবে না, সম্ভব নয়।

লেখক: কলামিস্ট, গল্পকার ও গণমাধ্যমকর্মী