দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের প্রবন্ধ ‘পূর্ণাঙ্গ দর্শন ও ইসলাম’

প্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০২০

দর্শনের উপকরণ হবে জীবন্ত মানুষের সবগুলো বৃত্তি ও প্রবৃত্তি। তার লক্ষ্য হবে পূর্ণ মানুষ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ। তার নৈতিক আদর্শ হবে পরস্পর ভিন্নমুখী প্রবৃত্তির সামঞ্জস্যবিধান। তার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক আদর্শ হবে ব্যষ্টি ও সমষ্টির অধিকারের সমন্বয়। সে পূর্ণাঙ্গ জীবন-দর্শনেরই অপর নাম ইসলাম। ইসলামকে তাই বলা হয় মানবতার ধর্ম। সেই ধর্মের উৎপত্তি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফার (সঃ) প্রচার থেকে নয়-সৃষ্টির আদি থেকেই নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভুল-ভ্রান্তির পথে মানুষ তার পূর্ণ পরিচয় লাভের জন্য এ পথেই চলছে। প্রয়োগ অথবা বৃদ্ধির আলোকে সে বিশাল জীবনের আংশিক আভাস যে মানুষ পেতে পারে না, তা নয়। কিন্তু সে আংশিক সত্যকে পূর্ণ সত্য ভ্রমে তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মানুষ হয়ে পড়ে দিশেহারা।

হযরত মুহাম্মদের (সঃ) পূর্বে যারা দুনিয়ার সত্য প্রচার করেছিলেন ইসলাম তাঁদের অস্বীকার করেনি, বরং যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গেই তাঁদের স্মৃতি বহন করছে। তাঁদের মতবাদ কোন বিশেষ দেশের বা বিশেষ কওমের লোকের ওপর প্রযোজ্য হওয়ার অথবা মানবজীবনের কোন বিশেষ দিকের ওপর জোর দেওয়ার কালে তাদের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তবুও ইতিহাসের ধারায় জ্ঞানের ও নীতির এক একটা বিশিষ্ট পর্যায় হিসেবে এখনও তাদের মূল্য রয়েছে যথেষ্ট। ইসলামকে বলা হয় মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। মানব প্রকৃতির সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধ বর্তমান। মানুষের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) বলেছেন, সদ্যোজাত শিশু সত্য ধর্মেই জন্ম নেয়; তার পিতামাতা তাকে য়াহূদী, ক্রিশ্চিয়ান বা সেবিয়ান করে তোলে।

ইসলাম গোড়াতেই মানবজীবনকে দেখেছে পূর্ণভাবে; সেজন্য বিভিন্ন প্রবৃত্তি বা জ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে তারতম্য করলেও কোনটাকেই অস্বীকার করেনি। মানবজীবনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-ক্ষুধা, যৌনস্পৃহা প্রভৃতিকে ইসলাম কোনদিনই অস্বীকার করেনি; বরং কিভাবে ক্ষুধার নিবৃত্তি সুষ্ঠুভাবে হতে পারে, কিভাবে মানুষ জীবনে শান্তি পায়-তার ব্যবস্থা করেছে। মানব-প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশের পথ সুগম করার জন্য এ জীবনদর্শনে মানবজীবনের বৈচিত্র্য গোড়াতেই স্বীকৃত হয়েছে। জগতের পূর্ণ পরিচয়ের পদ্ধতিরূপে বোধির সঙ্গে প্রয়োগ ও যুক্তি গৃহীত হয়েছে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে যাতে কোনো কালেই কোন সীমারেখা টেনে দেওয়া না হয়, সেজন্য মানুষের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেছেন, জ্ঞান আহরণের জন্য যদি প্রয়োজন হয় চীন দেশেও যাও। অপর এক বাণীতে বলেছেন, জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম পুরুষ ও নারীর পক্ষে ফরয (অবশ্য কর্তব্য)।

এক্ষেত্রে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, জ্ঞান বলতে তিনি শুধু ঐশী জ্ঞানকেই বুঝতেন না। জ্ঞান ছিল তাঁর কাছে ব্যাপক। সে চীন দেশের মনীষীর জ্ঞানই হোক তার সুদূর ইউরোপের জ্ঞানই হোক, যে কোন উপায়ে লব্ধ জ্ঞানকে তিনি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদানরূপে গ্রহণ করতেন। এ দর্শনে ব্যষ্টিকে সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন স্বয়ম্ভরূপে কল্পনা করা হয়নি। দেহের এক অঙ্গের সঙ্গে অপর অঙ্গের যেমন অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বর্তমান, তেমনি মানুষের মধ্যেও যে একই প্রকৃতি, একই রক্তধারা বর্তমান-সে সত্যটি গোড়াতেই ঘোষণা করা হয়েছে, এই যে তোমাদিগের জাতি, ইহা তো একই জাতি। (সুরা আম্বিয়া: ২১-৬-৯১)। অপর জায়গায় বলা হয়েছে,  প্রকৃতপক্ষে তোমাদের এ ভ্রাতৃত্ব একই ভ্রাতৃত্ব এবং আমি তোমাদের প্রভু; সুতরাং আমাকে ভয় কর। মানুষেরা তাদের বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করেছে এবং প্রত্যেক জাতি তার আইন-কানুন ও লোকাচারে আনন্দ বোধ করে। (আল মুমিনুন: ৩৫২-৫৩)

আরও জোরালো ভাষায় অন্য এক স্থানে মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে, মানুষেরা গোড়াতেই একই জাতি ছিল কিন্তু পরবর্তীকে তাতে নানা বিভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। (সূরা ইউনুস: ২-১৯)

কুরআনের এই যে শিক্ষা, সে সম্বন্ধে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে- সে জ্ঞান কোন্ পর্যায়ের? তা’প্রয়োগলব্ধ, না অন্য কোন উপায় গৃহীত? তা কি সকল মানুষের পক্ষে সহজলভ্য? না, দুনিয়ার কয়েকজন সেরা মানুষের পক্ষেই সে জ্ঞানলাভ সম্ভবপর? কুরআনের শিক্ষা কি অন্য উপায়ে পাওয়ার ব্যবস্থা নেই? কুরআনের জ্ঞান হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) লাভ করেন বোধির মাধ্যমে। তাকে অন্যান্য বোধিলব্ধ জ্ঞান থেকে পৃথক করার উদ্দেশ্য বলা হয় প্রত্যাদেশ । সে জ্ঞান প্রয়োগ বা যুক্তি বিরোধী নয়। সে জ্ঞানলাভ সকল মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোর আবিস্কার সকল মানুষের পক্ষে অসাধ্য। মানুষের জীবনকে সর্বাবস্থায় সুসামঞ্জস্য ও সুস্থ করার জন্য এ প্রত্যাদেশমূলক জ্ঞানের ছিল অত্যন্ত প্রয়োজন। তা থেকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষ কিভবে তাকে নিয়ন্ত্র করবে, সে সম্বন্ধে রয়েছে স্পষ্ট নির্দেশ। তবে প্রত্যাদেশমূলক জ্ঞানের আর যে বিশেষ প্রয়োজন নেই, তা হযরত মুহাম্মদের (সঃ) বাণী থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। মনীষী ইকবাল তাই উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করেছেন, ইসলামের নবুয়ত তার পরিপূর্ণতা লাভ করে আবিষ্কার করতে সমর্থ হয় যে, তার বিলোপের রয়েছে একান্ত প্রয়োজন। এ আবিষ্কার আর কিছু নয়, শুধু এ উপলব্ধি যে, জীবন চিরকাল নেতৃত্বের সূত্রে আবদ্ধ থাকতে পারে না- তার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞানলাভের জন্য মানুষকে তার স্বীয় শক্তির ওপরই নির্ভরশীল হতে হবে

তাই স্পষ্ট বোঝা যায়, কুরআনের শিক্ষা গোড়াতেই মানুষকে বুঝতে দিয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে আর প্রত্যাদেশ পাওয়ার প্রয়োজন নেই। মানুষকে তার প্রকৃতিদত্ত বিচারবুদ্ধি বা পঞ্চ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের ওপর নির্ভর করতে হবে। তা’ থেকে আরও অবরোহ বা deductions টেনে নেয়া যায়; কুরআনের বাণীগুলো মানুষ গ্রহণ করেও তার বুদ্ধি ও বিচার বুদ্ধিকে কার্যকরী রাখতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, পবিত্র কুরআন মজিদে যেসব আদেশ-নির্দেশ প্রদত্ত হয়েছে সেগুলোও মানুষ তাদের বিচার-বুদ্ধির আলোকে যাচাই করে দেখতে পারে। তবে এ সম্বন্ধে মানুষের হতে হবে হুঁশিয়ার। কুরআনের আদেশাবলী এ দুনিয়ার যেমন কার্যকরী, এ দুনিয়ার পরবর্তী অপর এক দুনিয়ায়ও ফলদায়ক। কাজেই সে আদেশাবলীর মধ্যে যেগুলো কেবল এ দুনিয়ার কার্যকরী, তাদেরই বিচার সম্ভবপর। অপরগুলোর বিচার হতে পারে না। তার ওপর কুরআনের জ্ঞান প্রত্যাদেশ বলে সে জ্ঞানলাভ সম্বন্ধেও থাকতে হবে স্পষ্ট ধারণা।

প্রত্যাদেশ এমন কোন অবাস্তব জ্ঞান নয়, যার সম্বন্ধে কোন কথা বলার কারও কোন অধিকার নেই। প্রত্যাদেশ বোধিরই এক সংস্করণ এবং বোধিলব্ধ জ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞানের জগতে ও মনোবিজ্ঞানে যথেষ্ট আলোচনা করা হয়েছে। কাজেই প্রত্যাদেশের সঙ্গে বোধির কি সম্বন্ধ এবং বোধি বাস্তবিকই জ্ঞানের এক পদ্ধতি কিনা, সে সম্বন্ধে আমাদের আলোচনা করা দরকার।

লেখকের ‘জীবন সমস্যা সমাধানে ইসলাম’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো