দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের প্রবন্ধ ‘মানুষের পরিচয়’

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২০

একটি সত্য স্বভাবতই চোখে পড়ে। এ যাবত সেসব মতবাদের উৎপত্তি হয়েছে, তাতে মানবজীবনের কোনো বিশেষ দিকের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, তারই আলোকে গোটা জীবনের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য হয়েছে প্রয়াস। যদিও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নামে তারা জগতে প্রচারিত তবুও তাদের মধ্যে রয়েছে অবৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি। বিজ্ঞানের আসল কথা, জীবনের সকল তথ্যকে গ্রহণ করে, তার ব্যাখ্যার জন্য সার্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। এসব ব্যাখ্যায় সকল তথ্যকে গ্রহণ না করে বিশেষ থিয়োরি বা মতবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার চেষ্টায় অনেকগুলোকে করা হয়েছে অস্বীকার অথবা তাদের বিকৃতি করে ফেলে দেয়া হয়েছে ছকের মধ্যে। তাতে আরোহ পদ্ধতির করা হয়েছে অবমাননা। কারণ বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য বিশেষ থেকে সার্বিকে উপস্থিত হওয়া। অবরোহ পদ্ধতিতে কোনো বিশেষ নীতিকে গ্রহণ করে নিচের দিকে নেমে যাওয়া বৈজ্ঞানিক জগতে আত্মহত্যারই নামান্তর। অথচ লক্ষণীয় যে, আরোহ পদ্ধতিই বৈজ্ঞানিক জগতে একমাত্র বিষয় পদ্ধতি বলে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও সেই অবরোহ পদ্ধতির প্রভাব বিজ্ঞান এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাই গোড়াতে জীব জগতে যুদ্ধ বা কামপ্রবৃত্তির মৌলিকতা, মানুষের স্বার্থপরতা প্রভৃতি সূত্রগুলোকে স্বীকার করে তাদের একচোখা আলোকে জটিল জীবনের সবগুলো দিকের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে।

এমনকি, যে কার্ল মার্কস হেগেলের চিন্তা মাধ্যমগুলোকে শ্রেণি-সংগ্রামে রূপান্তরিত করে উৎপাদন ও বণ্টন-ব্যবস্থার সূত্রে জীবনের গতি ও ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, তার মনেও সবসময় হেগেলীয় দর্শনের প্রভাবই ছিল কার্যকরী। তাই তাকে অস্বীকার করেও জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে তারই অমোঘতা স্বীকার করে নিয়েছেন। উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়া মানবজীবনে যত সব ফ্যাকটর কার্যকরী সেগুলোকে তিনি করেছেন সম্পূর্ণ অস্বীকার বা যুক্তিবাদের প্রভাবে তিনি একটি ছকে ফেলে মানবজীবনে সবগুলো দিকের ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তাই দেখা দিয়েছে অবৈজ্ঞানিক মনোভাব।

দ্বিতীয়ত, আধুনিক বিজ্ঞানে যুক্তি ও অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানের একমাত্র পন্থা বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এগুলো ব্যতীত মানবজীবনে জ্ঞানের অপর কোন পন্থা নেই বলে ধরে নেয়া হয়েছে।এ মনোভাবের মধ্যেও বিজ্ঞানের রয়েছে এক মস্তবড় গোঁড়ামি।

তৃতীয়ত, এসব আলোচনার ফলে আমরা দেখেত পেয়েছি মানবজীবনের মধ্যে রয়েছে মস্তবড় দ্বন্দ্ব। এক-চোখামি করে মানবজীবনের কোন ব্যাখ্যা করতে গেলেই মানবজীবনের অন্য দিক বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তার ফলে অন্য মতবাদের উৎপত্তি হয়। তাতেও জীবনের ব্যাখ্যা সুষ্ঠু হয় বলে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের উৎপত্তি ও সংঘাতের মধ্য দিয়েই মানব-সভ্যতার গতি চলছে ধেয়ে। কাজেই মানবজীবন সম্বন্ধে কোন সার্বিক সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছার আগে তার সম্বন্ধে পেতে হবে পূর্ণ জ্ঞান। সে পূর্ণ জ্ঞানের আলোকেই গড়ে উঠবে তার জীবন-দর্শন।

মানবজীবনের অসংখ্য বৃত্তি ও প্রবৃত্তির সন্ধান পাওয়া যায়। তার জীবনে রয়েছে যেমন স্ববোধ তেমনি রয়েছে পরার্থপরতা। তার যেমন রয়েছে ক্ষুদা, যৌন প্রেরণা, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার বাসনা, সৌন্দর্য ভোগ করার প্রবৃত্তি, তেমনি রয়েছে প্রেম, আত্মত্যাগ, স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষা, রুচিবোধ, নীতিবোধ, এ বিশ্বের প্রকৃত পরিচয় পাওয়ার জন্য অদম্য আকাঙ্ক্ষা।

মানব-মনে রয়েছে মনন ক্ষমতা প্রক্ষোভ ইচ্ছাশক্তি। মানবমনের সম্ভাব্য উৎসের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বোধি ভুয়োদর্শন ও যুক্তির মাধ্যম আদি থেকেই মানুষ জ্ঞানলাভ করছে। গোড়াতে যে কোন একটিতে জ্ঞানের সূচনা হলেও পরবর্তীকালে তার বিস্তৃতি ও ব্যাখ্যার জন্য অপরটির প্রয়োগও সম্ভবপর। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে বোধিলব্ধ জ্ঞানের তেমন কার্যকারিতা স্বীকার করা হয় না; কার্যকারণ-পরম্পরা সূত্রের অমোঘ বিধান ধ্রুব সত্য বলে গৃহীত হওয়ার পরই বোধিলব্ধ জ্ঞানকে অসুস্থ ব্যক্তির বিকৃত কল্পনা বলে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, বিজ্ঞান অথবা তত্ত্বজ্ঞানের জগতেও বোধির মাধ্যমেই সবগুলো আবিস্কার হয় সম্ভবপর। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ বা আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তর্কবুদ্ধির দ্বারা আবিষ্কৃত হয়নি। তাদের সূচনা বাইরের উদ্দীপক দ্বারা হলেও ইন্দ্রিয়জ জ্ঞানের দ্বারা তারা আবিষ্কৃত হয়নি। হটাৎ আলোর ঝলকানির মত মনীষীদের মনের আকাশে প্রকৃতির এসব সূত্র হয়ে ওঠে জলজ্যান্ত।

মানবজীবনে দেখা যায়, কোন এক বিশেষ বৃত্তির অতিরিক্ত অনুশীলনে ব্যক্তিজীবনে দেখা দেয় নৈরাজ্য। ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য মানুষ আহার করে। সেই আহার করতে গিয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই তাতে মগ্ন থাকে, তা হলে তার স্বাস্থ্যহানি তো হবেই, তার ওপর তাকে সম্মুখীন হতে হবে আরও নানাবিধ সমস্যার। তেমনি কামকলার অতিরিক্ত অনুশীলনে মানবজীবনে চরম অধঃপতনের স্তরে উপস্থিত হয়। কাজেই দেখা যায়, কোন বিশেষ বৃত্তির অতিরিক্ত বিকাশের ফলে অন্যান্য বৃত্তিগুলো হয় অবদমিত এবং তার পরিণতিতে এক বৃত্তির সঙ্গে অন্য বৃত্তির সংঘাত ও সংঘর্ষ হয়ে পড়ে অনিবার্য।

সেরূপ কেবল একটি পদ্ধতির অনুরণেরও জ্ঞানের অন্যান্য পন্থাগুলো হয়ে পড়ে অকেজো। জ্ঞানের অন্যান্য শক্তিগুলো হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অসাড়। তাই বিকাশের পথে দেখা দেয় চরম অন্তরায়। মানবজীবনকে সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত করে তুলতে হলে তার জৈব-জীবনের নানাবিধ প্রবৃত্তির সুস্থ বিকাশ তার পক্ষে অতীব প্রয়োজন। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও বোধি, বিচারবুদ্ধি ও ভূয়োদর্শনের যথাযথ স্থান নির্দেশ করে তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করলেই জ্ঞানের পথ হয় সুগম। মানুষ সত্যের সঙ্গে পরিচয় লাভে হয় ধন্য। মানুষের জৈব-জীবনের বিভিন্ন বৃত্তির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করা দরকার। সেই যোগসূত্রের কল্যাণে পরস্পরবিরোধী ভিন্নমুখী প্রবৃত্তির মধ্যে শৃঙ্খলা হয় প্রতিষ্ঠিত এবং ব্যষ্টিজীবনে স্থাপিত হয় ভারসাম্য। মানব মনের আদিম স্ববোধ ও পরার্থিতার মধ্যে সমতা সাধিত হলে সমাজ-ব্যবস্থা ও ব্যষ্টিকেন্দ্রিকতা বা সমষ্টি-কেন্দ্রিকতার দোলায় না দুলে প্রগতির পথে হয় অগ্রসর।

মানবজীবনে নানাবিধ সহজাত বৃত্তি ও প্রবৃত্তির আলোচনা করলে বা মনন, প্রক্ষোভ বা ইচ্ছাশক্তির আলোচনা করলে দেখা যায়-তারা আপাতত পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন বা পরস্পরবিরোধী মনে হলেও তাদের মধ্যে একটা মৌলিক ঐক্য রয়েছে। সে ঐক্যের মূলে রয়েছে মানুষের আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি এবং আত্ম-প্রতিষ্ঠার প্রবৃত্তি Self perpetuation। মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে তার স্বজাতীয় ও বিজাতীয় নানাশ্রেণীর শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে চায়। এজন্যই তার মধ্যে সহজাত নানাবিধ বৃত্তি দেখা দেয়। আবার এ বিশ্বের নানাবিধ শত্রু থেকে নিরাপদ হলে সে এ বিশ্বে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে চায়। এ দুটো বৃত্তিকে একত্রে আত্ম-সংরক্ষণের Self preservation বৃত্তি বলা যায়। অনুধাবন করলে দেখা যায়, মানুষের ক্ষুধা, যৌন প্রেরণা, প্রকৃতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার বসনা, সৌন্দর্য ভোগ করার প্রবৃত্তি, প্রেম, আত্মত্যাগ,স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, এ বিশ্বের প্রকৃতি পরিচয় লাভ করার জন্য বাসনা, রুচিবোধ, নীতিবোধ প্রভৃতি সকল বৃত্তির মূলে রয়েছে সেই আত্মরক্ষা বা আত্মপ্রতিষ্ঠার বাসনা। ক্ষুধা নিবারিত না হলে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। এজন্য এ বৃত্তির চরিতার্থতা তার জীবনের পক্ষে প্রয়োজন। যৌন প্রেরণার মাধ্যমে মানুষ এ বিশ্বে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে মানুষ অমরত্ব লাভ করতে চায়। প্রকৃতির সঙ্গে বিরোধিতা করে মানুষ টিকে থাকতে পারে না বলে তার আত্মরক্ষার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রীর সম্বন্ধে আবদ্ধ হতে চায়। সৌন্দর্য ভোগের মধ্যে এমন এক চিরন্তন সত্তার সন্ধান পেতে চায়, যাকে লাভ করার ফলে সে এ বিশ্বে চিরস্থায়ী হয়ে বাস করতে পারে। প্রেমের মাধ্যমে সে তার জীবনে বলিষ্ঠতা লাভ করতে চায়, যার ফলে সে সবকিছুকেই তুচ্ছ করে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। এ বিশ্বের প্রকৃত পরিচয় লাভ তার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ এ পরিচয় লাভ করতে পারলেই তার পক্ষে স্থায়ী স্থিতির রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। ভাল ও মন্দের পার্থক্য বিচার করার মধ্যেই তার মধ্যে রুচিবোধ প্রকাশিত হয়। এ পার্থক্য বিচারের মূল ভিত্তি হচ্ছে-তার জীবনের পক্ষে সহায়ক ও জীবনের পক্ষে মারাত্মক বিষয়ের পৃথকীকরণ। এ পার্থক্য বিচার না করতে পারলে সে বহু পূর্বেই ধরাপৃষ্ঠ থেকে উধাও হয়ে যেত। এ বিচারই কালে জীবন থেকে পৃথক নীতিবোধ হলে স্বতন্ত্র এক নীতিতে পরিণত হয়। কাজেই এ সকল বৃত্তি ও প্রবৃত্তির আলোচনা করলে একথাই প্রমাণিত হয়-সবগুলো বৃত্তির মূলেই রয়েছে দুটো লক্ষ্য। একটা হচ্ছে-মানুষের আত্মরক্ষা Self protection অপরটা হচ্ছে আত্মপ্রতিষ্ঠা Self perpetuation।

এসব বৃত্তি এ প্রবৃত্তির মূলত উদ্দেশ্য সাধনমূলক স্থিতি থাকলেও বর্তমানে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণরূপেই দেখা দিচ্ছে। তবে এ ব্যাপারটি কেবল বৃত্তি ও প্রবৃত্তির বেলায়ি সত্য নয়। মানবজীবনের নানাবিধ আচরণেও তা প্রকাশ পায়। একদা দেহের পুষ্টির জন্যই মানুষ আহার করত, লজ্জা শরম নিবারণের জন্য কাপড় পরতো। এখন আহার্যের ব্যাপারে মানুষের লক্ষ্য শুধু ক্ষুধার নিবৃত্তি নয়-জিহ্বার স্বাদেরও পরিতৃপ্ত বটে। তেমনি নানাবিধ সূক্ষ্ম বস্ত্রাদি তৈরি করে মানুষ শুধু লজ্জা নিবারণই করতে চায় না সঙ্গে সঙ্গে পরিহিত বস্ত্রের মাধ্যমে তাকে অন্যান্য লোকের কাছে মোহনীয়ও করতে চায়। তবে গোড়াতে আহার্য পুষ্টিকর না হলে যতই সুস্বাদু হোক না কেন তাতে দীর্ঘকাল মানুষ মজে থাকতে পারে না। তেমনি পরিধানের বস্ত্র দ্বারা লজ্জা নিবারণ না হলে তার দ্বারা বস্ত্র পরিধানের আসল উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। এজন্য মানবজীবনকে সুষ্ঠুভাবে বিকাশের পথে নিয়ে যেতে হলে তার জন্য এমন এক প্রকল্প Hypothesis গ্রহণ করতে হবে যাতে তার জীবনে সম্পূর্ণভাবে সন্তোষ বিধান সম্ভবপর হয়। তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের এমন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে, যা আমাদের জীবনকে নানাবিধ শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখতে পারে। তার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে- এ প্রকল্পের মধ্যে এমন প্রতিশ্রুতি থাকবে- যাতে এ বিশ্বে আমরা অমরত্ব বা আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করার সান্তনা পেতে পারি।

যদিও নানাবিধ বৃত্তি ও প্রবৃত্তির মূলে রয়েছে আত্মরক্ষা বা আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য-তবুও তারা আপাতত স্বাধীন ও স্বনির্ভর রূপেই দেখা দিচ্ছে, এজন্য সে প্রকল্পের মধ্যে এমন উপাদান থাকে- যাতে সে বৃত্তি ও প্রবৃত্তিগুলো ও সন্তোষ লাভ করতে পারে। এ প্রকল্পের মধ্যে শুধু পূর্বোক্ত বিষয়গুলোর সন্তোষ বিধান হলেই হবে না- তার মধ্যে জ্ঞানের নানাবিধ মাধ্যমেরও সন্তোষ ও বিকাশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা পূর্বেই দেখেছি, জ্ঞানকে শুধু পঞ্চেন্দ্রিয়জাত সীমার মধ্যে আবদ্ধ করলে জ্ঞানের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না। তেমনি জ্ঞানকে শুধু বুদ্ধি অথবা বোধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করলেও জ্ঞানের প্রকৃত স্বরূপ প্রকটিত হয় না। পঞ্চেন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি ও বোধির অনুশীলনের ফলে যে ব্যাপক ও সর্বাত্মক আকারে জ্ঞান দেখা দেয়- তারই ভিত্তিতে এ বিশ্ব জগৎ বা স্থিতি সম্বন্ধে যে প্রকল্প গঠন করা হয় সে প্রকল্পই প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক সন্তোষ দানে সমর্থ। অতএব আমাদের জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশ ও তার সন্তোষ বিধানের এরূপ একটা প্রকল্প গঠন করা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে বুদ্ধির সন্তোষ ও জীবনের সন্তোষের মধ্যেও পার্থক্য প্রদর্শন করা অবশ্য কর্তব্য। বুদ্ধির সন্তোষ দানের জন্য যুগে যুগে নানাবিধ দার্শনিক মতবাদের উৎপত্তি ও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। অতি আদিকালের গ্রিকদের মধ্যে যে সংস্কৃতির বিকাশ হয়েছিল, তাতে একে একে জড় বস্তুগুলোকে এ জগতের আদি সত্তা হিসেবে গ্রহণ করে ক্রমশ গ্রিক চিন্তাধারা অমূর্ত বিষয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। তাতে সাময়িকভাবে মানস-মানস, বিশেষত মানববুদ্ধি সন্তোষ লাভ করলেও মানবজীবন তাতে সম্পূর্ণ সন্তোষ লাভ করেনি। কারণ, বুদ্ধিই মানবজীবনের একমাত্র বৃত্তি নয়। তার সঙ্গে প্রক্ষোভ বা ইচ্ছাশক্তি তো রয়েছেই; তার ওপর নানাবিধ উপরিভাগজাত বৃত্তিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বুদ্ধিকে অভিজ্ঞতানিরপেক্ষ কোনও আদিম বৃত্তি বলেও গণ্য করা যায়, তাহলেও প্রত্যক্ষণজাত ইমেজ image বা কল্পনা প্রভৃতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তেমনি প্রক্ষোভজাত নানাবিধ বিষয় এবং ইচ্ছাশক্তির নানবিধ দাবী ও প্রকাশকেও অস্বীকার করা যায় না। কাজেই যে ক্ষেত্রে শুধু বৃদ্ধির সন্তোষ বিধানের জন্যই রয়েছে একমাত্র লক্ষ্য- সে মনোবৃত্তি বা তদ্‌জাত সিদ্ধান্তকে জীবনের চরম সন্তোষ বিধানের সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায় না।

এ জন্যই এক্ষেত্রে দর্শন ও জীবন-দর্শনের অর্থাৎ শুধু বুদ্ধিজাত সিদ্ধান্তের ও নানাবিধ বৃত্তির সন্তোষ বিধানকল্পে গঠিত প্রকল্পের পার্থক্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়া কর্তব্য। বুদ্ধির কারসাজিতে এখন পর্যন্ত মানুষ যেসব সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছে-তাতে কেবল বুদ্ধিই সন্তোষলাভ করেছে। মানবজীবনের আরও নানাবিধ বৃত্তি বা প্রবৃত্তি তাতে সন্তোষলাভ করেনি। এখানেই দর্শন ও ধর্মের মধ্যে রয়েছে গুরুতর পার্থক্য। দর্শন মানুষের বুদ্ধিকে সন্তোষদানে সাময়িকভাবে সমর্থ হয়। ধর্ম বা জীবনদর্শনের সার্থকতা হচ্ছে মানবজীবনের নানা বিষয়ের সন্তোষদানের সামর্থ্য। এজন্য মানবজীবনের দর্শনের প্রভাবের চেয়ে ধর্মের প্রভাব গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী। সমগ্র আদি যুগে কেবল দর্শনের চর্চা করা সত্ত্বেও খ্রিষ্ট ধর্মের আবির্ভাবের ফলে মানুষের মন সে ধর্মের প্রতি এমনভাবে আকৃষ্ট হল কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়-জীবনের একমাত্র বৃত্তি বুদ্ধির সন্তোষ বিধানে পর্যবসিত হওয়ার অন্যান্য বৃত্তি ও প্রবৃত্তির সন্তোষ-বিধানের জন্যই সে প্রতিক্রিয়া এরূপ প্রচণ্ডভাবে দেখা দিয়েছিল। দর্শন ও জীবন-দর্শনের মধ্যে আমরা এরূপ পার্থক্য করিনে বলে অনেক সময় শুধু বুদ্ধির আলোকে আমরা জীবন-দর্শনের আলোচনায় প্রবৃত্ত হই।

আমাদের তাই এ পার্থক্যকে সামনে রেখেই সে প্রকল্পের গঠনে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে এমন এক প্রকল্প গ্রহণ, যাতে কেবল বুদ্ধি নয়, সকল বৃত্তিও সন্তোষ লাভে হয় সমর্থ। এরূপ একটা প্রকল্পের সন্ধান আমরা পাচ্ছি ইসলামের আল্লাহ্‌ নামক ধারণার মধ্যে। এ ধারণার কোন ইন্দ্রিয়লব্ধ বা প্রত্যক্ষণজাত ধারণা নয়। বুদ্ধি দ্বারাও এ ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ ধারণার সন্ধান পেয়েছেন হযরত রসূলই-ই আকরাম (সঃ) প্রত্যাদেশ বা revelation-এর মাধ্যমে। এ প্রত্যদেশ স্বজ্ঞারই এক বিশেষ সংস্করণ। আমরা মানব-জ্ঞানের আলোচনা প্রসঙ্গে পূর্বেই দেখতে পেয়েছি স্বজ্ঞা থেকে নানাবিধ আবিস্কার সম্ভব হতে পারে। জুঙের বর্ণনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, স্বজ্ঞার কার্যকারিতার ফলে দ্রষ্টার সৃষ্টি হতে পারে। হযরত রসূল-ই আকরাম (সঃ) দীর্ঘকাল হেরা পর্বতে সত্য লাভ করার জন্য যে তপস্যা করেছিলেন তারই ফল হিসেবে প্রথমে ২৭ শে রমযানের রাত্রিতে আল্লাহ্‌র বাণী নিয়ে ফেরেশতা জিবরাইল (আঃ) দেখা দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে পূর্ণ ধারণা হযরতের মানসে জীবন্ত হয়ে দেখা দেয়। এজন্যই দেখা যায়, জ্ঞানের রাজ্যে অন্বেষণকারী যাতে অবলীলাক্রমে অগ্রসর হতে পারে, তার জন্য অন্য কোন স্বতঃসিদ্ধের প্রয়োজন দেখা দেয়নি। জ্ঞানবিস্তার আলোচনা করলে দেখা যায়-সাধারণত পঞ্চেন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান ও বুদ্ধিজাত জ্ঞানকেই শুধু দুটো রূপ বলে ধরে নেয়া হয়। অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিকদের মতবাদ অনুসারে আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা যে সব সংবেদন লাভ করি, তার ভিত্তিতেই আমাদের জ্ঞানের সৌধ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য এ মতবাদের প্রবর্তক জন্‌ লক মন্তব্য করেছেন, There is nothing in the intellect; which was not previously in sensation। অর্থাৎ, আমাদের বুদ্ধিতে এমন কোন কিছুই নেই যা আগে সংবেদনের মধ্যে ছিল না।

অপরদিকে বুদ্ধিবাদীদের বক্তব্য হচ্ছে, বুদ্ধি দ্বারাই সত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের রয়েছে একমাত্র সম্ভাবনা। বুদ্ধি বা যুক্তিবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছেন, Whatever is real is rational and whatever is rational is real. অর্থাৎ যা কিছু বাস্তব বা যুক্তিপূর্ণ এবং যা কিছু যুক্তিপূর্ণ তা বাস্তব। এ নীতির প্রথম দিকটা গ্রহণ করতে সকলেই সম্মত। কারণ যা কিছু সত্য তা যুক্তিপূর্ণ হতে বাধ্য। যাতে কোন যুক্তির অবকাশ নেই- তা হয় কাল্পনিক, না হয় মিথ্যা। তবে যা যুক্তিপূর্ণ তা বাস্তব বলা সব সময় ঠিক নয়। কারণ যুক্তির ধারায় আমাদের পক্ষে এমন এক স্তরেও আসা সম্ভবপর, যার স্থিতির স্বপক্ষে কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণ নেই বা অন্য কোন প্রমাণও নেই। তবে অভিজ্ঞতাকে বা যুক্তিকে- যে কোন পদ্ধতিকেই জ্ঞান লাভের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করি না কেন- অভিজ্ঞতা বা যুক্তি সে আমাদের সঠিক জ্ঞান দান করতে পারে, সে সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারিনে। এক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা বা যুক্তির বহির্ভূত অন্য কোন প্রত্যয়ের ওপর আস্থা স্থাপন করতে হবে। কেননা, এ বিশ্ব বিধানে এমন কোন শক্তি থাকতে পারে, যা সবসময়ই মানুষকে প্রতারিত করে। আধুনিক দর্শনের পিতা ডেকার্থ তাঁর অনুসন্ধানের প্রথম স্তরে এজন্য সবকিছুইকেই অবিশ্বাস করতে ছিলেন প্রস্তুত। অবশেষে Cogito Ergo Sum (আমি চিন্তা করি বলে আমি আছি) এ সত্যে এসে উপনীত হন। তবে এখানে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। তিনি যে চিন্তা করেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই- তবে সে চিন্তার বিষয়বস্তু সত্য কিনা তার তো বিচার হয়নি। এমনও তো হতে পারে যে, তাঁর চিন্তা সত্য, তবে তিনি চিন্তার ক্ষেত্রে বারবার শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন। তারঁ চিন্তা তাঁর সামনে যত সব বিষয় উপস্থাপিত করছে- বাস্তবে সে সবের কোন অস্তিত্ব নেই। চিন্তার বিষয়বস্তু পরিচ্ছন্ন হলেই তা সত্য হয় না। কোন চিন্তা সত্য হতে হলে বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ চাই। সে যোগ যে চিন্তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে,- তার কোন সার্টিফিকেট আমরা পাচ্ছিনে। এজন্য আমাদের ধরে নিতে হয় এ বিশ্ব চরাচরের সবকিছুই এমনভাবে সৃষ্ট যে, তা মানব জ্ঞানের পক্ষে অধিগম্য। সে স্বতঃপ্রমাণের ভিত্তি অভিজ্ঞতা বা যুক্তি নয়। সে স্বতঃপ্রমাণ আসে প্রত্যয় থেকে। ইসলামী মতে বলা হয়-আল্লাহ্‌কে স্বীকার করলে জ্ঞাতার সঙ্গে জ্ঞেয় বস্তুর সম্বন্ধ সবসময়ই পরিস্কার হয়ে দেখা দেয়। আল্লাহ্‌র বিধান মতে জ্ঞাতা সত্যিকার জ্ঞানলাভে সমর্থ। কেননা আল্লাহ্‌ এ বিশ্বকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তাতে জ্ঞাতার পক্ষে গান লাভ করার রয়েছে সমূহ সম্ভবনা।

আল্লাহ্‌র এ ধারণাকে মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধানে সফল বলে স্পষ্টই প্রমাণিত হয়। কারণ, আমরা পূর্বেই দেখেছি-শুধু বিচার-বুদ্ধির সন্তোষ লাভই মানবজীবনের কাম্য নয়। মানুষের মধ্যে তার সবগুলো বৃত্তি ও প্রবৃত্তির সন্তোষ লাভের রয়েছে অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তার মধ্যে যেমন যৌন আবেগের পরিতৃপ্তির জন্য আকাঙ্ক্ষা তেমনি ক্রোধ, লোভ সবগুলো রিপুকেই যথাযথ ব্যবহার করার জন্যে রয়েছে তাগিদ। আল্লাহ্‌ নামক এ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আদেশ-নিষেধপূর্ন যে পুস্তক-কুরআন-উল-করীমের আলোকে মানুষ তা সহজেই লাভ করতে পারে। এমনকি যে কল্পনাকে মানুষ শিশুদের জীবনে কার্যকরী এক বৃত্তি বলে উপহাস করে-সেই কল্পনারও যথাযথ সন্তোষ বিধানের সূত্র রয়েছে। অতএব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র বিভিন্ন গুণ কিভাবে কার্যকরী হতে পারে-সে সম্বন্ধে আমাদের আলোচনার প্রয়োজন।

লেখকের ‘জীবন সমস্যা সমাধানে ইসলাম’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো