দেবিকা সৌভাগ্যবান, তাই যুদ্ধটা চালিয়ে গেছে

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২৩

মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে দেখলাম। সিনেমা খুব কম দেখি, এতক্ষণ একনাগাড়ে বসে থাকার ধৈর্য থাকে না। মাঝে মধ্যে সিনেমা ছেড়ে অন্য কাজ করি। রেডিওর মতো শুনে শুনে কল্পনা করে নিই। সেটা বেশি উপভোগ করি।

 

এই সিনেমাটা একবারের বসাতে দেখলাম। আমি সিনেমা বোদ্ধা না। রানি মুখার্জির অসাধারণ আর সাবলীল অভিনয়ের জন্য মনে হলো, পুরা সিনেমাটা উনিই টেনে নিয়ে চলেছেন। আমি একটু সাজানো গুছান মানুষ। রানির মানে প্রটাগনিস্টের প্রথম দিকের অগোছালো সংসার, বা বাচ্চাদের সামলাতে হিমশিম খাওয়া দেখে বিরক্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ঠিকই আছে, এর কাছে বাচ্চা রাখার মানে হয় না।

 

এটা খুব ব্যক্তিগত ভাবনা। সবাই গোছানো হবেক, এর কোনো মানে নাই। আর এজন্য কারো বাচ্চা কেড়ে নেওয়ারও কোনো অধিকার কারো নাই।

 

সবচেয়ে বড় কথা, ইউরোপের মতো জায়গায় যেখানে ডমেস্টিক হেল্প পাওয়া আমাদের জন্য একটা অলীক চিন্তা, সেখানে পার্টনারের হেল্প ছাড়া দুই বাচ্চা পেলে বড় করা খুবই কঠিন কাজ। আমি এ ব্যাপারে প্রথমে পরিবারের আর এখন পার্টনারের পুরা সাপোর্ট পাই বলেই হয়ত প্রথমদিকের দেবিকাকে বুঝতে পারিনি, তাকে নিয়ে বিরক্ত হয়েছিলাম।

 

বাকি যেসব চরিত্র দেখানো হয়েছে, সেসব খুবই বাস্তব। আমার দেখা বেশিরভাগ, বলতে গেলে নব্বইভাগ বাবাই অনিরুদ্ধের মতো স্বার্থপর আর ছোটমনের মানুষ। তারা সংসারের কাজে বা বাচ্চা পালার কাজে বউকে সাহায্য করার কথা দূরে থাক, বউদের কষ্ট কিছুই বুঝতে চায় না। তারা মনে করে, জীবনে টাকা উপার্জন করাটাই সবচেয়ে বড় কাজ আর সংসারে এফোর্ট দেওয়া, বাচ্চা পালা এসব কোনো কাজই না, তুড়ি দিলেই এসব হয়।

 

সংসারে তারা মায়ের শ্রমকে কোনো মূল্যই দেয় না। সংসার সামলানোর মতো কাজকে তারা ননপ্রডাকটিভ ভাবে এবং তাদের চোখে এর কোন অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নাই। যেহেতু, অর্থনৈতিক মূল্যায়ন নাই, তারা তাই সংসারে নারীদের খুবই ছোট করে দেখে। দুইপয়সা দিয়ে মনে করে বাকি সকলের মাথা তারা কিনে নিয়েছে, ছোটলোকি চিন্তা বলতে যা বুঝায়।

 

কমবেশি সব পরিবারেই অনুরাগের মতো এরকম অকর্মা, লোভি একজন চাচা বা সদস্য থাকে, যাদের প্রথম চিন্তা কিভাবে অন্যদের ঠকিয়ে বা ব্যবহার করে সব হাতিয়ে নিবে। আমি এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। নিজের সমস্ত উপার্জন দিয়ে নির্ঝর, নিসর্গের জন্য যা করেছিলাম, আমি চলে আসার পরে সেগুলোতে তাদের লোভি চাচা-চাচির চোখ পড়েছে। আমার বাচ্চাদের সরিয়ে দিয়ে তারা এখন সেসব ভোগ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। বাকি সব চরিত্রগুলোই একদম বাস্তব।

 

এখানে দেবিকা সৌভাগ্যবান, তার পরিবার তার পাশে ছিল শেষ অবধি। তাই যুদ্ধটা সে চালিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছে। কিন্তু খুব কম নারীই নিজের যুদ্ধে পরিবারকে পাশে পায়। উল্টা অনেক পরিবার আছে, নারীদের পেছনে টেনে ধরে রাখে। এক কথায় সিনেমাটা দেখে আমি খুব ইন্সপায়ার্ড হয়েছি। দেবিকার মধ্যে যে সহজ, সাবলীল শক্তি ছিল, সেটা প্রত্যেক নারীর মধ্যে থাকা খুব জরুরি।

 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী