নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা

পর্ব ৪

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ২৩, ২০২০

গ্রীসের পরই ইউরোপে নাট্য ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ধারাটি হচ্ছে রোমের নাট্যচর্চা। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে গ্রীস রোমের অধীনে চলে যায়। শুধু গ্রীস নয়, ইউরোপের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রই তখন রোমের পদানত। প্রাচীনকালের পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল রোম। কিন্তু প্রাচীন যুগে রোমের আগে বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে গ্রীস। ভূমধ্যসাগর ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল ছিল গ্রীসের দখলে, পরে যা রোমের দখলে চলে যায়। শুরুতে গ্রীস ছিল কতগুলি ছোট ছোট নগররাষ্ট্রের সমাহার। খাড়া পর্বতমালা ও সমূদ্রের কারণেই প্রাচীনকালে গ্রীস দীর্ঘদিন ছোট ছোট নগররাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। গ্রীসের এই নগর রাষ্ট্রগুলির উপর কিছুদিন পারস্য মানে বর্তমান ইরানের আক্রমণ চলে খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে। কিন্তু ম্যারাথনের যুদ্ধে পারস্যরা প্রথমবার গ্রীকরাষ্ট্র এথেন্সের কাছে পরাজয় বরণ করে। ক্ষুদ্র এথেন্স বিরাট পারস্য বাহিনীকে পরাজিত করলে সে বিজয় সংবাদ নগরবাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য জনৈক সৈনিক ছাব্বিশ মাইল দৌড়ে নগরে প্রবেশ করে। বিজয় সংবাদটি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু ঘটে। ম্যারাথন দৌড় তার সম্মানেই প্রচলিত। বিশ্ব অলিম্পিকের শুরুও গ্রীসে। সালামিসের যুদ্ধে এথেন্স চূড়ান্তভাবে বিরাট পারস্য সাম্রাজ্যের বাহিনীকে পরাজিত করলে নগররাষ্ট্রটি দাম্ভিক হয়ে পড়ে। ফলে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই এথেন্স সমগ্র গ্রীস ভূখণ্ডের উপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়।

গ্রীসের ভিন্ন একটি নগররাষ্ট্র স্পার্টাও নিজ প্রভুত্ব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। ফলে গ্রীসের উপর আধিপত্য চালাবার জন্য স্পার্টা আর এথেন্সের মধ্যে বিবাদে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রগুলি দু-দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ত্রিশ বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর এথেন্স পরাজিত হয়। বিভিন্ন নগররাষ্ট্র সহ স্পার্টাও দুর্বল হয়ে পড়ে দীর্ঘদিন চালানো যুদ্ধের কারণে। গ্রীসের দুই পক্ষের ত্রিশ বছরব্যাপী সেই যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে থুকিডাইডিস লিখেছিলেন বিখ্যাত গ্রন্থ “পেলোপনেসীয় যুদ্ধ”, যা বিশ্বের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। গ্রীসের সবচেয়ে উজ্জ্বল নগররাষ্ট্র ছিল এথেন্স, বিশ্ব সভ্যতাতে জ্ঞানের জগতে যারা বহু কিছু দিয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতক ছিল গ্রীসের সেই যুগ যখন নাট্যকার ইউরিপিডিস, য়্যারিস্টোফেনিস আর দার্শনিক সক্রেটিস জন্মেছিলেন। খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সম্রাট আলেকজান্ডারের পিতা দ্বিতীয় ফিলিপ মেসিডোনিয়ায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে দুর্বল গ্রীস নগররাষ্ট্রগুলিকে একর পর এক দখল করতে শুরু করে। পরে আলেকজান্ডার নিজে দখল করে পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং মিশর। সিন্ধুনদ পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ভারতের বর্তমান ‘হিন্দু’ বা হিন্দুধর্ম কথাটা এসেছে এই সিন্ধু নদ থেকে। গ্রীক আর পারস্যরা নাকি ‘স’ উচ্চারণ করতে পারতো না। ফলে সিন্ধুকে বলতো ‘হিন্দু’ আর সিন্ধু নদীর ওপর পারে বসবাস করা মানুষদের বলতো হিন্দু। ফলে হিন্দু সত্যিকার অর্থে কোনো ধর্ম নয়, প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত সিন্ধুর ওপর পারের জনগোষ্ঠী, মানে সকল ভারতবাসীকে বলা হতো হিন্দু। পারস্যরাও তাই বলতো। বিপরীত দিকে ভারতীয়রা গ্রিক আর পারস্যদের বলতো ‘যবন’, কথাটার মানে বিদেশী। পাশাপাশি ম্লেচ্ছ কথাটার মানেও ভিনদেশী, হতে পারে সে ভারতীয় কিংবা ভারতের ভিন্ন অঞ্চলের। মনে করা হয়, সম্রাট আলেকজান্ডারের সময় নাটক বা ভিন্ন কিছু বিষয় নিয়ে চিন্তার আদানপ্রদান হয়েছিল ভারতবাসীর সঙ্গে গ্রীসের।

সম্রাট আলেকজান্ডার তেত্রিশ বছর বয়সে সম্ভবত ম্যালেরিয়ায় মারা গেলে গ্রীস সাম্রাজ্যের পতন আরম্ভ হলো। খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের প্রথমার্ধে ইতালীর দক্ষিণে অবস্থিত গ্রীস শহরগুলি রোম দখল করে নেয়। রোম এরপর সমগ্র গ্রীস এবং মেসিডোনিয়া নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে। খ্রীস্টের জন্মের বহু বছর পূর্বেই ঘটে ঘটনাগুলি। গ্রীস দখল করার পাশাপাশি রোমানরা যেমন গ্রিক শিল্পকলা গ্রহণ করেছিল, পাশাপাশি গ্রীক দেবদেবীদের পূজা আরম্ভ করে। কিন্তু গ্রীসে সেসব দেবদেবীদের যে নাম ছিল রোমের শাসনে তা পাল্টে যায়। গ্রীসের দেবী আফ্রিদিতি তাই রোমে এসে হয়ে যায় ভেনাস। খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময়ে সম্পূর্ণ গ্রীস রোমের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু প্রবল পরাক্রমশালী রোম নিজের পদানত গ্রীসের সাংস্কৃতিক দাসত্ব বরণ করে নিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে রোম গ্রীক সভ্যতার ধারক ও বাহক হিসাবে কাজ করে এবং ঐ সভ্যতার বহু অবদানকে ভিন্ন ভিন্ন জাতির দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছিল। যদিও নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে গ্রীস কিন্তু রোমের ওপর খুব প্রভাব ফেলতে পারেনি। জুলিয়াস সীজার রোমের একচ্ছত্র অধিপতি হবার আগেই দখল করে নেয় ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড। দুটো দেশের মানুষকে তখন বলা হতো বর্বর। কথিত আছে, প্রাচীন আদিবাসী এইসব মানুষরা নাকি বুরবুর করে কী ভাষায় কথা বলতো, তা বুঝতে না পারার জন্য বর্বর শব্দটার উৎপত্তি। সীজার পরে দখল করে স্পেন ও মিশর। ফ্রান্সকে বলা হতো তখন গল, ফ্রান্স দখল নিয়ে সীজারের নিজের লেখা গ্রন্থ আছে “গল অভিযান”।

সম্রাট জুলিয়াস সীজার প্রচুর পড়াশুনা করতেন, বিশেষ করে দর্শন আর কাব্য। বলতে গেলে সেদিক থেকে সীজার ছিলেন প্লাটোর সেই আকাঙ্ক্ষিত দার্শনিক বা প্রজ্ঞাবান শাসক। রবীন্দ্রনাথের নাটকে প্লাটোর আকাঙ্ক্ষিত এইসব দার্শনিক রাজাদের দেখা মিলবে। বলতে গেলে শুধু মাত্র ‘তাসের দেশ’ ছাড়া ‘রক্তকরবী’, ‘বিসর্জন’, ‘ডাকঘর’, ‘মুক্তধারা’, ‘রাজা’; প্রায় সকল নাটকেই রাজার চরিত্রটি জ্ঞানী কিংবা জনদরদী ঋষিতূল্য। সম্ভবত প্লাটোর রাষ্ট্রচিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যাপারটা রোমের ক্ষেত্রে সীজার পর্যন্তই সত্য ছিল, বাকি সম্রাটরা প্রায় সকলেই ছিল চরম ভোগবাদী। শাসকরা দার্শনিক চিন্তা নিয়ে মাথা ঘামাতো না পরের দিকে। ফলে রোমের নাট্যচর্চায় তার প্রভাব লক্ষ্য করা যাবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো এই যে, প্রাচীন যুগের রোমের শাসক বা মানুষরা ধর্ম বা পরকাল নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল না। পার্থিব জীবন নিয়েই তারা বেশি ব্যস্ত ছিল। সাম্রাজ্যে দেবদেবীর কেউ নিন্দা করলেও বা তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করলে তার জন্য শাস্তি হতো না। সম্রাট টাইবেরিয়াসের বক্তব্য ছিল, ‘দেবতারা যদি অপমানিত হয়েই থাকেন তবে তাঁরা নিজেরাই তার প্রতিকার করবেন’। বক্তব্যটা হলো এমন যে, সম্রাটের ক্ষমতা যখন দেবতাদের চেয়ে বেশি নয়, সম্রাটের তখন দেবতাদের ব্যাপারে কিছু করবার নেই। সর্বক্ষমতাময় দেবদেবীরা তার জন্য নিজেরা কী শাস্তি দেয় সেটাই দেখা যাক। সম্রাটের কাছে এসে দেবদেবীরা তো কেউ নালিশ জানায়নি কারো বিরুদ্ধে। নিজেদের অপমানিত হবার কথাটা বলছেই না কখনো।

গ্রীসের প্লাটো, য়্যারিস্টটলের মতো জ্ঞানী মানুষরা কিন্তু দেবদেবীর উপর আস্থা রাখতেন সাধারণ মানুষের মতোই। ফলে মদিরা ও শস্যদেবতা দিউনিসাসকে কেন্দ্র করে গ্রীসে নাট্যকলা জন্ম নিয়েছিল ও বিকশিত হয়েছিল। প্রাচীন রোমের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি, রোমানরা তাদের শস্যদেবতা তেল্লুসকে অবলম্বন করে উন্নতমানের কোনো নাট্যকলার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটাতে পারেনি। রোমে শস্যদেবতাদের সম্মানে যেসব উৎসব ছিল তাতে হাস্যকৌতুক, ভাঁড়ামি, অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শন ইত্যাদিই হতো। যদিও গ্রীসের নাট্যপ্রেরণা থেকেই রোমের নাট্য ইতিহাস শুরু। রোমবাসীরা নাটকের চেয়ে দড়ির খেলা, মুষ্টিযুদ্ধ কিংবা তারচেয়ে নৃশংস গ্লাডিয়েটরদের অনুষ্ঠান যা এ্যাম্ফিথিয়েটারে অনুষ্ঠিত হতো, তার প্রতি ছিল বেশি অনুরক্ত। শাসকরা নাটকের চেয়ে সেগুলিকেই বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করতো। বিরাট বিরাট স্টেডিয়াম বা খেলার মাঠে সিংহের সঙ্গে মানুষের নৃশংস যুদ্ধ যতো পৃষ্ঠপোষকতা পেতো শাসকদের, নাটকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো ছিল। ঠিক বর্তমান যুগের মতো। বর্তমানে স্পেনে মানুষের সঙ্গে ষাড়ের লড়াই দেখতে বহু মানুষ ভীড় জমায়। ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা, অলিম্পিক সহ নানা খেলায় বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের যেমন বিরাট পৃষ্ঠপোষকতা; নাটকের ক্ষেত্রে তা ঘটছে না। কারণ নাটক কথা বলে, মত প্রকাশ করতে চায়। প্লাটোর ভাষায়, নাটকের যখন সুশিক্ষা দেবার ক্ষমতা আছে, নাটক তখন কুশিক্ষাও দিতে পারে বা দেবতাদের সমালোচনা করে বসতে পারে।

রাষ্ট্র্রের স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটাবার ক্ষমতা রাখে নাটক। বিভিন্ন রকম খেলাধূলা বা শরীরচর্চা তা করে না বরং এগুলি মানুষকে উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখে। মানুষের চিন্তাশক্তিকে ধর্মীয় উন্মাদনার মতোই দখলদারী করে তোলে, হয় এর না হয় ওর পক্ষে। কাউকে পরাজিত করেই কাউকে বিজয়ী হতেই হয় খেলাধূলার ক্ষেত্রে। দর্শকরা মানুষের পরাজয়ে সেখানে যুক্তিহীনভাবে আনন্দ পায়, পক্ষপাত করে সম্পূর্ণ অন্ধ ভক্তি থেকে। নাটকের ক্ষেত্রে তেমন ব্যাপার নেই। দুপক্ষই সেখানে পরাজিত হতে পারে, ঠিক যেমন “সোহরাব রুস্ত”। নাটকের লক্ষ্য থাকে মতাদর্শ প্রচার, থাকে মানব সভ্যতার নানা বিশ্লেষণ। মানব মনের বিচিত্রজগত পর্যন্ত নাটকের বিষয়। মানবচরিত্রের অন্তর্জগতকে প্রকাশিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নাটক প্রাচীনকাল থেকে। কিন্তু শেষ হয়েও তা কখনো শেষ হচ্ছে না। নাটক-সাহিত্যের জগত বিশাল, পরিধি ব্যাপক; সীমাহীন। খেলাধূলার মতো খেলা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নাটক ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি ঘটে না। মানুষের মধ্যে নাটক দেখা শেষ হবার পরেই হয়তো নতুন চিন্তা আরম্ভ হতে থাকে। মানুষের চিন্তাশক্তিকে নাটক ঘা দেয়, কিন্তু অন্ধ ভক্ত বানায় না নাটকটি যদি সত্যিই নাটক হয়ে উঠতে পারে। নাটকের কাজ সমাজকে ব্যাখ্যা করা। সকল মহৎ নাট্যকাররা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, নাটকের প্রধান কাজ সমাজ-সত্য উচ্চারণ। ফলে নাটকের রয়েছে এক ধরনের প্রকাশ গুণ, রয়েছে প্রচরণার প্রবনতা। প্রচারণার লক্ষ্যটি হলো, মানুষের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করা, মানুষের মস্তিষ্কে নতুন চিন্তার বীজ বুনে দেয়া।

সাম্রাজ্যশক্তি হিসাবে রোমানরা গ্রীস জয় করে নিয়েছিল আর শাসকশ্রেণীর জন্য রোমের অর্থনীতি ছিল প্রাচুর্যপূর্ণ। নানা জায়গার সম্পদ চলে আসতো তাদের কাছে। হ্যাঁ, রোমেও শীঘ্রই নাটক কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। কিন্তু গ্রীসের মতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেল না। প্রাচীন গ্রীসে নাটকের আবির্ভাব ঘটেছিল ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে, সেখানে নাট্যাভিনয় ছিল জাতীয় উৎসব। রাষ্ট্রটি গণতান্ত্রিক হওয়ায় সকল নাগরিকের প্রবেশাধিকার ছিল প্রেক্ষাগৃহে, যা রোমের দর্শকদের বেলায় ঘটেনি। প্রাচীন রোমের অভিনেতারা তাঁদের পূর্বসূরী গ্রীক-অভিনেতাদের মতো উচ্চ ধর্মীয় বা সামাজিক মর্যাদা পাননি। এখানে অধিকাংশ অভিনেতাই ছিলেন দাসশ্রেণী থেকে উদ্ভূত, যাঁদের কোনো ধর্মীয় বা আইনগত অধিকার ছিল না। সমাজে এঁরা ছিলেন নিছক পেশাদার আমোদদাতা। গ্রীসে ক্রীতদাসরা নাগরিক ছিল না। ফলে প্রভু বা মালিকের সেবা করা ছিল তার কাজ, ব্যাপারটা সেযুগে রোমে একইরকম ছিল। ইউরোপে সেটা চলছিল দাসযুগ। গ্রীসের গণতন্ত্রীরাও ধর্মকে তাদের শাসনব্যবস্থার ভিত দৃঢ় করার জন্য বিপুলভাবে কাজে লাগিয়েছিল, কিন্তু পাশাপাশি চলে ধর্মের সমালোচনা। যারা ধর্মের প্রবক্তা, ঠিক বিজ্ঞানের চর্চা ঘটছে তাদের হাত দিয়েই। সক্রেটিসের শিষ্য প্লাটো ধর্মের পক্ষে কথা বললেও, বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। য়্যারিস্টটলের ক্ষেত্রে সেটা ছিল আরো অনেক বেশি সত্য। ফলে গ্রীসের ধর্মীয়-ব্যবস্থা সমাজে অচলায়তন সৃষ্টি না করে মুক্তচিন্তার পরিবেশ রেখেছিল। গ্রীসের নাট্যজগতে তাই বিভিন্নরকম চিন্তার দেখা মেলে। নানান দার্শনিক চিন্তার দেখা পাওয়া যায়। গ্রীসে নাটক দেখতো একসঙ্গে বসে হাজার হাজার মানুষ। ফলে সেখানে অভিনেতাকে সংলাপ শোনাতে হতো সবার আগে। দর্শক সংলাপের ভিতর দিয়ে নাট্যকারের দর্শন বা বক্তব্য উপলব্ধি করতে আগ্রহী ছিল। প্রাচীন গ্রীসের অভিনেতারা ছিলেন তাই নাট্যকারের বক্তব্য বা উক্তির বাহন মাত্র। হাজার হাজার মানুষকে নিজের দক্ষতা বা মুখাবয়বের প্রতিক্রিয়া দেখাবার সুযোগ অভিনেতার ছিল না। দার্শনিক চিন্তার এসব নাটকে দর্শকরা তখনকার বাস্তবতায় শুধু সংলাপ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতেন।

প্রাচীন রোমের নাটকের সাথে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো সংযোগ ছিল না। গ্রীসের মতোই রোমানদের দেবদেবীর সংখ্যা যথেষ্টই ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের জীবনধারায় পূজা পার্বন অনুপস্থিত দেখা যায়। নিরেট বাস্তব বোধসম্পন্ন রোমানরা অধিকতর আস্থা ও ক্ষমতা স্থাপন করেছিল যুদ্ধ আর রাজনীতিতে এবং জীবন উপভোগের ক্ষেত্রে বিলাস ও উচ্ছৃঙ্খলতায়। রাষ্ট্র কর্তৃক নাটক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ না করায় বহুক্ষেত্রে দেখা গেল, নাটকের পাণ্ডুলিপি শুধুমাত্র অনুসরণ করার দায় নেই অভিনেতাদের। নিজেরা কিছুটা শারীরিক কসরত দেখিয়ে আমোদপ্রমোদ দিতে পারতেন। ফলে সামান্য হলেও কিছুটা ভিন্ন মাত্রা পায় অভিনয়। খ্রীস্টপূর্ব সাতশো ত্রিশ সালে যে অভিজাততান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রোমে, সেখানে নাটক প্রধানত অভিনীত হতো বিভিন্ন ধর্মীয়, সামরিক, রাজনৈতিক ছুটি উপলক্ষ্যে। গ্রিক নাটকের ক্ষেত্রে নাটকের সঙ্গে যে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল রোমের ক্ষেত্রে তা ঘটলো না। যখন নাটক অভিনীত হতো সাধারণত দাসরা সেখানে অভিনয় করতেন। নাটক রচনার মান তেমন ছিল না। রথের দৌড় প্রতিযোগিতা আর গ্লাডিয়েটরদের লড়াই দেখতে যেখানে মানুষের বেশি উৎসাহ, সেখানে বৃহৎ মাপের নাটক সৃষ্টি না হবার কারণ থাকবেই। নাটক রচনার মান দুর্বল আর অভিনয় করছে দাসরা, ফলে জুলিয়াস সীজার ও সম্রাট অগাস্টাসের আইনকানুনের আওতায় এঁদের কোনো সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। সম্রাট টাইবেরিয়াস নাকি নৈতিক কারণে অভিনয় বস্তুটিকেই দেশ থেকে নির্বাসিত করেছিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না, নাটকের মান যাই হোক শাসকদের বিরুদ্বে কথা বলতে ছাড়েনি তারা। কথাটা সত্যি, প্রাচীন গ্রীস যেমন পরবর্তী যুগের জন্য বহু উল্লেখযোগ্য চিরায়ত নাটক রেখে গেছে, দুঃখজনক হলো ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত প্রাচীন রোম তা পারেনি। যখন এথেন্স পেরেছে তখন তার বিরাট সাম্রাজ্য ছিল না, ছিল একটি ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র। কিন্তু যখনকার কথা বলছি, রোম ছিল তখন দখলদার; পরের রাজ্য গ্রাসে তার সর্বাধিক উৎসাহ।

সম্রাট জুলিয়াস সীজার নিজে যদিও প্রাচীন গ্রীসের কিছু কিছু ধ্রুপদী নাটকের খুবই একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। তিনি নাটক আর বিভিন্ন কবিদের রচনা পাঠ করতেন সাহিত্য হিসেবে। তবুও রোম প্রজাতন্ত্রের সিনেট রোমের নাগরিকদের জন্য অভিনয় করা বা অভিনেতা হওয়া নিষিদ্ধ করেছিল। যদি সাধারণ নাগরিকরা কেউ এই পেশা গ্রহণ করতেন তাহলে তিনি নাগরিকত্ব ও সর্বপ্রকার নাগরিক অধিকার হারাতেন। দাসদের কাজ ছিল অভিনয় করা। সাধারণ মানুষরাও গ্রীসের মতো ভোটাধিকারপ্রাপ্ত ছিল না রোমে। ফলে প্রাচীন রোমে নাটক ছিল সম্পদশালী, বিলাসী অভিজাতদের ব্যসনের একটি অঙ্গ। সকলের সেখানে প্রবেশাধিকারও ছিল না। প্রাচীন রোমে নাটকের বিষয়বস্তু ও চরিত্র গ্রীসের মতো পৌরাণিক কাহিনীকে ঘিরে তৈরি হতো না, কাহিনী বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রিত হতো পারিবারিক ঘটনা নিয়ে। প্রাচীন রোমের নাটকে কোরাসের কোনো স্থান ছিল না। নাটকের চরিত্রগুলোই ছিল প্রধান কাহিনীবেত্তা, প্রায় আধুনিক নাটকের মতোই। চরিত্র সংখ্যাও ছিল অনেক। প্রাচীন রোমের নাটক সাধারণত শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় অভিজাতদের তুষ্টির জন্য রচিত হতো বলেই প্রাচীন গ্রিক রঙ্গালয়ের তুলনায় প্রাচীন রোমের প্রেক্ষাগৃহ খুবই ছোট আকার ধারণ করেছিল। নাট্যচর্চার ইতিহাসে রোমের অবদান প্রধানত নাট্যশালা তৈরির স্থাপত্য রীতিতে ধরা পড়ে। নাটক মঞ্চায়নের জন্য তারা বেশ কিছু নাট্য মিলনায়তন নির্মাণ করেছিল।

দার্শনিক সেনেকাই ছিলেন প্রাচীন রোমের সবচেয়ে অগ্রগণ্য নাট্যকার। সেনেকার স্পষ্ট প্রভাব ছিল বহু শতাব্দী পরের নাট্যকার শেক্সপিয়ারের ওপর। ইউরোপের রেনেসাঁস যুগের প্রথম দিকের নাট্যকারগণও সেনেকার ভাবধারা পুষ্ট ছিলেন। সেনেকাই নাটকে আত্মার আবির্ভাব ও ভয়াবহ রক্তাক্ত দৃশ্যের অবতারণা করেন। রক্ত, ভয়াবহতা, বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝা, মৃত্যুর করাল গহ্বর তাঁকে আনন্দ দিতো। তিনি নাটকের মধ্যে এগুলো নিরাসক্ত শান্তচিত্তে ও ঠাণ্ডা মাথায় ঘটাতেন। সেনেকার নাটকে ধর্মের কোনো স্থান ছিল না। প্রাচীন রোমের নাট্যকার প্লাইতুস লিখতেন জনগণের মনোরঞ্জনের জন্য আর তার উত্তরসূরী তেরেন্স চেয়েছিলেন বিদগ্ধজনের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে। নাটকে রোমানদের রুচি ও প্রকৃতির সমালোচনা করতেন তিনি। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে সেনেকা, প্লাইতুস, বা তেরেন্সের নাটকও গ্রীসের মতো না হলেও কমবেশি সংলগ্ন থেকেছে সমাজ ও রাজনীতির স্রোত এবং আবর্তের সঙ্গে। তবে প্রাচীন রোমের নাটকের মূল দিকটা ছিল মনোরঞ্জনই। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য নাট্যাশালা নির্মাণের স্থাপত্যশৈলী ও প্রকৌশলে অবদান রাখলেও সামগ্রিকভাবে নাট্যকলাকে তারা খুব উন্নত স্তরে না নিয়ে বরং অতীব হীন পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিল। শাসকদের দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন কারণেই তেমনটা ঘটেছিল।

ধনী অভিজাতদের শাসনে রোমে বিয়োগান্ত শোকগাথার চেয়ে দশর্কদের আগ্রহ জন্মালো ব্যাঙ্গাত্মক হাস্যরসের প্রতি। প্রধান কারণ সমাজটা ছিল ভয়াবহভাবে ভোগবাদী, গ্রীসের মতো চিন্তার-জগত প্রভাবিত সমাজ সেখানে ছিল না। বিষয়টি লক্ষণীয় যে, নাটক যখন জনতা থেকে সাধারণ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে, শুধুমাত্র ভোগবাদী রাজন্যদের অনুগ্রহ বা তাদের তুষ্টির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় তখন নাটকের চিন্তার দিকটি হারিয়ে গিয়ে তার মনোরঞ্জনের দিকটিই বড়ো হয়ে ওঠে। প্রাচীন রোমের নাট্য ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। গ্রীসে গণতন্ত্র ছিল আর রোম শাসিত হতে শুরু করে কতিপয় অভিজাত নিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারী শাসকদের দ্বারা। গ্রীসের নাট্যচর্চায় নাগরিকদের একটা অংশগ্রহণ ছিল। নাট্যকার সেখানে দর্শকের সামনে নানা দার্শনিক প্রশ্নকে উপস্থাপন করতেন। নাটক প্রদর্শিত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বড় বড় দার্শনিক বা চিন্তাবিদদের সমালোচনার সামনে নাটককে জবাবদিহিতা করতে হতো। কিন্তু সেখানে রোমে নাটক লেখা, অভিনয় করা সবই হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রধানত চাকরি আর বিনোদন দান। সাধারণত কোনো আদর্শ সেখানে যেমন ছিল না, নাটক রচনার পেছনে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যও সেভাবে কাজ করেনি। নাট্য মঞ্চায়ন ছিল বলতে গেলে উদ্দেশ্যহীনভাবে আনন্দ দেয়ার জন্য। মহৎ লক্ষ্য নিয়ে জনসাধারণের জন্য বা তাদের কথা ভেবে নাটক লেখা হতো না, হতো রাজন্যদের খুশি করার জন্য। প্রাচীন রোমের নাটক জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলেই ধর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়েও বিরাট কোনো নাট্যধারা সৃষ্টি করতে পারলো না, যা প্রাচীন গ্রীসের নাট্যকাররা পেরেছিলেন। জনগণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে জনগণের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন বলেই গ্রীক নাট্যকাররা মহৎ ধ্রুপদী নাটক রচনা করেছিলেন। যা প্রমাণ করে, উপাযোগিতা বাদ দিয়ে উদ্দেশহীনভাবে মহৎ নাটক রচনা করা যায় না।

স্মরণ রাখতে হবে, প্রতিটি সমাজ যে শুধু অন্ধকারে ডুবে থাকে তা নয়, ভিতরে ঠিক বিপরীত ধারাও নীরবে বহমান থাকে। শুধু অন্ধকার বা শুধু স্বর্ণ যুগ বলে কিছু নেই। সমাজ সর্বদাই ইতি আর নেতির যোগফল। ফলে রোমের নাটক যে কেবল ধ্বংসাত্মক পথেই গিয়েছিল তা নয়। নাট্যকারদের মধ্যে সেনেকা ছিলেন ব্যতিক্রম। যদিও চতুর্থ খ্রীস্টাব্দে সেনেকার জন্ম স্পেনে কিন্তু তিনি রোমেই শিক্ষাগ্রহণ করেন এবং থেকে যান। তিনি কেবল নাট্যকার হিসেবেই নন, বাগ্মী এবং দার্শনিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। বালক নীরোর তিনি ছিলেন শিক্ষক, সম্রাট হয়ে নীরো সেনেকাকে তাঁর উপদেষ্টা করে নেন। সেনেকার পরামর্শে নীরো দীর্ঘদিন শান্ত ছিলেন কিন্তু বাষট্টি খ্রীস্টাব্দে প্রাক্তন ছাত্র তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হন এবং তাঁকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেন। সেনেকার নাটকগুলির মধ্যে যে-কয়টি পাওয়া গেছে ‘ট্রোজানের রমণীরা’, ‘ইডিপাস’, ‘মিডিয়া’, ‘উন্মাদ হারকিউলিস’, ‘ফিনিসীয় নারী’, ‘ফ্রেইডা’, ‘আগামেমনন’; এই নাটকগুলির প্রতিটি সফোক্লিস, ইস্কাইলাস, ইউরিপিডিস প্রমুখ নাট্যকারের মূল রচনা অবলম্বনে রচিত। তিনি পূর্বসূরীদের নাট্য রচনায় মধ্যে গতি সৃষ্টি করেছিলেন, পরবর্তীকালের নাট্যধারায় তা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো। বিশেষ করে এলিজাবেথীয় বা জেকোবিয়ান যুগের নাট্যকলার বিবর্তনে সেনেকার প্রভাব সুস্পষ্ট। বিশাল রোম সাম্রাজ্যের দুর্ভাগ্য এই যে, রোমের নাট্য ইতিহাস খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারলো না খ্রীস্টধর্ম আবির্ভাবের ফলে। খ্রীস্টধর্ম আবির্ভাবে সেই প্রাচীনকালেই রোমে নাটক মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বলতে গেলে এরপর প্রায় বারশো বছরের বিশাল ফাঁক ইউরোপীয় নাট্যচর্চায়। মধ্যযুগের আগেই খ্রীস্টধর্মের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল সবকিছু। চলবে