
নাট্য সমালোচনা এবং সমালোচনা গ্রহণ না করবার প্রবণতা
পর্ব ৬
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২০
সাতাত্তর সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত জাতীয় নাট্যোৎসবের নাটকগুলো দেখে “জনৈক” লেখেন যে, বাংলাদেশে নাটকের নামে কতরকম পাগলামি চলছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। এ্যাবস্ট্রাক্ট, এ্যাবসার্ড, সামাজিক, নৈতিক, ঐতিহাসিক এবং জগাখিচুড়ি; এমনি নানা ধরনের নাটক দেখে একটা ধারণা করা গেছে; বাংলাদেশের নাটক মোটামুটি হাঁটতে শিখেছে, কিন্তু চোখ ফোটেনি। অন্ধের মতো চলছে, ঠোক্কর খাচ্ছে, মাথা ফাটাচ্ছে। তিনি আরো লিখছেন, ‘রেভ্যুলিউশন ও খৃষ্টাব্দ সন্ধান’ এবং ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’ নাটক নিয়ে বাহাত্তরে এক ধরনের নাটক ‘বদর বদর’ বলে দাঁড় ফেললো ঠিকই তবে সে সময় নাট্যচক্রের উদ্ধত তরুণেরা জানতো না, কোথায় তারা যেতে চায়। বর্তমানের পরস্পর অলিখিত প্রতিযোগী নাটুকে দলগুলোও জানে না কোথায় তারা যাবে। তবু যে যতো জোরে পারছে হাঁক মারছে, ‘বদর বদর’। বাহাত্তর থেকে এ পর্যন্ত অনেক নাটুকে দল দেখা গেছে, ‘আন্দোলন’ ‘আন্দোলন’ বলে নানারকম কসরতে বাজার গরম করার আপ্রাণ চেষ্টাও লক্ষ্য করা গেছে। নাট্যচর্চার তাতে উন্নতি না হলেও মহিলা সমিতির মিলনায়তনের ফটকে ‘মিলনায়তনপূর্ণ’ ফলকের গৌরবে ‘ল্যাজ’ ফুলেছে সবার।
নিজের নামে সমালোচনাটি না লিখে তিনি ‘জনৈক’ নামে লেখেন। জনৈকের মন্তব্য থেকে এটা উপলব্ধি করা যায়, মধ্যবিত্তের জায়গা থেকে এ সবই হলো মধ্যবিত্তের সফলতার আনন্দ প্রকাশ। মধ্যবিত্তের কর্মকাণ্ডকে বড় করে দেখা, বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে যার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি। মধ্যবিত্ত নাট্যকর্মীরা তবুও নিজের কর্মে নিজেরাই সন্তুষ্ট ছিলেন। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার সেদিনের জনগণের মধ্যে ছিল, তা থেকে কোনোভাবেই মুক্ত ছিলেন না নাট্যকর্মীরা। পাশাপাশি এ কথাও সত্য, সত্যিকার অর্থে শোষণমুক্তির রাজনীতি কী সে সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন না তাঁরা। বিভিন্ন নাটকের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের পর আমরা বলতে পারি, নাট্য আরম্ভের শুরুতে রাষ্ট্র ও সমাজ বিরোধিতা থাকলেও সেটা কোনোভাবেই রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা হয়ে উঠতে পারেনি। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর নাট্য আন্দোলনের এই প্রারম্ভটা যথেষ্ট উচ্চগ্রামে শুরু হলেও, যথেষ্ট সাড়া ফেললেও এর ব্যাপকতা ঢাকার বাইরে তেমন ছিলো না। ঢাকাতেও ছিলো খুব সীমিত গণ্ডীর ভিতরে। সে সময়কার একজন নাট্যকার নিরঞ্জন অধিকারী লিখছেন, সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রিক কিছু নাট্য প্রতিষ্ঠান বেশ আলোড়ন তুলেছে। নাট্যান্দোলন গড়ে তোলার শ্লোগান দিচ্ছে। কিন্তু এই আলোড়ন কি ঢাকার বাইরে তেমন সাড়া জাগিয়েছে? শুধু ঢাকা নিয়ে বাংলাদেশ নয়। তার বাইরেও রয়েছে প্রচুর কলাকুশলী, অভিনেতা ও দর্শক। তিনি আরো লিখছেন, গণ-নাটক গণ-জীবনে কোনো আবেদন, কোনো আগ্রহের সৃষ্টি করেনি এখনও। নিরঞ্জন অধিকারীর কথাটা মিথ্যা নয়, যদি কেউ বাংলাদেশের পরবর্তী বিভিন্ন দশকের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করেন, দেখতে পাবেন রাজধানী ছাড়া আর কোথাও নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের ধারা গড়ে ওঠেনি। ঢাকার বাইরে সারাদেশে বিভিন্ন যে দলগুলির অস্তিত্ব এখনো গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের তালিকাভুক্ত আছে, যদি বেশির ভাগের পরিসংখ্যান নেয়া যায়, প্রমাণিত হবে তাদের কেউ কেউ বছরে দুটি বা তিনটি প্রদর্শনী করে; কারো কারো বছরে কোনো প্রদর্শনী থাকে না।
নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার পরপরই গণমানুষের পক্ষে কথা বলার প্রবণতা গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মাঝে দেখা গিয়েছিল, তবে সামাজিক বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে। রাজনৈতিক চিন্তাকে বাদ দিয়ে, রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নাটককে জনতার বিষয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছিল। নতুন এই নাট্যধারার প্রবক্তারা সকলেই ছিলেন মধ্যবিত্তশ্রেণী থেকে আগত। সামাজিক অঙ্গীকারের প্রশ্নে লক্ষ্যহীনভাবেই আসলে বাংলাদেশের নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল। সামাজিক অঙ্গীকার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাপার। এর সঙ্গে শুধু নাটক জড়িত নয়, নাট্যকর্মী, নাট্যসংগঠন, তার দিকনির্দেশনা সবই এর সঙ্গে সম্পর্কিত। সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ নাটক মানে হচ্ছে এমন নাটক যা সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে তুলে আনে এবং জনগণকে স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে ভাবতে শেখায়। বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যে শুরুতে এধরনের কোনো অঙ্গীকার ছিল না। পঁচাত্তর সালের পূর্বে যাঁরা বাংলাদেশের নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন তাঁদের সম্পর্কে শাহরিয়ার কবির লিখেছেন, ‘শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করার অবকাশ তখন খুব কমই ছিল। কারণ বিভিন্ন মাধ্যমে আগে থেকে অনেকে এমন জাঁকিয়ে বসেছিলেন যে সদ্য অভিজ্ঞ এই তরুণরা সেখানে কিছু করার সুযোগ পাননি। তাই তাঁরা নাটক নিয়ে মেতে উঠলেন।’ সেখানে সামাজিক প্রশ্ন যে একেবারে আসেনি তা নয়। প্রবলভাবেই অনেক সময় নাটকে সামাজিক প্রশ্ন ধরা পড়েছে তবে তার পেছনে কোনো সমাজবিজ্ঞানের চেতনা ছিল না। একটি রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলবে তেমনি চিন্তাও নাট্যকর্মীদের মধ্যে দেখা যায়নি।
খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে নাট্যচর্চা শুরুর পেছনে তাহলে তাদের মূল সামাজিক অঙ্গীকারটি কী ছিল? নাটক তারা কার জন্য, কেন মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল? মতাদর্শগত কোনো সংগ্রামের প্রশ্ন সেখানে ছিল কি না? দলগুলোর বক্তব্য ও নাট্য প্রযোজনা প্রমাণ করে এই নাট্য আন্দোলন ছিল একটি তাৎক্ষণিক উত্তেজনা, কোনো সুসংগঠিত আন্দোলন নয়। পঁচাত্তর সালের একটি সেমিনারে পঠিত আলী যাকের-এর প্রবন্ধে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বাংলাদেশের বা ঢাকার নাট্য আন্দোলনকে একটি আকস্মিক ঘটনা বলে মনে করেন। তিনি আরো বলেন যে, কোনোরকম অনুশীলন ছাড়াই প্রায় প্রস্তুতিহীন, নবিশ কুশীলবরাই প্রধানত ঢাকার নাট্য আন্দোলনের কর্মী। মন্তব্যগুলো যথার্থই ছিল। দু-চারটি নাটকের কথা বাদ দিলে পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত নাটক ছিল বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে মূলত বিভ্রান্তিকর ও বৃত্তাবদ্ধ। খুব গভীরতর প্রশ্ন, পরেও কি সেই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল? উপরের “জনৈক” নাটক নিয়ে যে মন্তব্য তা কিন্তু সাতাত্তর সালের। প্রথম দিকের নাট্যচর্চার উদ্দেশ্য নিয়ে বহু ইতিবাচক কথাবার্তা পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখায়, কিন্তু আলাদাভাবে নাটক বা নাট্যদলের প্রযোজনা নিয়ে খুব ইতিবাচক মন্তব্য নেই। নাট্যা-আন্দোলন নিয়ে সকলে যতোটা সরব, বিভিন্ন দলগুলির নাটক রচনা বা নাট্য প্রযোজনা নিয়ে কিন্তু নয়।
নাটক তার যাত্রালগ্নে যতোটা আবেগ নিয়ে পথ হেঁটেছে ততটা যুক্তি দিয়ে ভাবনা চিন্তা করে পথ চলতে পারেনি। বিভিন্নজন সেসময়েই তা মন্তব্য করেছেন। প্রশ্ন হলো, তারপরেও কি নাট্যদলগুলি নিজেরা নাট্যচর্চা সম্পর্কে গভীরতর কোনো বিশ্লেষণে বসেছিল? সেরকম ঘটনা আমার জানা নেই। “নাটক আমরা কেন করবো?” কয়েকদিন সময় ধরে এরকম একটা আলোচনা চালাবার কথা বলেছিলাম তখন কাউকে কাউকে। হয়তো সেটা করা গেলে বহু রকম ইতিবাচক পরামর্শ বা বিরোধী মতামত চলে আসতো। সেখান থেকে একটি সংশ্লেষ তৈরি করা যেতো। ক্রমাগত সেটার উপর ভিত্তি করে দিনের পর দিন আলোচনা বা মতবিনিময় চালিয়ে নেয়া যেতো। নানা কারণে সেটা আর হয়নি। নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নিতে খুব সঠিক সমালোচনা করাটা ছিল কঠিন কাজ। প্রায় সকলেই চায় নিজেদের প্রশংসা শুনতে, বিন্দু পরিমাণ সমালোচনা নয়। বহু সময় বহু জনকে দেখেছি, মিলনায়তনে আমার পাশে বসে নাটক দেখতে দেখতে নাটকটির কড়া সমালোচনা করেছেন যিনি, সামান্য পরেই সেই দলের নাট্যকার বা নির্দেশকের মুখোমুখি হয়ে তিনিই বলেছেন, ‘চমৎকার প্রযোজনা’। নাট্যকার, নির্দেশক বা নাট্যদলের কর্মীদের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি কথাটা বলতে তিনি ভয় পেয়েছেন। নাট্য-সাহিত্য বা নাট্যচর্চা খুব বেশি তাহলে আগাবে কী করে?
কামালউদ্দীন নীলু আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। বিদেশ থেকে প্রায় ফোন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতো, আমার ভালোমন্দ জানতে চাইতো। ‘স্ট্যালিন’ নাটক নিয়ে আমি সমালোচনা লেখার পর সে আর যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু আমি তাকে এখনো ব্যক্তিগতভাবে আমার একজন বন্ধুই মনে করি। সমালোচনার কারণে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার ভয়ে কেউ আর সমালোচনা করতে চান না। ফলে বাংলাদেশে নাটকের সমালোচনার সংস্কৃতি গড়ে-ওঠেনি। কখনো কখনো দেখা গেছে নাটকের সমালোচনা করার জন্য, মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে সমালোচককে ব্যক্তিগতভাবে অপমান বা আক্রমণ করা হয়। কামালউদ্দীন নীলু তা করেনি আমার সঙ্গে। কিন্তু যোগাযোগ বন্ধ করেছে। স্বভাবতই নাটকের সমালোচনা করে বন্ধুত্বকে হারাতে চায়? বরং মনের কথা চেপে রেখে “ভালোই হয়েছে দোস্ত” বললেই চুকে গেল। নীলু তার নাটকের সমালোচনা করার জন্য আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করলেও খারাপ ব্যবহার করেনি। কখনো আমাকে আক্রমণ করে কিছু বলেনি। মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। তার কষ্টে কিছুটা কষ্ট আমিও পেয়েছি। নীলু সরাসরি আমার সঙ্গে বিরোধ এড়িয়ে গেলেও, ভিন্ন একজন আমাকে খোঁচা মেরে বলেছে, ‘আপনি স্টালিনকে নিয়ে একটা নাটক লেখেন’। মানে পারলে নাটক লিখে দেখান। সেরকম একটা অবস্থায় নাট্য সমালোচনা করতে কেউ উৎসাহ পাবে? ভবিষ্যতে তেমন সম্ভাবনা কম। প্রসঙ্গক্রমে বলছি, উপরের ত্রিশ দশকের নাটকের আলোচনায় খেয়াল করলে দেখা যাবে, “জনৈক” নামে একটি সমালোচনা গেছে। সমালোচনাটা গিয়েছিল থিয়েটার পত্রিকায়। সমালোচক নিজের নাম দেননি। তিনি নিজের নাম দিতে ভয় পেয়েছেন। সাতাত্তর-আটাত্তর সালের ঘটনা এটা। সমালোচক নিজের নাম দিতে সাহস পাননি। ঘটনাটা প্রমাণ করে, সমালোচনা গ্রহণ না করবার প্রবণতা কতোটা প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সমালোচকরা যে সবসময় সঠিক কথা বলেন, তা তো নয়। কিন্তু সমালোচনার ভিতর দিয়ে মতবিনিময় হবে, বিভিন্ন রকম যুক্তি প্রদর্শন চলবে; সকলে একটি সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে সেভাবেই। সন্দেহ নেই. কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে কারো নাটকের নিন্দা করার জন্য সমালোচনা লেখা হতে পারে। কলকাতায় যেমন এক সময় পিএলটি-র বিরুদ্ধে এরকম ঘটেছিল। উৎপল দত্ত পরিচালিত পিএলটি ছিল সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। সে কারণে আনন্দবাজার সহ কয়েকটি পত্রিকা তার নিন্দা করতে মুখিয়ে থাকতো। পিসকাটর আর ব্রেশটের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে। বহুক্ষেত্রে তেমনটা ঘটে। কিন্তু দর্শক বা পাঠকদের সেটা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগে না। ইতিহাস হচ্ছে শেষ বিচারক, কথাটা আগে বলা হয়েছে। উৎপল বাংলা নাটকের বিরাট দিকপাল হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন, একইভাবে পিএলটির প্রযোজনাগুলি প্রশংসা পেয়েছে। পিএলটির চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগের বহু প্রযোজনার কথা বয়স্ক নাট্যামোদী মানুষদের মুখে কিংবদন্তীর মতো এখনো উচ্চারিত হয়। সেসব উচ্চারিত হয় সেখানকার নাট্য-ইতিহাসে আর নাট্য দলগুলির আলোচনায়। আনন্দবাজার পত্রিকা পর্যন্ত জীবনের শেষে উৎপল দত্তকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তিনি যেসকল নাটক করেছেন, যা কিংবদন্তী তুল্য, তার মধ্যে কি সামান্য কোনো ত্রুটিই ছিল না? যথার্থ সমালোচক নাটকটির বহুল প্রশংসা করার পাশাপাশি নাট্যকার আর নির্দেশকের দৃষ্টি সেই সামান্য ত্রুটির দিকে নিয়ে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
সমালোচকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে বিচার করতে না পারলে তাতে আত্মতৃপ্তি লাভ হয়, ত্রুটিগুলি কাটিয়ে ওঠা যায় না। বাংলাদেশের মঞ্চ-নাটকের দর্শক যে কমে যাচ্ছে তার কারণ নিশ্চয় আছে? বাংলাদেশে বছর দুয়েক আগে একটি নাটকের প্রদর্শনী হয়, খুব নামডাক শোনা যায় প্রদর্শনীটির। টিকেটের দামও যথেষ্ট ছিল। কয়েকজন আমরা একসঙ্গে নাটকটি দেখতে যাই। নতুন দু-তিনজন নাট্যদর্শক ছিলেন সেদিন আমার সঙ্গে । বিভিন্নভাবে আমাদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে নাটক দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা। নাটকটি দেখতে দেখতে আমার দু পাশের দুই বন্ধু জানতে চাইলেন, নাটকটার বক্তব্য কী? বললাম, আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। তিনি তো অবাক, নিজেকে তিনি মুর্খ ঠাউরেছিলেন এতক্ষণ। ভাবছিলেন তিনিই বোধহয় একা উচ্চমানসম্পন্ন নাটকটির বক্তব্য বুঝতে পারছেন না। যখন জানালাম, ভাইরে আমিই নিজেই কিছু বুঝতে পারছি না। বললাম, পারলে আমিই উঠে চলে যেতাম। কিন্তু সবটা না দেখলে পরে বলবে, পুরো নাটকটা দেখেননি তো নাটকটা বুঝবেন কী করে? সেদিন আমরা যে ছয় জন গিয়েছিলাম, তাঁদের কেউই নাটকটার বক্তব্য বুঝতে পারেননি। কিন্তু একজন বললেন, নাটকের নানারকম কারিগরী কাজ আর আলো তাঁর ভালো লেগেছে। বক্তব্য তিনি বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারলাম, মুর্খ আমি একা নই, আমরা ছয়জনই। পরে পরিচিত নিকটজনদের যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, নাটকের বক্তব্য তাঁরা কেউই পুরোপুরি ধরতে পারেননি। নাটক তাঁদের ভালো লাগেনি। বুঝলাম, তারাও মুর্খের দল। শুধুমাত্র প্রতিভাবান সেই প্রদর্শিত নাটকের নাট্যকার, নির্দেশক আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা হয়তোবা বুঝেছেন, নাট্যকার যেভাবে বুঝিয়েছেন।
দর্শকরা মুর্খ হলে, নাট্যকার আর নাট্য নির্দেশক অসম্ভব প্রতিভাবান হলে, দর্শক তো কমতেই থাকবে। নাট্যকারদের অসম্ভব প্রতিভা আর দম্ভের সঙ্গে দর্শকের চিন্তার মিল না হলে যা হবার তাই হবে। নাটক কখন সার্বিকভাবে সফল হয়? ‘যখন আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। নাট্যকার আর নির্দেশক যা বোঝাতে চান, দর্শক প্রাথমিকভাবে ঠিক সেটাই বুঝতে পারে। কিন্তু নাট্যকার এবং নির্দেশকের প্রতিভা যদি এমন হয়, ছয়জন মানুষ একসঙ্গে নাটক দেখতে গেল যাদের কেউই নাটকটার বক্তব্য বুঝতে পারলো না, তখন তার মূল্যায়নটা কী হবে? ছয়জন মুর্খ বা পুরো মিলনায়তনের মুর্খরা নাটকটা না বুঝলে, মহাপ্রতিভাধর নাট্যকারের কী করার আছে; তিনি শুধু দর্শকদের করুণা করতে পারেন! তাই নয় কি? ভিন্ন দিকে ফলাফল কী দাঁড়াবে? মিলনায়তনের সকল মুর্খ দর্শকরা সেসব নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য নাটক দেখার জন্য ভীড় বাড়াবে। কিছু লোক ধীরে ধীরে মিলনায়তনের দিকে যাওয়া ছেড়ে দেবে। সেক্ষেত্রে হয়তো তথাকথিত প্রতিভাবানদের জন্য সত্যিকারের মন ছুঁয়ে যাওয়া নাটকগুলি কিছু দর্শক হারাবে। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে তথাকথিত প্রতিভাবানদের অভাব নেই, কিন্তু কালজয়ী কিছুই রেখে যেতে পারছেন না তাঁরা। মহাপ্রতিভাদরদের সকল প্রতিভা দু-এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে হারিয়ে যেতে বসে। মহাপ্রতিভাদর কিছু সমালোচকদের চোখেই সেগুলি মাত্র কালজয়ী, ইতিহাসের বিচারে নয়।
নাট্যচর্চা এখন বিভিন্ন জনের জন্য বিভিন্ন রকম পথ খুলে দিয়েছে। কারো কারো কাছে পুরোমাত্রায় আত্মপ্রতিষ্ঠা, কারো কাছে কিছুটা আত্মপ্রতিষ্ঠা আবার কিছুটা বিপ্লবীয়ানা। কারো কাছে এখনো লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন। বহুজন লক্ষ্য ঠিক করবার কাজে ব্যস্ত, কিছু মানুষ সেখানে ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বৃহৎ কিছু করবার কথা ভাবছে। কারো কাছে নাটক করাটা সখ আর জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রচেষ্টা। সকলেরই এসব ব্যাপারে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আছে। কিন্তু কিছু মানুষকে তা সত্ত্বেও জবাবদিহি করতে হবে, অন্যের কাছে না হোক নিজের কাছে; যারা বলেছিলেন বা ঘোষণা দিয়েছিলেন তাঁরা সমাজটাকে পাল্টাতে চান, নাট্যচর্চার ভিতর দিয়ে জনগণের ভাগ্য পাল্টাতে চান। নিঃসন্দেহে সমাজ অনেকবেশি পাল্টে গেছে ধনীদের পক্ষে, সাধারণ মানুষের ভাগ্য পাল্টায়নি। নাট্যজগতের সেই সব ঘোষণাকারীদের জবাবদিহি করতে হবে, এইরকম পরিবর্তনই তারা চেয়েছিলেন কি না। সমালোচনা বা প্রশ্নবানে আহত না হয়ে তাদের নিজেদের বিবেকের কাছে হিসেব মেলাতে হবে, সত্তর দশকে বা আশির শুরুতে তাঁরা যা চেয়েছিলেন, বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছরের নাট্যচর্চার ভিতর দিয়ে তাই ঘটেছে কি? চলবে