চিত্রকর্ম: মলয় বালা

চিত্রকর্ম: মলয় বালা

নাট্যকলা: শিল্পের জন্য শিল্প নাকি উদ্দেশ্যমূলক শিল্প

প্রবন্ধ ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৪, ২০২০

ইতিপূর্বের দীর্ঘ আলোচনায় যে ব্যাপারটি সর্বতোভাবে স্পষ্ট হলো তা হচ্ছে, নাটক কোনোকালেই উদ্দেশ্যহীন ছিলো না। নানাভাবে সে তার উদ্দেশ্য প্রচার করেছে। সে উদ্দেশ্য কখনো ধর্মের পক্ষে, কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে, কখনো রাষ্ট্রের পক্ষে, কখনো বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে; কখনো ব্যক্তি বা জনগণের পক্ষে কিংবা তার বিপক্ষে। নাটকে শাসক ও শোষক উভয়ের পক্ষেই প্রচার চলেছে। সব সময়ই তার একটা ব্যবহারিক দিক ছিল, একটি উপযোগিতার দিক ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাহলে প্রশ্ন জাগে, বিশ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নাটককে হঠাৎ কেন তবে এ শ্লোগান তুলতে হলো; শিল্পের জন্য শিল্প নয়, নাটক হোক সমাজ সচেতনতার হাতিয়ার কিংবা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণই ছিল এই রকম একটি প্রশ্ন উত্থাপনের। এই শ্লোগানটির পিছনে রয়েছে দীর্ঘ এক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা। মূলত ফরাসী বিপ্লবের পর নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কিংবা ‘মানুষের জন্য শিল্প’ দুটি শ্লোগানই প্রথমবারের মতো উত্থাপিত হয়। শাসকদের সাথে শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্ক কী হবে সেই প্রেক্ষিত থেকেই এই শ্লোগান দুটির জন্ম। কেন এবং কোন্ ঘটনার প্রেক্ষিতে এই শ্লোগানগুলোর আবির্ভাব ঘটে নীচের আলোচনায় সেই ইতিহাসটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।

শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের ধারণা প্রথম পাওয়া যায় নিকোলাস-এক-এর সময়কার আলেকজান্ডার পুশকিনের রচনাবলীতে। রাশিয়ায় তখন জার নিকোলাস-এক-এর শাসন কাল। নিকোলাসের শাসনকালে শিল্প-সাহিত্যের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল অধিকতর কঠোর। বিশেষ করে নাট্যশালার সর্বপ্রকার কার্যক্রমকে গোপন পুলিশ কর্তৃপক্ষের আওতায় নিয়ে আসা হয় যার প্রধান ছিলেন নিকোলাস নিজেই। গোপন-পুলিশের এই বিভাগ নাটক মনোনয়ন থেকে শুরু করে চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনও করতেন। সমগ্র উনিশ শতকে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে বহু নাট্যশালা গড়ে উঠেছিল, এসবের অনেকগুলোরই মালিকানা ছিল ব্যবসায়ীদের হাতে। সেগুলিকেও গোপন পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ মেনে চলতে হতো। নিকোলাসের শাসনামলেই জন্ম নেয় শিল্পের জন্য শিল্পের তত্ত্ব, যার শুরুর ইতিহাসটা বড়ই বিচিত্র। প্লেখানভ তাঁর ‘শিল্প ও সমাজ’ গ্রন্থে ব্যাপারটি চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। শিল্পের জন্য শিল্প এ তত্ত্বটি ভুল কি ঠিক সে বিচারে না গিয়ে প্রথমত বুঝতে চেষ্টা করা যাক এই ধারণার উৎপত্তির কারণটি কী। প্লেখানভের শিল্প ও সমাজ গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে যে, পুশকিন একদা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। বরং উল্টোটাই তাঁর লেখনীতে ধরা পড়েছিল। তিনি তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে সমাজের দুর্ভোগ দৈন্যতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। সরকারি মহল থেকে তিনি যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করছেন এমন অভিযোগও উঠেছিল। তিনি তাঁর ‘মুক্তি’ কবিতায় ঘৃণা-ক্রোধ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নিজ জাতিকে শৃঙ্খলে বন্দী হতে দেখে, মানুষকে শাসকদের হাতে অত্যাচারিত হতে দেখে। উদ্ধত অভিজাতদের ক্ষমতার অপব্যবহারেও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সেজন্য প্লেখানভ লিখছেন, ‘একদা পুশকিন শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। সে সময় তিনি বিবাদকে এড়িয়ে যেতেন না বরং বিবাদ করার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। সে আলেক্সান্দর-এক-এর সময়ের কথা। পরে তাঁর মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়। প্রথম নিকোলাস-এর সময় তিনি ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বের পক্ষাবলম্বন করেন। মূলত এ ধারণার উৎপত্তি উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। নিকোলাসের সময় কেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন ঘটে? কোন্ প্রেক্ষাপটে তিনি নিজের চিন্তাকে পাল্টে নিয়েছিলেন?

রাশিয়াতে আঠারশো পঁচিশ সালের চৌদ্দই ডিসেম্বর বিপ্লবী কর্মকর্তাদের দ্বারা ভূমিদাসত্ব ও জারদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান ঘটে। সেই অভ্যুত্থানকে দমন করা হয়, অভ্যুত্থানের পাঁচ জন নেতা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন, বাকিদের অনেকেই সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হয়েছিলেন। প্রথম আলোক্সান্দরের মৃত্যুর পর নিকোলাস-এক তখন মাত্র শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। নিকোলাস-এক-এর সময়কার এই অভ্যুত্থান তাঁকে ভীষণভাবে বিপ্লব সম্পর্কে ভীত করে তোলে। তিনি যে-কোনো রকম বিপ্লব থেকে রাশিয়াকে রক্ষা করবার জন্য দৃঢ় মনোভাব গ্রহণ করেন। দুটি বিশেষ লক্ষণের দ্বারা নিকোলাসের রাজত্বকাল চিহ্নিত হয়; জঙ্গী সামরিকতা ও আমলাতান্ত্রিকতা। সামরিক বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা দিয়ে নিকোলাস নিজেকে ঘিরে রাখতেন। নিকোলাসের মূল প্রশাসনযন্ত্র ছিল পুলিশ দপ্তর। সাধারণ মানুষের কাছে শেষ পর্যন্ত এই দপ্তরই নিকোলাসের শাসনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল; গোপন সন্ত্রাস ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে নিকোলাসের প্রধান হাতিয়ার ছিল তা। পশ্চিম ইউরোপের বিপ্লবী রাজনৈতিক সামাজিক আদর্শ যে রাশিয়ার পক্ষে বিপজ্জনক সে সম্বন্ধে তাঁর কোনো সংশয় ছিল না। সুতরাং নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কঠোর নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করা হয়। ছাড়পত্র ব্যবস্থার মাধ্যমে রাশিয়াতে সমস্ত প্রকাশনার ওপরেও কঠোর নজরদারি চলে। মুক্তচিন্তার সমস্ত পথ রোধ করা হয়। বিধিনিষেধের এই বাড়াবাড়ি প্রায় হ্যস্যকর হয়ে উঠলো। গোপন পুলিশ সমস্ত রকম রাজনৈতিক কার্যকলাপের ওপরেও কঠোর দৃষ্টি রেখেছিল, বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম দমনের জন্যই গোপন পুলিশকে ব্যবহার করা হতো।

পুশকিন নিকোলাসকে একেবারেই পছন্দ করতেন না, সম্রাট সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বলতেন। এসবের জন্য পুশকিন স্বভাবতই নিকোলাসের পুলিশ প্রধানদের সর্তক নজরে পড়েন। নিকোলাস ক্ষমতায় আসার পর পুশকিনের কাছ থেকে আশা করছিলেন, পুশকিন রাষ্ট্র বা শাসকদের স্বার্থে লিখুক। পুশকিনের প্রথম দিকের লেখাগুলো নিকোলাসের মোটেই পছন্দ হয়নি। পুশকিন যেভাবে তাঁর রচনাতে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতেন শাসকরা তার মধ্যে বিদ্রোহের এবং উচ্ছৃঙ্খলতার গন্ধ পাচ্ছিলেন। নিকোলাস চাইছিলেন, পুশকিনের কাছ থেকে নৈতিকতা সম্পন্ন লেখা; যে-লেখা যুব সমাজকে রাষ্ট্রের প্রতি, শাসকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলবে। নিকোলাস নিজে প্রধানত এই নৈতিকতার ভিত্তিতেই শিল্পকে দেখেছেন। ইতিপূর্বে ফ্রান্সের ষষ্ঠদশ লুইয়ের মতও ছিল একই রকম যে, শিল্প স্বলক্ষ্য সম্পন্ন নয় বরং অবশ্যই নৈতিক শিক্ষার হাতিয়ার। নৈতিক শিক্ষা মানেই ছাঁচেঢালা প্রথাবদ্ধ শিক্ষা, মুক্তচিন্তা নয়। নীতিশিক্ষার অর্থ হলো একটি বিশেষ বিশ্বাস বা ধারণার প্রতি অন্যের মতকে প্রভাবিত করা। রাষ্ট্রের শাসকরা সর্বদাই নীতিশিক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেদের বিশ্বাসগুলিকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। বিপ্লবের পর ফরাসী দেশের শাসকদের চিন্তাভাবনা এর থেকে আলাদা কিছু ছিল না। ফরাসী বিপ্লবের নেতারাও নাটককে নৈতিক শিক্ষার হাতিয়ার মনে করতেন, নেপোলিয়ন-প্রথমও চাইতেন সাহিত্য এবং শিল্প যেন নৈতিক উদ্দেশ্যকে সেবা করে। ফরাসী বিপ্লব নৈতিক শিক্ষা দিতে চেয়েছিল সাম্য স্বাধীনতা ও মৈত্রীর পক্ষে, কিন্তু নেপোলিয়ন নৈতিক শিক্ষা দেবার কথা ভাবলেন বুর্জোয়া শাসকদের লুণ্ঠনের স্বার্থে এবং বুর্জোয়া শোষণকে টিকিয়ে রাখতে।

নাট্যশালাকে নীতিকথার বিদ্যালয়ে পরিণত করার দাবি উঠেছিল বুর্জোয়া মতাদর্শের অভ্যূত্থানের সময়ই। সে নীতিকথা কী বা কেন সে নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও নীতিকথা প্রচার নাট্য প্রযোজনার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো। সিডনি ও টমাস ন্যাশের মতন মুক্তচিন্তার প্রবক্তরা পর্যন্ত সে দাবি মেনে নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। নতুন উঠতি বুর্জোয়ার চিন্তাধারা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল শিল্পী সাহিত্যিকদের বড় একটা অংশকে। বেন জনসনের মতন সমাজ সচেতন নাট্যকারও রঙ্গালয়কে নৈতিকতার পাঠশালা বলে স্বীকার করে নিলেন। গসনও বারংবার নাটকে শিক্ষার কথা উত্থাপন করেছেন। গসন যে নাটককে নীতিকথা রূপে দেখেছিলেন সে ধারা বুর্জোয়া সমালোচকদের বহুদিন পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ফরাসী চিন্তাবিদ মার্সিয়া মনে করতেন, নাট্যকারদের প্রথম কর্তব্য হলো নাগরিকদের নৈতিক এবং ব্যবহারিক মান উন্নত করা। ফরাসী বিপ্লবের পর যোশেফ পায়াঁর মতো বিপ্লবীও দেশপ্রেমিক লেখকদের কাছে আবেদন জানালেন এই বলে, ‘একবার ভেবে দেখুন, নাটকের মধ্য দিয়ে আমরা কী গভীরভাবে মানুষকে নৈতিক দিক থেকে প্রভাবিত করতে পারি।’ নাট্যকার জন গলসওয়ার্দি নাটকে এই নীতিবোধ প্রচারকে সমালোচনা করে লিখেছিলেন, গড় নাটকের নীতিবোধ এখন তো বটেই, সম্ভবত চিরকালই তথাকথিত মন্দনীতির ওপর যে কোনওভাবে অপেক্ষাকৃত ভালোর জয় ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ। তিনি আরো লিখছেন, বিকৃত নৈতিকতা নাটকের হাড়েমজ্জায় প্রবেশ করে নাটকের শৈল্পিকতা, মানবিকতা ও তাৎপর্য নষ্ট করেছে। স্রষ্টা, অভিনেতা, দর্শক, সমালোচক সকলকেই তা সংক্রামিত করেছে।

নাট্যকার যখন গড় জনতাকে তার প্রত্যাশা-মাফিক নৈতিকতার মাপকাঠিতে জীবন তথ্য সরবরাহ করেন, তিনি জনগণের যাবতীয় সংস্কার অক্ষুন্ন রেখে তাদের তাৎক্ষণিক উপকার করছি ভেবেই তা করেন। কিন্তু বিষয় পাল্টে যায়, নীতিবোধও পাল্টায়, মানুষ থাকে। সেজন্য বিশেষ কারো নীতিশিক্ষা নয়, মানুষ ও তার জীবনতথ্যের বিশ্বস্ত উপস্থাপন দর্শক-চেতনাকে ধারালো করতে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে। নীতিশিক্ষা নয়, দরকার সমাজকে ব্যাখ্যা করা; দর্শকের সামনে সমাজসত্য উপস্থাপন করা। দর্শক যেন নাটকের ভিতর দিয়ে তার পারিপার্শ্বিক জীবন-জগত সম্পর্কে গভীর জ্ঞানলাভ করে, দর্শক যেন বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়; দর্শক যেন শুধু সমাজ-সচেতন নয়; সমাজবিজ্ঞান সচেতন হতে পারে। সামন্ত-শাসকশ্রেণী ও বুর্জোয়ারা সেটা বুঝতে চাইলেন না। নাটক যে ইশপের উপকথা নয়, নাটকের উদ্দেশ্য যে নীতি প্রচার নয় বরং সমাজ-বাস্তবতা তুলে ধরা; সে সত্যটা তাদের বোধগম্য হলো না। শাসকরা সমাজকে বিশ্লেষণের চেয়ে নীতিকথা বলার মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করলো নাটক বা শিল্প-সাহিত্যকে। ঠিক সেই পরামর্শই তারা দিতে থাকে লেখক-কবি ও নাট্যকারদের। ভি এ ঝুকোভস্কি একজন বড়ো কল্পনাপ্রবণ কবি আর সভাসদও বটে, তিনি আঠারশো ছাব্বিশ সালের বারোই এপ্রিল পুশকিনকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠির বক্তব্য ছিল, পুশকিনের লেখা পড়ে যুব সমাজ বিদ্রোহী চেতনার সাথে পরিচিত হয়। পুশকিন ইতিমধ্যেই সেভাবে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলেছেন। তিনি পুশকিনকে গতানুগতিক নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে লেখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন প্রতিভা কিছু নয়, নৈতিকতাই বড় কথা।

পুশকিনকে এ রকম বহু ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় তাঁর প্রথম দিকের বিদ্রোহী ধরনের লেখার জন্য। পাশাপাশি প্রথম নিকোলাসের সময় রাষ্ট্রের পক্ষে লেখার জন্য চাপ আসতে থাকে। শাসকদের এই চিন্তার সাথে পুশকিন নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না। শাসকদের পক্ষে লেখা মানেই জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এটা পুশকিন বুঝতেন, কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে আসার বৈপ্লবিক পথটাও তাঁর জানা ছিল না। তাই তিনি লক্ষ্যহীন অন্তর্দ্বন্দ্বে হয়ে পড়েছিলেন ক্ষত-বিক্ষত। তিনি সৎ ছিলেন, তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল এবং তিনি জানতেন কী করা উচিৎ। তিনি জানতেন না কীভাবে তা করতে হবে। সরকারি সকল বিধি-নিষেধ ও ত্রাস সৃষ্টিকারী ঘটনায় দেশের মানুষের জীবন তখন চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ। রাষ্ট্রটা যেন একটা কারাগার, যেন একটা লোহার গরাদ, পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখির মতো নাগরিকজীবন তার মধ্যে ছটফট করছে। চারদিকে শুধু ক্লান্তি, অবসাদ আর একঘেয়েমির চিত্র! পুশকিন বুঝতে পারছিলেন না সাধারণের স্বার্থে কীভাবে তিনি কী করবেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল শাসকদের স্বার্থে পুশকিনের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং তাঁর লেখনী শাসকদের স্বার্থে পরিচালিত করা। কিন্তু যে-লেখক রাষ্ট্রের এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নিতে চান না তিনি কী করবেন? স্বভাবতই তিনি রাষ্ট্রের এই উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করবেন। সরকারের পক্ষে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কিছু রচনা করা উচিৎ নয় বলেই তিনি মনে করবেন। সেই বিরোধিতা হতে পারে দুভাবে। হয় তিনি এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন, নতুবা তিনি শাসকদের সাথে কোনরকম ঝামেলা এড়িয়ে পলায়নপর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। পলায়নপর ভূমিকার অর্থ আপাতভাবে তিনি নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করবেন। শোষক বা শোষিত কারো পক্ষেই তিনি উচ্চকণ্ঠ হবেন না। পুশকিনের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল। শাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য তিনি দ্বিতীয় পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন।

যখন পুশকিনকে সরকারের পক্ষে লিখতে বলা হলো অর্থৎ পুশকিনের রচনাকে সরকারের প্রচার মাধ্যম বানাবার চেষ্টা করা হলো, তখনি পুশকিন সরকারের এই দাবির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন। সে বিদ্রোহ কোনো সরব বিদ্রোহ নয়। সে বিদ্রোহ ছিল কৌশলেরই নামান্তর। শিল্প যে সরকারের প্রচার যন্ত্র নয় সেটা প্রমাণ করার জন্যই তিনি ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। পুশকিন নিজের লেখাকে শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা এবং শাসকশ্রেণীর চিন্তা প্রচার না করার জন্যই ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ রচনায় মনোযোগী হন। শাসক মহলের চাপে পুশকিন যৌক্তিক কারণেই শিল্পের উপযোগিতাবাদের বিরুদ্ধে চলে যান। ‘জিপসী’ কবিতায় এ সম্পর্কে পুশকিন লিখেছিলেন ‘টাকায় তাহারা বাণিজ্য করে মুক্তি’। বণিকশ্রেণীর সেই টাকার মাহাত্ম্য পুশকিন প্রচার করতে চাননি। ব্যাপারটা যে শুধু পুশকিনের ক্ষেত্রেই ঘটেছিল তা নয়, এটা ছিল একটা যুগের ব্যাপার। শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যেহেতু পুশকিন তার শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বকে ব্যবহার করেছিলেন, সেজন্য তাঁর এই চিন্তা সেদিন জনগণের পক্ষেই ছিল। কারণ তিনি শাসকচক্রের প্রচারের বিরুদ্ধে ছিলেন। শাসকচক্রের শেখানো বুলি তিনি প্রচার করতে চাননি। সর্বদা সৎ পথে চলো, রাষ্ট্রের প্রতি বিনীত থাকো, বিচার ব্যবস্থা আইনকে মান্য করো, ধর্মে মন দাও; ইত্যকার প্রথাবদ্ধ কথা মুক্তচিন্তার মানুষের পক্ষে লেখা বা বলা সম্ভব নয়। ফলে সরকারের উদ্দেশ্যের পক্ষে লিখবেন না বলেই তিনি ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ চর্চার সমর্থক হতে বাধ্য হলেন। তিনি শাসকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাইলেন, শিল্পচর্চার উদ্দেশ্য নেই। শিল্পকলা বা সাহিত্য সৃষ্টির কারণ শুধুমাত্র আনন্দ লাভ।

কিছু ব্যতিক্রমবাদে পুশকিনের সমসাময়িক ভাববিলাসীরাও ছিলেন শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের সমর্থক। শাসকদের অনুশাসন অগ্রাহ্য করবার জন্যই, তার থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যই তাঁরা প্রধানত এই ধ্বনি তুলেছিলেন। ফ্রান্সের তয়েফিল গতিয়ে তাঁদের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য। একইভাবে রুশ দেশের তুর্গেনেভও শিল্পের উপাযোগিতাবাদী প্রবক্তাদের দারুণ অপছন্দ করতেন। বুর্জোয়াদের প্রতি ঘৃণা থেকেই এই ব্যাপারটা ঘটে। বুর্জোয়াদের প্রতি শেক্সপিয়ার, ন্যাশ, গ্যাটে, মলিয়েরের যে কারণে ঘৃণা ছিল, এদের ঘৃণারও প্রধান কারণটা তাই; মুনাফার প্রতি বুর্জোয়াদের অতিরিক্ত লোভ। এই বুর্জোয়ারা কারা? গতিয়ে লিখছেন, তারা হলো ব্যাংকার, দালাল, উকিল, বণিক, দোকানদার প্রভৃতি সকলেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের ভাষায় বুর্জোয়ারা হলো এমন মানুষ যার কেবল ইশ্বর একমাত্র সম্বল, নিজের স্বার্থ ছাড়া যার রক্ষা করার আর কিছু নেই। বুর্জোয়ারা সৌন্দর্য্যরে চেয়ে টাকাকেই বড় করে দেখতো। সেই টাকার মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য তারা শিল্প সাহিত্যকে কাজে লাগাতে আরম্ভ করে। বুর্জোয়াদের এই নোংরা প্রচারের হাত থেকে নিজেদের শুদ্ধতা রক্ষা করার জন্যই ভাববিলাসীরা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরেন। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ মতবাদের প্রবক্তা তাহলে বুর্জোয়ারা নয়। বুর্জোয়ারাই বরং শিল্পকে, শিল্প-সাহিত্যকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল বুর্জোয়া বিপ্লব ও মতাদর্শের পক্ষে। যতো গণ্ডগোলের শুরুও সেখান থেকেই। শিল্পের জন্য শিল্প মতবাদের ইতিহাসটারও সেখানেই আরম্ভ বা যাত্রা।

বুর্জোয়া ব্যবস্থায় সৎগুণ, ভালোবাসা, বিশ্বাস, জ্ঞান, চেতনা ইত্যাদি সবকিছু এক কথায় বাণিজ্যের অন্তর্গত হয়ে গেল। নৈতিক কিংবা শারীরিক সবকিছুর একটি ব্যবসায়িক মূল্য দাঁড়ালো। মানুষের পুরানো আবেগ চট করে এই অবস্থাটা মানতে পারছিল না যে টাকাই হবে সবকিছুর মানদণ্ড। ভাববিলাসীরা তাদের সময় বুর্জোয়াদের কেন ঘৃণা করছিল এ ব্যাপারে বাঁভিলের বক্তব্য ছিল, বুর্জোয়ারা সবকিছুর ওপর কড়িকে মূল্য দিয়েছে। বুর্জোয়ারা টাকার চেয়ে বড়ো করে আর কিছুই দেখতো না। পূর্বেই দেখা গেছে যখন আধুনিক রাষ্ট্র জন্ম নিচ্ছিলো, তখন শাসকরা আশা করছিল শিল্প-সাহিত্য সবসময়ই রাষ্ট্র বা শাসকদের স্বার্থকে সেবা করবে। রাষ্ট্রের তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের পক্ষে প্রচার চালাবে। বুর্জোয়াদের এই মনোভাব শিল্পী সাহিত্যিকদের একটা অংশ মেনে নিতে পারেননি। সেজন্য বুর্জোয়াদের কোনোরকম উপকার সাধন করতে তাঁরা চাইতেন না। প্লেখানভ তাই লিখছেন, বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতি যুবক ভাববিলাসীদের এরূপ ধারণা থাকার ফলে স্বভাবতই তাঁরা উপকারী শিল্পের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পকে ‘উপকারী’ বা উদ্দেশ্যমূলক করে তোলার অর্থ ছিল, যে-বুর্জোয়া শ্রেণীকে তাঁরা এতো গভীরভাবে ঘৃণা করেন শিল্পকে তাঁদের জন্য উপকারী করে তোলার সমান। সেদিক থেকে ভাববিলাসীদের এই চিন্তা প্রগতিশীলও বটে। কারণ বুর্জোয়াদের পক্ষে লিখবেন না বলেই তাঁরা শিল্পের জন্য শিল্পের সমর্থক হলেন। বুর্জোয়াদের প্রতি এটা তাঁদের ঘৃণারই প্রকাশ।

বুর্জোয়াদের প্রতি ভাববিলাসীদের এই ঘৃণার প্রকাশ ঘটেছিল শুধু তাঁদের শিল্পকর্ম বা লেখালেখিতেই নয়, দৈনন্দিন আচার আচরণেও। বুর্জোয়ারা সাধারণত যে ধরনের পোষাক, বেশবিন্যাস ধারণ করতো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা তা সজ্ঞানে বর্জন করেন। বুর্জোয়াদের সাথে সবসময় তাঁরা নিজেদের একটি পার্থক্য তৈরির জন্য নানা পথ, পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। যুবক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের কাছে লম্বা চুল পরার মতো অদ্ভুত সব পোষাক পরা ছিল ঘৃণিত বুর্জোয়া এবং তাঁদের মধ্যকার পার্থক্য প্রকাশের একটি উপায়। বুর্জোয়াদের অতিরিক্ত পরিপূর্ণতার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। বুর্জোয়ারা যা কিছু ভব্যতা বলে প্রচার করছিল এবং যা কিছু মনে করতো আদর্শস্থানীয়, তা বর্জন করলেন এইসব বিদ্রোহীরা। বুর্জোয়া রুচি, আচার-আচরণের প্রতি নীরব এই বিদ্রোহ আসলে বুর্জোয়াদের ধ্যান-ধারণার প্রতি তাঁদের ঘৃণারই প্রকাশ। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর প্রকাশ কীভাবে ঘটলো? ইউরোপে কলাকৈবল্যবাদ বা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্ব-র দেখা দিয়েছিল যখন সমাজের সর্বস্তরে শিল্প-বিপ্লবের সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়লো। বুর্জোয়াদের স্থূল রুচি ও সংকীর্ণতাবোধের সাথে যেসব সংবেদনশীল শিল্পীরা সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেননি, বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তাঁদের বিদ্রোহ একান্ত শিল্প সাধনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লো। বুর্জোয়া শাসকদের স্থূল মনোভাবের বিপক্ষে তাঁরা কোনো সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বা সাহসী জোরালো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাই একান্ত শিল্প সাধনায় মনোনিবেশ করলেন।

দুর্ভাগ্যজনক যে, নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ফ্রান্সে আবার বুরবঁ রাজবংশ ক্ষমতায় ফিরে এলো। ফ্রান্স তখন মূলত একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত হলো। ব্যক্তি স্বাধীনতা অনেকটা হরণ করা হলো, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা হলো, শিক্ষা-ব্যবস্থা আবার বিশপদের অধীনে চলে গেলো। নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা বা নতুন প্রশাসন নেপোলিয়নের চেয়ে আরো বেশি স্বৈরাচারী হয়ে উঠলো। আঠারশো চব্বিশ সালে অষ্টাদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর দশম চার্লস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন। রাজশক্তিতে ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি বিপ্লবের এবং বিপ্লবী আদর্শের ঘোর শত্রু ছিলেন। স্বভাবতই তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। দশম চালর্সের রাজত্বের প্রথম থেকেই যাজকদের ও দেশত্যাগী অভিজাতদের ফিরিয়ে এনে অধিক ক্ষমতা প্রদান করা হলো। শিক্ষা-ব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর যাজকদের নিয়ন্ত্রণ পূর্বের চেয়েও বৃদ্ধি পেল। তেমনি এক অবস্থার মধ্যেই, যেখানে সকলের কণ্ঠরুদ্ধ; প্রতিকূল সেই আবহাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়েই ভাববিলাসী ও পারনেশিয়ানরা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। শাসক হিসেবে নেপোলিয়নের পতনের পর বহু তরুণ শিল্পীর কাছে মনে হয়েছিল যে, আঠারশো পনেরোর পরের ফ্রান্স বুর্জোয়া ভব্যতায় ফিরে গেছে। এতে তাঁদের মন তিক্ততায় ভরে গিয়েছিল। সেজন্য এ যুগের শিল্পের মেজাজ ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিষন্ন ও অন্তর্মুখী। কারণ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়বার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই তাঁদের ছিল না, আবার তা মেনে নিতেও তাঁরা পারছিলেন না। তাই অন্তর্মুখী শিল্পচর্চায় তাঁরা মনোনিবেশ করেন। ফরাসী বিপ্লব তাঁদের মধ্যে যে আকাক্সক্ষা জন্ম দিয়েছিল আর জন্মলগ্ন থেকেই তার যে বীভৎস চেহারা তাঁরা দেখতে পেলেন দুয়ের মধ্যে কোনো মিল ছিল না। বিপ্লব হয়ে দাঁড়ালো বাক্যবাগীশ, লুণ্ঠন, ধ্বংস ও হত্যার সংমিশ্রণ। পঞ্চাশ বছর পার হতে না হতেই বিপ্লব হয়ে দাঁড়ালো ধনীকদের সর্বগ্রাসী লুণ্ঠনের নামান্তর। স্বভাবতই তা শিল্পী ও সাহিত্যিকদের হতাশ করেছিল।

ফরাসী দেশে আঠারশো তিরিশের বিপ্লবের পর ক্ষমতায় এলো লুই ফিলিপ। লুই ফিলিপ ছিল বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি। তিরিশ সালের এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের অভিজাতশ্রেণীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা হলো এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর চূড়ান্ত বিজয় ঘটলো। সাংবিধানিক শাসনতন্ত্রের ও প্যারিসের জনতার স্বীকৃতি দিয়েছিল এই বিপ্লব। এই বিপ্লবেব ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য চলে গেল উচ্চমধ্যবিত্তদের হাতে। বিপ্লবের তেরঙা ঝাণ্ডা আবার ফ্রান্সের পতাকা হলো। বুর্জোয়াদের এই ক্ষমতা লাভের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তারা হয়ে উঠলো সর্বেসর্বা তেমনি শ্রমিকশ্রেণীর সাথে তাদের বিরোধও তীব্র হয়ে উঠলো। উচ্চ-বুর্জোয়াশ্রেণী নিজেদের সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠাতেই বেশি আগ্রহী ছিল। মালিকদের শ্রম শোষণে দেশের ভিতর যেমন অর্থিক সংকট দেখা গেল, তেমনি শ্রম শোষণের কারণে শ্রমিক পরিবারগুলোর দুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করলো। ফ্রান্সের বেশ কিছু লেখক, রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদগণ তাঁদের রচনায় এই ব্যবস্থার ত্রুটি ও বৈষম্য সম্পর্কে তীক্ষ্ম মন্তব্য করেন। পাশাপাশি ভিন্ন ঘটনা ঘটে, শিল্পী ও সাহিত্যকদের মধ্যে একটি অংশ এই সময় বুর্জোয়াদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় তাঁদের কলম। কিছু কিছু ভাববিলাসীরা নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণের চেষ্টা করেন। শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের প্রচারকরা, যাঁরা বুর্জোয়াদের ঘৃণা করতেন তাঁরা কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থার উচ্ছেদ চাননি। বুর্জোয়া কিছু কিছু অভ্যাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও এই সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা তাঁরা বলেননি। বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেই তাঁরা বুর্জোয়াদের কিছু কিছু দোষ সম্পর্কে সমালোচনা করেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের ধারক ও বাহকরা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেও সে বিদ্রোহ সমাজের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের দিকে সম্প্রসারিত হলো না। থিয়োডর দ্য বাঁভিল সেজন্য বলেছেন, ভাববিলাসীরা বুর্জোয়াদের উপর আক্রমণ করেছেন তবে সামাজিক শ্রেণী হিসাবে তা বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি। মূলত ভাববিলাসীদের বিদ্রোহ ছিল এক ধরনের রক্ষণশীল বিদ্রোহ। শাসকদের দাবির বিরুদ্ধে তাঁরা এক ধরনের পলায়নপর পথ বেছে নিলেও শাসকদের দাবির বিরুদ্ধে তীব্র কোনো স্রোতধারা তৈরি করতে পারেননি। শাসকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের লড়াইয়ে তাঁরা নামেননি। নামতে চাননি। সে দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের এইসব ধারক-বাহকরা একাধারে যেমন ছিলেন বিপ্লবী, তেমনি রক্ষণশীলও বটে। পরবর্তী সময় শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের সমর্থকদের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রটিও খুব পরিষ্কারভাবে অনুভূত হয়।

যখন রুশ দেশে সরকারের পক্ষে লিখবেন না বলে পুশকিন শিল্পের জন্য শিল্পের প্রবক্তা হলেন, রুশ দেশে তখন প্রতিক্রিয়াশীল নাট্যকার এবং উপন্যাসিক হলেন নেস্তর ভাসিলিয়েভিচ কুকলনিক। কুকলনিকের নাটক ‘সর্বোচ্চশালীর শক্তিই আমাদের পিতৃভূমিকে রক্ষা করছে’ দেশপ্রেমের পক্ষের নাটক। নাট্যকারের দেশপ্রেম মানে শাসকদের পক্ষে যতোরকম সমর্থন বা প্রেম। পলেভয়েভ সম্পাদিত ‘মস্কোভস্কি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় কুকুলনিকের নাটকটির বিরুদ্ধ সমালোচনা হলে, সরকারের দিক থেকে পত্রিকাটিকে বাজেয়াপ্ত করা হলো। কিছুদিন পর পলেভয়েভ নিজেই যখন ‘রুশ নৌবাহিনীর বুড়ো দাদা’ এবং ‘ব্যবসায়ী ঈগলকিন’ নামে দেশপ্রেম নিয়ে দুটি নাটক লেখেন, জার তাঁর নাট্য প্রতিভায় আনন্দিত হয়েছিলেন। জার নাকি বলেছিলেন, লেখক অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন, তাঁর উচিৎ লেখা, লেখা এবং লেখা। ঠিক সেই সময়ে রুশ নাট্যকার আলেকজান্ডার নিকোলায়েভিচ অস্ত্রভস্কি দর্শকদের উপকারী শিক্ষা দেয়ার অভিলাষে লেখা ‘অন্যের দায় কাঁধে’ সরকারের পক্ষে যাওয়ায় সম্রাটের সদয় স্বীকৃতি লাভ করেছিল। ফরাসী দেশে তখন তয়েফিল গতিয়ে, থিয়োডর দ্য বাঁভিল, লেকঁত দ্য লিস্ল, শার্ল বোদলেয়ার, গঁকুর এবং ফ্লবেয়ার; সকলেই সেখানকার বুর্জোয়া পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। বলতে গেলে মধ্যবিত্তদের সেবায় তাঁদের চেতনাকে উৎসর্গ করেছিলেন। গঁকুর এবং ফ্লবেয়ার ছাড়া বাকিরা ছিলেন শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী। ফরাসী নাট্যকার এমিল অজিয়ের ‘জেঁদর দ্য মঁসিয়ে পৈরিয়ে’ নাটকে বুর্জোয়াদের কিছু কাজের উপর দেবত্ব আরোপ করেন। গঁকুর এবং ফ্লবেয়ারের মতো স্বাভাবিকবাদীরা কিন্তু সেখানে বুর্জোদের বহু ধ্যান-ধারণার সমালোচনা করেছিলেন। হয়তো বুর্জোয়াদের বিলাসিতার দোষ ধরেছিলেন ভিন্নদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে নিজেদের প্রগতিশীল চরিত্রটি ঠিক রাখার জন্য কিন্তু ঠিক সেইটুকুই। বুর্জোয়াদের কিছুটা সমালোচনা করে নিজেদের সাস্ত্বনা দেয়া, বুর্জোয়া ব্যবস্থাটা বাতিল করতে চাননি তাঁরা। কারণ বুর্জোয়ারা টিকে থাকলেই তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হবেন। বাংলাদেশের দিকে তাকালে হয়তো নাট্যকারদ্বয়ের চরিত্রটি বুঝতে সুবিধা হবে।

ফ্লবেয়ারের মূল চরিত্রটি ধরা পড়বে অন্যত্র। তিনি যে ভিতরে ভিতরে শাসকদের পক্ষে ছিলেন তা প্রমাণিত হবে। তিনি নিজের দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘আজ প্রমিথিউসকে বিদ্রোহ করতে হবে জিউস বা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে নয়, জনগণ নামক নতুন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। পুরানো যাজকতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতাকে ছাড়িয়ে যাবে অন্য একটি একতন্ত্র; যা আরো ধূর্ত, দুর্বোধ্য এবং প্রভুত্বব্যঞ্জক যা অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে একটি কোণও খালি রাখবে না।’ ১৮৭১ সালের আটই সেপ্টেম্বর জর্জ স্যান্ডের কাছে এক চিঠিতে ফ্লবেয়ার লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি জনতা, ইতর লোকজন সব সময়েই ঘৃণ্য। সকল সময়ে অন্যদের চেয়ে অগ্রসর, এক অন্যের উপর নির্ভরশীল, একই মানসিকতার জ্ঞানী ক্ষুদ্র একটি দল ছাড়া আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ তিনি আরো লেখেন, ‘সার্বজনীন ভোটাধিকার হলো মানব-চেতনার অসম্মান, কারণ সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে এমন কি অর্থকেও।’ কিন্তু তাঁর এসব চিন্তাচেতনা তাঁর সাহিত্যে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ফলে সাহিত্যের বা শিল্পকলার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকতে হবে কথাটা বলাই যথেষ্ট নয়। কথাটা হলো কার পক্ষে থাকবে শিল্প-সাহিত্য। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় সেদিক থেকে পুশকিন শিল্পের জন্য শিল্পের সমর্থক হয়েও, গঁকুর আর ফ্লবেয়ারদের চেয়ে জনগণের পক্ষের লোকই ছিলেন। শিল্পের জন্য শিল্প যেমন কখনো কখনো প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে কবি নাট্যকারদের ক্ষেত্রে, কখনো কখনো শিল্পের উদ্দেশ্য জনগণের বিরুদ্ধে যেতে পারে। ফরাসী নাট্যকার আলেকজান্ডার ডুমা শিল্পের উদ্দেশ্যে থাকার পক্ষে ছিলেন। তিনি কিছুদিন ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটিতে বিশ্বাস করলেও পর্যায়ক্রমে ঘোষণা করেছিলেন, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ অর্থহীন। তিনি তাঁর রচিত নাটক ‘লা ফিলস ন্যাচুরেল’ এবং ‘লা পিয়ের প্রডিগ’ সরকারের পক্ষে ব্যবহার করেন। তিনি পুরানো সমাজকে, বিশেষত যে-সমাজ চারদিকে ভেঙে পড়েছে টুকরো টুকরো হয়ে সে-সমাজকে, তাঁর রচনা দিয়ে টিকিয়ে রাখাটা জরুরি মনে করতেন। মানে সামন্ত আর যাজকদের সমাজব্যবস্থাটা ধরে রাখার পক্ষে ছিলেন। ঠিক একই ভাবে, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না রুশ দেশের আলেক্সেই কনস্তানতিনোভিচ টলস্টয়। কিন্তু তিনি সরকারের পক্ষে নয়, জনগণের পক্ষে রুশ দেশের কৃষকদের পক্ষে কলম ধরেছিলেন। টলস্টয় ধার্মিক হয়েও কলম ধরেছিলেন কৃষকদের পক্ষে। জীবনের শেষে ধার্মিক হয়েও প্রগতিশীল মানুষটি বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গেই ছিলেন লেখালেখির ক্ষেত্রে এবং জীবনযাপনে। চলবে