নাট্যকলা: শিল্পের জন্য শিল্প নাকি উদ্দেশ্যমূলক শিল্প

শেষ পর্ব

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৫, ২০২০

ফরাসি বিপ্লবের পর আঠারশো আটচল্লিশ সাল ছিল ইউরোপের জন্য বিপ্লবের বছর। আঠারশো আটচল্লিশ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের শক্তিশালী ঝড়ঝঞ্ঝার সময় শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী অনেক ফরাসী শিল্পী তা দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন। থিয়োফিল গতিয়ে লিখেছিলেন, বোদলেয়ার কাব্যের জগৎ থেকে বাগ্ -বিভূতি, আবেগ এবং সত্যের একনিষ্ঠ অনুকৃতিকে নির্বাসিত করেছেন। বোদলেয়ার শুধু তাতেই ক্ষান্ত হননি, স্বীয় কাব্য কবিতায় এই তত্ত্বকে অনুসরণও করেছেন। চিত্রাদির দ্বারা হেঁয়ালিপূর্ণভাবে নাম লিখনের মতো সে গদ্যের অর্থ অনুমান করে নিতে হয়। ফলে সে অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাবিষ্কৃতই থেকে যায়। শিল্পের সম্পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন যে বোদলেয়ার, তিনি বিপ্লবের পর নিজের পুরানো বিশ্বাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ‘লা স্যালুট পাবলিক’ নামে একটি বিপ্লবী সাময়িকী প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তিনি এ সময় শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বকে বালসুলভ বলে মনে করেন এবং ঘোষণা দেন শিল্পের সামাজিক উদ্দেশ্য থাকতে হবে। পুশকিন বা অন্যান্য ভাববিলাসীদের ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেকেই তাদের লেখনীকে ব্যবহার করেন। শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের বিরুদ্ধে তখন থেকেই সচেতনভাবে বহু লেখালেখি শুরু হয়। চেরনিশেভস্কি, দব্রলিউবভ, নেকরাসভ সকলেই স্পষ্ট করেই বললেন, শিল্পকলার অবশ্যই একটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে। রাশিয়ার ভূমিদাসতন্ত্র উৎখাত এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য এঁরা সবাই আন্দোলন করেছিলেন উনিশ শতকের ষাটের দশকের শুরুতে। ॥

শিল্পের জন্যই শিল্প এই মতবাদ যেভাবেই আসুক না কেন, তার মূলে এই একটি চিন্তাই থাকে শিল্প সমাজ নিরপেক্ষ। সমাজের কল্যাণ-অকল্যাণ করার কোনো ভূমিকা শিল্পের নেই। তা যখন নেই তখন শিল্পী সামাজিক ন্যায় অন্যায় নিয়েই বা মাথা ঘামাতে যাবেন কেন এবং শিল্প কোনো প্রয়োজন সিদ্ধ করলো কি না এখানে তাও বিচার্য বিষয় নয়। এই চিন্তার বিরুদ্ধেই রাশিয়ায় চেরনিশেভস্কি লিখছেন, ‘শিল্পের জন্য শিল্পে’র ধারণা হলো ‘সম্পদের জন্য সম্পদ’ ‘বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান’ প্রভৃতি ধারণার মতোই আজগুবি। ধন সম্পদ হলো মানুষের উপকারের জন্য। বিজ্ঞানও মানুষকে নির্দেশনা দানের জন্য। শিল্পও তেমনি কোনো নিষ্ফলা আনন্দের পরিবর্তে কিছু প্রয়োজনীয় লক্ষ্যকেই সেবা করবে। তিনি লিখছেন, শিল্পের মূল্য নির্ধারিত হবে তার দ্বারা সমাজে সঞ্চারিত জ্ঞানের মাত্রার উপর। তিনি বলতে চান শিল্প জীবনকে শুধু নতুন করে সৃষ্টি করে না, একে ব্যাখ্যাও করে। চেরনিশেভস্কির আগে বেলিনস্কি আঠারশো সাতচল্লিশ সালে লিখেছিলেন, জনকল্যাণের উপায় হলো জন-চেতনা আর চেতনা উন্নয়নে বিজ্ঞানের চেয়ে শিল্প কম যায় না। বিজ্ঞান ও কলা সমভাবে অপরিহার্য, কেউ কারো বিকল্প হতে পারে না। চেরনিশেভস্কি স্বভাবতই বেলিনস্কির ধারণায় বিশ্বাস করতেন। চেরনিশেভস্কি এবং তাঁর অনুগামী দব্রলিউবভের মতে শিল্পের অবশ্য কর্তব্য হলো জীবনকে নতুন করে সৃষ্টি করা এবং জীবন সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করা। শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে এ ধরনের বক্তব্য বহুজন দিয়েছেন। ফরাসী বিপ্লবের সময় যেমন মার্শিয়া বলেছিলেন, নাট্যকলা হলো মানবিক যুক্তিবোধকে শক্তিশালী করার এবং গোটা জাতিকে আলোকিত করার সব থেকে ক্ষমতা সম্পন্ন এবং প্রত্যক্ষ মাধ্যম বা পদ্ধতি। ফিকটে মনে করতেন, শিল্পের লক্ষ্য শিক্ষা; তবে শুধুমাত্র মনের শিক্ষা নয় বরং শিল্পের লক্ষ্য সমগ্র মানুষটিকে শিক্ষা দান। টলস্টয় তার শিল্পের স্বরূপ গ্রন্থে খুবই জোরের সাথে শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের বিরোধিতা করেন।

স্বাভাবিকবাদ বা বাস্তববাদী যে নাট্যধারা দেখা যাবে তা কখনো শিল্পের জন্য শিল্প ছিল না। বাস্তববাদী নাটকের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেই দেখা যাবে পুঁজিবাদী সমাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভই সেখানে প্রকাশিত। যেমন অঁরি বেক-এর ‘ভালচারস’ নাটকটি, এ নাটকে বেক পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের ক্ষমাহীন ও করুণাহীন বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার, চক্রান্তের ও প্রতারণার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। জার্মানীর গেরহার্ট হাউপ্টমান সমাজতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে সবচেয়ে দক্ষ নাট্যকার। তাঁর ‘উইভারস’ নাটকে তিনি বস্ত্রকলের মালিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পরাভূত তন্তুবায়শ্রেণীর মজুরির দাবিতে ধর্মঘটের কাহিনী বলেছেন। হাউপ্টমানের অন্য নাটক ‘সূর্য্যদয়ের আগে’ শ্রমিকশ্রেণীর ব্যক্তিগত শোকগাথা নিয়ে রচিত। নাটকে তিনি একটি সাইলেশীয় খনিশ্রমিক পরিবারের আকস্মিক বড়লোক হয়ে ওঠার পেছনের গোপন রহস্য এবং বড়লোক হওয়ার পর তাদের নৈতিক অধঃপতন ও অবক্ষয়ের কাহিনীর মাধ্যমে পুঁজিবাদী মূল্যবোধ ও জীবন পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা উপস্থিত করেছেন। কৃষকদের জীবন কথা নিয়ে লেখা তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক হলো ‘রোজ বার্নড’। হাউপ্টমান ছিলেন ইবসেন, বার্নার্ড শ-র মতোই যুক্তিবাদী ধারার লোক। শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে তাঁরা কেউ বিশ্বাসী ছিলেন না।

ফরাসী দেশের রঁম্যা রলাঁ ছিলেন গণনাট্যের একজন বড় প্রবক্তা। যিনি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে নাটককে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন এবং নাটককে সর্বসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেবার দাবি তুলেছিলেন। স্বভাবতই তিনি শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর গণনাট্য চিন্তার মূল লক্ষ্য ছিল নাটকের মধ্য দিয়ে জনগণকে সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। রঁম্যা রলাঁ তাঁর এই বিশ্বাসের পক্ষে উনিশশো সাল থেকে উনিশশো তিন সাল পর্যন্ত ফরাসী পত্রিকায় বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। উনিশশো তিন সালেই প্রবন্ধগুলো একত্রিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় যার নাম দেয়া হয় ‘তেয়াতর দু পুপ্ ল’ বা জনগণের নাট্য। তিনি তাঁর গ্রন্থে লিখছেন, ‘যুগের চাহিদা বা ইচ্ছার সঙ্গে শিল্প বিযুক্ত থাকতে পারে না। জনগণের নাট্য বা গণনাট্যকে অবশ্যই জনগণের সংগ্রামের অংশীদার হতে হবে। সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্ট, তাদের আশা-আকাঙ্খা, তাদের লড়াইয়ে অংশ নিতে হবে। খোলাখুলিভাবে বলা যায়, গণনাট্য হবে অবশ্যই জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত।’ তিনি বলছেন, তা যদি না হয় তাহলে গণনাট্য কখনই সফল হবে না। নাটককে সেসময় থেকেই বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার চেষ্টা চলতে থাকে। সেজন্য স্বাভাবিকতাবাদী বা বাস্তববাদীদের নাটকে বুর্জোয়া সমাজের প্রতি তীব্র বিরোধিতাপূর্ণ মনোভাব সুস্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত হয়। বুর্জোয়া ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে সেই চিন্তা ক্রমশই দানা বাঁধতে থাকে। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব তখন বাতিল হয়ে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে নাটককে ব্যবহার করার কথা বলা হতে থাকে।

বুর্জোয়াদের বিপক্ষেই যে শুধু শিল্প-সাহিত্য রচিত হচ্ছিলো ব্যাপারটা তা নয়, বরং বুর্জোয়াদের চিন্তার পক্ষেও অনেক শিল্প-সাহিত্য রচিত হচ্ছিলো। যেমন ন্যূট হামসুন, ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেল, পল বুর্জে ছিলেন এই ধারার নাট্যকার যাঁরা বুর্জোয়াদের জয়গান গেয়েছেন। পরের দিকে জর্জ অরওয়েল ‘এনিমেল ফার্ম’ লিখেছিলেন। প্রথম জন নরওয়েজিয়ান, পরের দুজন ফরাসী দেশের। শেষজন ব্রিটিশ। তাঁদের পূর্বসূরী নেস্তর ভাসিলিয়েভিস কুকুলনিক ছিলেন রুশ প্রতিক্রিয়াশীল নাট্যকার। ফ্লবেয়ারও ছিলেন ন্যূট হামসুনদের আদর্শগত পূর্বসূরী। ন্যূট হামসুনের ‘দ্য গ্রেট অব দ্য কিংডম’ নাটকের নায়ক আইভার কারেনা একজন প্রতিভাবান তরুণ লেখক, যে নিজেকে খুবই মুক্তমনের অধিকারী মনে করে। মুক্তমনের এই চিন্তাবিদের বক্তব্য মতো প্রলেতারিয়ানরাই হলো প্রতিরোধযোগ্য আর প্রলেতারিয়ানরা হলো অবশ্যই ঘৃণ্য। প্রলেতারিয়ানদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ করার কথা চিন্তা করে, সে নিশ্চয় বুর্জোয়া আদর্শবাদী। এই কারেনাকে নাট্যকার মনে করছেন একজন প্রথম সারির বিপ্লবী বলে। ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেল, তাঁর নাটক ‘লা রেপা দ্য লিয়ঁ’। নাটকটির প্রধান চরিত্র জাঁ দ্য সাঁসি পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের কার কী ভূমিকা সে সম্পর্কে বক্তব্য রাখছে। সাঁসির বক্তব্য, একপাল শেয়াল মরুভূমিতে সিংহকে অনুসরণ করে শিকারের উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য। ষাঁড়কে আক্রমণ করার শক্তিতে অপারগ, তুরগ হরিণের পেছনে ছুটবার গতিতে অসমর্থ শেয়ালদের সমস্ত প্রত্যাশা বাঁধা আছে মরুভূমির রাজা সিংহের ঐ থাবার ভিতর। যখন রাত্রি ঘনায়, ক্ষুধায় কাতর হয়ে সিংহ তার আবাস ত্যাগ করে ছোটে শিকারের খোঁজে। এইখানেই তো কথা। সে শক্তিশালী ব্যূহ তৈরি করে এমন এক যুদ্ধ ঘটায়, যে-যুদ্ধটা নৈতিক। আর জগৎ যে রক্তে ভেসে যায় তা সবসময়ই শিকারের রক্ত নয়। তারপর রাজকীয় ভোজন, শেয়াল দেখে আগ্রহে ও শ্রদ্ধায়। সিংহ পুরোপুরি তৃপ্ত হলে শেয়ালদের খাবার পালা আসে। শিকারটা যদি সিংহ শেয়ালদের প্রত্যেককে সমান ভাগে ভাগ করে দেয় আর এক ভাগ নিজের জন্যে রাখে তবে সিংহের জন্যে ঐ খাবার কী যথেষ্ট হয়? না, মোটেই না। এ রকম সহৃদয় সিংহ, সিংহ নামের আযোগ্য। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে নাট্যকার বুর্জোয়াদের সিংহ আর শ্রমিকদের শিয়ালের সাথে তুলনা করেছেন।

নাট্যকার বা নাটকের নায়ক জাঁ দ্য সাঁসির মতে পুজিঁপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম হলো সিংহের বিরুদ্ধে ঈর্ষান্বিত শেয়ালের সংগ্রাম। নাট্যকার এখানে সরাসরি পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের আন্দোলনে পুঁজিপতিদেরই পক্ষ নেন। মালিক যে শ্রমিকদের লালন-পালন করেন সে কথাও বলতে চান। বুর্জেও তাঁর নাটকে প্রায় ন্যূট হামসুন ও ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেলের কথার প্রতিধ্বনি তোলেন। বুর্জের রচিত নাটক ‘লা ব্যারিকেড’-এর মূল ধারণা হচ্ছে আধুনিক শ্রেণীসংগ্রামে প্রত্যেকের অবশ্যই তার নিজ শ্রেণীর পক্ষে অংশ নেয়া উচিৎ। নাটকের সবচেয়ে পছন্দনীয় চরিত্র হিসাবে বুর্জে মনোনীত করেছেন গশাঁর নামক একজন বৃদ্ধ শ্রমিককে, যে গশাঁর নিজশ্রেণীর পক্ষ না নিয়ে তার নিয়োগকর্তার পক্ষ নিয়েছে। নাট্যকার এটাকে গশাঁর নৈতিক আদর্শ ও মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে দেখেছেন এবং শ্রমিকদের সকলের কাছ থেকে তিনি মালিকদের জন্য এই ধরনের নৈতিক ব্যবহার আশা করছেন। শ্রমিকটির এই ধারণার মধ্যে আসলে কী দেখতে পাওয়া গেল? যে ধারণা এই শ্রমিককে চালনা করে তা এমন একজন দাসের ধারণার মতো, যে দাস তার শেকলকে ঐতিহ্য মনে করে। বুর্জে শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষকে দাস হিসাবে দেখতে চান। শ্রমিকরা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে, তিনি সেটা চাইছেন না। কখনো কখনো বা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলা মানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাসত্বকে টিকিয়ে রাখা। হাজার বছরের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার কথা বলা মানে হাজার বছরের শোষণের বা দাসত্বের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার কথাই নিজের অবচেতনেই বলা হয়। সুবিধাভোগীরাই সবসময় ঐতিহ্য রক্ষার কথাটা বেশি বলে থাকে। সাধারণ মানুষরা কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষা ব্যাপারটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

ন্যূট হামসুন বা ফ্রাঁসোয়া দ্য কারেল ও বুর্জে তাঁদের নাটকে স্পষ্টতই একটি রাজনীতি প্রচার করছেন। সে রাজনীতি বুর্জোয়াদের পক্ষের রাজনীতি। ফরাসী বিপ্লবের পর রাজনীতি প্রধানত দুটো ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। সম্পদের ওপর দখলদারির প্রশ্নে মানুষ হয়ে গেল দুটো পক্ষ। সকল রকম আইন-কানুন বিচার ব্যবস্থার মূল কথাটা হলো, সম্পদশালীদের সম্পত্তি রক্ষা করা। প্রাচীন যুগ থেকে সেকারণেই আইন আর বিচার-ব্যবস্থার যাত্রা আরম্ভ। ফরাসী বিপ্লবে গণ-মানুষের নানা অধিকারের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ধনীদের সম্পদ রক্ষার বা তাদের নিরাপত্তাদানের কথাটা খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল সংবিধানে। ফরাসী বিপ্লব ঘটার পর নানা জটিলতা আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের পিছনে ছিল একদিকে সম্পদের অধিকারী সুবিধাভোগী মানুষ, অন্যদিকে সম্পদহীন শোষিত মানুষ। বুর্জে সম্পদশালী মানুষের পক্ষে তাঁর রাজনীতি প্রচার করেছেন। ফরাসী বিপ্লব ও প্যারিস কমিউন গঠনের মধ্য দিয়ে মানুষ যেমন সচেতনভাবে রাজনীতিতে অংশ নিতে শুরু করে, তেমনি নাটক হয়ে পড়ে অত্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠভাবে দু-পক্ষেরই হাতিয়ার। কোনো নাটকই তাই অরাজনৈতিক নয়। যে-কোনো নাটকই তাই স্ব-স্ব শ্রেণীর পক্ষে শ্রেষ্ঠ প্রচারই হয় শেষ পর্যন্ত। আর এ যে কতো বড় সত্য তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর সব মহান সৃষ্টিগুলোতে। বুর্জোয়াদের পক্ষের নাটকগুলোও এই প্রচারের বাইরে নয়। বুর্জে, কারেল ও হামসুনের মতো শিল্পীরা তাঁদের রচনার মাধ্যমে কী রক্ষা করছেন? সেইসব সামাজিক সম্পর্ক যা বুর্জোয়া ব্যবস্থার জন্য প্রাচুর্যময় উৎস। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষকে তাঁরা দাস ও প্রভু হিসাবে বিভক্ত করে রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপক জনগণ তাহলে তাঁদের এই নাটক গ্রহণ করবে কেন? ব্যাপক জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে তাঁদের নাটকগুলো, সে কারণেই নাট্যকার হিসাবে এঁরা দাঁড়াতে পারলেন না। জনপ্রিয়তা যেমন পেলেন না, নাটকের ইতিহাসেও তাঁদের জায়গা হলো না। ইবসেন, চেখভ, বার্নার্ড শ, গলস্ওয়ার্দীর নামের পাশে এঁরা হারিয়ে গেলেন।

শাসকশ্রেণীর মুখপাত্ররা ইতিহাসের বিচারে প্রগতিশীল বলে বিবেচিত হতে পারেন, হনও কখনো কখনো তবে শোষিত জনতার মুখপাত্র না হলে যুগের মুখপাত্র হওয়া অসম্ভব। বর্তমানকে লঙ্ঘন করে চিরন্তনকে ধরা যায় না। যাঁরা বর্তমানের দ্বন্দ্বপূর্ণ সত্যকে লুকিয়ে শুধু এক পক্ষের প্রচার চালিয়েছিলেন, ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁরা টিকে থাকতে পারলেন না। প্রলেতারিয়েত মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষমাহীন যুদ্ধ ঘোষণা দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না। বুর্জোয়ারা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলো তাদের মুখপাত্ররা জনতার হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারছে না। বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি নাট্যকাররা জনগণকে যে-কথা বলতে চাইছে তার কোনো মূল্য নেই সাধারণ দর্শকের কাছে। কারণ, বুর্জোয়ার সম্পদ বানানোর গল্প কিংবা বুর্জোয়ার সম্পদ হারানোর বেদনা নাটকের বিষয়বস্তু হতে পারে না। রাশকিন যেমন বলেছিলেন, কুমারী তার হারানো ভালোবাসার জন্য দুঃখের গান গাইতে পারে কিন্তু কৃপণ তার হারিয়ে যাওয়া পয়সার জন্য দুঃখ করে গান গাইতে পারে না। কৃপণ কেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া পয়সার জন্য গান গাইতে পারে না? কারণ দর্শকদের হৃদয়ে তা কোনো আবেগ সৃষ্টি করবে না। কৃপণ যদি তার লোকসানের জন্য গান গায় তা কারো ভেতরে সাড়া জাগাবে না। দর্শকের সাথে যোগাযোগ তৈরির মাধ্যম হিসাবে তা ব্যর্থ হবে। কিন্তু কুমারীর হারানো ভালোবাসার বেদনা দর্শকের সাথে যোগাযোগ তৈরি করবে, দর্শকের হৃদয়ে দোলা দেবে। মানবজগতে রয়েছে ভালোবাসার জন্য হাহাকার, মানব মনের চিরন্তন ধর্ম তা। রাশকিন তাই বলেছিলেন, ‘শিল্পকর্মের গুণ নির্ধারিত হয় ঐ শিল্পকর্মে প্রকাশিত আবেগের মাহাত্ম্যে’। টাকার গৌরবে নয়।

সমস্ত শিল্পই কাল নিয়ন্ত্রিত। একই সঙ্গে শিল্প এই সীমাবদ্ধতাকেও অতিক্রম করে যায় এবং ইতিহাসের কালসীমার মধ্যেই নিরন্তর বিকাশের সম্ভাবনা নিয়ে মানবতার ক্ষণকে রচনা করে। মানুষের মধ্যকার শ্রেণীসংগ্রাম বা ইতিহাসের সর্বমুহূর্তে বিরাজিত প্রবাহমানতাকে ধারণ করতে পারলেই নাটক হয়ে উঠতে পারে চিরকালীন। দুই শ্রেণীর বা দুই পক্ষের ঘৃণা যদি নাটকের বিষয়বস্তুর মধ্যে ধারণ করা যায়, নাট্যকার তাহলেই হতে পারেন কালজয়ী। রণকবিতা যেমন শত্রুর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে তেমনি এইসব কবিতা সৈনিকের নিবেদিত দুঃসাহসকে, দেশ জাতি ইত্যাদির জন্যে তাদের মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর তৎপরতাকে উচ্চ প্রশংসা করে। ব্রেশ্ট সেজন্য বলেছিলেন, নাট্য প্রযোজনায় অবশ্যই উপলব্ধির উত্তেজনাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং বাস্তবতাকে বদলানোর আনন্দে দর্শককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কীভাবে প্রমিথিউস মুক্ত হয়েছিলেন দর্শককে শুধু সেটা জানালেই চলবে না, নিজেদের মুক্ত করার আনন্দদায়ক কর্মে তাঁদেরকে আলোড়িত করতে হবে। প্রাচীন গ্রীক নাটক, দান্তে, শেক্সপিয়ার, গ্যাটে, বালজাক ও টলস্তয় এঁরা সবাই মানবীয় বিকাশের বিরাট যুগের পর্যাপ্ত চিত্র প্রদান করেন; সেজন্যই তাঁরা চিরকালীন। ইবসেন, চেখভ, বার্নার্ড শ, হাউপ্টমানদের ক্ষেত্রেও সে কথা সমানভাবে সত্য। বুর্জোয়ার মুখপাত্ররা তা পারেননি।

সাধারণ মানুষের পক্ষে না দাঁড়িয়ে, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে কখনো কোনো নাট্যকলা টিকে থাকতে পারেনি। বুর্জোয়া প্রচারকদের পক্ষে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচার চালানো খুব সাফল্য অনতে পারেনি। বুর্জোয়াদের বা শাসক কিংবা শোষকের পক্ষের শিল্প-সাহিত্যকে জনমনে গেঁথে দেয়া সম্ভব হয়নি বলেই বুর্জোয়ারা একটা সময়ের পরে ভিন্ন পথ ধরে আগাতে চেষ্টা করলেন। শিল্প-সাহিত্যে কলা কৈবল্যবাদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠলেন তাঁরা। কেন তাঁরা সে পথে গেলেন? বাস্তববাদী নাট্যধারায় শিল্প-সাহিত্য যখন পুনরায় উদ্দেশ্যমূলক হয়ে ওঠে বুর্জোয়া ব্যবস্থার জন্য এর পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক। ইবসেনের নতুন কোনো নাটক বা বাস্তববাদী নাট্যশালায় বিশেষ কোনো নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে শুনলে শাসক সম্প্রদায় শঙ্কিত হয়ে উঠতো। সেজন্য ইবসেনের নাটক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম উইন্টার সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ইবসেনদের জন্য মঞ্চকে নির্বাচন করা ভুল হয়েছে। বক্তৃতা মঞ্চই তাঁর উপযুক্ত ক্ষেত্র। তিনি আরো লিখলেন, ইবসেনদের মতো নাট্যকারদের দুষিত সমাজচিন্তা দর্শক চিত্তকে অভিভূত করে কলুষিত করে তুলবে। বুর্জোয়া মুখপাত্রদের সমালোচনা ছিলো সেটা। এই সময় থেকে শিল্পী ও সাহিত্যকদের রচনায় বুর্জোয়া ব্যবস্থার দোষত্রুটিগুলো নানাভাবে সমালোচিত হতে থাকে। বিশেষ করে প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে এবং পরে বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি, গোর্কির নাটকে যেভাবে বুর্জোয়াদের আক্রমণ করা হয়, তাতে বুর্জোয়ারা খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন বাস্তববাদী নাট্যধারা আরো বেশি রাজনৈতিক হয়ে উঠছে এবং তা ধনবাদী শোষণের বিরুদ্ধেই চলে যাচ্ছে।

সমালোচকরা যে যেভাবে দেখে থাকুন না কেন, ইবসেনের নাটকে সমাজ সত্যের প্রতিফলন ছিল বলেই দর্শক চিত্ত অভিভূত হয়েছে, কিন্তু বুর্জোয়ারা তা মানতে চাইছিলেন না। সেজন্য শিল্পী-সাহিত্যিকদের আক্রমণের হাত থেকে বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে রক্ষা করবার জন্য বুর্জোয়া মুখপাত্ররা নতুন খেলায় নামতে বাধ্য হলেন। পুশকিনের মতো তাঁরাও হঠাৎ শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। বুর্জোয়াদের পক্ষ থেকেও বক্তব্য রাখা হলো, শিল্প-সাহিত্য দ্বারা কোনো রকম প্রচার চালানো বা শিল্প সাহিত্যকে উদ্দেশ্যমূলক করে তোলা মানেই শিল্পের মান ক্ষুন্ন করা। শিল্প-সাহিত্যের আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করবার জন্য বুর্জোয়ারাই এই বক্তব্য দিলেন। কিন্তু এই বুর্জোয়ারাই একদিন টাকার মাহাত্ম্য প্রচারের লক্ষ্যে, ব্যক্তিত্ববাদের জয়ধ্বনি দেয়ার জন্য শিল্প-সাহিত্যের আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধনীদের সম্পদ রক্ষকারী শাসকরা বলেছিলেন, শাসকদের পক্ষে দেশপ্রেম প্রচার করার উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্প-সাহিত্য রচনা করতে। নিজেদের স্বার্থেই নাটককে উদ্দেশ্যমূলক করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। যখন তা করা গেল না তখন নতুন কৌশল ধরলেন। নাটক উদ্দেশ্যমূলক হতে পারবে না বলে প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। কারণ বাস্তববাদী নাটকে টাকার মাহাত্ম্য প্রচারের পরিবর্তে, ব্যক্তিত্ববাদের জয়ধ্বনি দেয়ার পরিবর্তে ধনীদের আক্রমণ করা হচ্ছে। ধনীদের নিজের সম্পর্কে প্রচারে আপত্তি নেই, কেবল শোষিতের স্বার্থরক্ষার ব্যাপার দেখা দিলেই শাসকদের কাছে শিল্পের এই উপযোগিতার ধারণা অসহ্য হয়ে ওঠে। সেজন্য রঁম্যা রলাঁ বুর্জোয়াদের আক্রমণ করে লিখেছিলেন, ‘রাজনীতি নিয়ে নাটকের করণীয় কিছু নেই; এই প্রতিবাদ আপনারাই তুলেছিলেন। তা সত্ত্বেও আপনারাই জনগণকে আকৃষ্ট করার জন্য আপনাদের নানা প্রযোজনায় একটি রাজনৈতিক তাৎপর্যকে সবসময়েই তুলে ধরতে চেয়েছেন। এ কথা কি আপনারা অস্বীকার করতে পারেন যে, যে-রাজনীতির বিরুদ্ধে আপনারা লড়াই করছেন বা বিরোধিতা করছেন তা আপনাদের নিজেদেরই বিরুদ্ধে প্রযুক্ত রাজনীতি নয়?’ তিনি বুর্জোয়াদের উদ্দেশ্যে করে আরো লিখেছেন, ‘আপনারা বোধ হয় ভেবেছেন গণনাট্যের কাল এখনও আসেনি আর সেই সময়টাকে কাজে লাগাতে আপনারা জনগণের গলায় আপনাদের বুর্জোয়া নাট্যকে জোর করে বিঁধিয়ে দেবার জন্য এক অন্য নাট্যধারা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আপনাদের এই নাট্যকলাকে সরিয়ে রাখুন, কারণ এই ধরনের নাট্য আমরা চাই না।’ বাস্তববাদী নাট্যধারার রাজনৈতিক চিন্তার পক্ষেই তিনি এ কথা লিখেছিলেন। স্বভাবতই সেই রাজনীতি ছিল ধনিকদের লুন্ঠনের বিরুদ্ধে। বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্য দিয়েই বাস্তববাদী নাট্যধারা জন্ম নিয়েছিল। যারা শাসকদের সমালোচনা করে, ধনীদের লুণ্ঠনের সমালোচনা করে। ফলে ধনীদের কাছে, ধনীদের পদলেহনকারী শাসকদের কাছে বাস্তববাদ আর গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। বিমূর্তরীতি আমদানী করলেন বাস্তববাদের বিপক্ষে। বাস্তববাদী আর রাজনৈতিক নাটকের আক্রমণের মুখে শাসকরা নিজেদের স্বার্থেই আবার উদ্দেশ্যহীন, অবাস্তব নাট্য প্রযোজনার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠলো। বক্তব্য দান ছিল বাস্তববাদী নাটকের প্রধান লক্ষণ, আর বুর্জোয়াদের পরবর্তী নাট্যধারা বিমূর্ততার পথ ধরে ভিন্ন পথে আগাতে থাকলো। বিমূর্ত দার্শনিক ধারণাকে প্রকাশ করার জন্য বাস্তবকে বিকৃত করা হলো। রজার গ্যারডি দেখান যে, বস্তুবাদ চিরকালই মানুষের পক্ষে, সমাজ প্রগতির পক্ষে। আর বিমূর্ততা মানবিক মূল্যবোধের বিরোধী, মানুষের প্রগতির বিশ্লেষণ না করে তার ভাঙাচোরা বিকৃতরূপ হাজির করে। মানুষকে সুস্থ চিন্তা দেয়ার পরিবর্তে তা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। বুর্জোয়ারা বা তার মুখপাত্ররা ইচ্ছাকৃতভাবেই এ বিভ্রান্তি ঘটায়। বিমূর্ত যা মানুষের বোধগম্য নয়; তেমন নাট্যকলা, শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা আর ভাস্কর্য পৃষ্ঠপোষকতা পেল ধনীদের। কারণটা স্পষ্ট, বিমূর্তরীতি স্পষ্ট করে কিছু বলে না। ফলে বুর্জোয়া শাসকদের বিরুদ্ধে বা ধনীদের শক্তভাবে আন্দোলন গড়বার ক্ষমতা নেই এই রীতির।

ফরাসী বিপ্লবের সময়ে প্রথমদিকে বুর্জোয়া শিল্পচেতনাই আদর্শ শিল্পচেতনা বলে চিহ্নিত হতো। সেখানে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্নকে আদর্শ করা হয়েছিল। কিন্তু বুর্জোয়ারা হলো সমাজের নতুন লুণ্ঠনকারী। বুর্জোয়া অগ্রগমনের সঙ্গে সঙ্গে তাই স্বাধীনতার চেতনা আবার ব্যক্তি-সর্বস্বতায় পর্যবসিত হলো। রেনেসাঁ যুগের বুর্জোয়া মানবতাবাদ যে স্বাধীন শোষণহীন মানুষের কথা ভেবেছিল, সেই চিন্তা থেকে বুুর্জোয়ারা তখন বহু দূরে সরে গেছে। লুণ্ঠনের স্বার্থে মধ্যপথে তারা নিজেদের চিন্তা পাল্টে ফেললো। নিজেদের স্বার্থ চিন্তা ও নিজেদের ক্ষমতা রক্ষাই সেখানে প্রাধান্য পেল। নিজেদের স্বার্থে প্রথম মহাযুদ্ধ আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ঘটালো তারা। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ধনীকদের মুনাফার লোভ কী করে বিশ্বকে রক্তাক্ত করছে নাটক দৃঢ়তার সঙ্গে সে কথা বলতে আরম্ভ করলো। ধনীকরা নিজেদের মুনাফার স্বার্থে, বাজার সৃষ্টির স্বার্থে, নিজেদের সামরিক অন্ত্র বিক্রির স্বার্থে কেমন করে যুদ্ধ লাগায় তা নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালো। পিসকাটর আর ব্রেশট ছিলেন এই ধারার পথিকৃত। নাটককে তাঁরা সরাসরি পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করার কথা বললন। পিসকাটর আর ব্রেশটের তত্ত্বে বহু মানুষ নাট্যরচনা আর মঞ্চায়নের নতুন প্রেরণা পেলেন। যুক্তরাষ্ট্রে পর্যন্ত একটা সময়ে তা খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। মহামন্দা চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর তরুণ মধ্যবিত্ত আর শ্রমিকরা নাট্যদল গঠন করে পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধার বিরুদ্ধে কথা বলা আরম্ভ করলো। সোভিয়েত দেশের সমাজতন্ত্রের পক্ষে নাটক লিখলেন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা, মধ্যবিত্ত তরুণরা। মহাসমারোহে তা মঞ্চস্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের মধ্যে। স্বভাবতই রাষ্ট্র ভয় পেয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রের তখন দরকার ছিল এর বিরুদ্ধে আর একটা নাট্যরীতি দাঁড় করানো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল এর মধ্যে। চার্লি চ্যাপলিনের “গ্রেট ডিক্টেটর’ চলচ্চিত্রটি পছন্দ করতে পারলো না যুক্তরাষ্ট্রের ধনীরা। চ্যাপলিনের চেয়ে হিটলার হলেন আপন মানুষ পুঁজিবাদী সমাজের কাছে। চ্যাপলিনের পরের ছবি, “মঁশিয়ে ভার্দু” আরো ক্ষেপিয়ে তুললো ধনীকদের। মানবতাবাদীর চোখ দিয়ে সমাজ-সত্য প্রকাশ করায় চ্যাপলিনকে গালাগাল করা হলো সাম্যবাদী বলে। চ্যাপলিনকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মুখোমুখি হয়ে জবাবদিহিতা করতে হলো। চ্যাপলিনের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। চ্যাপলিন ছিলেন একদা যুক্তরাষ্ট্রের সকল মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার আর অভিনেতা, সবচেয়ে বেশি টাকা আয় করেছে চ্যাপলিনের ছবি; শাসকদের ক্ষোভের মুখে সেই চ্যাপলিনের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো।

বিশ শতককে চিহ্নিত করা হয়েছে রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার শতক হিসাবে। বিশ শতকের শুরু থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়কাল পর্যন্ত বিভিন্ন নাট্যধারার সাথে বিশ্বের যে পরিচয় ঘটে, রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার উন্মেষকালও সেটা। এই সময়কালে যেমন পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে নতুন নাট্যচিন্তার সূত্রপাত হতে দেখা যায়, চলচ্চিত্রও হয়ে ওঠে রাজনৈতিক। ধনতান্ত্রিক সরকার আর ধনীরা লক্ষ্য করে, যা কিছু মানবতাবাদী তাও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রাজনীতি প্রচারে সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক সব উঠেপড়ে লেগেছে আর দর্শক সাধারণ তাতে সাড়া দিচ্ছে। সবকিছুই সেখানে উদ্দেশ্যমূলক, ধনীদের মুনাফা লোভ আর যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচার চলছে সেসব শিল্প-সাহিত্যে। নানা শিল্প-সাহিত্যে শ্রেণীর প্রশ্ন বা শ্রেণীসংগ্রামের কথা স্পষ্টভাবে চলে আসছে। ধনীকরা এর বিরুদ্ধে নতুনধারার শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করার কথা ভাবলেন। বিমূর্তরীতিকে এই রীতির বিরুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতা করা শুরু হয়েছিল আগেই, কিন্তু দেখা গেল রাজনৈতিক চিন্তার কাছে বিমূর্তবাদীরা টিকতে পারছে না। পিসকাটর-ব্রেশটদের নাটক দেখতে মানুষ যেমন ভীড় জমাচ্ছে, বিমূর্তরীতির নাটকের ক্ষেত্রে তা ঘটছে না। বিমূর্তরীতির জনপ্রিয়তা আর তার পক্ষে প্রচার বাড়াবার জন্য স্যামুয়েল বেকেটের মতো বিমূর্তরীতির নাট্যকারদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো। কিন্তু সারাবিশ্বে যাঁর নাটক সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বা যিনি একটা পুরো শতকে ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত নাট্যকার, সেই ব্রেশট নোবেল পুরস্কার পেলেন না। সবটাই ধনীদের পাতানো খেলা। ধনীদের বন্ধু-শাসকরা নোবেল পুরস্কার দিয়েও বিমূর্তরীতির পক্ষে সাধারণ মানুষকে দলে টানতে পারলেন না, বিমূর্তরীতির পাণ্ডারা হলেন বেশির ভাগ ধনীদের উচ্ছিষ্ট ভোগ করা মানুষ। যখন বিমূর্তরীতিকে সফল করে তুলতে পারলো না শাসকচক্র, যুবসমাজকে বিপথগামী করার জন্য চলচ্চিত্রে-শিল্প-সাহিত্যে-চিত্রকলায় আনলো যৌনতা।