নাট্যচর্চায় স্বাভাবিকবাদ আর বাস্তববাদের দ্বন্দ্ব

পর্ব ১২

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ৩১, ২০২০

ইউরোপে আঠারশো আটচল্লিশের পর নাট্যজগতে নানা ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে নাট্য ইতিহাসের আর একটি যুগ সন্ধিক্ষণের জন্ম হয় এসময় থেকেই। ইতিমধ্যে শিল্প বিপ্লব ঘটে গেছে। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারে তাই নাটকীয়-উচ্ছ্বাসপূর্ণ রোমান্টিক বা ভাববিলাসী ধারা থিতিয়ে এলো। সর্বত্রই যুক্তিবাদ পেতে লাগলো পূর্ণাধিকার। নাট্যশালার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও নাটক দেখার লোক হয়ে উঠলো মধ্যবিত্তশ্রেণী, যারা সম্পূর্ণ বাস্তবের মাটিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। তাই তারা মঞ্চে চাইলো দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের যুক্তিপূর্ণ কোনো শিল্পকলা। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এসময় ন্যাচারিলিজম বা স্বাভাবিকবাদ জায়গা করে নেয়। বলা হলো নাট্যকারদের উচিৎ তার চারপাশের জগৎ ও জীবনের সত্যকার চিত্র নাটকে তুলে ধরা, যে জগৎ-জীবনকে তিনি পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের মাধ্যমে দেখেন ও জানেন। তাদের উচিৎ সর্বতোভাবে স্বাভাবিকবাদী হওয়া, কল্পনার বিলাসিতা বাতিল করা। প্রথম যুগের বুর্জোয়া চেতনা যে ব্যক্তিত্ববাদের জন্ম দিয়েছিল, সেই চেতনা গণমানুষের সামাজিক দ্বন্দ্বকে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারেনি, সমাজের সকল মানুষকে নাটকে স্থান দিতে পারেনি। ভাববিলাসী দৃষ্টিভঙ্গি সেখানে ছিল খণ্ডিত। ভাববিলাসী বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ববাদের বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সেজন্য স্বাভাবিকবাদ বা প্রকৃতিবাদের উদ্ভব। স্বাভাবিকবাদের আগমনে ফল কী হলো? ঘটনার দ্বান্দ্বিক দিক বাদ দিয়ে দৈনন্দিন বাস্তব ঘটনার বর্ণনা দেয়া। সাদা চোখে দৈনন্দিন বাস্তবকে যেভাবে দেখা যায় তাকে সেভাবেই প্রতিফলিত করার সাংবাদিক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল এই সময়কালে।

ইউরোপের বুর্জোয়াশ্রেণীর ক্ষেত্রে, তাদের উত্থানের পর্বে স্বাভাবিকবাদী চেতনাকে ধারণ করা ছিল তাদের সামন্তান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তির প্রধান তাত্ত্বিক শর্ত। নাট্যপ্রযোজনা এই চিন্তার বাইরে থাকতে পারে না। স্বাভাবিকবাদী এই নাট্যধারার তাগিদেই নাট্যপ্রযোজনায় তৈরি হলো চতুর্থ দেয়ালের প্রশ্ন। এতদিন নাট্যপ্রযোজনায় দর্শক যা কিছু দেখেছে এবং শুনেছে, সেটা দর্শকদের দেখানোর ভঙ্গিতেই নির্মিত হতো। স্বাভাবিকবাদী নাট্যপ্রযোজনায় তা মোটেই গ্রহণযোগ্য হলো না। স্বাভাবিকবাদী নাট্যভঙ্গি নির্মিত হলো এমনভাবে দর্শকরা যেন ঘরের একখানি দেয়াল সরিয়ে চরিত্রগুলোর অজান্তে তাদের বাস্তব জীবনযাত্রার একাংশ উঁকি মেরে দেখে নিচ্ছে। এই সময়কার নাট্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দর্শকদের উপস্থিতির কথা ভুলে যেতে চেয়েছিলেন। বলা হলো মঞ্চের সামনে দর্শক রয়েছে সেটা কখনো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাথায় রাখা চলবে না, দর্শকের সাথে সরাসরি কথা বলা কিংবা চিন্তা আদান-প্রদান করা যাবে না। কখনো দর্শকের উদ্দেশ্যে কোনো কথা বললে বা কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ করলে তৎক্ষণাৎ নাটকের বাস্তবতা লঙ্ঘিত হবে। গ্রীক নাটকের কোরাস যারা সরাসরি দর্শকদের সাথে কথা বলতো কিংবা শেক্সপিয়ারের নাটকের চরিত্রদের স্বগতোক্তি সর্বত্রই বাস্তবতা লঙ্ঘন করছে বলে বাতিল করে দেয়া হলো। নাট্য প্রযোজনার সাথে স্বাভাবিকবাদীরা দর্শকের অনুভূতিকে একাত্ম করে ফেলতে চেয়েছিলেন। নতুন চিন্তা বা আঙ্গিক ভাঙার তাগিদটা এলো সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলার জন্য। বিজ্ঞানের সাথে মানুষকে পরিচিত করে তুলবার জন্য।

নাটকের পরিভাষার সাথে যারা পরিচিত নন, তাদের কাছে চতুর্থ দেওয়ালের ব্যাপারটা স্পষ্ট নাও হতে পারে। নাট্যাভিনয়ে চতুর্থ দেওয়াল থাকা না থাকার ব্যাপারটা আসলে কী? ব্যাপারটা হলো পাত্রপাত্রীরা জনান্তিকে কিছু বলতে পারবে না। নাট্যাভিনয়ের তেমন একটি উদাহরণ ধরা যাক যেখানে চতুর্থ দেয়াল ছিল না অভিনেতার কাছে। নাট্যাভিনেতা অভিনয়কালে দর্শকের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই কথা বলছে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে। মঞ্চায়িত নাটকের একজন নাট্যাভিনেতা মঞ্চে তার সহ অভিনেতাকে খুব হম্বিতম্বি করে বলছে, ‘কী বললে? আমি তোমার ভয়ে ভীত?’ ঠিক তারপরেই দর্শকের দিকে ফিরে সহ-অভিনেতা যেন শুনতে না পায় তেমনভাবে বললো, ‘ব্যাটা ভাব দেখাচ্ছে! জানেন দর্শকবৃন্দ, আমি কিন্তু মোটেই ভীত না এবং ধরুন আমি ভয় দেখালেই ও কিন্তু কাৎ।’ পরক্ষণেই আবার পার্শ্ব অভিনেতার দিকে ফিরে কপট সাহস দেখিয়ে বললো, ‘দেখো, যদি সত্যিই লড়তে চাও, তাহলে তোমার তরবারি বের করো। দেখি তুমি কেমন লড়তে পারো।’ পরক্ষণেই আবার দর্শকদের দিকে ফিরে চোখে কটাক্ষ হেনে বললো, ‘জানি ব্যাটার কাছে এই মুহূর্তে কোনো তরবারি নেই। থাকলে যে আমার ভাগ্যে কী হতো কে জানে।’ পরক্ষণেই আবার পার্শ্ব অভিনেতাকে লক্ষ্য করে বললো, ‘কী ব্যাপার, তোমার তরবারি বের করছো না কেন ভাই, আমি তো লড়বার জন্য প্রস্তুত। মনে হচ্ছে তুমি ভয় পাচ্ছ।’ ঠিক এরপরেই পুনরায় দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দেখলেন তো ব্যাটাকে কেমন বেকাদায় ফেলেছি। যদি সত্যি সত্যি ওর কাছে তরবারি থাকতো, ভয় আমাকেই এ স্থান ছেড়ে পালাতে হতো।’ নাট্যাভিনেতার এই যে দর্শকদের সঙ্গে কৌতুক করা এবং সরাসরি দর্শকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন বা কথা বলার রীতি, স্বাভাবিকবাদীরা এটা মানতে রাজী নন। স্বাভাবিকবাদীরা মনে করেন এতে বাস্তবতা ক্ষুন্ন হয়। স্বাভাবিকবাদীরা সেজন্য দর্শক ও মঞ্চের মাঝখানে কাল্পনিক চতুর্থ দেওয়াল স্থাপন করেছিলেন।

নাট্যাভিনয়ে চতুর্থ দেওয়ালের প্রশ্নে আঁন্দ্রেইনির একটি চিঠি পাওয়া যায়। তিনি পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি ফ্রান্সে গিয়েছিলেন এবং সারা ইউরোপে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল এক মহান অভিনেতা হিসেবে। নাট্যশৈলীর মহান স্রষ্টা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি কী আবিষ্কার করেছিলেন? চতুর্থ দেওয়াল ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি তাঁর অভিনেতাদের বললেন, তারা যে এতদিন দর্শকদের উদ্দেশ্যে সংলাপ ব্যবহার করতো তা যেন আর না করে। কিন্তু মঞ্চে যে পার্শ্ব বা সহ অভিনেতা রয়েছে তার সঙ্গে ব্যবহারটা করে যেন ইন্ধনকারী হিসেবে। মঞ্চের অভিনেতাদের সাথে ইন্ধনকারী হিসেবে অভিনয় করে দর্শকদের সজাগ করতে তাঁর আপত্তি ছিল না। কিন্তু সরাসরি দর্শকদের সাথে কথা বলায় তাঁর আপত্তি ছিল। যখন আঁন্দ্রেইনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, দল তাঁর নির্দেশনা ছাড়াই অভিনয় করে যাচ্ছিলো। কিছুদিন পর তাঁরা পূর্বের ধারায় ফিরে গিয়ে অভিনয় করতে শুরু করলো সরাসরি জনান্তিকের ব্যবহারে অর্থাৎ দর্শকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে। সমস্ত অভিনেতাদের গালাগালি দিয়ে আঁন্দ্রেইনি তখন এক চিঠি লেখেন। সে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘তোমাদের ভুলে যেতে হবে যে প্রেক্ষাগৃহে তোমাদের সামনে দর্শক বসে আছে। দর্শকের কথা মাথায় রাখবে না। স্মরণে রাখবে তোমরা একটা নাট্যশালার ভিতর আছো, কোনো বাজারে নয়।’ মঞ্চের সামনের দর্শকের কথা ভুলে যেতে হবে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের, সেটাই বহু বছর পর স্বাভাবিক নাট্যধারায় একটা আদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।

মূলত বাস্তববাদী নাট্যধারার প্রথম পর্ব হলো প্রকৃতিবাদ বা স্বাভাবিকতাবাদ কিংবা স্বভাববাদ। প্রকৃতিবাদীরা মানুষের জৈব দিকের উপরই বেশি জোর দিলেন। প্রকৃতিবাদের প্রথম প্রবক্তা এমিল জোলা। তিনি মনে করতেন প্রকৃতিবাদী নাটক মানেই একখানি বৈজ্ঞানিক নথি বা প্রমাণপত্র। সোজা কথায় জীবনের একটি নির্ভেজাল অংশ। স্বভাববাদ বা প্রকৃতিবাদের উদ্দেশ্য ছিল, একজন বৈজ্ঞানিক যেমন গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন কিংবা একজন শল্য চিকিৎসক যেমনভাবে শব ব্যবচ্ছেদ করে থাকেন ঠিক তেমনিভাবে জীবন ও বাস্তবতাকে দেখা। যা সাদা চোখে দেখা যায়, ততটুকুই। উনিশ শতক ধরে যে যন্ত্রনির্ভর পুঁজিতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, তা পুরানো সমাজ ভেঙে ফেলে নতুন শ্রেণীসমূহের জন্ম দিচ্ছিলো। এই নতুন আবির্ভূত শ্রেণীসমূহের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সংঘাতের পরিমণ্ডলে আঠারো শতকীয় যুক্তিবাদে বা ভাববিলাসীদের ভাবালুতায় নাট্যকারদের পক্ষে আস্থা রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। আঠারশো একাত্তর সালে প্যারিস কমিউনের সদস্যরা বুঝলেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতির অর্থই হচ্ছে জীবনের অনুপস্থিতি। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এই চিন্তা দেখা গেল। দীর্ঘদিনের ভাববিলাসী ধারার জায়গায় এ সময় দেখতে পাওয়া যায় খুব দ্রুত বেশকিছু নতুন নাট্যচিন্তা ও নাট্যভঙ্গির উপস্থিতি।

সারা ইউরোপে উনিশ শতকের শেষপাদে জীবনকে যথাযথভাবে তুলে ধরা বা জীবন যেমন ঠিক তেমনি দেখানো নাটকের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসী দেশের এমিল জোলা ছিলেন যেমন এর প্রধান প্রবক্তা, তেমনি তিনি নাট্যপ্রযোজনায় স্বভাববাদ শিরোনামে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লেখেন। জোলা লিখলেন যে, মানুষকেও মৌলিক পদার্থসমূহের মতো বীক্ষণের আওতায় আনতে হবে এবং তাদের প্রতিক্রিয়াসমূহ লক্ষ্য করতে হবে। জোলার মতে নাট্যকলাকে বিকশিত হতে হবে তার স্বাভাবিক শক্তিতে। নাট্যশিল্প সরাসরি বাস্তব থেকে এতটুকু মিথ্যা বর্ণনা না করে রক্তমাংশের একটা লোককে সোজা মঞ্চে তুলে দেবে। সমস্ত কাল্পনিক চরিত্রদের সেখান থেকে বিদায় নিতে হবে। নাট্যক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হবে, কোনো মিথ্যা চাতুরি বা ভান না করে সে হবে বাস্তবসম্মত। সকল ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানসিকতা আনতে হবে নাটকে। নতুনতর পদ্ধতি প্রয়োগের সুস্পষ্ট ইচ্ছা নিয়ে জোলা যখন নাট্যশালায় এলেন স্বভাবতই বহুজন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। জোলার এই পথ ধরে যাঁরা এগিয়েছিলেন তাঁরাই স্বভাববাদী ধারার সাথে সম্পৃক্ত বলে ধরা হয়। প্রথম দিকে স্বাভাবিকবাদী নাটক পূর্বেকার সমস্ত নাট্য ধারণাকে স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতেন। সেজন্যই নাটক থেকে নাটকীয়তা বাদ দিতে চাইলেন স্বভাববাদীরা। স্বভাববাদী নাটকের আরম্ভ হয়েছিল উনিশ শতকে। এটা ছিল এক নতুন পথে যাত্রার সূচনাবিন্দু।

স্বভাববাদের প্রধান প্রবক্তাদের একজন এমিল জোলা। তিনি মনে করতেন, সমসাময়িককালের বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক মনোভাব অচিরেই নাট্যশালায় প্রভাব বিস্তার করবে এবং নাট্যপ্রযোজনার আমূল সংস্কার সাধনে এটি হবে একমাত্র সম্ভাব্য পথ। তিনি মনে করতেন, নাট্যশালার তাবৎ কর্মকাণ্ডের; পরিচালনা, মঞ্চস্থাপত্য, প্রযোজনা সবকিছুর পরিবর্তন আবশ্যক। নাট্যকলার পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে জোলা দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রতিনিয়ত আমার নাটকে এমনভাবে চরিত্রদের পেশাগত জীবনকে মঞ্চে উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করেছি যে তারা দর্শকের চোখে যেন অভিনয় না করে জীবন্ত হয়ে ওঠে।’ স্বভাববাদী নাট্যধারা আসার আগে পর্যন্ত নাটক ছিল নাট্যধর্মী। জীবনকে যথাযথভাবে শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলতে চাননি, চেয়েছিলেন তার ভাবসত্যকে ফুটিয়ে তুলতে। স্বভাববাদী নাট্যধারায় নাটক হয়ে উঠলো জীবনের যথাযথ অনুকরণ। স্বভাববাদী নাটকের চরিত্রগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক হওয়া চাই, তাদের কথা বা সংলাপও হবে দৈনন্দিন জীবনের মতো। এ ছাড়াও তাদের মানসগঠন বা মনোবিজ্ঞানও হবে আজকের দিনের মানুষের মতন, তাদের মানস গঠনের অনুরূপ; যাদের দর্শকরা চেনে ও জানে এবং বুঝে। দৈনন্দিন জীবনে যাদেরকে চারদিকে দেখতে পায়। বাস্তব জীবনে যেভাবে ঘটনাগুলো ঘটে মঞ্চের ঘটনাগুলো অনুরূপ ঘটবে। স্বাভাবিকতা ক্ষুন্ন করা যাবে না নাট্য রচনা ও পরিচালনায়। এসবই ছিলো স্বভাববাদী নাটকের মূল কথা।

নাটক এ সময় থেকেই কাহিনী প্রধান হয়ে উঠলো এবং তা গদ্য ভাষায় লিখিত হতে থাকলো। মানুষের দৈনন্দিন ভাষাকে আশ্রয় করলো রচিত নাটক। স্বভাববাদী এই নাট্যধারার পরীক্ষা-নিরীক্ষা জোলা এবং গকুর থেকে আরম্ভ করে ইবসেন, স্ট্রিন্ডবাগ, বার্ণর্ড শ হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সে-সময়কার নাট্যকার বা নাট্যচিন্তকরা সচেতনভাবেই পুরানো চিন্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। পুরানো বহু কিছু ভেঙে-চুরে অনেক কিছু নতুন করে গড়াই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। জোলা বলেন, বিশেষ নাট্যভঙ্গির অস্তিত্ব নেই; নাট্যভঙ্গি আছে একাধিক। সর্বদাই নাটকের বিষয়বস্তু ও ভঙ্গি হতে হবে যুগোপযোগী যা নিয়ত পরিবতনশীল এবং যা কোনো বাঁধা-ধরা নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ নয়। তিনি বলেন ‘যেহেতু ভঙ্গি পরিবর্তনশীল সেহেতু গতকালের অচল ভঙ্গির বৈপরীত্যে আগামী কালের নতুন ভঙ্গি অন্বেষণের স্বাধীনতা প্রত্যেকের আছে।’ তিনি বলেন, এক কথায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেই বর্তমান সমাজকে উপলব্ধি করতে হবে। হাউপ্টমান যিনি ছিলেন এমিল জোলার যোগ্য শিষ্য তিনি মন্তব্য করেছেন, যেসব ক্ষেত্রে আমরা নাট্যভঙ্গিতে জীবন গড়ে তুলতে পারি না, সেসব ক্ষেত্রে কি আমাদের শিল্পভঙ্গিকেই জীবনের মতো আত্মস্থ করতে পারা উচিৎ নয়? স্বভাববাদের আগে নাটকে যেসব পরিবর্তন এসেছে, যেভাবে নাটক একধারা থেকে অন্য ধারায় চলে গেছে তা ছিল অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত বিবর্তনের এক ধারা। নাট্য ইতিহাসে এই প্রথম সচেতন বিদ্রোহ দেখা যায় নাটককে এক ধারা থেকে অন্য ধারায় নিয়ে যাবার জন্য। স্বভাববাদী এই নাট্যচিন্তা থেকেই নাট্যনির্মাণের সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। শুধু নাটক লেখা নয়, নাটকের প্রকৃতি নিয়েও চিন্তা-ভাবনা শুরু হলো। নাটকের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলো নানা মত ও পথের।

স্বভাবধর্মী নাটকের উদ্দেশ্য হলো বাস্তব জীবনের যথাযথ অনুকরণ। বলা যেতে পারে যা পরিচিত, যা প্রাত্যহিক, যা স্বাভাবিক তাকে উদ্ঘাটন করাই হলো এই নাটকের দর্শন। যে বাস্তব স্থূল, রুক্ষ, কুৎসিত ও কলুষিত তাই বাস্তববাদীদের অতি প্রিয়। মুটে, মজুর, মিস্ত্রি, কসাই, দালাল, বেশ্যা ইত্যাদি; এরাই হলো বাস্তববাদী নাটকের চরিত্র। এদের জীবনের সমস্যা ও সংগ্রাম, বিকৃতি ও দুর্নীতি, বেদনা ও ব্যর্থতা বাস্তববাদী নাটকের মধ্যে অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে অঙ্কিত হতে থাকে। যে জীবন মানুষ দেখতে চায় না অথবা যে জীবন নিষ্ঠুরভাবে সত্য, তাই স্বাভাবিকবাদী নাটকের মধ্যে চিত্রিত হয়। স্বাভাবিকতাবাদী নাট্যচিন্তা আগমনের সাথে সাথে সকল কিছুই নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালো। চিকিৎসালয়, কয়লাখনি, হাটবাজার, গোরস্থান, কোটিপতির বাড়ি, বস্তি, কারখানা, শুঁড়িখানা, বিদ্যালয়, বেশ্যালয়; বাস্তব বলতে যতদূর চোখ চলে সবকিছুই নাট্য প্রযোজনায় তুলে আনা হলো। সামাজিক জীবনের প্রতিটি কানাগলি, চোরাগলি নাটকের বিষয়ের মধ্যে চলে এলো। নাট্যকলার তখন প্রধানতম আগ্রহ হলো দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের সব ঘটনাকে নাটকে জড়ো করা, তার যথাযথ চিত্র নাটকে তুলে ধরা এবং নাটকীয়তা বর্জন করা। স্বভাববাদী নাট্যপ্রক্রিয়া সব কিছুতেই এমন স্বাভাবিকত্ব বজায় রাখে যে দর্শক তাঁর বিচার বিবেচনা, কল্পনাশক্তি এবং আবেগ দ্বারা সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পান না। পরিবর্তে দর্শক নিজেই এমন নিমগ্ন ও একাত্ম হয়ে যান যে তিনি নিজেই হয়ে ওঠেন বস্তু।

স্বভাববাদের এই ধারা খুব দ্রুত ইউরোপকে গ্রাস করলো। ব্রাহাম এই নতুন শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বললেন, নতুন শিল্পরীতি হলো একটি কথায় সত্য। অভিনেতার কাজ হলো দর্শকের কাছে অতি সরলভাবে বাস্তব মানুষের পরিপূর্ণ চেহারা তুলে ধরা। বিশেষ নাট্যভঙ্গিতে সাজানো মানুষ নয়, কেবলমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মানুষ। দৈনন্দিন জীবনের বিশ্বাসযোগ্য বাস্তব। জোলা বললেন, পবিত্র বিশুদ্ধ নীতিবান নায়কেরা কেবলই জিতে যায় এবং নীতিবিবর্জিত খলনায়কেরা প্রভূত চক্রান্ত করেও কেবলই হেরে যায় অথবা আকস্মিকভাবে তাদের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে; এসব আর চলবে না। তা দর্শকদের ক্লান্তিই উৎপাদন করছে। নতুন ধরনের নাটক দরকার যা হবে বাস্তবধর্মী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তায় ভরপুর। নায়ক-নায়িকার চেয়ে নর-নারীই চরিত্র হিসাবে মানুষ তাঁদের কাছে গুরুত্ব পেল। নতুন ধরনের নাট্য রচনায় খলনায়করাও বাস্তবসম্মতভাবে জিতে যেতে পারে; শেষ দৃশ্যে নায়কের অবশ্যই জয়ী হবার কোনো প্রথাবদ্ধ নিয়ম সেখানে জায়গা পেল না। শুধুমাত্র বড় বড় অসাধারণ মানুষরা নাটকের নায়ক হবে সে-ধারণাটাও বাদ পড়লো; কোনো অসাধারণত্ব নেই এমন মানুষদেরই সেখানে জায়গা হলো। পূর্বে রাজা বাদশার চরিত্রের পাশাপাশি যে সাধারণ মানুষের চরিত্র ছিল না তা নয়, তবে তারা নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে আসতে পারেনি, ঘটনার কেন্দ্রে তারা ছিল না। প্রকৃতিবাদ সাধারণ মানুষকেই ঘটনার কেন্দ্রে নিয়ে এলো। নাট্যরচনার ক্ষেত্রে নতুন এক ধারা শুরু হলো। নতুন এক বিপ্লব।

স্বাভাবিকবাদী নাট্যাভিনয়ের সারবস্তু হলো বিষয়বস্তুর অনুষঙ্গী হিসেবে এর নানা খুঁটিনাটি জোগান দেওয়া। চরিত্রগুলির বাহ্যিক অবয়ব, মুখমণ্ডল, পোষাক-আষাক, ভাবভঙ্গি, কণ্ঠস্বর, পারিপার্শ্বিকতা সবকিছুই যেন দৈনন্দিনের মতো হয়। নাটকের সংলাপকে বিশেষ অর্থপূর্ণ করে উপস্থাপিত করা হয় না, বরং জীবনের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে থাকে তেমনি অসংলগ্নভাবে, বাধাগ্রস্থভাবে এবং বিচ্ছিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়। নাট্যশিল্পে এরূপ বাস্তব আলাপনের অনুকৃতি ছাড়াও এ পদ্ধতিতে ছিল সমস্ত আনুষঙ্গিক এবং সমস্ত চরিত্র বাস্তব জীবনে ঠিক যেমনটি ঠিক তেমনভাবেই উপস্থিত করা। নাটক উচ্চকিত হবে না, হবে স্বাভাবিক জীবনে যেমনটা ঘটে ঠিক তেমন। নাট্যশিল্পকে আলোকচিত্রের সামিল করা হলো। বাস্তবোত্তর এবং বাস্তবের মধ্যকার পার্থক্য নাট্যকর্মে ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টা চললো। পুঙ্খানুপুঙ্খ বা খুঁটিনাটিতে এসে এই নাট্যশিল্প আটকে গেল নাটকীয়তা সৃষ্টির পরিবর্তে। সাজানো গোছানো পরিকল্পিত নাট্যক্রিয়াকে বাদ দিয়ে দৈনন্দিনকে তুলে ধরতে গিয়ে নাটকে পৌনঃপুনিকতার বাড়াবাড়ি ধরা পড়লো। মনে রাখা দরকার পৌনঃপুনিকতার ফলে সমস্ত আমোদই ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকবাদী নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। স্বাভাবিকবাদী নাট্য রচনা ও প্রযোজনা একটি প্রচেষ্টা হয়েই থাকলো কিন্তু তেমন সাফল্য লাভ করলো না। কারণ নাট্যরচনা ও পরিচালনায় দীর্ঘদিনের একটি ঘটনাকে দু-তিন ঘণ্টার পরিসরে বাঁধতে গেলে তাকে দৈনন্দিনের সংলাপ দিয়ে বা দৈনন্দিনের আবহাওয়ায় সবসময় সাজানো যায় না। বাস্তবে যা ঘটতে দশ বছর লাগে নাটকে তাকে তিন ঘণ্টার পরিসরে বাঁধতে গেলে নাট্যকারের ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব এসে পড়ে। বাস্তবের বিক্ষিপ্ততা, অসংলগ্নতা ও আকস্মিকতাকে বর্জন করে নতুন করে গল্প সাজাতে হয়, নতুনভাবে চরিত্র আঁকতে হয়। দশ বছরের ঘটনাকে তিন ঘণ্টার পরিসরে বাঁধতে গেলে স্বাভাবিক থেকে সরে গিয়ে সংলাপগুলিকে সাজিয়ে লিখতে হয়, তাকে সুসংগঠিত করতে হয়। প্রতিদিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্যকে বৃহত্তর সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে গেলে, দৈনন্দিতাকে বাদ দিয়ে নতুনভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। বাস্তব জীবনে নায়ক নায়িকা থাকে না, নাটকে নায়ক নায়িকা উপস্থিত করা হয় দৈনন্দিনের নির্যাসকেেউপস্থাপন করার জন্য, প্রতিদিনের বাস্তবকে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখবার জন্য।

নতুন এই নাট্যরীতি স্বাভাবিকতাবাদ সম্পর্কে বহু সমালোচকই বলেছিলেন মঞ্চে একে প্রতিষ্ঠা দেয়া অসম্ভব। সেইসব সমালোচনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে স্বাভাবিকতাবাদ শীঘ্রই স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হলো কিন্তু পূববর্তী নাট্যধারাকে সম্পূর্ণ বাতিল করতে পারলো না। স্বাভাবিকবাদ রীতি নাট্যজগতে এক নতুন বার্তা বয়ে নিয়ে এলো। যদিও স্বাভাবিকতাবাদ বা প্রকৃতিবাদ খুব অল্প সময়ই নাটকের ইতিহাসে তার আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছিল, তবে এই ধারাই নতুন নতুন সব নাট্যধারার পথ বাতলে দেয়, নাট্য ইতিহাসে এক নতুন পথ, পদ্ধতির সৃষ্টি করে। প্রকৃতিবাদ বা স্বভাববাদ, এই ভঙ্গি আবিষ্কারের পেছনে মূলত কী চিন্তা কাজ করেছিল? কেন তার আর্বিভাব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল উনিশ শতকের শেষ পাদে? কারা এই ভঙ্গিকে সাধুবাদ বা স্বাগত জানিয়েছিল? কেনই বা খুব বেশিদিন এ ধারা টিকে থাকতে পারলো না? স্বভাববাদী নাট্যধারা সৃষ্টির শুরু হয়েছিল আসলে কোথা থেকে বা এর মূল উৎসটি কী? এইরকম নানা প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক। প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তরও রয়েছে। আঠারশো চল্লিশ সালে ডেভিড হিল নামক এক ভদ্রলোক ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিকে যে ধরে রাখা যায় এটা জানতে পেরে মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলো। বাস্তবকে অনুকরণ করাও শুরু হলো। পাশাপাশি যে ঘটনাটি ঘটে, আঠারশো একাত্তর সালে প্যারিস কমিউন গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণী কয়েক মাসের জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে। এই ধরনের রাজনৈতিক পালাবদলের ঘটনায় শ্রমিকরা বা নীচুতলার মানুষরা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নজর কেড়ে নেয়। নীচুতলার মানুষরাও যে বিরাট বিরাট ঘটনার নায়ক হয়ে উঠতে পারে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তারই প্রমাণ ঘটে এবং তা শিল্পী ও সাহিত্যিকদের চিন্তাকে ভীষণরকম প্রভাবিত করে। স্বভাবতই নীচুতলার মানুষদের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রে আনতে হলে রাজা বাদশার আঙ্গিনা ছেড়ে নাটককে ঢুকে পড়তে হয় সাধারণ মানুষের জীবনে। শ্রমিকদের কুঁড়ে ঘরে উঁকি দেয় সে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রতিফলিত করতে চায় নাটকে। সাধারণ মানুষকে চিত্রিত করতে গিয়ে নাটকের ঘটনা বিস্তৃত হয় পথেপ্রান্তরে, হাটেবাজারে, পুলিশ কার্যালয় থেকে সর্বত্র। নাটকের বিষয়বস্তু পাল্টাতে গিয়েই নতুন চিন্তা, সেই সাথে নাটকের নতুন আঙ্গিক জন্ম নেয়।

শাসকশ্রেণীর আধিপত্য শিল্প-সাহিত্যে প্রভাব ফেলতে বাধ্য এ কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। ফলে যে শ্রমিকশ্রেণী সামান্য সময়ের জন্য হলেও প্যারিসে শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁরা যে শিল্প-সাহিত্যে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করবেন এটাই তো ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনা। তাই প্যারিস কমিউনের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণী তাঁর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রেখে গেলেন শিল্প-সাহিত্যে। সাধারণ মানুষের কাছে সাধারণ মানুষের নাট্যশিল্পকে পৌঁছে দেয়ার জন্য এই সময় থেকেই গণনাট্যের ধারণাও শক্তিশালী হতে শুরু করে। ফ্রান্সে যে-ব্যক্তি প্রথম গণনাট্যের আদর্শ অনুভব করতে পেরেছিলেন তাঁর নাম মরিস পত্তিসের। প্যারিস কমিউন বা আঠারশো একাত্তর সালের শ্রমিক বিপ্লবকে ঘিরেই যেমন প্রকৃতিবাদের জন্ম তেমনি এইসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাট্যচিন্তায় জনগণ ও রাজনীতির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল। নাট্যজগতে এক বিরাট আলোড়ন তুলেছিল ঘটনাটি। নাটক নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছিল। সাধারণ মানুষের স্বার্থকে মাথায় রেখে নাটক লেখা ও মঞ্চায়িত হওয়ার ব্যাপারটি এ সময় থেকেই গুরুত্ব পেতে থাকলো। পাশাপাশি এ কথাও সত্যি যে, প্যারিস কমিউন বা শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র যেমন খুব শীঘ্র মুখ থুবড়ে পড়েছিল, তেমনি স্বভাববাদের ধারণাও খুব শীঘ্রই বাতিল হয়ে গেল। কারণ স্বভাববাদ মানবজীবনকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ না করে জীবনের যথাযথ ছবি তুলে ধরতে লাগলো। চোখ ঝলসানো মঞ্চসজ্জার কোনো ব্যাপার সেখানে নেই। সাধারণ বিষয়, সাধারণ ঘটনা, সাধারণ রীতিনীতি, সমাজের গড় একটা ঘটনা, যা এতোই শূন্যগর্ভ, এতোই তাৎপর্যহীন যে, চার ঘণ্টা ধরে তা দেখার পর দর্শক স্বভাবতই প্রশ্ন করতে পারেন এর সঙ্গে তাঁর জীবনের সম্পর্ক কী? নাট্যকার স্ট্রিণ্ডবার্গের মতে চার ঘণ্টা ধরে সে নাটক দেখাটাও ছিল খুবই যন্ত্রণাদায়ক।

মানুষের চোখের দেখা আর চিত্রগ্রহণের মধ্যে পার্থক্য আছে। চিত্রগ্রহণের কাজে নির্দিষ্ট জায়গার কোনো কিছুই বাদ পড়ে না, সামান্য ধুলিকণাও নয়। মানুষের চোখে কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গার সব কিছুই নজরে আসে না। যার গুরুত্ব নেই তা তার দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। স্বাভাবিকবাদী নাটকও হলো চিত্রগ্রহণের মতো, গুরুত্বহীন ধুলিকণাও যেন এখানে বাদ পড়তে পারবে না। বাস্তবের সবকিছুই সেখানে ধরা পড়তে হবে। স্বাভাবিকবাদীরা মনে করেন প্রকৃতির কোনো এক খণ্ডাংশের বর্ণনাই হলো শিল্প। প্রশ্ন হলো, সে বর্ণনা যদি মানব সভ্যতার বিকাশকে ব্যাখ্যা করতে না পারে কিংবা মানব সমাজের বিকাশের স্বার্থে কাজে না লাগে তাহলে তার মূল্য কী? টলস্টয় স্পষ্ট করে বললেন, দৈনন্দিনের এই প্রতিবিম্ব শিল্প হতে পারে না। বাস্তবের অনুকৃতি শিল্পৎকর্ষের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট শিল্পীর উপলব্ধি দ্বারা অপরকে সংক্রামিত করা। প্রতিটি সৃষ্টিতে থাকবে স্রষ্টার মনন এবং কল্পনার বৈচিত্রের ছাপ। বাস্তবকে শিল্পী নতুন করে সৃষ্টি করবেন। নাটককে তখন নাটকীয় ঘটনার ভিতর দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। ফলে নাটক রচনা সহজ কাজ নয়, দৈনন্দিনকে চিরন্তন করতে দরকার সৃষ্টিশীলতার।

মানুষের দৈনন্দিন জীবনে গালাগাল রয়েছে বলেই কি নাটকে গালাগাল টেনে আনতে হবে? খিস্তি বা গালাগাল আসলে কী? মানুষের প্রচণ্ড ক্রোধের প্রকাশ। ফলে নাটকে গালাগালটা প্রধান নয়, প্রধান হলো মানুষের ক্রোধটাকে সৃষ্টিশীলতার ভিতর দিয়ে ধারণ করতে পারা। বাস্তব জীবনে বহু কিছুই ঘটে সবটা কী নাটকে উপস্থাপন করা সম্ভব? নাকি করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে! নাটকে যদি নর-নারীর পুরো একটা যৌন-সঙ্গমের দৃশ্য দেখিয়ে ফেলা হয়, দর্শক কি তখন শারীরিক উত্তেজনায় শিহরিত হবে, নাকি নাটকের বক্তব্যটাকে গুরুত্ব দেবে? যৌন-উত্তেজনায় শিহরিত দর্শক কি নাটকের বিষয়বস্তুকে ঠাণ্ডা মাথায় বিচার করবে নাকি মিলনায়তনে ভিন্ন ঘটনা ঘটাবে? বাস্তব জীবনে কী ঘটে? প্রিয়জন মারা গেলে মানুষ দিনের পর দিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না, নিজের যত্ন নেয় না। স্নান করে না বা দাঁত মাজে না। চরিত্রের দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে কি এসব বিস্তরিতভাবে দেখানো হবে নাটকে? শম্ভু মিত্র বলেন, মাত্র ছোট্ট একটা দৃশ্য দিয়ে চরিত্রের এই দুঃখবোধ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। চরিত্রটি যদি জানালা দিয়ে ভাবলেশহীনভাবে কিছুক্ষণ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে তাতে এমন বোধ ফুটিয়ে তোলা যায়। চরিত্রটির অভিনয়ের ক্ষমতার উপর তা নির্ভর করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, সেই সত্য যা রচিবে তুমি যা ঘটে তার সব সত্য নয়। সেই সত্যটাকে ধরার উপায় নাটককে সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে বাস্তব থেকে বাস্তবোত্তরে নিয়ে যাওয়া।

শিল্পকলার প্রধান দায় শিল্পের অনুভূতিকে প্রধান করে তোলা, বাস্তবের খুঁটিনাটি বর্ণনা নয়। বরং প্রয়োজনাতিরিক্ত বর্ণনার দ্বারা সে সংক্রমণ-ক্রিয়া সাধারণত বাধাপ্রাপ্ত হয়। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ নির্ভর বিস্তৃত বর্ণনার দ্বারা শিল্পরস গ্রহণেচ্ছুর মনোযোগ ভিন্নমুখি করে দেওয়া হয়। বাস্তবতার পরিমাণ কিংবা উপস্থাপিত বিষয়ের খুঁটিনাটি বর্ণনা কতোটা যথার্থ শিল্পসৃষ্টিতে সহায়ক, টলস্টয় সে প্রশ্নটি তুলেছিলেন। তিনি বলেন, খুঁটিনাটি বর্ণনার দ্বারা কোনো প্রকৃত শিল্পকলা সৃষ্টি করা যায় না; চমক সৃষ্টি করা যায় মাত্র। মানুষের চিন্তায় দোলা না দিয়ে, মানুষের মধ্যে অনুভূতি সঞ্চারিত না করে তা মানুষের স্নায়ুর ওপর ক্রিয়াশীল হয় মাত্র। খুঁটিনাটি বর্ণনার দ্বারা শিল্পকলা কেবল স্থূলত্ব প্রাপ্ত হয়। লিও টলস্টয় ভুল বলেননি। স্বভাবতই পথে-ঘাটে প্রতিদিন যা কিছু দেখতে পাওয়া যায় তার সবকিছুই মানুষ মঞ্চে দেখতে পছন্দ করে না। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যা দেখছে তাকে আবার হুবহু মঞ্চে তুলে আনার কোনো অর্থ নেই। মানুষ নাটকে দেখতে চায় ঘটনার নির্যাসটুকু। অনুকরণ-নির্ভর যাবতীয় শিল্প প্রকাশকে সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন প্লেটো। তিনি বলেছিলেন, অনুকরণ সত্যকে চিনতে শেখায় না বরং সত্য সম্পর্কে বিভ্রম সৃষ্টি করে। প্লেটো সেখানেই থামলেন না, অনুকরণ-নির্ভর শিল্পীকে তিনি উন্মাদ, নকলবাজ ও আহাম্মক বলে তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন।

য়্যারিস্টটল কিন্তু প্লেটোর সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন না। তিনি গুরুর অনুকরণ তত্ত্বকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করলেন। য়্যারিস্টটলের মতে সকল শিল্পই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো না কোনো ঘটনা বা বিষয়কে অনুকরণ করেই সৃষ্টি হয়। তবে এই অনুকরণের রীতি-পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণে সৃষ্টি হয় শিল্পের নানা রূপ। যথাযথ বা সরাসরি অনুকরণকে সাধারণভাবে নকল বলা যায়। কোনো ঘটনার হুবহু অনুকরণে শিল্পীর নিজস্ব কোনো চিন্তার ছাপ থাকে না। এইরকম নিছক অনুকরণ বা নকল কখনো শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। প্রকাশকামিতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সে প্রকাশ করে তার আবেগ-অনুভুতি-ধারণা-বিশ্বাস ইত্যাদি। কিছু প্রকাশ স্বাভাবিক, সাবলীল, বাধাহীন স্বতঃস্ফূর্ত; আর কিছু প্রকাশ নিয়ম-রীতি, প্রকরণ ও ব্যাকরণের সীমায় বন্দী। মানুষ সুখের অনুভূতিতে হাসে, দুঃখের অনুভূতিতে কাঁদে; এ তাঁর অনুভূতির স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। এই প্রকাশে নিয়ম-রীতির কোনো বালাই নেই। নিয়ম-রীতিহীন এই প্রকাশ তাই কখনো শিল্প হয়ে ওঠে না। মানবানুভূতির নিয়ম-রীতি, প্রকরণ-ব্যাকরণ সিদ্ধ প্রকাশই হয়ে ওঠে যথার্থ শিল্প। কারণ শিল্পীর চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ রয়েছে তার মধ্যে।

নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ দেখিয়েছেন যে, রাস্তা ঘাটে প্রতিদিন যা ঘটছে তা দেখে জীবনকে বুঝতে যাওয়া কয়েকটা প্রতিবাদ সভার ছবি দেখে জনগণের সমস্যা বুঝতে যাওয়ার মতোই অর্থহীন। ফ্রান্সে সেই সন্ত্রাসের দিনে সংঘটিত সবগুলো হত্যাকাণ্ডের ছবি জোগাড় করে তা হাজারবার দেখলেও বিপ্লবের প্রকৃত অর্থ অবোধ্যই থেকে যাবে। জীবনে ঠিক যেমন যেমন ঘটে, তার প্রকৃতপক্ষে কোনো মানে নেই। একটা পুলিশকর্মী তিরিশ বছর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা প্যারির আদালতে বসে খুব খেয়াল করে দেখেও এ বিষয়ে যতোটা বুঝবে, একটা বাচ্চা ছেলে বা কোনো সন্ন্যাসিনী ব্রিয়ঁর একটা মাত্র নাটক দেখেই তা বুঝে যাবে। কারণ ব্রিয়ঁর কাজই হলো প্রতিদিনের ধুন্দুমার কাণ্ড থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটিকে ছেঁকে বার করে এমনভাবে তা সাজানো, যাতে এই সমস্ত ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক একটা তাৎপর্য পায়। মানুষের চারদিকে বিরাজমান যা কিছু তার সবই নাটকের উপাদান হয়ে উঠতে পারে। মানুষের চারদিকে যা ঘটছে তার ভাবময় কল্পনারঞ্জিত প্রকাশই নাটক। কিন্তু নিছক বাস্তবের অনুকরণ নাটক বা শিল্পকলা নয়। নিজের মনোজগতের ভাবনা প্রকাশ এবং তা অন্যের কাছে পৌঁছানো শিল্প-স্রষ্টার মূল উদ্দেশ্য। কারণ অন্যের মধ্যে তিনি তাঁর নিজের ভাবনার-কল্পনার প্রতিধ্বনি শুনতে চান। ফলে যথেচ্ছ প্রকাশ মাত্রই শিল্পকলা নয়-সৃষ্টির পিছনে শিল্পীর লক্ষ্য উদ্দেশ্য সুপ্ত থাকতে হবে। জন্ম থেকে মানুষ বা একজন শিল্পী নির্ভরশীল তার পারিপার্শ্বিকতার উপর। কিন্তু পারিপাশ্বিকতার বেড়াজালে সে বন্দী হয়ে থাকতে চায় না। মানুষ তাঁর পারিপাশ্বিকতা ভিতরেই নতুন সব সত্যকে উপলদ্ধি করতে চায়, যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না।

মানুষ উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা পছন্দ করে যা ইতিহাসে প্রতিদিন ঘটে না। মহৎ নাট্যকাররা রচনাশৈলীর মধ্য দিয়ে সেইসব উত্তেজনাকে মঞ্চে হাজির করতে চায়, স্বাভাবিকবাদীরা যার বিরুদ্ধে। সেজন্যই স্বাভাবিকতাবাদী নাট্যধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হলো। সমালোচকরা বলতে শুরু করলেন, এগুলো অসার এবং সামাজিক চেতনাশূন্য। ব্রেশটের ভাষায়, স্বভাববাদী নাট্যশালায় এমন বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি যা নাট্যশালার বাইরে পাওয়া যেতো না। পিসকাটর লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিকতাবাদ জনগণের দাবিগুলোকে তুলে ধরার থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই সঙ্গে অবশ্যই মানতে হবে, স্বাভাবিকতাবাদ বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন নয়, আধুনিক অর্থে মার্কসীয় নয়। জীবন সম্পর্কে যেখানে আমাদের উত্তর পাবার কথা, সেখানে শুনেছি জীবন সম্পর্কে শুধু আর্তনাদ।’ তিনি লিখছেন, স্বাভাবিকতাবাদ যুগের একটা ভগ্নাংশ মাত্র, বিশ্বচিত্রের একটা খণ্ড; কিন্তু কখনই পুরোটা নয়। সমস্ত যুগের শিল্পের মধ্যে আছে সরল আর প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত ভাবাবেগ। শিল্প ব্যক্তির ভাবপ্রবণ অংশকে প্রকাশ করে এক বিশেষ ধরনে। শিল্প চিরকালই মানুষের ব্যক্তিত্ব, সহজাত প্রবৃত্তি, ভাবপ্রবণতা, অর্থনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন। কিন্তু স্বভাববাদী ধারায় এই ধরনের কোনো প্রতিফলন প্রকাশ করা অসম্ভব। কারণ ‘সত্য’, আর কিছু নয় শুধু সত্য; এই হলো স্বভাববাদের মূল কথা। কিন্তু সকল সত্যই পাল্টে যায় স্থান কালের প্রেক্ষিতে। চিরসত্য বলে কিছু নেই। ফলে সত্যকে কোনো নিয়মের মধ্যে বাঁধা যায় না। সত্য সর্বদাই আপেক্ষিক এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রেক্ষিতে বিচার্য। মার্কস-এঙ্গেলস বিশেষ জোরের সাথেই বলেছেন, বাস্তবতার প্রতিফলন কথাটির অর্থ বাস্তবের অনুকরণ নয়। কথাটির মূল অর্থ বাস্তবের মধ্যে অন্তর্নিহিত যে মর্মবস্তু লুকিয়ে থাকে তাকেই সচেতনভাবে আবিষ্কার করা।

রজার গ্যারডি ফরাসী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক বিরল ব্যক্তিত্ব। প্রকৃতিবাদকে তিনি মানবতাবিরোধী বলেছেন, কেননা, প্রকৃতিবাদ মানব প্রকৃতির বিভিন্ন সম্পর্ককে যথাযথ বিশ্লেষণ না করে শুধুমাত্র ঘটনার বিবরণ দিচ্ছে। রাষ্ট্রের সাথে, সমাজের সাথে মানুষের সম্পর্কেও; তা যে-শ্রেণীরই হোক বা ব্যক্তিগতই হোক, তার কারণ অনুসন্ধানের পথে এ নাট্যধারা পা বাড়ায়নি। ফলে স্বভাববাদী ধারা জীবনের গভীর দিকগুলির সাথে সম্পর্কহীন। এ ভাবেই স্বভাববাদী ভঙ্গির দোষ ত্রুটি ধরা পড়তে লাগলো। প্রশ্ন উঠলো জীবনকে কি যথাযথ তুলে ধরা সম্ভব? জীবনতো শুধু ঘটনা স্রোত নয়, জীবন বলতে একটা যুগের চিন্তাভাবনা, ধ্যনধারণা স্বপ্ন-সাধনা সব। জ্ঞান বাদ দিয়ে, অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে, পূর্বে আহরিত তথ্য বাদ দিয়ে, কল্পনা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র চোখের ওপর নির্ভর করে কি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা যায়? যদি তাই হতো, গ্যালিলিওর চিন্তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। সাদা চোখে সূর্যটাকে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে দেখা যায়। স্বাভাবিকবাদী নাট্যধারায় সবকিছু এতোই স্বাভাবিক যে কারো পক্ষে দাঁড়িয়ে কিছু বিশ্লেষণের অবকাশ ছিল না। এই নাট্যধারা জনগণের কল্যাণের স্বার্থেই কাজ করছিল, যদিও জনগণের স্বার্থ প্রতিফলিত করার সঠিক পদ্ধতি এই ধারার জানা ছিল না। সমালোচকরা ব্যাপারটাকে এভাবেই দেখেছিলেন। ব্রেশ্ট তাঁর এক রচনায় স্বভাববাদ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন, ‘যতই শিল্প উন্নত হবে ততই জীবনকে দেখতে গেলে বাস্তবজীবন থেকে কম সাহায্য নিতে হবে। একথা সত্য যে আমরা বাস্তবজীবন থেকে ঘটনার অনুকরণ করি কিন্তু সেটা ছাড়াও আরও আছে। শুধু ঘটনা নিয়ে কী হবে? আসল কথা হচ্ছে ঐ অনুকরণ করার পিছনে আমাদের কারণ বা লক্ষ্যটা কী?’ তিনি আরো লিখছেন, অনুকরণকে উদ্দেশ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করলে আর নাট্য বস্তুটার অস্তিত্ব থাকবে না।

সত্যিকার অর্থে ব্রেশ্টের বক্তব্যের মূল দিকটা হলো খণ্ডিতভাবে সত্যকে দেখা যায় না। জীবন এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নাটকের লক্ষ্য হলো, খণ্ডিত মানুষের দৈনন্দিনতাকে অনুকরণ করা নয়; জীবনের সামগ্রিক সত্যকে ব্যাখ্যা করা। নাটক করার পেছনে উদ্দেশ্যটাই আসল। খণ্ডিত দৈনন্দিতার মধ্যে সেই উদ্দেশ্যকে ফুটিয়ে তোলা যায় না। নাটক সম্পর্কে য়্যারিস্টটলের চিন্তা ছিল, যা হয় তাকে হাজির করা নয়, যা হওয়া উচিৎ তাকে দেখানো। ইতিহাসের সঙ্গে নাটকের ধারণাকে তিনি এই সুবাদেই আলাদা করেছেন। প্রকৃতিবাদীরা সেক্ষেত্রে জোর দেন যা হয় তার ওপরে, তার যে কোনো রদবদল হতে পারে সেটা দেখানোর দায় তারা বোধ করেননি। প্রকৃতিবাদী নাটক সম্পর্কে স্ট্রিণ্ডবার্গ লিখেছিলেন, মানুষ নাটক দেখতেই আসে, হুবহু জীবনচিত্র দেখতে আসে না। সুতরাং বাস্তবতার নামে এমন কোনো সীমারেখা টানা উচিৎ নয় যাতে করে দর্শকদের পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সামগ্রিকভাবে প্রকৃতিবাদী নাট্যধারা কিন্তু তার দায়িত্ব থেকে খুব একটা বিচ্যুত হয়নি। বরং এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে প্রকৃতিবাদ বা স্বভাববাদ ‘নাটক রচনা’কে নিয়ে যায় একটি রাজনৈতিক চিন্তার মঞ্চে। চিন্তার এই বিকাশশীল ধারার এক পর্যায়ে এসে নাট্য প্রযোজনাকে আর স্বভাববাদ না বলে, বাস্তববাদ বলতে আরম্ভ করা হয়।

স্বাভাবিকতাবাদ ধারা থেকেই খুব দ্রুত জন্ম নেয় বাস্তববাদী ধারা যা বস্তুনিষ্ঠতার পক্ষে কথা বলে। সত্য সেখানে আপেক্ষিক। বাস্তববাদী ধারা হলো স্বাভাবিকতাবাদেরই এক বিবর্তিত বা উন্নত রূপ। জার্মান নাট্যকার ব্রেশ্ট এ সম্পর্কে লিখেছেন, স্বাভাবিকতাবাদ বেশিদিন ধোপে টিকলো না। রাজনীতিজ্ঞদের কাছে এটা মনে হলো নিস্তরঙ্গ এবং শিল্পীদের কাছে বিরক্তিকর, তাই তা এসে দাঁড়ালো বাস্তববাদে। সমাজচিন্তা থেকে উদ্ভব স্বভাববাদী জোলার নাট্য পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল বাস্তববাদী নাট্যরীতির আসন্ন সম্ভাবনা। ইবসেনের নাট্যরচনা ও সমাজচিন্তা সেই আসন্ন সম্ভাবনাকে বাস্তবসত্যে পরিণত করলো। পরবর্তীকালে এই সমাজচিন্তা অধিকতর ঘনত্ব অর্জন করে আরও সুসংহত হয়ে উঠেছিল। জার্মানীর মহাকাব্যিক নাট্যকলার ভিত্তিমূলেও আছে এই স্বভাববাদের অবদান। ব্রেশ্ট নিজেই স্বীকার করে বলেন, মহাকাব্যিক নাট্যধারার সূত্রপাত স্বভাববাদ থেকেই। কিন্তু নাটকীয়তা বাদ দেয়া যাবে না। নাটক মাত্রেই নাটকীয়, জীবন থেকে অনেক উচ্চগ্রামে বাঁধা কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর যে-সকল নাট্যকাররা একই সাথে জনপ্রিয় ও মহৎ নাট্যকার হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাঁরা নাটকের মধ্যে নাটকীয়তা সৃষ্টি করেছেন, মুহুর্মুহু চমকপ্রদ সব ঘটনা ঘটিয়েছেন, দর্শককে নাটক ভালো লাগাবার যতো পেশাদারী বাণ আছে সব ছুঁড়েছেন, একইসঙ্গে দর্শককে নতুন চিন্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। জনপ্রিয় নাটক রচনার পাশাপাশি জনতার চিন্তাশক্তিকেও নাড়া দিয়ে গেছেন। শুধু ঘটনার বর্ণনা করেই তারা ক্ষান্ত হননি, পাশাপাশি ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। জগত সম্পর্কে, মানুষ সম্পর্কে নতুন সব ধারণার সাথে মানুষকে পরিচিত করে তুলেছেন। নাটককে জনপ্রিয় করার তাঁদের কায়দা কানুন কখনও ঘটনার বাস্তবতা ও নাটকের শিল্পমানকে ক্ষুন্ন করেনি।

ইতিহাস অনুসরণ করলে দেখা যায়, বাস্তববাদী নাটক সমাজের নীতিগত ও বুদ্ধিগত দ্বন্দ্বের সঙ্গে ক্রমশই ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। নাটক দেখা যে একটা মানসিক বিশ্রাম লাভের আনন্দ, বাস্তববাদী যুগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দর্শক সে আনন্দ পেতে চেয়েছেন তাঁদের নিজেদের দ্বন্দ্ব সমস্যার মঞ্চ প্রতিফলনের মাধ্যমে। সে সময় ইউরোপের নাট্যশালায় বাস্তববাদীরা তাঁদের নাট্যপ্রযোজনায় এমন একটি রূপ তুলে ধরলেন, যে রূপের মাধ্যমে শুধু যে মঞ্চ ও সমাজের যোগাযোগটি স্পষ্ট হয়ে উঠলো তা নয়, সমস্যার বিভিন্ন দিক জীবন্ত আলোচনাকক্ষ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অভিনয়ান্তে দর্শকদের সেই সমস্যাকে বিচার করার যোগ্যতা এনে দিয়েছিল। সেদিনের ইউরোপে বিশৃঙ্খল ও বিচ্ছিন্ন দর্শকচেতনার পক্ষে সমাজসত্যকে উপলব্ধি করা যে খুবই প্রয়োজন, যুক্তির অনুসরণ করাই যে প্রধান পথ; এই সত্য সেদিনের বাস্তববাদী নাট্যশালা গুরুত্বের সাথেই হৃদয়ঙ্গম করেছিল। বাস্তববাদী নাটক হলো শিল্পের সঙ্গে বাস্তব জগতের যোগাযোগ আর বাস্তববাদী মাধ্যম হলো বাস্তব ঘটনার কার্যকারণ সম্বন্ধে শিল্পীর সচেতন ব্যাখ্যা। ঐতিহাসিক গতিকে ব্যাখ্যা করেই শিল্পী মানুষের কাছে বাস্তব ঘটনা উপস্থাপন করেন। বিশ্লেষণ তাই বাস্তববাদী নাট্যের প্রধান লক্ষণ। বহু যুগ আগে য়্যারিস্টটল একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, শিল্প অবশ্যই বস্তুকে ব্যাখ্যা করবে, হয় তারা যেমন আছে অথবা তাদের যেমনটি হওয়া উচিৎ, যেমনভাবে চিন্তন করা উচিৎ তেমনভাবে। শিল্পের ভূমিকা এখানে দুটি; হয় জীবন যেমন তেমনি শিল্পে প্রকাশিত হওয়া অথবা জীবন যেমন হওয়া উচিৎ, তেমনিভাবে স্রষ্টার সৃষ্টিতে বিকশিত হওয়া। বাস্তববাদী শিল্পকে অবশ্যই বস্তুবাদী মাধ্যমকে বাহন করতে হবে। বিভিন্ন যুক্তিবাদী নাট্যকারদের হাতে পড়ে পরবর্তীকালের বাস্তববাদ অবশ্যই নাট্য ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব এবং যথেষ্ট নান্দনিক ও জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিশ্রুতিশীল ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। স্বভাববাদ বিভিন্ন চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে এক সময়ে এভাবেই নিজেকে বাস্তববাদে উত্তীর্ণ করে এবং স্বভাববাদের পরিবর্তে বাস্তববাদ নাট্য ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। চলবে