নাট্যচর্চায় স্বাভাবিকবাদ আর বাস্তববাদের দ্বন্দ্ব

শেষ পর্ব

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : আগস্ট ০৩, ২০২০

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নাট্যকার স্বভাববাদী ধারা থেকে সরে এসে বাস্তববাদী ধারায় নাটক লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বাস্তববাদীরা শুধু কী হয় তাই দেখাননি, কী হওয়া উচিত তাও দেখাতে চেষ্টা করেছেন। যা আছে তার বর্ণনা দেওয়া এবং একই সাথে অন্তর্লীন কারণসমূহের অনুসন্ধান করা; দুটোকেই প্রাধান্য দেওয়া হলো। যদিও উচিত-অনুচিতকে তারা দেখেছেন নিজ নিজ চিন্তার আলোকে, প্রচলিত নানা বিশ্বাস ও তার বিরুদ্ধমতের আলোকে। প্রচলিত নীতিবোধ দ্বারা তারা যেমন প্রভাবিত হয়েছিলেন, তেমনি আবার নতুন মূল্যবোধ নীতিবোধের জন্ম দিয়েছিলেন। সামাজিক দ্বন্দ্বকেই তাঁরা মূল বিষয়বস্তু হিসাবে গ্রহণ করেন। তাদের রচিত নাটকগুলো নাট্য ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক চিন্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসাবে বিরাজ করছে। গোড়া থেকেই এ নাট্যধারা যেসব সমস্যার বোঝা মাথায় নিয়ে এগুতে থাকে তা অতীতের কোনো নাট্য সাহিত্যে ছিল না। অতীতের নাটকে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য প্রচ্ছন্ন ছিল তা এসব নাটকে প্রত্যক্ষভাবে বলা হতে থাকে। তাই এ ধরনের নাটকে দ্বন্দ্ব শুধু ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে নয়; ব্যক্তির সঙ্গে, বিশেষ করে নাটকের নায়কের সঙ্গে এখানে দ্বন্দ্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের।

বাস্তবধর্মী নাটকে সমাজসত্তার সঙ্গে ব্যক্তির একটি সজাগ ও সক্রিয় সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। সমাজনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বের কোনো মহিমা বাস্তববাদী নাটকে থাকে না। সমাজের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ক্রিয়াবিক্রিয়ায় মানবচরিত্রের যে বিশেষ বিশেষ ভাব ও কর্মরূপ পরিস্ফুট, তার পরিচয়ই আধুনিক বাস্তববাদী নাটকে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিসত্তা সমাজ-পরিবেশের অধীন বলে এখনকার অনেক নাটকে কোনো বিশেষ ব্যক্তি আর অনন্য প্রাধান্য লাভ করে না, সেজন্য সেসব নাটকে এক নায়কের স্থলে বহু নায়ক দেখা যায়। ব্যক্তির পরিবর্তে ঘটনা নায়ক হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচীন গ্রীক নাটকেও প্রধান চরিত্রের সাথে রাষ্ট্রের সরাসরি একটি সম্পর্ক ছিল। প্রধান চরিত্রটি রাষ্ট্রের বাইরে ছিল না বরং প্রধান চরিত্রটি ছিল রাজা বা শাসকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের সাথে সেখানে প্রধান চরিত্রের দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু বাস্তববাদী ধারায় সে দ্বন্দ্ব সাধারণ জনগণের সাথে রাষ্ট্রের। শাসকদের চিন্তার সাথে বিভিন্ন চিন্তার বিরোধ সেখানে নিত্য নৈমিত্তিক; রাষ্ট্র সেখানে শুধু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও বটে।

বাস্তববাদী নাটক ভাবতে আরম্ভ করে যে নাট্যশালা নিছক আমোদ প্রমোদের স্থান নয়। বৃহৎ একটি দায়িত্ব তার রয়েছে। বাস্তবধর্মী নাটক হৃদয়বৃত্তি অপেক্ষা মনন এবং বুদ্ধিবৃত্তির স্তর অবলম্বন করে বলে সেখানে নানা বির্তক ও বিচার এবং বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করা হয়। সমাজ সম্বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের নানা রীতিনীতি, প্রথা ও সংস্কার সম্পর্কে বিশেষ প্রতিক্রিয়া ও মতবাদ নাটকের চরিত্রের মুখে ব্যক্ত হওয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ধারার নাট্যকারদের মধ্যে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন হেনরিক ইবসেন, গেরহার্ট হাউপ্টমান, ভিক্টর উগো, আন্তন চেখভ, জর্জ বার্নার্ড শ, ম্যাক্সিম গোর্কি, গলসওয়ার্দি প্রমুখ। যুক্তিবাদী নাট্যকার হিসাবেই এঁরা স্বীকৃত। নবধারা সৃষ্টিতে এঁদের রয়েছে ভীষণ অবদান। ভাববিলাসী বা ধ্রুপদী বাস্তববাদ নাটকে যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, তেমনি আধুনিক বাস্তববাদী নাটকে হেনরিক ইবসেন একটি যুগের স্রষ্টা। ইবসেন তাঁর নাটকের উপাদান গ্রহণ করেছিলেন সাধারণ লোকের দৈনন্দিন জীবন থেকে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, সামাজিক প্রথা ও জীবনধারার সঙ্গে ব্যক্তি সত্তার সংঘাত ও সংগ্রাম হলো তাঁর নাটকের প্রধান দিক। সমসাময়িক সামাজিক সমস্যাগুলির দিকে তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। ধ্রুপদী বাস্তববাদ বা ভাববিলাসী যুগ পর্যন্ত দেখা গেছে শ্রেষ্ঠ কবিরাই ছিলেন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, বাস্তববাদ বা স্বভাববাদের যুগে এসে দেখা গেলো নাট্যকারদের কবি হবার দরকার নেই। যেমন হেনরিক ইবসেন, জর্জ বার্নার্ড শ ও আন্তন চেখভ। স্বভাববাদ বা বাস্তববাদের যুগে নাটক হয়ে উঠলো গদ্য সাহিত্য।

ধ্রুপদী এবং ভাববিলাসী যুগে শেক্সপিয়ার একরকমের নাটক লিখেছেন কিন্তু তারপর একটা বিরাট পরিবর্তন ধরা পড়ে যখন ইবসেন, বার্নার্ড শ, চেখভ প্রমুখের যুগে এসে পড়ে, দেখা যায় নাটক মঞ্চায়নের উদ্দেশ্য পাল্টে গেছে। কিন্তু উদ্দেশ্য একটা আছেই। শেক্সপিয়ার যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক লিখতেন; ইবসেন, বার্নার্ড শ-র সময় সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক লেখা হতে থাকলো। নাট্য রচনার মূল যে উদ্দেশ্য সেটা তখন পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে নাট্য রচনার ভঙ্গি। কিন্তু কেউই উদ্দেশ্যহীন নয়। শেক্সপিয়ার ভাববিলাসী ধারার নাট্যকার ছিলেন এবং তাঁর সময়কার মানুষ এবং সমাজ নিয়েই লিখেছেন। ঠিক একইভাবে ইবসেন, বার্নার্ড শ লিখেছেন তাদের সময়কার সমাজ নিয়ে। কিন্তু সমাজটা এতো পাল্টে গেছে যে নাটকের বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক দুটোই পাল্টাতে হয়েছে নতুন সময়কে ধরার জন্য। দর্শকের কাছে নাটকের বিষয়বস্তু পৌঁছে দেয়ার জন্য। যখন সারা পৃথিবীতে পুঁজিপতিরা বা বুর্জোয়ারা পুরোপুরি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন তাদের প্রয়োজনে নতুন নাটক লেখা হলো এবং সন্দেহ নেই বুর্জোয়াদের সমালোচনা করেও নাটক রচিত হলো। বুর্জোয়া বাস্তববাদ আর ধ্রুপদী বাস্তববাদ বা ভাববিলাসী শেক্সপিয়ারের যুগ সম্পূর্ণ ভিন্ন। শেক্সপিয়ারের যুগে নাটক মঞ্চায়ন হতো খোলা ময়দানে, বহু দর্শক একসঙ্গে নাটক দেখতো। সেজন্য বাস্তবতাকে চড়া রঙ দিতে হয়েছে, শেক্সপিয়ারের নাটকে তাই দেখা যায় প্রচুর খুন-জখম, যুদ্ধ, বারবার তলোয়ার খেলা। সময়ের প্রয়োজনেই, দর্শকের চাহিদার কথা ভেবেই ঘন ঘন নাটকীয়তা তৈরি করতে হয়েছে শেক্সপিয়ারকে; এটাই হলো ধ্রুপদী বাস্তবতা।

বুর্জোয়া বাস্তবতার শুরুটা ছিল এর পূর্বেকার ধ্রুপদী বাস্তবতার ঠিক উল্টো ধারা না হলেও, একেবারে অন্য ধরনের নাটক। সেখানে চাই বিশ্বাসযোগ্য বা দৈনন্দিন বাস্তবতা। নাটক মঞ্চস্থ হতো শুধু চার দেয়ালের ভিতর মিলনায়তনে। গরীব মানুষদের সে নাট্যশালায় যাবার সুযোগ নেই। কেননা সেখানে প্রবেশপত্রের মূল্য এতবেশি যে প্রথমেই ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণী নাট্যশালায় যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হলো। সুতরাং বুর্জোয়া নাট্যশালার দর্শক বুর্জোয়াশ্রেণী, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকরা। ধূমপান বারণ করা হলো মিলনায়তনে, শেক্সপিয়ারের যুগে যা চিন্তাই করা যেতো না। শেক্সপিয়ারের নাট্যশালায় ধূমপান কেন সেখানে মদ্যপানও করতো দর্শকরা। শেক্সপিয়ারের নাট্যশালায় কেউ কোনোদিন মঞ্চসজ্জার কথা ভাবেনি। দর্শকদের কল্পনায় বুঝে নিতে হয়েছে ঘটনার স্থান, কাল সবকিছু। কিন্তু বুর্জোয়া নাট্যশালায় মঞ্চসজ্জা একটা বিরাট ব্যাপার। ধ্রুপদী বাস্তবতার যুগে বা শেক্সপিয়ারের সময়ে একটা খালি ফাঁকা মঞ্চ, সেখানে একা অভিনেতা চিৎকার করছে। চরিত্ররা যখন ক্রোধের নানা দিক দেখাতে থাকে; তার সবটাই অভিনয়ের মাধ্যমে, সবটাই সংলাপের মাধ্যমে। নানা ধরনের অভিব্যক্তির ভিতর দিয়ে অভিনেতা নাটকের বক্তব্যকে বের করে আনতেন। নানা ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশই ছিল অভিনয়ের মূল দিক। শেক্সপিয়ারের নাট্যশালায় দর্শক আসতো বাস্তবে যা ঘটে তার চেয়েও বেশি কিছু পাবার কথা ভেবে, চমক লাভের আশায় কিন্তু ইবসেনের নাট্যশালায় দর্শক আশা করতো বাস্তবের হুবহু কিছু। সমকালীন সঙ্কট নিয়ে তাই নাটক লিখলেন ইবসেন। কিন্তু যুক্তি-তর্কের বেড়াজালে সে নাটকের গতি এমনভাবে তৈরি হলো যে, দর্শক মুগ্ধ হয়ে বসে থাকতো। নাটক দেখার সে এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা।

ইবসেনের নাটকে এমন সমস্ত সমস্যা আনা হয় যেগুলি তার আগে মঞ্চে দেখানো প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। ইবসেন নির্ভীকভাবে সেইসব সমস্যার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নাটক লিখলেন। ইবসেনের সমাজসংস্কারের ধারণা ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তিনি যে বিপ্লবের কথা বলেন তা মানবতার বিপ্লব। সমাজের উন্নতি করতে গেলে, তিনি বিশ্বাস করতেন প্রথমে মানুষের নিজেকে উন্নত করতে হবে। ইবসেন তাঁর নাটকে এমন সমস্ত সামাজিক সমস্যা নিয়ে এলেন যেগুলি নাটকের উপজীব্য হতে পারে বলে আগে কেউ চিন্তাই করেননি। চপলতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আভিযান চালানোর জন্য তিনিও সমস্তরকম কৃত্রিমতার পথ পরিহার করলেন। ইবসেনের আর্বিভাবের ফলে ফরাসী চটুল নাটকের প্রভাব ইউরোপ থেকে তিরোহিত হলো। তিনি তাঁর যুগের জন্য বৈপ্লবিক চিন্তা নিয়ে এসেছিলেন। সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। তিনি মানব সমাজের দোষ ও দুর্নীতিগুলি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করলেন, ভ্রান্ত ধারণা ও আদর্শসমূহকে কঠোর আঘাতে বিচলিত করলেন, ভণ্ডামি ও সর্বপ্রকার সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলেন। বলা হয়ে থাকে, জীববিজ্ঞানে ডারউইনের মতবাদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউটনের তত্ত্ব যে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল তেমনি এক বিপ্লব এনে দেয় ইবসেনের নাটক ইউরোপের নাট্য-জগতে। ইবসেন নাটকে বিপ্লব আনতে পেরেছিলেন তার কারণ তাঁর নাটকগুলি ছিল উদ্দেশ্যপ্রধান এবং বক্তব্যমূলক। কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, শুধুমাত্র উদ্দেশ্য থাকলেই নাটক জনপ্রিয় হবে; নাটককে সর্বাগ্রে নাটক হয়ে উঠতে হবে। সমাজসত্য প্রচারের দায় নাটকের রয়েছে ঠিকই কিন্তু নাটককে সাহিত্য হয়ে উঠতে হবে, শিল্পমান রক্ষা করতে হবে। সমাজসত্য প্রচার না করে কোনো নাটকই বিশ্বসাহিত্যে চিরায়ত হতে পারেনি।

নাট্যকার ইবসেন ও নাট্যকার বিয়র্নসন দুজনেই ছিলেন নরওয়েবাসী এবং তাঁরা দুজনেই বাস্তববাদী নাট্য রচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় দুজনেই ছিলেন বিদ্রোহী। বিয়র্নসন রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন এবং ইবসেন কিছুকালের জন্য সমাজতন্ত্রী ছিলেন। দুজনেই তৎকালীন সামাজিক ও নৈতিক পাপের উপর আক্রমণ চালিয়ে গেছেন। দুজনের মধ্যে পার্থক্যও লক্ষণীয়। সকল ক্ষেত্রে নানা সুচিন্তিত বাস্তব সমস্যা তুলে ধরলেও বিয়র্নসন নাটকের সমাপ্তি সুখময় করতেন যা ইবসেনের মধ্যে ছিল না। তিনি নির্মম সত্য উদ্ঘাটিত করেছেন এবং চরম পরিণতি দেখিয়েছেন। ইবসেনের নাটক আধুনিক এবং বাস্তববাদী, তবে তা বাস্তবের হুবহু চিত্রাঙ্কনের জন্য নয়। পরিবেশের বাইরেও আছে সমাজ সত্য, আছে জীবন সত্য, আছে মানস গঠন এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের অমোঘ স্বীকৃতি; যা ইবসেনের নাটকে খুঁজে পাওয়া যায়। আধুনিক নাটকের এক যুগান্তর হলো ইবসেন থেকেই যার মূল তাৎপর্য সমাজকে এবং ব্যক্তিসত্তাকে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ও যুক্তি দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা। সমাজের সাথে ব্যক্তির বিরোধ তৈরি করে এভাবেই তিনি নাটককে রাজনৈতিক করে তুললেন। ইবসেনের চিন্তাধারা ও সিদ্ধান্তের সাথে আজকের দিনে সবাই একমত নাও হতে পারেন, তবে তাঁর যুগে তিনি বৈপ্লবিক চিন্তাধারা নিয়ে এসেছিলেন একথা সর্বজনসম্মত। সব চেয়ে বড়ো কথা, তিনি সেদিন যা সত্য বলে উপলদ্ধি করেছিলেন, নির্যাতন বা তিরস্কার কিংবা উপেক্ষার ভয়ে তা প্রকাশ করতে তিনি কখনো কুণ্ঠিত হননি। তিনি কেবল নতুন রূপরীতি ও আঙ্গিকই আনলেন না, তাঁর নাটকে দিলেন মানুষকে চিন্তারও খোরাক। নাটক লেখার জন্য ইউরোপের অভিজাত সম্প্রদায় ও তথাকথিত ভদ্রলোকেরা ইবসেনের মুণ্ডুপাত করে ছেড়েছিলেন, কারণ শূন্যগর্ভ আভিজাত্যের আঁতে ঘা দিয়েছিলেন ইবসেন।

রাষ্ট্র সম্পর্কে ইবসেন কী মত প্রকাশ করতেন তা জানা যায় তাঁর এক চিঠি থেকে। ইবসেন জর্জ ব্রাণ্ডকে লিখছেন, ‘রাষ্ট্র বস্তুটির বিলোপ দরকার, এক ধরনের সরকারের জায়গায় আরেক ধরনের সরকার হলো একই জিনিসের এপিঠ ওপিঠ; অপেক্ষাকৃত কম বা বেশি। এর সবটাই মূর্খতা।’ সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে ইবসেনের প্রতিক্রিয়া কী ছিল জানা যায় তাঁর একটি বক্তব্যে। তিনি লিখছেন, ‘আমি একথা বলি না যে সমাজতন্ত্রের বিষয়টি আমি কখনো চিন্তা করিনি। ঘটনা হলো এই বিষয়টিতে আমি খুবই উৎসাহী এবং আমার সাধ্যমত তার ভিন্ন ভিন্ন দিক সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করেছি, আমি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছি সামাজিক গণতান্ত্রিক নীতিবাদী দার্শনিকরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে যে সিদ্ধান্তে এসেছেন আমি সচেতনভাবে না হলেও ঐ বিষয়ে কিছু কিছু ব্যাপারে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।...তবুও একান্তে স্বাধীনভাবে নিজের পথ ধরে চলাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’ ইবসেনের রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক তিনি ছিলেন তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। বহুকাল পর্যন্ত ইউরোপের মঞ্চে এবং নতুনদের নাট্য রচনার ধারায় তাঁর প্রভাব বিস্তৃত ছিল। ইবসেন ইউরোপে তাঁর যুগের প্রধান নাট্যকার ছিলেন। তিনি কোনো উদ্দেশ্যহীন নাটক রচনা করেননি কিংবা তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতি থেকে পালিয়ে বেড়াননি। তিনি সক্রিয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিলেন না বটে কিন্তু নাটকে তিনি রাজনীতি প্রচার করে গেছেন, সমাজের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলেছেন। সমাজের মাথাওয়ালাদের দুর্নীতিকে আক্রমণ করেছেন, পাশাপাশি জনতার কুসংস্কার কীভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় তা স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। ‘জনতার শত্রু’ ও ‘সমাজের গণ্যমান্য’ নাটক দুটি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ; বিত্তশালীদের নানা দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সরাসরি এই নাটক দুটিতে তিনি তুলে ধরেছেন। ইবসেন ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা প্রচার চালিয়েও নাটকগুলিকে শিল্পসম্মতরূপে রচনা করে গেছেন। সারাবিশ্বে তাঁর নাটকগুলি রচনার একশো বছরের অধিককাল পরেও তাই বিপুল সমারোহে মঞ্চস্থ হয়ে চলেছে।

ইবসেনের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে বিংশ শতকের অক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত দুজন নাট্যকার রুশ নাট্য প্রযোজনার রূপান্তর ঘটায়। দুজনের মধ্যে একজন আন্তন চেখভ, অন্যজন ম্যাক্সিম গোর্কি। দুজনেই তাঁদের সমকালীন রুশ জীবনের দিকে লক্ষ্য রেখে নাটক রচনা করেছেন। দুজনেই ছিলেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী। রুশ নাট্যকার আন্তন চেখভের নাটকে তীব্র সংঘাত, উচ্চকণ্ঠ উত্তেজনা বা ভয়ংকর মৃত্যু নেই। চেখভ নাটকে চরিত্রের আত্মিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। চেখভের নাটকে রুশীয় সমাজের এক ক্রান্তিলগ্ন ধরা পড়েছে, সামন্ততন্ত্রের বিলয় এবং বুর্জোয়াতন্ত্রের উত্থান। চেখভ যেমন তার সময়ের হতাশা, বিষন্নতা তুলে ধরেছেন তেমনি তিনি ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথাও বলে গেছেন। শ্রমিক, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ সম্পর্কে চেখভের অপরিসীম দরদ ছিল। নির্যাতিত নিপীড়িত, শোষিত বঞ্চিত মানুষের পক্ষে তিনি তাঁর নাটকে জোরালো বক্তব্য রেখেছেন। বুর্জোয়া মতাদর্শ ও প্রথার প্রতি ছিল তাঁর তীব্র ঘৃণা, ‘চেরী বাগান’ নাটকে তা ধরা পড়ে। নতুন বণিকশ্রেণীর প্রতিনিধি সেখানে লোপাখিন, যাদের স্বভাব পেশল, আগ্রাসী ও স্থূল। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এভাবেই তাঁর ঘৃণা প্রকাশিত। তিনি বুঝেছিলেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ‘জীবনের ভিত্তি হলো দাসত্ব’। চেখভের নাটকে দেখা যায় বুর্জোয়া জগতের প্রতি তাঁর কঠোর বিচারকের চেহারা। তিনি চরম ভোগবাদী এবং বিলাসী বুর্জোয়াদের মনে করতেন, ‘মানবতার নিকৃষ্টতম অংশ’। তিনি ছিলেন বুর্জোয়াদের সাথে সকলরকম আপোষ রফার বিরোধী। কিন্তু তার পরিবর্তে কী হওয়া উচিত বা ভবিষ্যতে কী ঘটবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার অভাব ছিল বলেই সে সম্পর্কে কোনো ভবিষ্যৎ বাণী নেই তাঁর নাটকে। তিনি মনে করতেন সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় মানুষকে সংগ্রাম করে যেতে হবে। সেজন্যই বুর্জোয়া সমাজের যে অসঙ্গতি ও অসারতা এবং সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্যের শূন্যগর্ভ অহংকার তা তিনি নিপুণভাবে চিত্রিত করেছেন। সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে তিনি ভেবেছেন। ‘তিন বোন’ নাটকে সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টি আছে পরোক্ষে। তিন বোন এখানে সামন্ত সমাজের সুবিধাভোগীশ্রেণীর প্রতিভূ এবং তারা তাদের সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হচ্ছে নবীন ব্যবসায়ীশ্রেণীর দ্বারা।

সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের উত্থান দেখেছিলেন চেখভ। সামন্তরা যেমন তাঁর পছন্দনীয় ছিল না, তেমনি বুর্জোয়ারাও তাঁর কাছে কাম্য ছিল না। তবে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী যে লড়াই করতে আসছে সেটা তিনি ধরতে পারেননি, যা পেরেছিলেন গোর্কি। যদিও শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক ভূমিকা চেখভের উপলব্ধিতে ছিল না বা তাঁর যুগের ক্রমবর্ধমান বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি কোনোভাবেই সংযোগ রাখেননি, তথাপি বিজ্ঞানের সাফল্যসমূহ ও সভ্যতার অগ্রগতির প্রতি তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল বলেই শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও সপ্রশংস। বিজ্ঞান ও প্রগতির বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে চেখভ অত্যন্ত বিরক্ত হতেন। সামাজিক চেতনা ও অনুভূতি ছিল তাঁর অত্যন্ত তীব্র। তাঁর কালের সভ্যতার অবদানগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও বুর্জোয়া ব্যবস্থার সঙ্গে কোনো আপস করার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। শিল্পীর স্বাধীনতা সম্পর্কে চেখভের ধারণায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন না যে, জীবনদৃষ্টি থেকে বিচ্যুত হয়ে কোনো শিল্পী প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন হতে পারে। সে ধরনের সব স্বাধীনতাকে তিনি মনে করতেন নিকৃষ্টতম পরাধীনতা। চেখভ স্পষ্ট করে বলেছিলেন, যদি আমি চিকিৎসক হতাম আমার দরকার হতো একটি চিকিৎসা কেন্দ্র ও রোগী, যখন আমি লেখক তখন আমার দরকার জনগণের মাঝেই থাকা। নিজের নাটকের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি তাঁর ভাই আলেকজান্ডার টিখোনভকে উনিশশো দুই সালে এক পত্রে লিখেছিলেন, ‘মানুষকে আমি সততার সঙ্গ বলতে চেয়েছি নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো, কী নিকৃষ্ট; বিষন্ন নিরানন্দ তোমাদের জীবন। মানুষের নিজের সম্পর্কে এই উপলব্ধি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাহলেই তারা নিজেদের সুন্দর জীবন সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হবে।’ তিনি মনে করতেন যে-কোনো নাটকের অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকবে যা দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তো থাকবেই কিন্তু নাটক রচনার ভঙ্গি হিসেবে তাঁর কাছে নাট্যক্রিয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলতেন, নাটকের কাঠামো সুসংবদ্ধ হতে হবে এবং তা যতো সুসংবদ্ধ হবে ততোটা উজ্জ্বল অভিব্যক্তিসম্পন্ন হবে। তিনি আরো মনে করতেন, নাটককে হতে হবে পুরোদস্তুর মানবিক।

সর্বদাই চেখভ একজন অনুসন্ধানীর দৃষ্টিতে তাঁর চারপাশের জগতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর রচনা দর্শকদের এক গভীরতর জটিল অভিজ্ঞতার সন্ধান দেয় যার অংশত আবেগময়, অংশত বুদ্ধিগ্রাহ্য। তিনি হাসির যে-সব নাটক লিখেছিলেন সেগুলি নিছক বিনোদন ছিল না। আঠারশো চুরাশি সালের বিশে মে নিকোলাই লেইকিনকে লেখা চিঠিতে তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি রোগীকে প্রথম হাসাবো এবং সে হাসতে আরম্ভ করলে তারপর চিকিৎসা শুরু করবো।’ বহু বছর পর ব্রেশ্টের নাটকে এবং চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। নিজের রচিত নাটকে চেখভ কোনো পক্ষ নেন না কিংবা বিচারকের আসনে বসে রায় দেন না, তিনি শান্ত বিনয়ী একজন পর্যবেক্ষক; মানুষের মনের দরজায় উঁকি দেন মাত্র। তিনি বাস্তবতার পক্ষে কিন্তু প্রকৃতিবাদীদের হুবহু জীবনকে মঞ্চে তুলে আনার মতো কট্টোর নন, তাঁর মূল্য লক্ষ্যটা ছিল শিল্পসম্মত সত্যকে বা বাস্তবকে নাটকে প্রকাশ করা। চেখভের বিখ্যাত নাটক ‘চাচা ভানিয়া’। নাটকের বিষয়বস্তু ক্ষুদ্র, যেখানে ব্যক্ত হয়েছে ছোটো মাপের মানুষদের জীবন ও তার যন্ত্রণা-বেদনার কথা। নিঃস্বার্থভাবে এই ছোটো মাপের মানুষটি অন্যের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কর্তব্য পালন করে। ভানিয়ার বয়স সাতচল্লিশ এবং কপর্দকহীন। বিশ্রাম বা বিনোদন কী জিনিস তা সে জানে না। জীবনের শ্রেষ্ঠ বছরগুলি যখন পার হয়ে গেছে তখন তার চোখে এক ভয়াবহ সত্য ভেসে ওঠে। সে উপলব্ধি করে তার যৌবন তার তাবৎ ব্যক্তিসত্ত্বা সে উৎসর্গ করেছিল এক অপদার্থ মানুষের জন্য। দুঃখজনকভাবে তার চোখে যে মানুষটি দেবতা ছিলেন তিনি আসলে এক অন্তঃসারশূন্য, নগণ্য, স্বার্থপর জীব; আকণ্ঠ ভানভণিতায় পূর্ণ অহংসর্বস্ব এক শিক্ষিত সুবিধাভোগী অধ্যাপক। চেখভ এভাবেই শিক্ষিত ভদ্রসমাজের মুখোস উন্মোচন করেন এবং মানুষের ব্যক্তিপূজার ধারণাকে আঘাত করেন। চেখভের নাট্য রচনা তাই উদ্দেশ্যহীন নয়, সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়।

চাচা ভানিয়া যে মানুষটিকে সেবা করে গেছে তিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে, সেই অধ্যাপক শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছেন কিন্তু শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ জানেন না। তিনি শুধু অন্যের চিন্তার চর্বিতচর্বণ করে গেছেন আর পঁচিশ বছর যাবৎ ভানিয়া এই অপদার্থ লোকটাকেই সাহায্য করার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছে। ভানিয়া ছিলেন স্বপ্নালু এবং আদর্শবাদী যুবক কিন্তু তার পরিশ্রমের ফলে বেড়ে ওঠা অধ্যাপক সেরেব্রিয়াকভ ছিল এক কদাকার অকেজো ঘৃণ্য এক মানুষ। ভানিয়া তাই শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করে এবং নাট্যকার দেখান যে এই ধরনের ‘তথাকথিত’ মহান ব্যক্তিদের জন্য জীবন উৎসর্গ করা চরম অর্থহীনতার প্রকাশ। চেখভের নাটককে তাই রাজনীতির বাইরে রাখা যায় না, কারণ সুবিধাভোগী সমাজের অপকর্মকে তা ধিক্কার জানায়; দর্শককে সেই সমাজের প্রতি সচেতন করে তোলে। চাচা ভানিয়া নাটকে চিকিৎসক আস্ত্রভের সংলাপটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যখন সে ভানিয়াকে বলে, ‘বন্ধুবর এ জেলায় দুটি সুভদ্র নম্র বুদ্ধিজীবী ছিলো; আমি এবং আপনি। কিন্তু মাত্র দশ বছরের মধ্যে এক ঘৃণ্য, অর্থগৃধ্নু, উদাসীন জীবন আমাদের গিলে খেয়েছে; এজীবন তার দুর্গন্ধপূর্ণ ধোঁয়ায় আমাদের রক্তও বিষাক্ত করে তুলেছে এবং আমরাও আর পাঁচজনের মতো নোংরা কুৎসিত, ঘৃণ্য জীবে পরিণত।’ এই সংলাপের মধ্য দিয়ে নাট্যকার পুরো সমাজের মূল ধরে টান দেন যা বর্তমানকালের সমাজেও একইভাবে সত্য বলে পরিগণিত হয়।
পুঁজিবাদী সমাজে টাকা ও সম্পদ বানাবার লোভ কী করে অন্যদের আদর্শকে গিলে খায় এই সত্য বারবার চেখভসহ বহুজনের নাটকে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু চেখভের মতো বহুজনই এই সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভের উপায়টির কথা বলে যেতে পারেননি। সন্দেহ নেই, চেখভ মুক্তির স্বপ্ন দেখে গেছেন তিন বোন নাটকে। তিনি যেন অদূর ভবিষ্যতে বিপ্লবের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন। তিন বোন নাটকের একটি চরিত্র তাই ভবিষ্যৎ বলার মতো উক্তি করে, ‘সময় আগত, আমাদের জীবনে একটি মহৎ কিছু অচিরেই ঘটতে চলেছে; এক তীব্র ঝড় ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে এবং অচিরেই কাজ সম্বন্ধে সব জড়তা, কুসংস্কার দ্বিধা ক্লান্তিকর একঘেয়েমি আমাদের সমাজ থেকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।’ চেখভের নাটকে এভাবেই বিশাল শুভশক্তির উপস্থিতি অনুভূত হয় এবং পাশাপাশি সমাজের নিষ্ক্রিয় ও স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে তার সমালোচনা জাগ্রত থাকে। সত্যকার অর্থে নাটকে এই ধারা প্রথম বহন করে আনেন ইবসেন।

ইবসেন নাটকে এমন ধারা নিয়ে এলেন যার প্রভাব পড়লো সারা ইউরোপে। নানা দেশে তাঁর অনুসারীরা তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলো। চেখভ, বার্নার্ড শ, গলসওয়ার্দি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বার্নার্ড শ ইবসেনের স্বঘোষিত অনুসারী, শিষ্য। ইবসেন কিছুদিন রাজনীতিতে আগ্রহ দেখালেও পরে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে অস্বীকার করেন, বার্নার্ড শ সেখানে ছিলেন ফেবিয়ান সমাজবাদী ও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। সত্যিকার অর্থে ফেবিয়ান সমাজবাদী ভাবধারার মূল উৎস ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী। মার্কসবাদী সমাজতন্ত্রকে তাঁরা ইংল্যান্ডের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থায় নতুনভাবে রূপদানের চেষ্টা করেন। মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পুঁজিপতিশ্রেণীর ধ্বংসের অনিবার্যতার কথা প্রচার করেছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের তৎকালীন অবস্থায় এই পুঁজিপতিশ্রেণীর বিলুপ্তির কোনো লক্ষণই প্রকাশ পাচ্ছিলো না। বরং দেখা গেল যে নতুন বণিকশ্রেণী ও পুঁজিবাদের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে একদিকে শিল্পকৃষ্টির অভূতপূর্ব প্রসার ঘটতে থাকে এবং অপরদিকে শ্রমিকদের জন্য বহু প্রকার উন্নয়নমূলক আইন কানুন প্রবর্তিত হতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ইংল্যান্ডের শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবাত্মক পন্থার পরিবর্তে আইনগত পদ্ধতিতে দাবি দাওয়া আদায়ের প্রতি আস্থাশীল হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের বুদ্ধিজীবী মহলেও আইনানুগ পদ্ধতিতে দাবি আদায়ের নীতি সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। কল-কারখানার শ্রমিকশ্রেণী তাদের অধিকার অর্জনের পন্থা হিসাবে ধর্মঘট আহ্বানের অধিকার লাভ করে। ফেবিয়ানরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ এড়িয়ে সংস্কারের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ফেবিয়ান শব্দটির মানে বা উৎপত্তি কোথা থেকে এই প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। মধ্যযুগের রোমান সেনাপতি কুইনটাস ফেবিয়াস ম্যাকসিমাস-এর নামানুসারে ফেবিয়ান সমাজবাদ কথাটি চালু হয়। কুইন্টাস ফেবিয়াস দুর্ধর্ষ হ্যানিবলের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে বিলম্বন পন্থা অবলম্বন করতেন। কখনো বা পিছু হটে গিয়ে অপেক্ষা করতেন এবং শত্রুর অসর্তকতার সুযোগে তাদের উপর শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সহসা আক্রমণ চালাতেন।

মার্কসবাদী সমালোচকদের মতে অবশ্য ফেবিয়ান সমাজতন্ত্র আদৌ মার্কসবাদী নয়। কারণ মার্কসবাদের অনেক নীতিই ফেবিয়ানিজমে অনুপস্থিত। প্রথমত বৈপ্লবিক পন্থায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা তাঁরা স্বীকার করেননি। তাঁদের বিশ্বাস ছিল সমাজতন্ত্র আসবে বিবর্তন ধারায় বা পর্যায়ক্রমিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে। তাঁদের মতে সংসদীয় আইন বা রাষ্ট্রিয় নিয়মকানুন প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়। বার্নার্ড শ সম্পর্কে লেনিন লিখেছিলেন, ‘শ একজন ভালো মানুষ যিনি ফেবিয়ানদের দলে পড়ে অধঃপতিত। অবশ্য তিনি তাঁর দলের তুলনায় অনেক বেশি বামপন্থী’। ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ নাট্যকার তীব্র ব্যঙ্গ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুঁজিবাদী সভ্যতার তথাকথিত ভদ্র ও সংস্কৃতিবান উঁচুতলার ব্যক্তিবৃন্দ কীভাবে শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত তার অনতিগোচর প্রক্রিয়াসমূহ উন্মোচন করে দেখান। বার্নার্ড শর নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, তা মানুষের মস্তিষ্ককে নাড়া দেয়, মনকে ভাবিয়ে তোলে। তাঁর যুক্তি অনেক সময় মানুষের পূর্ব প্রত্যয়কে ভেঙে দেয়। দেখা জিনিসকে নতুন করে দেখতে হয়। জানা জিনিসকে নতুন করে জানতে হয়। যুক্তির সোপান রচনা করে শ সব জিনিসকে এমনভাবে দেখিয়ে দেন যে, আগের দেখাটা দৃষ্টিভ্রম বলে মনে হয়। মঞ্চে যুক্তির লড়াই দ্বন্দ্বযুদ্ধের মতোই উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে তাঁর নাটক সেটাই প্রমাণ করে। মানুষের সযত্নে লালিত বিশ্বাসকে আক্রমণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, নিজের চিন্তাকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সমরনায়কদের বীরত্বে তিনি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন, ইংরেজ জাতির ঠুনকো সম্ভ্রমবোধকে তিনি বিদ্রুপ করেছেন, প্রণয়ের শ্রেষ্ঠ পরিণতি বিবাহ একথা তিনি অস্বীকার করেছেন। কোনো ভাবালুতাকেই তিনি আমল দেননি।

জর্জ বার্নার্ড শ নাটককে দার্শনিক বিতর্কের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছেন এবং এ সমস্ত বির্তক নাটকে ঘটনার স্থান দখল করেছে। তাঁর নাটকে চরিত্ররা সত্যাসত্য, ভালোমন্দ, নারী-পুরুষের ভালবাসা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, ব্যক্তি ও সমাজ, মানুষ ও ভগবান, অর্থনৈতিক শোষণ ও স্বাধীনতা, উদারনীতি ও সমাজতন্ত্র প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ তর্কে লিপ্ত হয়, যার এক একটা বক্তৃতা কখনো কখনো ছাপানো এক পৃষ্ঠার চেয়ে লম্বা। শ-র নাটকের বিভিন্ন চরিত্ররা সমাজের প্রচলিত ধারণা, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবোধ বা সংস্কার নিয়ে হাসিঠাট্টা করে এবং মানুষের বাস্তবজীবনের সঙ্গে ঐ সব ধ্যানধারণার বিরোধ বা ব্যবধানের দিকেও আমাদের দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে। গণ্ডীবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থাই বার্নার্ড শর আক্রমণের লক্ষ্য। নাট্য রচনায় রাজনীতি কিংবা সমাজসত্য প্রচারের প্রবণতা থাকলে বড় নাট্যকার হওয়া যায় না, ইবসেন ও চেখভের মতো বার্নার্ড শ তা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সমাজের আসল ভিত্তি অর্থনীতি। তিনিই একমাত্র ইংরেজ নাট্যকার যিনি প্রথম থেকেই বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর বলিষ্ঠ মতামত ব্যক্ত করেন। শ-র স্পষ্ট বক্তব্য ছিলো মুষ্টিমেয় ব্যক্তি যারা জাতির পরগাছা এবং অতিশয় মূর্খ তারাই হচ্ছে ধনী এবং শাসক। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাই জোর করেই বুদ্ধি ও মানবতার প্রতিষ্ঠা ঘটাতে হবে। বার্নার্ড শ বাস্তবধর্মী নাটককে সম্পূর্ণ বুদ্ধিধর্মী করে তুললেন। শ-র নাটকের দিকে তাকালে দেখা যাবে, শ্রেণীসংগ্রামের কোনো চেহারা তাঁর রচনায় নেই কিন্তু পুঁজিপতিরা কলঙ্কিত চরিত্র হিসাবেই আবির্ভূত। শ-র নাটকে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালানো হলেও শ্রমিকদের নৈতিক চরিত্রের ওপরও গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।

বাস্তববাদী ধারার বৃটেনের একজন সফল নাট্যকার জন গল্সওয়ার্দি। বার্নার্ড শয়ের পর গল্সওয়ার্দিও সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর নাটকগুলি রচনা করলেন। বৃটিশ নাট্যশালায় কী বিষয়বস্তু, কী জীবনদৃষ্টিতে তিনি একটা নতুন ধারা এনে দেন। গল্সওয়ার্দির নাটকে নাটকীয় আবেগের প্রতিও দৃষ্টি দেয়া হলো। বাস্তব জগতে যে কতো নিষ্ঠুরতা, কদর্যতা, অবিচার ও নৈরাশ্য রয়েছে তিনি তা দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো সমাজবিজ্ঞানসম্মত। মানুষের নির্বুদ্ধিতা বা ছলনা দেখে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমতো তাঁর মনে তবে তিনি বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলতেন না, আবেগকে তিনি যুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতেন। সমাজ সংস্কারের চিন্তা থাকলেও নাট্যকারের স্বধর্ম থেকে তিনি বিচ্যুত হতেন না। তিনি ছিলেন একই সাথে নাট্যকার ও সমাজ সংস্কারক। সমাজের গলদগুলি তিনি দেখিয়েছেন, কোনো সিদ্ধান্ত টানতে তিনি চেষ্টা করেননি। তিনি কোনো পক্ষপাতিত্ব না করে নাটকে সমাজ সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। বার্নার্ড শ-র সমসাময়িক নাট্যকার হয়েও তিনি ছিলেন শ-র চেয়েও অনেক বেশি মঞ্চসফল। জন গল্সওয়ার্দি তাঁর ‘সিলভার বক্স’ বা রূপার কৌটা নাটকে দেখিয়েছেন আইন সর্বদাই গরীবদের প্রতি বেশি নিষ্ঠুর। একজন গরীব গৃহপরিচারিকা অন্যায়ভাবে চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয় এবং তাকে পেতে হয় কঠোর সাজা অথচ তার চেয়ে কতো বড় বড় অপরাধ করেও একজন বিক্তশালী পেয়ে যান অব্যাহতি। বিত্তশালীদের বেলায় আইন অনেক বেশি উদার।

জন গল্সওয়ার্দির নাটকের চরিত্ররা সংগ্রাম করে সমকালীন সামাজিক ও আইনগত বৈষম্যগুলির বিরুদ্ধে। রাষ্ট্র বা সমাজকাঠামোর অসঙ্গতি তুলে ধরাই ছিল গল্সওয়ার্দির নাটকের উদ্দেশ্য। তাঁর সমসাময়িক কালের টিন-প্লেট কারখানার একটি ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন ‘স্ট্রাইক’ বা ধর্মঘট নাটকটি। গল্সওয়ার্দির এই নাটকেই প্রথম ইংরেজ শ্রমিকদের জীবন স্থান পায় এবং নাটকীয় সংঘাত বাধে শ্রমিক-মালিক বিরোধকে কেন্দ্র করে। দুই বিরুদ্ধ শক্তির মধ্যকার সংঘাতে নাটকটি জমে ওঠে। পারিপার্শ্বিক বিচারে গল্সওয়ার্দিকে শ্রমিকশ্রেণীর বিপরীত শ্রেণীভুক্তই করা চলে; কিন্তু মানসিকতার দিক থেকে সেই স্বকীয় শ্রেণীচরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি দরদী মন নিয়ে শ্রমিকচরিত্র অঙ্কনে সফল হয়েছেন। মালিক পক্ষের একগুঁয়েমিও তিনি সমানভাবেই দেখিয়েছেন। ভ্রান্ত জেদের বশবর্তী হয়ে মানুষ কীভাবে নিজের অশান্তি ও অমঙ্গলকে ডেকে আনতে পারে মূলত তাই দেখানো হয়েছে নাটকে। সেখানে আরো বলা হয়েছে শক্তিমান ব্যক্তি দম্ভবশতঃ কেবল অন্যের দুঃখের কারণ হয় না, নিজের জন্য দুঃখজনক পরিণতিও ডেকে আনে।

ধর্মঘট নাটকটি শ্রমিক-মালিক বিরোধকে ঘিরে রচিত হলেও এটিকে ঠিক বিপ্লবী বা শ্রেণীসংগ্রামের নাটক বলা যায় না। মতাদর্শের দিক থেকে গল্সওয়ার্দি পুঁজিবাদের উচ্ছেদকামী কোনো বিপ্লবী ছিলেন না, তিনি চেয়েছিলেন তার খানিকটা সংশোধন। পুঁজিবাদী সমাজের ধনিকদের প্রতি তাঁর তীব্র সমালোচনা প্রকাশ পেয়েছিল বিভিন্ন নাটকগুলিতে। তাঁর ‘জাস্টিস’ বা ন্যায়বিচার নাটকে দেখা যায় প্রেমিকের জন্য একটি ব্যাংকের চেক কারচুপি করতে গিয়ে এক সামান্য কেরানির জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি। দরিদ্র কেরানির পক্ষে চেকটি কারচুপি করা ছাড়া সেই অর্থ সংগ্রহ করার আর কোনো উপায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত কারচুপি ধরা পড়ে এবং কেরানির সাত বছর কারাদণ্ড হয়। নাটকের একাধিক দৃশ্যে দেখানো হয়েছে কারাজীবনের মর্মন্তুদ চিত্র। উইনস্টন চার্চিল ছিলেন তখন বৃটেনের স্বরাষ্ট্র সচিব। নাটকটি দেখে তিনি এতোই অভিভূত হন যে, কারাজীবনের কঠোরতা খানিকটা শিথিল করতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন। নাটক মঞ্চায়নের যে একটি উদ্দেশ্য থাকে এবং নাটকের প্রভাব সৃষ্টি করবার ব্যাপারটা যে সত্যি এ ঘটনায় তা আবার প্রমাণিত হয়।

জর্জ বার্নার্ড শ ও জন গলসওয়ার্দির পর গ্র্যানভিল বার্কার, ব্যারী প্রমুখ নাট্যকারদের নাটকে বাস্তবতার বিচিত্র প্রসার দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিডনি হাওয়ার্ড, আর্থার মিলার প্রমুখ বাস্তববাদী ধারার নাটক রচনায় বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের নাটকেও প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিল। ত্রিশ চল্লিশ বছর ইউরোপীয় নাটকের প্রধান স্রোত ছিল এই বাস্তববাদী ধারা। পূর্বে উল্লিখিত বাস্তববাদী ধারার নাট্যকাররাই হচ্ছেন রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার পথপ্রদর্শক; যাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতিকে প্রতিপাদ্য করে নাটক লিখেছিলেন, যুক্তি দ্বারা তাঁদের নাট্য ঘটনাকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। যুক্তি দ্বারা সেসব নাটকে শুধুমাত্র সমসাময়িক জীবনই চিত্রায়িত হয়েছে, বুর্জোয়া সমাজের নানা দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছে, শোষিতদের প্রতি নাট্যকারদের সহানুভূতিও প্রকাশ পেয়েছে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। বুর্জোয়া সমাজ থেকে বের হয়ে আসার বা বুর্জোয়া সমাজের অসঙ্গতি থেকে মুক্তি লাভের উপায় তাঁরা বলেননি কিংবা এ ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশনাও দেননি। সমসাময়িক সময়ের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন যদিও সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়বার কথা বলেননি; যা লক্ষ্য করা যায় পরবর্তী রাজনৈতিক নাট্যচিন্তার মধ্যে। রাজনৈতিক নাট্যচিন্তায় সরাসরি বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে উচ্ছেদের পক্ষে কথা বলা হয়, বাস্তববাদী নাট্যকারদের চিন্তায় তা দেখতে পাওয়া যায় না। রাজনৈতিক নাটক বলে শ্রেণীসংগ্রামের কথা এবং সে বিশ্বাস করে বুর্জোয়া সমাজের ধ্বংস অনিবার্য।

নাট্যচর্চার ইতিহাসে স্বাভাবিকবাদী ধারার পর পাওয়া গেল বাস্তববাদী ধারা। বাস্তববাদী ধারা স্থির হয়ে রইলো না। উনিশ শতকের শেষ দশকে বাস্তববাদী নাট্যধারায় দেখা গেল, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নতুন নতুন পথের সন্ধান চলছে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল নাটককে ব্যাপক জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার এক প্রচেষ্টা। জার্মানীতে এই উদ্দেশ্যে গড়ে উঠলো ‘ফোকস্-ব্যুহ্নেন’ নামের একটি নাট্য সংগঠন। যারা নবীন নাট্যকারদের লেখা নাটকগুলো নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিকদের মধ্যে মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল। ঠিক এর পরই দেখা গেল এরকম অসংখ্য উদ্যোগ, যেখানে মূল প্রশ্ন ছিল দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ, দর্শকদের সঙ্গে আত্মীয়তা, সাধারণ মানুষের জন্য রঙ্গালয়ের দরজা খুলে দেয়া। বাস্তববাদী নাট্যধারার প্রধান যে কয়জন নাট্যকার, তাঁদের প্রায় সকলেই নাটকের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া সময়কালের সমালোচনায় নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিলেন। সময় ও নিজস্ব শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রত্যেক বড় বাস্তববাদী শিল্পীই মূল সমস্যার আলাদা সমাধানে উপনীত হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে সবার চিন্তার ঐক্য ছিল যে, তাঁরা তাঁদের বিরাট সময়কালের বেশ গভীরে প্রবেশ করেছিলেন এবং সময়কালকে যেভাবে দেখেছিলেন তদানুযায়ী বাস্তবতার যথার্থ নির্যাসকে অমোঘভাবে চিত্রিত করেছিলেন। বুর্জোয়া সমাজ স্বভাবতই এসময় কঠিন সমালোচনার মুখোমুখি পড়ে। উনিশ শতকের মধ্য ভাগে ভাববিলাসীরা বুর্জোয়াদের ঘৃণা করলেও তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ধরনের সমলোচনা এড়িয়ে গিয়েছিলেন শাসকদের ক্রোধ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য। বাস্তববাদী প্রধান ধারার নাট্যকাররা তা করলেন না। সরাসরি তাঁরা পুঁজিবাদের সমালোচনায় অংশ নিলেন। এই সময়ই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের জন্য নাটক বা গণনাট্যের ধারণাও ব্যাপকতা পেতে থাকে। স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে ‘রাজনৈতিক নাট্য’ কথাটারও যাত্রা আরম্ভ তখন থেকেই।