নামাজে মন ফেরানো

পর্ব ৪

শারিন সফি অদ্রিতা

প্রকাশিত : জুলাই ১৩, ২০২০

কোনো কিছুতে বিজয়ী হতে হলে আমরা কার বিরুদ্ধে লড়ছি, সেই ব্যাপারে পরিষ্কার জ্ঞান রাখতে হবে। তবেই না আমরা সেই শত্রুর মোকাবিলা করতে পারবো। নামাজে আমাদেরকে অমনোযোগী করে শয়তান। রসূল (সা.) বলেন, যখন আজানের শব্দ উচ্চারিত হয়, শয়তান তখন সশব্দে বায়ু ছাড়তে ছাড়তে দৌড়ে পালিয়ে যায় যাতে তার কানে আজানের শব্দ না আসে। আজান শেষ হলে আবার সে ফিরে আসে; ইকামাতের সময় আবার সে পালিয়ে যায় এবং শেষ হলে আবার ফিরে আসে, এবং মানুষের মনকে ফিসফিসিয়ে ধোঁকা দিতে থাকে যেন নামাজ থেকে মনোযোগ সরে যায় এবং মানুষকে এমন সব জিনিস মনে করিয়ে দেয় যা নামাজের আগে তার মাথায় ছিল না। যার ফলে মানুষ ভুলে যায় যে, সে কোন রাকাআতে নামাজ পড়ছে। (বোখারি)

কি চেনা চেনা লাগছে না? কল্পনা করুন আপনি নামাজে দাঁড়িয়ে আর আপনার ঠিক পাশেই কদাকার এক শয়তান কানের কাছে ফিসফিস করেই যাচ্ছে। চিত্রটা বেশ ভয়ঙ্কর! তাই এই শয়তানের ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে তবেই নামাজ শুরু করতে হবে। সানা পাঠ শেষ করে আমরা বলি, আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজিম। মানে, বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম— শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম দয়ালু এবং অসীম করুণাময়। এরপর আমরা পাঠ করি চিরচেনা সূরা ফাতিহা। চলুন আজকের পর্বে নতুন করে সেই সূরা ফাতিহা আবিষ্কার করা যাক। আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আ`লামিন— আল্লাহ এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। তিনি আমাদের রব, প্রভু, মনিব।

আরবি রব শব্দটার মানে এমন কেউ যে টুয়েন্টি-ফোর-সেভেন আমাদের দেখভাল করে যাচ্ছেন। আমাদের প্রত্যেকটা হার্ট-বিটের তত্ত্বাবধান, আমাদের খাওয়ানো, পড়ানো, সুস্থ রাখা, আমাদের অনুরোধগুলো শোনা, আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা— এই সবই রব শব্দটার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ আমাদের প্রভু, আমরা তাঁর গোলাম। আমরা আল্লাহর সম্পত্তি। নিজেকে কারো গোলাম ভাবতে অনেকের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। কারণ মানুষ স্বভাবতই স্বাধীন থাকতে পছন্দ করে। তাছাড়া দুনিয়াবি দৃষ্টিতে প্রভুরা তার দাসের উপর ক্ষমতার জোর খাটায়, অত্যাচার করে। কিন্তু আমাদের আল্লাহ অন্যরকম প্রভু। তিনি এমন প্রভু যে তাঁর গোলামের সাথে কখনো অন্যায় করেন না। তিনি তার বান্দাকে ধরেবেঁধে রাখেন না, বরং বান্দাদেরকে একটা নির্দিষ্ট পরিধি পর্যন্ত স্বাধীন ইচ্ছা (free will) দেন। এই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি কে কিভাবে চ্যানেল করে হিদায়াতের পথে থাকতে হবে সেটার কমপ্লিট ইন্সট্রাকশনও তিনি দিয়ে দিয়েছেন।

আমাদের হাত-পা-মুখ সবকিছুই আল্লাহর। খুব সীমিত সময়ের জন্যে আল্লাহ আমাদেরকে আমানত হিসেবে কিছু জিনিসের কন্ট্রোল দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন আমাদের নিজেদের হাত-পা গুলিও আমাদের কর্ম অনুযায়ী আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে। তাই আল্লাহই সার্বিক ব্যপারের কন্ট্রোলে আছেন ভেবে আমরা খুশি খুশি এই আয়াতের মাধ্যমে নিজেদের দাসত্ব আল্লাহর কাছে স্বীকার করি। আমরা দাসেরা তাই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকি। তিনি এমন একজন রব, যার জন্যে সমস্ত প্রশংসা নির্ধারিত। আরবি হামদ শব্দটা প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা দুইটাই ইঙ্গিত করে। কারণ, কেউ যখন মন থেকে প্রশংসা করে কাউকে ধন্যবাদ দেয়, তার কৃতজ্ঞতা হয় নির্ভেজাল। আমরা সূরা ফাতিহাতে নির্ভেজাল ভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।

আলহামদুলিল্লাহ— এখানে আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই আয়াতের বিশ্লেষণে বুঝা যায়, আমাদের প্রশংসার আসলে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ আল্লাহর প্রশংসা ছেড়ে দিলেও আল্লাহর রাজ্য থেকে একটা কিছু কমে যাবে না। আবার দুনিয়ার সমস্ত মানুষ মিলে আল্লাহর প্রশংসা করতে ঝাঁপিয়ে পড়লেও সেটার ফলে আল্লাহর মহিমা এতটুকু বেড়ে যাবে না। আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলি বা না বলি, আল্লাহ সবসময় প্রশংসিত। আলহামদুলিল্লাহ বলে আমরা আল্লাহর কোনো উপকার করছিনা। বরং লাভটা আমাদের নিজের। যখন একজন মাকে দেখি তার বুকের ধন সন্তানকে কবর দিয়ে ফেরত এসে বলছে, আলহামদুলিল্লাহ! আমার ছেলে এখন ইব্রাহীমের (আ.) সাথে জান্নাতে খেলছে। একজন ভাইকে দেখি চাকরি হারিয়ে বলছে, আলহামদুলিল্লাহ। আরো অনেক কিছুই তো হারাতে পারতাম। একজন বোনকে দেখি বিছানায় শুয়ে প্রচণ্ড অসুস্থতায় বলছে, আলহামদুলিল্লাহ। এই কষ্টের মাধ্যমে আল্লাহ আমার গুনাহ্গুলি মাফ করে দিচ্ছেন— তখন আলহামদুলিল্লাহর মর্মটা বুঝি। আমরা যতবার নামাজে এই আয়াত পড়ছি, ততবার আমরা নতুন করে পজিটিভ হতে শিখছি। শত কষ্টের মধ্যে থেকেও আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারার চেয়ে শক্তিশালী আর শান্তিদায়ক আর কিছু নেই। দিনের মধ্যে পাঁচবার করে নামাজে আমরা সেটারই প্র্যাক্টিস করছি।

আ`লামিন— আলামিন শব্দের অর্থ,‍ `সকল সৃষ্টি জগতের (পালনকর্তা)। অর্থাৎ আল্লাহ তা`আলা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার রব। সুবহানাল্লাহ!  ভালো নেটওয়ার্ক না থাকলে চাকরি পাওয়া যায় না। ভালো রেকমেন্ডেশান লেটার না থাকলে এডমিশন পাওয়া যায় না। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহ ধনী, গরিব, কালো, সাদা— সবার জন্যে প্রযোজ্য। তিনি যে রব্বুল আলামিন। আমরা মানুষরাও যেন আমাদের অনুগ্রহ বিলানোর সময় নিজেদের মধ্যে তারতম্য করা বন্ধ করি।  তাহলে এক বাক্যে এই আয়াতের অনুবাদ হয়, যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা। কিন্তু একটু সময় নিয়ে ব্যাখ্যাসহ বুঝে পড়লে, প্রতিটা শব্দ অন্তরের ভিতরে গিয়ে নাড়া দেয়। আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন— আমাদেরকে প্রতিবার রিমাইন্ডার দিচ্ছে যে, সীমাহীন প্রশংসার যোগ্য আমার রব সারাক্ষণ আমার যত্ন নিচ্ছেন, তিনি আমার সকল সমস্যার সমাধান দিয়ে গিয়েছেন এবং তিনি আমাদের কারো মধ্যেই তার প্রভুত্ব নিয়ে ভেদাভেদ করেন না। এমন রব থাকতে আমাদের কীসের চিন্তা বলুন? চলবে