নামাজে মন ফেরানো

পর্ব ২

শারিন সফি অদ্রিতা

প্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০২০

আচ্ছা আমরা কি জানি যে, আল্লাহর তরফ থেকে একমাত্র নামাজ ছাড়া কোনো আদেশ আকাশে অবতীর্ণ হয়নি? রোজা, হাজ্জ, হিজাব ইত্যাদি বিধানগুলো নাজিল হয়েছে পৃথিবীর মাটিতে, ফেরেশতা জিবরীল (আ.) মারফত ওহির মাধ্যমে। কিন্তু নামাজের আদেশ বান্দার জন্যে কার্যকরী করার সময় আল্লাহ স্বয়ং রসূলকে (সা.) মেহমান করে নিয়ে যান সাত আসমানের উপর। বান্দা ও আল্লাহর মধ্যকার সমস্ত দূরত্ব ভেদ করে রসূল (সা.) চলে যান তাঁর প্রতিপালকের দরবারে এই বিশেষ উপহারটি নেবার সময়। কতটা সম্মান আর ভালোবাসায় মুড়িয়ে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্যে নামাজের বিধান নাজিল করেছেন, সুবহানআল্লাহ! কল্পনা করা যায়, নামাজের মধ্যে প্রতিবার সরাসরি আল্লাহর সাথে আমাদের মুখোমুখি মিটিং হচ্ছে? আমরা কি সেই মিটিংকে আমাদের প্রতিপালকের তরফ থেকে আসা ডিরেক্ট উপহার হিসেবে নিচ্ছি? নাকি নামাজ কেবল আমাদের শত কাজের লিস্টের মধ্যে একটি কাজ মাত্র, যেটাকে যন্ত্রের মতো কোনোমতে পালন করে আমরা পরের কাজে চলে যাই।

আজকের পর্বে আমরা জানব, নামাজে পঠিত সানার অর্থ ও ব্যখ্যা। সুবহানাকাল্লাহুম্মা, ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারকাসমুকা, ওয়া তাআ`লা জাদ্দুকা, ওয়ালা ইলাহা গইরুকা। অর্থ, আল্লাহ আপনি কতই না পবিত্র, আপনার কোনো ভুল নেই। আমি সারাজীবন আপনার প্রশংসা করেই যাব, আপনার নামগুলি সবচেয়ে বরকতপূর্ণ, আপনার নির্ধারিত হুকুম সবচেয়ে উচ্চ, আমি কখনোই আপনি ছাড়া আর কারো ইবাদাত করবো না। (অর্থাৎ কাউকে আপনার থেকে বেশি গুরুত্ব দেব না।) সুবহানাকাল্লাহুম্মা, ওয়া বিহামদিকার অর্থ হচ্ছে, আমাদের আল্লাহ সবচেয়ে পারফেক্ট, তিনি সমস্ত ভুল হতে পবিত্র এবং সমস্ত প্রশংসা কেবল তাঁরই জন্যে। একটু খেয়াল করি, আমরা মানুষরা জীবনে এই দুইটা জিনিসই খুব চাই, Perfection and Praise. অর্থাৎ নিজেদের জন্যে আমাদের সবকিছু পারফেক্ট হতে হবে; পারফেক্ট ক্যারিয়ার, পারফেক্ট বিয়ে, পারফেক্ট বাড়ি। আর অন্যের কাছে আমরা আশা করি, প্রশংসা বা এপ্রিশিয়েশান। আমরা খুব চাই যে, পরিবারে, সমাজে অন্যেরা আমাদের সমাদর করুক।

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের জীবনের বেশির ভাগ কষ্ট আসে এই দুইয়ের অভাবে। হয় নিজেরা পারফেক্টলি কিছু করতে পারিনি, তাই নিজের উপর হতাশ। নাহলে অন্যের কাছে যেই সমাদর আশা করেছি সেটা পাইনি, তাই অন্যের উপর হতাশ। চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে, আল্লাহ বারবার নামাজে আমাদেরকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ত্রুটিহীনতা এবং প্রশংসা— এই দুইটি বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি আল্লাহ রব্বুল আলামিনের আয়ত্বে। আমাদের আয়ত্বে না। যেই আমরা নামাজে দাঁড়িয়ে বলছি, সুবহানাকা আল্লাহুম্মা (আল্লাহ তুমি কত পবিত্র, ত্রুটিহীন), ওয়া বিহামদিকা (এবং আমি তোমার প্রশংসা সারাজীবন করেই যাব)—সাথে সাথে আমরা আল্লাহর সামনে নিজেদের ত্রুটিপূর্ণ সত্তাকে কবুল করে নিই। অন্য কোনো সৃষ্টির কাছে সমাদর না খুঁজে একমাত্র আল্লাহর দিকে ফোকাস করি। এটা খুব পাওয়ারফুল। নামাজে দাঁড়িয়েই এটা একজন মুসলিমকে মেন্টালি স্ট্রং বানিয়ে দেয়। সে জানে যে, তার হতাশ হবার কিছু নেই। সে ভুলে ভরা হলেও আল্লাহ তাকে তার ঈমানের সহিত করা ছোট/বড় সকল আন্তরিক চেষ্টার জন্যে পুরষ্কৃত করবেন। অন্য কারো কাছে প্রশংসা বা উপযুক্ত সমাদর না পেলেও তার কষ্টের কিছু নেই। সত্যিকার প্রশংসা তো কেবল আল্লাহর জন্যে, তার নিজের জন্যে তো না। ইম্পারফেক্ট বান্দার জন্য রয়েছে তার পারফেক্ট রব।

ওয়া তাবারকাসমুকার অর্থ, আল্লাহ তোমার নামগুলি কতই না বরকতপূর্ণ। এখানে, আরবি বারাকাহ শব্দকে ইংরেজিতে Blessing এবং বাংলায় আশীর্বাদ বলা হয়। খুব কমনলি আমরা একে অন্যকে বলে থাকি, May Allah Bless you। মানে আল্লাহ তোমাকে বরকত দিক। বরকত বলতে আমরা সাধারণত বুঝি কল্যাণ, মঙ্গল— জীবনে যা কিছু ভালো।  বারাকাহর আরেকটা ইন্টারেস্টিং অর্থ কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না। বারাকাহ মানে হচ্ছে, যখন আল্লাহ আমাদের জীবনে কল্যাণ এমনভাবে বাড়িয়ে দেন যে, আমরা অনেক কম সময়ে অনেক বেশি কিছু অর্জন করে ফেলতে পারি। বারাকাহর একটা প্রাইম উদাহরণ দেই। গেল রোজায় আমার এক বড় বোন কয়েকজন মুরব্বিদের ইফতারে দাওয়াত করবেন বলে নিয়ত করলেন। কিন্তু আপুর হাতে ওইদিন সময় ছিল অনেক কম। সারাদিনের ঝড়-ঝাপটা শেষে সন্ধ্যার ঠিক আগে হাতে পেল এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এতগুলা মানুষের খাবার এত কম সময়ে সে কীভাবে করবে? আপু তখন ভাবলো, ইয়া আল্লাহ, আমি তোমার জন্যে নিয়ত করেছি যে, তোমার বান্দাদের ইফতার খাওয়াবো। তুমি আমার জন্যে পথ করে দাও। মাগরিবের আজান পড়ার পাঁচ মিনিট আগে সে যখন টেবিলে দশটার বেশি আইটেম রেডি করে ফেললো, টেবিল ভর্তি খাবার দেখে আপুর বিস্ময়ে অস্ফুটে মুখ থেকে বের হলো, এটা আমি করি নাই! এটা আল্লাহর বারাকাহ!

যখন আল্লাহ সময়ে বারাকাহ দেন, তখন সেই সময় এমনভাবে প্রশস্ত হয়ে যায় যে, কম সময়ে অনেক বেশি কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব হয়, যেটা আল্লাহর বারাকাহ ছাড়া অসম্ভব। নামাজ এমন একটা ইবাদাত, যেটা করতে খুব কম সময় লাগে। কিন্তু আমরা যদি সেটা সঠিকভাবে জীবনে পালন করতে পারি, তাহলে প্রতিদিনের কয়েক মিনিটের এই নামাজই আমাদের জীবনে অসম্ভব রকমের কল্যাণ এবং বরকত নিয়ে আসবে। নামাজের শুরুতেই যখন আমরা বলছি যে, ওয়া তাবারকাসমুকা— আল্লাহর নামগুলি বরকতপূর্ণ— তখন আল্লাহর কাছে আমরা সেই লেভেলের বারাকাহর আশা করছি। যে সত্তার নামই এত বরকতপূর্ণ তিনি নিজে না-জানি কতটা বরকতপূর্ণ! অকল্পনীয় এই বারাকাহর কল্যাণ আল্লাহ ছাড়া আমাদের জীবনে আসা সম্ভব নয়— এটাই আমরা প্রতিদিন পাঁচবার নামাজে মেনে নিচ্ছি। সুবহানাল্লাহ! নামাজ যেমন বারাকাহ বাড়ায়, গুনাহ তেমনি বারাকাহ কমায়। সেজন্যে আমাদের গুণাহ থেকে অনেক দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে, যেন জীবনের বারাকাহগুলো গুনাহ দিয়ে আমরা হারিয়ে না ফেলি। কষ্ট করে নামাজ পড়ে যে বারাকাহ পাচ্ছে, সে ওই বারাকাহ প্রোটেক্ট করার জন্যে সমস্ত চেষ্টা দিয়ে গুনাহ থেকে দূরে থাকবে। এজন্যেই তো বলে, নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুত ৪৫)

নামাজের শুরুতেই একজন বান্দা মেন্টালি স্ট্রং হয়ে যাচ্ছে এই ভেবে যে, দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিপালক, সে তাকে সমাদর এবং প্রশংসা করবে এবং সেই প্রতিপালক তার বান্দার জন্যে অসম্ভব কল্যাণ এবং বারাকাহর দরজা খুলে দিতে সক্ষম। কেবল আমাদের মানুষের প্রশংসার আশা আর গুনাহগুলোকে ছুড়ে ফেলে প্রতিপালকের প্রতি আন্তরিক হবার অপেক্ষা। চলবে