
নামাজে মন ফেরানো
পর্ব ৩
শারিন সফি অদ্রিতাপ্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২০
মাঝে মাঝে কাজের চাপে খুব অস্থির লাগে। মনে হয়, দশ দিক থেকে আমাকে টানা হচ্ছে আর মাঝখানে আমি তব্দা খেয়ে বসে আছি। কোনো দিকেই যেতে পারছি না। তখনই মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে শুনি নামাজের আহবান, আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। আমাকে ডাকতে থাকে, নামাজের দিকে আসো। কল্যাণের দিকে আসো। তখন এই অগোছালো আমি অন্তত একটা ডিরেকশানে যাবার পথ খুঁজে পাই। এলোমেলো টেবিলটা ওভাবেই ফেলে চলে যাই প্রতিপালকের কাছে নিজের আত্মাকে গুছিয়ে নিতে। এটা যে কতটা উপকারী এবং শক্তিশালী অনুশীলন, যে কোনো দিন এর স্বাদ পায়নি তাকে বুঝানো কঠিন।
মুহাম্মদ ফারিস তার ‘প্রোডাক্টিভ মুসলিম’ বইতে নিজের জীবনের এমন একটা ঘটনা লিখেছিলেন। একবার তাদের এলাকায় বড় ধরনের বন্যা হয়। ফলে তাদের বাড়ির অনেকটা অংশই ডুবে যায়। লেখক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে নিজের সাজানো ঘরটাকে বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেতে দেখতে থাকেন। এরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠিক রাখা দায়! ঠিক ওই সময় তিনি শুনলেন, আজান দিচ্ছে। সাথে সাথে তিনি মসজিদের দিকে হাঁটা দিলেন। ওই ওলটপালট অবস্থা থেকে বের হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলে মনটা শান্ত করে নিলেন। মাথা ঠাণ্ডা হলে পরবর্তী কাজ সম্পাদনের একটা দিশা পেলেন।
যখন প্রচণ্ড মন খারাপের দিনে কিছুই করতে ইচ্ছা করে না, হতাশায় শুধু মনে হয় ঘরের এক কোণে গিয়ে বসে থাকি, তখনই একজন মুসলিম নামাজের জন্যে উঠে দাঁড়ায় নিজের প্রতিপালকের কাছে গিয়ে নিজেকে গুছিয়ে আনতে। আলহামদুলিল্লাহ, এভাবেই নামাজ একজন মুসলিমের মনোবল চাঙা করে এবং শক্তি বৃদ্ধি করে। নামাজে সানার দ্বিতীয় অংশ আজ আমরা জেনে নেব। ওয়া তা আ`লা জাদ্দুকা— জাদ্দুকা মানে Determination, Decree। সহজ বাংলায় ইচ্ছাশক্তি বা আইন পাশ করে দেয়া। আ`লা মানে Higher, উঁচু, মহান। তাহলে এর অর্থ দাঁড়ালো, আল্লাহর ইচ্ছা সবচেয়ে বড়।
আমাদের কত শত ইচ্ছা থাকে, কিন্তু আমাদের ইচ্ছামতো সবকিছু হয় না। তখন আমরা অনেকেই ভেঙে পড়ি, কষ্ট পাই। অথচ নামাজে প্রতিদিন আমরা সানায় স্বীকার করে নিচ্ছি, হে আল্লাহ, আমার ইচ্ছার থেকে আপনার ইচ্ছা বড়। আমাদের সামান্য জ্ঞান দিয়ে আমরা কোনো কাজের কী পরিণাম, সেটা বুঝতে পারি না। কিন্তু প্রতিপালক মহান আল্লাহ, তিনি স্থানকালপাত্র ভেদ করে সবকিছু জানেন। তাঁর থেকে ভালো আর কেউ জানবে না, এখন আমার জন্যে এই বিয়ে, চাকরি অথবা কাজ হয়ে যাওয়াটা আসলেই কতটা কল্যাণকর। যে ব্যক্তি ওয়া তা আ`লা জাদ্দুকার মর্ম বুঝে নামাজে এটা পাঠ করবে, না পাওয়ার কোনো গ্লানি তাকে জেঁকে ধরতে পারবে না। তার অন্তর জুড়ে থাকবে প্রশান্তি।
ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা— আল্লাহ, আমি আপনি ছাড়া আর কারো ইবাদাত করবো না। এই পর্যায়ে এসে সানায় আমরা স্বীকার করি নেই যে, আল্লাহ আমাদের প্রভু। আমরা তাঁর গোলাম। আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে আমাদের মাথা নত করবো না। নিজেদের কামনা-বাসনা এবং নফসের সামনে না। সমাজে সামনে না, শয়তানের ওয়াসওয়াসার সামনে না। আমরা আল্লাহর থেকে বেশি কোনো কিছুকেই গুরুত্ব দেব না। আচ্ছা একটু ভাবি, দিনের মধ্যে পাঁচবার করে যদি আমরা কাউকে নিজে থেকে গিয়ে বলে আসি যে, তুমি আমার লাইফে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং বলার সাথে সাথেই যদি এমন এমন কাজ তার চোখের সামনে করতে থাকি করি যা ওই ব্যক্তি মোটেও পছন্দ করে না, তাহলে পরবর্তীতে তার সামনে যেতে আমাদের অনেক লজ্জা লাগবে না?
কষ্টের কথা কি জানেন, এই কাজটা আমরা দৈনিক আল্লাহর সাথে করে আসছি। এজন্যেই যে বুঝে নামাজ পড়ে, তারা জানে যে, আল্লাহর সাথে সে যে প্রতিশ্রুতি করেছে সেই প্রতিপালকের দরবারে এখনই হাজিরা দিতে যেতে হবে। কীভাবে আল্লাহকে এতটা অসন্তুষ্ট করে তাঁর সামনে দাঁড়াই? কীভাবে তাঁর বান্দাকে কষ্ট দিয়ে, তাঁরই বান্দার হক মেরে এসে তাঁকে বলি যে, ওয়া লা ইলাহা গাইরুক? আমরা নামাজ পড়ি আর আমাদের মনে হয়, কই, নামাজ পড়েও তো খারাপ কাজ করেই যাচ্ছি। এটা আমাদের নিজেদের দুর্বলতা, নামাজের না। আল্লাহ আমাদের ইবাদত, আখলাক এবং ইখলাস আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিক। আমিন। চলবে