নারী ফেকাহ বিশারদ ও তাদের পরিচালিত পাঠ্যসভা

মিন্নাহ তিললাওয়ি

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৯

গাউন পরিহিত সুউজ্জ্বলা যুবতী। পিঠ বেয়ে নেমে এসেছে মাথার চুল। লাস্যময়ী কোমর দুলিয়ে সম্রাটের সাথে নাচছে। পাশে রয়েছে হরেক কিসিমের মদ্যপেয়ালা। অন্য দৃশ্যে, সম্রাটপত্নী ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে অথবা ধনের বদলে রাজকীয় গোপন কথার সস্তা বাজার করছে। কেউ আবার টাকার বিনিময়ে সেরা হারটি কেনার ধান্দা করছে। এভাবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও দশম দৃশ্যে ইতিহাস নারীকে তুলে ধরছে শুধুই ভ্রান্তি ও পতনের হেতু স্বরূপ।

প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে সৎ ও জ্ঞানান্বেষী নারীদের ঐতিহাসিক আলোকময় ভূমিকাসমূহ। এমনকি বুঝানো হয়ে থাকে ইসলামি সমাজের প্রথম যুগ দাঁড়িয়েছে শুধুই পুরুষদের প্রচেষ্টায়। অন্য দিকে মহিলারা ছিল গৃহপরিচর্যা ও সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বে। এটি যদিও সুন্দর সমাজ বুননে তাদের বড় এক ভূমিকা, তাই বলে তারা কেবল এ কাজেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং যুগে যুগে ইসলামি সভ্যতা ও আদর্শ প্রচারে পুরুষদের পাশাপাশি অনন্য ভূমিকা রেখেছে।

তারা মসজিদ নববির পাঠাসরে অংশ নিয়েছে। নবিজির স্ত্রীদের কাছে তাদের অতি আসা-যাওয়ার কারণে নবিজির ঘরগুলো কানায় কানায় ভরপুর থাকত। যেন ছোট-খাটো সাংস্কৃতিক সভা। যেখানে বিভিন্ন মাসআলা ও বাস্তব জীবনের সমস্যা নিয়ে বাতচিত করা হতো। আয়েশা রা. বলেন, ‘আনসারী মহিলারা কত চমৎকার! লাজুকতা তাদের দ্বীন শিখতে বারণ করেনি।’ নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর তারাও নববিবার্তা বহন করেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ইসলামি শুদ্ধ সংস্কৃতি প্রচার করেছে।

হজরত আয়েশা রা.
নবিজির ওফাতের পরে সাহাবারা পারিবারিক বিষয়গুলো জানার জন্য তার ঘরে এসে ভিড় করতেন। আয়েশা রা. তাঁদের অস্পষ্ট বিষয়গুলো বলে দিতেন। আবু মুসা আশআরি রা. আয়েশা রা. এর ব্যাপারে বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনো হাদিসের ব্যাপারে জটিলতা দেখা দিলে আয়েশা রা.-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেই আমরা সমাধান পেয়ে যেতাম।’ অন্য দিকে উম্মে সালামা রা.। যিনি ফিকহি বিষয়ে বেশ জ্ঞাত ছিলেন। পাশাপাশি শিক্ষা প্রদান করেছেন অন্যদেরকেও।

লাইলা বিনতে আবদুল্লাহ
লাইলা বিনতে আব্দুল্লাহ। তাকে শিফা বলে উপাধী দেয়া হয়েছিল চিকিৎসাবিষয়ে তার খ্যাতির কারণে। পরে শেফা নামেই পরিচিতি পান তিনি। যাকে বলা হয় ইসলামের প্রথম শিক্ষিকা। দক্ষতার সাথে লিখতে-পড়তে শিখেছেন। শিখিয়েছেন অন্যদেরকেও। তাঁর সুদক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে মদিনার অনেকেই জানতেন। শুধু তাই নয়, হযরত ওমর রা. বাজার দেখভালের জন্য তাঁকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেন, ওমর রা. তাঁকে অর্থমন্ত্রণালয়ে হিসাব বিভাগে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনিই প্রথম মুসলিম নারী, যিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে ওমর রা.-এর শাসনকালে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁরই শিষ্যত্ব লাভ করেছেন হাফছা বিনতে ওমর রা.। চিকিৎসাজ্ঞানে তাঁর যোগ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত। তার সুদক্ষতার ফলে মদিনাবাসী তাকে ‘শিফা’ (আরোগ্য) বলে উপাধী দিয়েছিল।

উমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান
উমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান (২৯-১০৬ হিজরি)। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস যত্নের সাথে হিফজ করেছেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস সম্পর্কে অধিক জান্তাদের মাঝে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর বর্ণিত হাদিসগুলো অত্যন্ত নিখুঁত প্রমাণিত হয়েছে হাদিস বিশারদদের কাছে। বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজী ও নাসায়ী শরীফে তার বর্ণিত হাদিস লিপিবদ্ধ হয়েছে। হাদিস লিপিকরণ ও মুখস্ত করার ক্ষেত্রেই কেবল তার ভূমিকা সীমিত ছিল না। বরং শিক্ষা প্রদান করেছেন বিভিন্ন হাদিসের মজলিসে।

যাইনাব বিনতে আলী রা.
যাইনাব বিনতে আলী রা. (৫-৬২ হিজরি)। হুসাইন রা.-এর শাহাদাতের পর তিনি মদিনায় গমন করেন। সেখান থেকে মিশরে যান। মিশরে তিনি মহিলাদেরকে ফিকহি বিষয়াদি শিক্ষাদানে নিয়োজিত হন। তাঁর তালিমি জলসা শুধু মহিলাদের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অংশ নিয়েছেন পুরুষরাও। বিষেশ করে ‘আহলে বাইত’ সংক্রান্ত মাসআলাগুলো জানার জন্য।

ফাতেমা বিনতে হুসাইন রা.
যাইনাব বিনতে আলীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন ফাতেমা বিনতে হুসাইন রা.। যাঁর চেষ্টার ফলে হুসাইন রা.-এর জীবন ও কর্ম এখনও অমর হয়ে আছে। অন্য দিকে কাব্যজগতে ‘আহলে বাইতের’ অবদান বিশদভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর বোন সাকিনা রা. আরবী ভাষা ও সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। ভাষাজ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে তার অপার আগ্রহ ছিল। শুধু তাই না, বরং সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্যসভাও করতেন তিনি। যেখানে আলোচনা হতো আররি ভাষা ও সাহিত্যসহ ফিকহি বিষয়সমূহ।

নাফিসা বিনতে হাসান
নাফিসা বিনতে হাসান (১৪৫-২০৮ হিজরী)। তিনি ইমাম মালেক রহ. (৯৩-১৭৯ হিজরী)-এর শিষ্যত্ব লাভ করেছেন। মিশর যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মদিনায় ইমাম মালেক রহ.-এর পাঠসভায় অংশ নিতেন। মিশরে এসে তিনি শিক্ষাদানে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর মজলিসে উপস্থিত হয়েছিলেন তৎকালীন অনেক আলেম। ইমাম শাফেয়ী রাহঃ (১৫০-২০৪ ) ছিলেন তাঁদের মাঝে অন্যতম। তাঁর মৃত্যুলগ্ন পর্যন্ত ইমাম শাফেয়ী রহঃ তাঁর মজলিস ত্যাগ করেননি।

শুহদা বিনতে আহমাদ বিন আল ফাজর
মুসলিম নারীগণের ভূমিকা আহলে বাইতের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং সাধারণের মাঝেও শিক্ষার আলো ব্যাপক ছিল। তেমনই সেরাদের একজন ছিলেন শুহদা বিনতে আহমাদ বিন আল ফাজর আল ইবরি (৪৮৪-৫৭৪ হিজরী)। চমৎকার হাতের লেখা ছিল তাঁর। তৎকালীন খলিফা তাকে চিঠি, ওয়াজ এবং স্মারক লেখার কাজে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ভাষা, ইতিহাস ও সাহিত্যসহ একাধিক বিষয়ে পুস্তিকা লিখেছেন। একশ আটষট্টি জন বিশিষ্ট পণ্ডিত তাঁদের গবেষণাকর্মে শুহদা বিনতে আহমাদ রহ-এর সহযোগিতা নিয়েছেন। ‘ফখরুন্নিসা’ (নারীকুলের গৌরব) উপাধিতে ভূষিতা হয়েছিলেন তিনি।

ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ বিন আহমাদ সমরকান্দী
ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ বিন আহমাদ সমরকন্দি। যিনি ফিকাহজগতে অনুসরণীয় প্রদীপতুল্য। শিক্ষাপ্রদান করেছেন। ফিকাহ ও হাদিস শাস্ত্রে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। বাদশাহ নুরুদ্দিন শহিদ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর থেকে পরামর্শ নিয়েছেন। এবং সে অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করেছেন। ইতিহাস বিষয়ে লিখিত আল বাদায়ে ওয়াস সানায়ে নামক বইয়ের লেখক আলাউদ্দীন কাসানী রহ. (মৃঃ ৫৮৭ হিজরী) ছিলেন তাঁরই জীবনসঙ্গী। কাসানী রহ.-এর থেকে কোন অশুদ্ধতা প্রকাশ পেলে তিনি শুধরে দিতেন। বরং প্রকাশিত ফতোওয়াগুলো তাঁদের উভয়ের নামই বহন করত।

ফাতেমাহ বিনতে আব্বাস বাগদাদী
অন্যতমাদের মাঝে আরো ছিলেন ফাতেমাহ বিনতে আব্বাস বাগদাদী (মৃঃ ৭১৪ হিজরী)। তিনি ইবনে তাইমিয়া রহ-এর ছাত্রীদের একজন। ইবনে তাইমিয়া রহ. তাঁর সুতীক্ষ্ণ মেধা ও বিচক্ষণতার কারণে তাঁর খুব প্রশংসা করতেন। এমনকি তিনি জটিল জটিল প্রশ্ন করতেন বলে ইবনে তাইমিয়া রহ.-কে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে পড়াতে আসতে হত। তারই শিষ্যত্ব লাভ করেছেন প্রখ্যাত আলেম ইবনে জাওজী রহ.।

হাফছা বিনতে আলহাজ আল রুকুনিইয়াহ ও ওলাদাহ বিনতে মুস্তাকফী
ইবনে হাযাম রহ. আন্দালুসী মহিলাদের প্রশংসায় বলেন, ‘তাঁরাই (জ্ঞানতাপসী মহিলারা) আমাদের কুরআন শিখিয়েছেন, কবিতা পড়িয়েছেন এবং হাতের লেখা অনুশীলন করিয়েছেন।’ হাফছা বিনতে আলহাজ আল রুকুনিইয়াহ ও ওলাদাহ বিনতে মুস্তাকফী তাদের মাঝে অন্যতম। যাঁরা পরবর্তীকালে মরোক্ক শহরে শিক্ষিকা হিসেবে প্রেরিত হন।

হাতে গোনা কয়েকজনের কথা লেখা হলো। রয়ে গেল অনেকের কথা। এ সকল নারীর জীবনকথা তাদের জন্য প্রমাণ স্বরূপ, যারা আমাদের দাসীর রূপ দিতে চায়। কাঁচপাত্রের মতো ভেঙে যাওয়ার ভয়ে ঘরের কোণে লুকাতে চায়। আমরা শিক্ষা লাভ করি তারা এটা চায় না। অস্বীকার করে। বরং ধর্মের নামে ভিত্তিহীন খেয়ালি কথা আমাদের পড়িয়ে বেড়ায়। সাথে আছে অপপ্রচার। বলে, আমরা জাতিকে নষ্টামির পথে ঠেলে দিই, জাতি ধ্বংসের মূল হেতু নাকি আমরাই।

আর ঘরের বিষয়ে বলছেন? স্বভাবতই আমরা এ বিষয়ে প্রচুর আগ্রহী। প্রভু আমাদের এ বিষয়ে পারদর্শী করেই সৃষ্টি করেছেন। আর জাতি ধ্বংস ও ফেতনার ব্যাপারে আপনারাই বলুন, বাইরে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করব (অবশ্যই দ্বীনের আওতায় থেকে), না ঘরের কপাট আটকে টিভির উপস্থাপিত সিরিয়াল গলধঃকরণ করব? না বসে বসে মানুষের গিবত ও অপবাদের দুষ্ট চর্চা করব? এভাবে অর্থহীন বসে থাকলে আগত প্রজন্ম আমাদের থেকে কী আশা করবে? নিশ্চয় এর চেয়ে শতগুণ উত্তম হবে যে, আমরা শিখে উপকৃত হব এবং আমাদের হাতে প্রতিপালিত শিশুরাও উপকৃত হবে।

‘শিক্ষা বালিকার জন্য দূর্গ স্বরূপ। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মুক্তির হার স্বরূপ।’ এই কালের সবচে ভীতিকর বিষয় হলো, আমাদের অর্থহীন সময় পার করা। আর এটাই আমাদের (মেয়েদের) প্রাণশক্তি বিনাশ করে দিচ্ছে।

অনুবাদ: আরিফ বিল্লাহ