নাসরীন জাহানের খুদে গল্প ‘আমি তোমাকে রেখে গেছি’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪

তুমি সভ্য সমাজ থেকে চলে যাও, ন্যুনতম যোগ্যতা নেই তোমার, তুমি মাকড়সা, তুমি পোকা... অপমানিত হতে হতে যখন রু নুব্জপ্রায়, যখন ঘুম চলে গেছে বাড়ির কার্ণিশ পেরিয়ে বহুদূরে... বিছানায় শরীর বসছিল না, মেঝেতে ছটফট শুয়ে দেখছিল সিলিংফ্যান, তখন পুরোই বোধশূন্য অবস্থার মধ্যে পড়ে যায় সে।

যার সাথেই সম্পর্ক হয়েছে, একপর্যায়ে প্রায় সবাই বলেছে, নিজের রুচিকে সংযত করো। নইলে জগতে চলা সামনে চলা মুশকিল হবে, এসব কী পোশাক পরো?

নোংরা বস্তিতে বড় হতে হতে সমস্ত ময়লার সাথে দারুণ সখ্য করে বহু কষ্টে সে পড়াশোনা করে একটা পর্যায়ে এসেছিল। ভালো রেজাল্ট করে যত এগিয়েছে, বন্ধুরা স্বার্থে মিশে গেলে তত চলে যেতে যেতে বলেছে, তুমি রুচিহীন একজন।

বিভ্রান্ত রু নিজেকে সামলাতে গিয়ে কখনো ক্যাটকেটে লাল কখনো কাচা হলুদ, এসব যা দামে,রুচিতে কুলায় পরতে শুরু করে।

এর মধ্যেই তার জীবনে শুভ আসে। সে দারুণ সান্নিধ্যে এসে এসে তাকে শিখিয়ে যেতে থাকে, জগতের সব রং সুন্দর, শুধু নিজের শরীরের সাথে কোনটা কখন মানায়, এ বুঝে নেয়াই বড় ব্যাপার।

সে এসব শিখিয়ে কাছে এলো একসময় মনে হলো, তার বুঝিবা প্রেমও হলো,শুভ আওরাত, আমি তোমাকে রেখে গেলাম ঈশ্বরের হাতে... বিহবল রু শুভকে বুঝে উঠতে পারত না কখনও। টিউশনি থেকে ফিরতে ফিরতে নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্ত বোধ করত, আর মনে হতো, শুভ তাকে করুণা করছে না তো?

আমি এগিয়েছি তোমার রোদের দিকে অথবা তুমি আলো হয়ে জড়িয়েছ আমাকে, আমি ঢুকে গেছি তোমার আত্মায় অথবা তুমি প্রাণ হয়ে ভিজিয়েছ আমাকে, আমি... থামো, বলতো রু, তোমার হেঁয়ালি নিতে পারছি না।

হা হা,আসলে তুমি আমাকে বুঝতেই পারো না... এমন আলোছায়া বোধের মধ্যেই সহসা একদিন শুভ হারিয়ে গেল।

সে হারিয়ে গেলে রু নিজেকে কামড়ে কিছুদিন থেমে থামলেও ফের দারুণ এক জেদে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে শুরু করে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিনরাত লেগে থাকে, কীভাবে কম দামের কাপড়ে কী কী সুন্দর নির্মাণ করা যায়, কোন রঙের সাথে কোনটা ঠিকঠাক মানায়... এর মধ্যেও তার জীবনে কত যে মানুষ এলো, কত রকমভাবে। চলেও গেল।

এভাবে পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে একেবারে সে যখন দুর্দান্ত রেজাল্ট খারাপ করে, বিছানায় মা ভাষা হারিয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। বোনগুলো এক এক করে বিভিন্ন পথে চলে যেতে শুরু করে... সে দিকভ্রান্ত বোধে পাগল পাগল অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়, কিন্তু যেভাবেই হোক প্রাণের ওড়না দিয়ে বোনদের আটকায়।

পরক্ষণেই মনে হতে থাকে, শুভ তার সাথে এমন আচরণ করতে পারল? তার মানে তার অবয়বে দরিদ্রতার, রুচিহীনতার যে ছাপ লেগে থাকে, শুভ মন থেকে তা গ্রহণ করতে পারেনি। অন্য সবার মতো?

রেজাল্টের পরে যেন তার হুঁশ ফেরে। ফের সিলিং ফ্যান যত এগোচ্ছে, সে ততই নিজেকে শক্ত করে যখন দাঁড়াচ্ছে, হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে।

রিসিভারে কান পাততেই সেই কণ্ঠ, রু, আমি তোমাকে রেখে গেছি ঈশ্বরের...

তার সারা শরীর প্রথমে হীম পরে যেন রক্ত ছেড়ে দেয়, বলে তুমি? জানো...

এখনো তোতলাও?
কাঁপতে কাঁপতে রীতিমতো আছড়ে পড়ে বলে সে, তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? জানো, আমি... আমি সবুজের সাথে হলুদ, মেরুনের সাথে কালো, মানে কত যে রং শিখেছি, কিন্তু...
দরকার নেই রু, আমি রোজ দেখেছি তোমাকে। তুমি কোনো দিন বোঝোনি, তোমার যুদ্ধটাকে কত সম্মান করি আমি।

যদি প্রেম বিশ্বাস এসব না থাকতো, তবে পৃথিবী জন্মের অর্থ কী? কিন্তু ভাবিনি, এসব করতে গিয়ে রেজাল্টটা... যেন ঘনছায়া, যেন প্রচ্ছায়া আলোছায়ার রূপ নেয়, শীত এত মিষ্টি, গায়ে সোয়েটার টানে, বুদবুদ ওঠে সমস্ত অস্তিত্ব তরঙ্গে, সে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে ভাবে, রেজাল্ট, এ আর এমন কী? হয়ে যাবে...