নাসরীন জাহানের গল্প ‘প্রথম শান্তিনিকেতন’

প্রকাশিত : মার্চ ২৪, ২০২৪

সেই প্রথম কলকাতা যাওয়া। চারপাশের ধূপের গন্ধ। অন্য এক দেশের গন্ধে কেমন যেন বিমোহিত বোধ করছিলাম। শপিং করতে যাবে? আহা! যেন কত টাকা আছে আমাদের! বাদ দাও,পরে দেখা যাবে। ফিরে এসে স্ট্রিটফুড খাব।

ইট রঙের নিউমার্কেটের পাশের সস্তা হোটেলে উঠে পরিচ্ছন্ন বিছানায় নিজেদের নিয়ে যাওয়া নতুন চাদর বিছিয়ে দিয়ে বকুলকে বলি, দারুণ লাগছে। কাল ক’টার ট্রেন?

বকুলও আমাকে নতুন জায়গায় নতুনভাবে পেয়ে একেবারে পাগলের মতো জড়িয়ে বলে, আপনার ভাবতে হবে না। এ আমার ডিপার্টমেন্ট।

টেক্সিতে হাওড়া যেতে যেতেই দুজনের তর্ক শুরু হয়। বকুল হঠাৎ বলে, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তোমার আদিখ্যেতার কারণেই শান্তিনিকেতন যাচ্ছি, নইলে আমি মন্দারমণি যেতাম।

আমি চুপ করে থাকি। এবং তাজ্জব বোধ করি, আশ্চর্য! আর আগে বকুল এ কথা একবারও বলেনি আমাকে। বলতে বলতে ভেতরে ভয় জমতে থাকে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের এই মানুষটাকে বিয়ে করে ভুল করিনি তো?

মন্দারমণি? কই? আগে তো বলোনি? পুরো স্টেশনে রাজ্যির মানুষ গিজগিজ করছে। ওপর থেকে ধেয়ে নামছে গরম, আর প্রভাতের ছায়া মুছে যেতে থাকছে নানা রকম কাউ কাউয়ে।

ট্রেনের দিকে ছুটতে ছুটতে বলে, দীঘা এখন মাছের বাজার হয়ে গেছে, মন্দারমণির বীচ বালুর নয়, মাটির, চারপাশের আবহ খুব সুন্দর আমার এক বন্ধু বলছিল, আসলে সমুদ্র আমার খুব প্রিয়।

হতভম্ব আমি গলা উঁচাই, এ কথাটা তুমি একবার আমাকে বলতে পারলে না? কীভাবে বলি? নতুন বউ এত শান্তিনিকেতন করছে, মরা মানুষের ছায়া যেখানে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে যেতে কেন যে আগ্রহ এত তোমাদের, তাও যদি রবী ঠাকুরের সাথে দেখা করার ব্যাপার থাকত।

ট্রেন চলছে,আর তর্ক চলছে, বকুল বলেই যাচ্ছে,আসলে তোমাকে খুশি করার জন্য তোমার স্বপ্নের জায়গায় যেতে রাজি হয়েছি।

ফের ভয়ে পুঞ্জিভূত বোধ করে ট্রেন থেকে দুজন নামি। স্টেশন পেরিয়ে ছায়াচ্ছন্ন শান্তি নিকেতনের হাউসে যেতে রিকশায় উঠি।

চারপাশের পরিবেশ দেখে মনে হয়, প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে যেন রবীন্দ্রনাথ বাস করছে। প্রচুর স্টুডেন্টের মধ্যেও কী অদ্ভুত ভদ্রতাবোধের চলাফেরা।

ভিড়ের মধ্যেও শান্ত প্রচ্ছায়া আমি যখন চারপাশ দেখি, ততো বকুলের রাগ, এমন হ্যাবলার মতো চারপাশ দেখার কী আছে?

আমাদের কথা ছাপিয়ে কে যেন বলে যেতে থাকে, দেখুন এ পাশে কলাভবন, শিল্পভবনও আছে।

তুমি মন্দারণির কথা কেন আগে আমাকে বলো নি? যেন আর্তনাদ করে উঠি, কে যেন বলতে থাকে, সোনা ঝুরির হাটে যেতে হয় লালমাটির পথ পেরিয়ে, অনেক সুন্দর সুতোর কাজের জিনিস পাওয়া যায়, বকুলের যেন হুঁশ হয়, সে রিক্সাওয়ালাকে ধমক দেয়,
তুমি এত কথা বলছ কেন,আমরা জানতে চেয়েছি?

আমাদের তর্কের মধ্যে প্রচণ্ড ভদ্রভাবে উচ্চকিত হয়, রিক্সাওয়ালার কন্ঠ, আপনারা দেখছি কিছুই দেখতে আসেননি, এই যে বায়ে ছাতিমতলা রবীঠাকুর এখানে বসে ছাত্রদের পড়াতেন।

আমি বায়ে তাকাতেই কী বুঝে বকুল চুপ হয়ে যায়,আমার চোখ ভিজে উঠতে থাকে, রিক্সাওয়ালা বলে, বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বুঝছি,জীবনে ঝগড়া করার অনেক সূযোগ পাবেন দাদা,শান্তি নিকেতনে আর আসতে পারবেন কীনা,তা আপনারা নিশ্চিত করে
জানেন?

আহা! আমাদের হানিমুন! বকুল আমার হাত মুঠো করে যত ধরে, ততো ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি কান্নায় ভেসে যেতে থাকি।

(তিনবার শান্তি নিকেতন গিয়েছি আমরা)। আমাদের প্রথমবার শান্তি নিকেতনে যাওয়ার অভিজ্ঞতার ছায়ায় লেখা এই গল্প। গল্পের তর্কের সাথে আমাদের তর্কের মিল নেই। তর্ক ছিলো অন্য বিষয় নিয়ে।

আমাদের দুজনেরই শান্তি নিকেতনে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। ভ্রমণও অপার্থিব ছিলো। কিন্তু রিকশাওয়ালার কথোপকথন শতভাগ সত্য ছিল।