নাসরীন জাহান

নাসরীন জাহান

নাসরীন জাহানের গল্প ‘যখন বেজে ওঠে’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০২৪

আঙুল নড়ছে না, যেদিন তুমি এপ্রিলের তীব্র রৌদ্রে আমার বুক বরাবর ছুড়ে দিলে সূর্য, আমার হাত বোবা হয়ে গেল। কন্ঠ থেকে সুর বাষ্প হয়ে উড়ে উড়ে উড়ে গেল।

ফিসফিস স্ফিনিক্স পাখি বললো,, আমি আছি। দশতলায় উঠে ঝাঁপ দিই। কিন্তু শরীর নড়ে না। কেউ সুন্দর স্মৃতি ফেলে চলে গেলে তাকে ভোলা কঠিন। তাকে ঘৃণা করা কঠিন, ঘৃণা ছাড়া তাকে ভুলে যাওয়া কঠিন।

দিনরাত বিপন্ন সংসারে নিশ্চল দেহমন নিয়ে অফিসে যাই, ফিরে এসে অসুস্থ তোষকে গা পেতে ময়লা সিলিং ফ্যানকে চুপ থাকতে দেখি।

এদিকে গরমে যত ভিজে যাচ্ছি, ততো পাশের ঘরে হাউকাউ, ভাই বলে আলু আর বেগুন ভাজি আর কত? মা বলে, কামাই কর, পরে এইসব ক, বোন বলে জন্ম দিছ ক্যান?

গুরুজি হারিয়ে যাওয়ার পরে আমার জীবনের সর্বনাশ আমাকে ছাড়ছেই না। গীর্জার পাশের ইশকুলে কী সুন্দর ছাত্রদের পিয়ানো শেখাতেন গুরুজি। আমি জানালা দিয়ে লুকিয়ে দেখতাম, আমার সমস্ত লোমকূপে অদ্ভুত শিহরণ ঘুরতে থাকত।
এরপর গুরুজি আমাকে লক্ষ্য করে নিয়ে গেলেন ক্লাসে বিনে পয়সায় পিয়ানো শিখালেন, একদিন দেখি,আমার ঘরে গুরুজির পিয়ানো, আমাকে দিয়ে গুরুজি হারিয়ে গেলেন।

গুরুজির মাথাভর্তি ছিল চুলগাছ,অদ্ভুত এক বিমোহন সৃষ্টি করতে পারতেন তিনি। একদিন শুনি গুরুজি নিজের দেহ দান করে চূড়ান্ত অনন্তে চলে গেছেন।

একটা চিরকুট আসে, রু তুমি কিচ্ছুর বিনিময়ে পিয়ানো ছেড়ো না। সবার সব ক্ষমতা থাকে না। তুমি জাতশিল্পী। পিয়ানো ছেড়ো না। হতভম্ব হয়ে বসে থাকি। এদিকে বাড়ির অবস্থা করুণ।

বাবা বলে, তোরে কে কইছিল, কেরানির ঘরে জন্ম নিতে? অতই অসহ্য যদি ধনী পরিবারে আইতি? আমি চাইছি? বোন ফুস্কে ওঠে, যোগ্যতা নাই, তো সেক্স করছ ক্যান? বাবা বলে, আরেকটা পোলার জন্য, তোরে আমরা চাইছি? তুই নিজের ইচ্ছায় আইছস।

পোলা! তোমার ভাইয়ের পোলা বাপের সব প্রপার্টি নিয়ে বউকে নিয়া দেশের বাইরে গিয়ে খবর নিছে কারোর? এরপরেও পোলা পোলা,, শরম করে না?

ফ্যান ছেড়ে দিই। ঘাম শুকানো বাস্তবতায় ফোন আসে, ভালো আছ? আগে হলে গা জ্বলে যেত, এবার উল্টোবাজির ঝিঁঝি
লেগে যায়। জানার ওপারে দিন নাকি রাত্রির অপরাহ্ন ঠাহর করতে পারি না।

ভালো আছি কীনা। তুমি কেন যে নাছোড়বান্দার মতো আমার প্রেমে পড়েছিলে, কে জানে? তোমার টানে পড়ে বুদ্ধু আমার
ভেতরও শিহরণ সৃষ্টি হল। আমরা ক্যাফেতে, প্রকৃতিতে দেখা করতাম। একদিন তোমার বাড়িতে ডাকলে। তাজ্জব লেগেছিল,
এরমধ্যেই বাবা মার সাথে দেখা করাতে চাইছ?

বললাম, ভয় করছে, বললে, আরে ধুর, সারপ্রাইজ! পুরো বাড়ি শূন্য। হা হা হেসে বললে, সবাই বাড়ি গেছে, তুমি নিশ্চয়ই পুরানা আমলের মতো সতীত্বে বিশ্বাস রাখ না? আমি তেজে বললাম, তুমি জানো, আমি ভার্জিন নই। ওহ হো, তোমার সেই চাচার করা এক্সিডেন্ট?

প্লিজ, চুপ। কাউকে কেন কিছু জানাওনি পিয়ানো কন্যা? আমাকে আমূল জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলো, কারণ, সেদিনই চাচা স্ট্রোক করে মারা গেছিলেন।

যখন তোমার স্পর্শে আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিশেহারা, তুমি বললে, ভাগ্যিস, তোমাকে বিয়ে করিনি, নয় এই বাসী শরীর দিয়ে বাসর রাত হতো।
আমি বিছানা থেকে উঠে বসি, চলো, আমরা অনেক দূরের বনে যাই, যেখানে পাহাড়ের ওপরে অনেক অজগর আর আর রাক্ষস মিলে আসমান থেকে রঙধুনুর রস টেনে জড়াজড়ি, হুড়োহুড়ি করে আর,,,

চুপ! মাথা থাইকা লেখার ভূত যায় নাই? হেসে উঠি, আসো, বুকে আসো, আরও আসো, আরও,, ফোন কেটে দেয়।
আমি ফের বিছানায় শুয়ে হাসতে হাসতে কাঁদতে শুরু করি।

ফিনিক্স ফের বলে ওঠে, আমি আছি। শুনতে পাইনি শব্দ। ফলে হাসপাতালে। রাজ্যির চিকিৎসা। কিন্তু হাসি ফুরিয়ে যাওয়া আমার অনুভব থেকে সমস্ত বাজনের বিষয় আধমরা বাদুড়ের মতো আমার রাত্রির গ্রন্থিতে ঝুলতে শুরু করল।

মিডিয়ায় তোলপাড়, ফুরিয়ে গেছেন সুরশ্রষ্টা। আর আমি নিথর বিছানায় হয়ে নিশ্চল পড়ে থাকি, চারপাশে ঘুরতে থাকে, খচ্চরের পিঠে চড়া বৃষ্টি আর আঁধার ফেরিওয়ালা।

এইভাবে দিনরাত যাচ্ছিল। মা বলেন,আর পারতাছি না,হয় তুই চাকরি ঠিক রাখ, নয় বিয়া কর। একটা সংসারে তিনজন পোলা
মাইয়া নিয়া আমি আর পারতাছি না।

মার কোলে পিচ্চি পোলাকে দোল খেতে দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যায়, বলি, লজ্জা লাগে না? সামর্থ নাই, একটার পরে একটা বাচ্চা পয়দা দেয়ার? আমারে আমার মতো থাকতে দেও, নইলে আরও খারাপ কথা কমু।

মনোচিকিৎসক বলেন,জোরে চিতকার করুন, ঘৃণা করুন তাকে, যাকে ভালোবেসেছিলেন,ছাদে উঠে গালি দিন,যা ভেতরে আসে উগড়ে দিন। নিজেকে সামলে আমার মা ভাবলেশহীন।

এরপর আমার কেনা পুরোন হারমোনিয়ামে, গীটার আর সমস্ত বাজনের সামনে নিয়ে যান, যেসব ছাড়া আমার কোন জীবন ছিলো না।

মেঘহীন ধূ-ধূ খরা আসমানের মতো।

ফের ফিনিক্সের ফিসফিস, আছি,,, এক এক করে এসব বাজন বিক্রি হতে থাকে।

আর আমি একদিন সমস্ত কাপড় খুলে পুরোবাড়ি ঘুরতে ঘুরতে যখন অনুভব করছিলাম,জগতের কোন প্রাণী নিজেকে
ঢাকতে কোন কাপড় পরে না,আমি অসুস্থ, তাই পরছি।

এরপর নিজেকে দেখতে পাই,একটা মনো হাসপাতালে। বাড়ি যেন ছিল আমার কারাগারের মতো।
এখানে একটার পরে একটা ছিমছাম বিছানা পাতা।

কিন্তু বেশিরভাগ বিছানায় কেউ নেই। রাত বাড়তে থাকে আর আমি হাঁটতে শুরু করি। দেখি,একেকটা কক্ষে একেকটা নানা রকম অঙ্গভংগি করছে। কেউ বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছে।

আসলে মনো সমস্যা হলেও আমি একেবারে চুপ হয়ে গেছিলাম। ফলে, ওরা আমাকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়েছিল।
একেবারে জাতে মাতাল তালের মতো, সব মনে ছিলো।

সেখানে একজন জানিনা কী কারণে যে উপুড় হয়ে কাঁদছিল, তাকে মনের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল। এরপর প্রতিটি কক্ষে গিয়ে বাজনহীন গান গেয়ে, আমূল ভালোবেসে বেসে যখন বিছানায় ফিরে আসি,
তখন ভোর হয়ে গেছে।

শুনতে পাই, মার কন্ঠ,তারা বলছে,আপনার কন্যা একেবারেই অসুস্থ নয়, সে এক রাতে আমাদের অনেক পেসেন্টদের পজেটিভলি বদলে দিয়েছে।

গীর্জার গুরুজি আমাকে পিয়ানো উপহার না দিলে কীভাবে কিনতাম এটা? আমার রক্তে পিয়ানো, এ একমাত্র গুরুজিই বুঝেছিলেন।

একসময় এ ফকিরের পোষা হয়ে হাতীর খরচের পোহাতে না পারলে, যখন পিয়ানো বিক্রির প্রশ্ন আসে, আমি আমূল জড়িয়ে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গেলে, মা সেটাকে কীভাবে আগলে বাঁচিয়েছে, আল্লাহ জানে। বাড়ি ফিরে আসি। বাড়িতে অনেকদিন পরে মাংস রান্না হয়, বহুদিন পরে বাবা এসে আমার পাশে বসেন।

আমি সহসা কথা বলতে পারি না। বাবা বলেন, যে যত অসত উপার্জন করে, লাখ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে সন্তান মানুষ করে, আসলে তারাই ভালো।

কী মনে হয় তোমার? চারপাশে যেন ঝিঁঝি ডাকে। বদ্ধ চারদেয়ালের স্তব্ধতার বাতাস আমাকে বিমূঢ় করে তোলে।
আমরা যারা পারি না, ঘুষ নিতে,আমাদের লাত্থি দিয়ে চলে কোটি টাকা কামাই করা পিওনেরা, তোমার কী মনে হয়,
এরা ধর্মে বিশ্বাস করে? পরকালে বিশ্বাস করে?

আমি বাবাকে আঁকড়ে ধরি, এসব তো আমাদের মতো মানুষের টাকাতেই হয়। শ্রমিকদের ঘাম রক্তের টাকায় হয়,
সরকারি পিওনের কাছে কোন হেল্প চাইলে এরা রাজা হয়ে ফকিরের মতো হাত পাতে,, বাবা বলেন হুম, রাজা হয়েও নয়,রাজার মতো, অবশ্যই, আমাদের টেক্সের টাকায় একজন পিওনও রাজা, আর ওদের বসদের কথা ভাবো? বলতে বলতে
বাবা, চুপ হয়ে যান, চারপাশে প্রচ্ছায়া ঘুরতে থাকে, আর প্রচন্ড গরমের ভাপে একটা টুনি ঘরে আমরা
সেদ্ধ হতে থাকি, বাবার মুখে অপরাধ বোধ,তোর শিল্পটা হলো না,আমাদের জীবনে পুড়তে পুড়তে।

প্লিজ বাবা, এ নিয়ে কষ্ট পেয়ো না, আমি নিজেই ব্যর্থ, পিয়ানোর নেশায় ঠিকঠাক পড়াশোনা শেষ করতে পারিনি,বলে একটা লম্বা নিশ্বাস নিই,চিন্তা করো না, আমি এইবার অনার্স ফাইনাল দিয়ে তোমাদের দেখিয়ে দেব, আমি অকম্মার ধাড়ি নই।
ফের ছায়া,,রোদ নিভতে থাকে,বাবা বলে, টাকা?

অস্ফুটে বলি,আমি দুটো টুইশনি নিয়েছি। এইভাবে যখন সব যত ঠিক চলে ততো তোমার তাচ্ছিল্য মনে পড়ে যতো, ততো অদ্ভুত এক শক্তি রঙিণ বুদবুদ হয়ে আমাকে তোমার বিরুদ্ধে খাড়া করায়।

কিন্তু ভেতর বেদনা আমার জীবন অসহ্য করে তোলে। এইভাবে দিন যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে অনুভব করেছি, তোমার সাথে বিচ্ছেদেও আমি তোমার কাছে যত সুন্দর থাকতে চাইব,ততো তোমার তাচ্ছিল্য ভুলতে পারব না, ফলে হঠাৎ তোমাকে ফোন দিই,যেই তুমি বিরক্তিভরা কন্ঠে হ্যালো বলেছ,তক্ষুনি চিতকার করে বলতে শুরু করলাম,এই ফকিন্নীর পুত,কুত্তার বাচ্চা নিজেকে
কী মনে করেছিস তুই, হারামী,,,

এরপর অনেকদিন কেটে যায়। আমার ভেতরটা যত হালকা হতে থাকে,ততো আমার সামনে পিয়ানো
এসে দাঁড়ায়। আমি হুহু করে কাঁদতে থাকি।

এরমধ্যে ইউটিউবে আমার আগে বাজানো পিয়ানোর ভিডিও দেখে দেশের বাইরে থাকা একজন ধনী লোক, যিনি কীনা আবার শিল্পপিপাসু, আমাকে ফোন দিয়ে আমার একটা একক অনুষ্ঠানের স্পন্সর হতে
আগ্রহ প্রকাশ করেন।

তখন মনে হয়, আরও কুতসিত গালি দিই তোমাকে। আমার প্রতি তোমার তীব্র ঘৃণা হোক, আমারও
তোমার প্রতি। এ ছাড়া বিচ্ছেদ অসম্ভব।

সেই ধনী স্পনসর বলেন, আমি জলদি দেশে আসছি। তুমুল বিলোড়ন ভেতরে উঠলেও কল্পনা করিনি,
মঞ্চে এসে আমি হতভম্ব বোধ করব।

আঙুল নড়ছে না। সামনে শত দর্শক, শ্রোতা। অবশ্য তখন তুমি লাত্থি খেয়ে আমার পায়ের কাছে
এসে বসেছ। এবার খচ্ছর তোমার পিঠে চড়ে আমি মাফলার উড়াই, ধীরে ধীরে তুমি নিচে গড়িয়ে পড়ো,, কিন্তু সুর আসে না।
এইভাবে ভালোবাসাহীন আমি রিহার্সালহীন নিজেকে পুরো শেষ করে দিতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে, আমি জনারণ্যের সামনে
আলোকিত মঞ্চে পিয়ানোর সামনে দাঁড়াই।

কিন্তু চারপাশে যত কোলাহল ততো অনুভব করি স্থবির হয়ে যাচ্ছি আমি,,, আঙুল নড়ছে না।

মার চোখ গড়িয়ে জল সীমাহীন। যেন প্রাণ উড়ে উড়ে উড়ে যা,, ফের ফিনিক্স পাখির শব্দ।

এবার শুনতে পাওয়ার সাথে সাথে পিয়ানোহীন মঞ্চে অনুভব করি, অপুর্ব সুর আর করতালির মূর্ছনা। এ ভ্রম! কিন্তু ধীরে ধীরে টের পাই, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে কেউ।

অনুভব করি, আমার দশ আঙুল যেন বা একশো আঙুল হয়ে যায়। ঘাড় ঘোরাই, গুরুজি! পুরো হল অদ্ভুত সুন্দর কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে। কেবল আমি অনুভব করি, কেউ আমার পিয়ানো আমার আঙুল দিয়ে কেউ বাজিয়ে উঠেছে।