
ছবি: সুস্মিতা দাশ অনুরাধা
নিতির গল্প
উপন্যাস ১
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : এপ্রিল ২৭, ২০২০
হঠাৎ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে নিতি কেঁপে উঠল। মাথা ঘুরিয়ে দীপের দিকে হাঁ করে চেয়ে থকল। দীপ চোখেমুখে হাসছে। সে হাসির মধ্যে কেমন একটা নির্লজ্জ ভাব আছে। ভয় আছে। আতঙ্ক আছে। শঙ্কা আছে। আর আছে অবিশ্বাস। নির্জন পথে কুড়িয়ে পাওয়া গয়নার বাকসো দেখে মানুষের মুখ যেমন হয়, দীপের মুখটা তেমন লাগছে। অচেনা সাপ পথের সামনে দাঁড়ালে মানুষের মুখে যে আতঙ্কের ছাপ পড়ে, নিতির মুখে সেই ছাপ।
নিস্তব্ধ দুপুর। শুক্রবার। পাশেই মসজিদ। জুমার নামাজ শেষে কয়েকশো মুসল্লি কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। মুয়াজ্জিন মসজিদের দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেল। পাশের বাড়ির দুইতলার বারান্দায় একটা কিশোরী মেয়ে এসে দাঁড়াল। সদ্য স্নান সেরেছে। খোলাচুল। ভেজা টাওয়েল টাঙানো দড়িতে শুকাতে দিয়ে আবার ভিতরে চলে গেল।
দু`একটা রিক্সার শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু দূরে বড় রাস্তা। সেখান থেকে ভেসে আসছে গাড়ির হর্নের আওয়াজ। বাসাটি পাঁচতলা। সরকারি কোয়ার্টার। সিভিল অ্যাভিয়েশনের। জায়গাটির নাম কাওলা। নিতি এই প্রথম এখানে এসেছে। দীপের মামা এয়ারপোর্টে চাকরি করে। স্বপরিবারে সিঙ্গাপুর বেড়াতে গেছে। ফিরবে সাতদিন পর। দীপ ভার্সিটির হলে থাকে। মামার অনুরোধে গতকাল থেকে এখানে আছে। নিরাপত্তার ঘাটতি নেই। নিচে চব্বিশ ঘণ্টা সিকিউরিটি থাকে। তবুও মামা ভরসা পান না। কোথাও গেলে দীপকে রেখে যান।
নিতি একটা সিঙ্গেল সোপায় বসে আছে। দীপ পাশের সোপাটাতে বসল। নিতি অন্যমনস্ক। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল, ওদেরকে অ্যাপার্টমেন্টের গেট খুল দেবার সময় আড়চোখে সিকিউরিটি ছেলেটা নিতিকে দেখছিল। কৌতুক মেশান দৃষ্টি। বেহায়া নয়, তবে স্বাভাবিকও নয়। দীপ ছেলেটার হাতে পাঁচশো টাকার একটা নোট গুজে দিল। ছেলেটি লজ্জা পেয়ে হেসে কিছুক্ষণ না না বলল। এরপর মুখ নিচু করে পকেটে টাকাটা ঢুকিয়ে রাখল।
ঘরে এসি চলচে। দীপ আগে থেকেই চালিয়ে রেখেছিল। জানালার পর্দা দেওয়া। টিউব লাইট জ্বলছে। টিভিটা অন করা। মিউট পজিশানে আছে। দীপ রিমোট হাতে তুলে নিল। এরপর নিতিকে বলল, জল খাবে? নিতি ঘাড় নাড়িয়ে না জানাল। নিতির একটু শীত শীত লাগছে। টিকটিকি টিক টিক করে ডেকে উঠল। এখানে আসতে কাওলা নেমেছিল নিতি। এসি বাস। ইডেনের সামনে থেকে উঠেছে। কন্ডাকটর কাওলা নামাবে না। স্টপেজ নেই। বিস্তার কথা খরচের পর রাজি হলো। প্যাসেঞ্জারদের অনুকম্পা ছিল। না হলে এয়ারপোর্টে থেকে আসতে হতো। সেটা অনেক ঝঞ্ঝাট।
নিতি ওভারব্রীজ পার হয়ে এপারে নামতেই দীপকে দেখতে পায়। এরপর একটা রিক্সা নিয়ে এই অ্যাপার্টমেন্টে। বেশি দূরের পথ নয়। এর আগেও নিতি দীপের রিক্সায় উঠেছে। তখন এমন মনে হয়নি। আজ নিতিকে ভয়ে পেয়েছে। কেউ যেন দেখছে। কেউ কিছু শুনছে। সারাক্ষণ নিতির আতঙ্কিত চোখ যেন সেটাই দেখছে। উৎকর্ণ যেন সেই শব্দই শুনছে।
দীপ আবার কথা বলে উঠল, খারাপ লাগছে? নিতি এবারও কিছু বলল না। ঘাড় নাড়িয়ে না সূচক ইঙ্গিত করল। নিতির এখানে এক সপ্তাহ থাকার কথা। দীপের সাথে তেমনি কথা হয়েছে। নিতি ইডেনের ছাত্রী। হোস্টেলে থাকে। বাড়ি মাগুরার মোহম্মদপুর। দীপের বাড়ি যশোরের বেজপাড়া। অ্যাডমিশন কোচিং থেকে পরিচয়। দুজনেই একই ব্যাচের। দীপের ঢাবিতে চাঞ্চ হয়েছে। নিতির হয়নি। নিতির প্রথম প্রথম এ নিয়ে খুব মনকষ্টে ছিল। দীপের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার পর আর নেই।
দীপ প্রায়ই নিতির হাতের রান্না খেতে পায়। মেয়েরা যাকে ভালোবাসে, তার জন্য একটু রাঁধে। না রাঁধলে নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয়। বেমানান লাগে। মেয়েদের ভালোবাসা প্রকাশের এটা চিরন্তন দিক। টিএসসিতে দুজন আড্ডা দেয়। সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখে। বসুন্ধরায়, গাউসিয়ায় সপিং করে। সব স্বাভাবিক। কিছুতেই কিছু মনে হয়নি। আজ হচ্ছে। নিতি ভেতর থেকে দুর্বলতা টের পাচ্ছে। বাস থেকে নামার পরই ওর পা সরছিল না। বহু কষ্টে, সময় নিয়ে ওভারব্রিজ পার হয়েছে।
নিতির সপ্রতিভ মুখে গ্রীষ্মের দুপুরের মেঘের ছায়া। গাঢ় ও স্পষ্ট। দীপ উৎফুল্ল। যেন লটারির টিকিট পেয়েছে। কোথা থেকে আইসক্রিমের কাপ নিয়ে এসে নিতির হাতে ধরিয়ে দিল। নিতি নিঃশব্দে টেবিলের কাচের উপর নামিয়ে রাখল। দীপ আবার বলে উঠল, ফ্রেশ হবে? আইসক্রিম তুলে রাখব? ফ্ল্যাটে তিনটা ওয়াশরুম আছে, তুমি যেটা ইচ্ছে ইউস করতে পারো। বকবক করে দীপ বেশ কটা কথা বলে ফেলল। নিতি তবুও নিশ্চুপ।
হল থেকে আসার সময় বাড়ি যাচ্ছে বলে এসেছে। হাতে ছোট একটা ব্যাগও নিয়েছিল। তাতে টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস। মেয়েরা খালি হাতে কোথাও যেতে পারে না। এটা মেয়েদের নিয়ম বিরুদ্ধ। নিতিও সে নিয়ম ভাঙেনি। তারপর বেশ ক’দিনের ব্যাপার! আবার কি সে হলে ফিরে যাবে? নিতি কিছু ভাবতে পারছে না। ব্যাপারটা বড্ড ভাবাচ্ছে তাকে। গা ছমছম করছে। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড বোকা মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে বড্ড খারাপ মনে হচ্ছে। একটা অদ্ভুত দোটানায় নিতির মন বিষণ্ণ হয়ে উঠছে।
দীপের সেদিকে খেয়াল নেই। দীপ রিমোটটা আবার তুলে নিল। চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। কোন তাড়াহুড়ো নেই। উদ্বেগ নেই। মনের মধ্যে বসন্তের বাতাস। কোকিলের ডাক। সাতদিন নিতি এখানে থাকবে। ভেবেই দীপের অবিশ্বাস্য লাগছে!
গতকাল বিস্তর টাকা খরচ করে অনেক প্রস্তুতি নিয়েছে। কিছু ঔষধ। ইউএন্ডমি এক ডজন। ইমকন চারটা। পাঁচ রোল টিস্যু। সাত লিটার প্রাণের ইউএইচটি দুধ। ডাবর হানির মাঝারি বোতল। সোলা। হামদার্দের সিনকারা। পাঁচকেজি খাসির মাংস। এক কেজ ডিম। কোকের ক্যান বারোটা। বিয়ার দশটা। পাঁচ প্যাকেট ব্যানসন আর যা যা দরকার হতে পারে। এলাহী ব্যাপার।
নিতি এসবের অনেককিছুই জানে, অনেককিছুই জানে না। সব বুঝতে পারছে। কেন এসেছে? কি করতে হবে? সব। বুঝেশুনে, বিস্তার আলাপ-আলোচনা, মান-অভিমান, অনেক পরিকল্পনা সেরেই এখানে এসেছে। নিতি মডার্ন মেয়ে। জিন্স টপ্স পরে। সিগারেট টানে। বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেয়। ফেসবুকে সাবলীল। নিতির ছবির নিচে কিছু কমেন্টস আসে— সো হট, সো কিউট, সেক্সি ডল। নিতি সেসব কমেন্টস্ ডিলিট করে না।
বিয়েতে আগ্রহ কম। বন্ধুমহলে সবাই দীপ-নিতিকে গুড কাপল হিসাবে চেনে। দু`জনেই গুড লুকিং। সব ঠিকঠাক। কিন্তু নিতির কোথায় যেন কি একটা বাধা দিচ্ছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট নিতি সোপায় বসে থেকে ভিতরের দিকে চলে গেল। দীপকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। কোন দিকে তাকাল না। সোজা মাস্টারবেডে। খাটের উপর হাতব্যাগটি রাখল। ছোট কাপড়ের ব্যাগ ড্রইংরুমেই রয়ে গেল।
এই নির্জন দুপুরে কেউ তাদের কিছু বলতে আসছে না। কেউ তাদের পথে বাধা দেয়নি। কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। দু`জনেই এমন দুপুর, এমন বাসা, এমন দিন-রজনী চেয়েছিল। বহুদিনের অপেক্ষা। আজ সত্য হতে চলেছে। তবে কিসের বাধা? কিসের দ্বিধা? কিসের সঙ্কোচ? আর জড়তায় বা কিসের! দুটি তরুণ-তরুণী। যাদের ঠোঁটজোড়া গোলাপি। যাদের মুখের চামরা চকচক করে রোদে। প্রথম যৌবনের ঐশ্বর্য সাতমহলা বাড়ির সৌন্দর্য নিয়ে যাদের দেহ-মনে এসে ধরা দিয়েছে। তাদের কিসের ভ্রুকুটি?
নিতির মন সাইনওয়েভের মতো খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। একবার হাঁ, একবার না। নিতি ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে দিল। দরজা খুলতেই বড় আয়নায় নিতির মুখ দেখা যাচ্ছে। নিতি নিজেকে চিনতে পারছে, আবার ভুলেও যাচ্ছে। এমন হয় কখনো! নিজের মুখ নিজের কাছে অচেনা লাগে! নিতি ভয় পেয়ে গেল। বেসিনের ট্যাপ খুলে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিল। হঠাৎ একটা বিড়াল ম্যাঁউ করে স্বশব্দে ডেকে উঠল। নিতি উৎকর্ণ হলো। শরীর কেঁপে উঠল। এমন হচ্ছে কেন? নিতি কি তাহলে অসুস্থ হয়ে পড়ছে?
হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল। নিতি ভেজা মুখে খাটের পর এসে বসল। মাথাটা আবার চক্কর দিল। বিছানায় নিতির হালকা শরীর এলিয়ে পড়ল।
২৬ এপ্রিল ২০২০