অলংকরণ: ফাহমিদা জামান ফ্লোরা

অলংকরণ: ফাহমিদা জামান ফ্লোরা

নিতির গল্প

উপন্যাস ৪

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : এপ্রিল ৩০, ২০২০

বেশ কিছুক্ষণ ওরা ছাদের কার্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। কতক্ষণ, সেটা ঘড়ি ধরে বলা যাবে না। তবে সেই সময়ের মধ্যে আবার আকাশে একফালি চাঁদ দেখা দিল। যে মেঘদল এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছিল; সেই মেঘদল সরে মৃদু মৃদু জোছনা নেমে এলো। ওদের ক্লান্ত মন, নরম আলোয় ভিজিয়ে দিল। বিনা আমন্ত্রণে একগুচ্ছ হিমেল বাতাস এসে ওদেরকে ভাসিয়ে দিল।

নিতির চুল উড়ল। মনের মেঘ কেটে গেল। দীপের দীপ জ্বলল। মনের আঁধার সরে গেল। এতক্ষণ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ কারো হাত ধরল না। গুনগুন করে গানও গেয়ে উঠল না। শুধু নিতির দিকে তাকিয়ে দীপ বলল, যাবে এখন? নিতি দীপের চোখের দিকে চেয়ে বলল, চলো।

দুটি প্রাণ নিচে নেমে এল। তালা খোলা হলো। দুজনে ঘরে ঢুকল। ঘরের ছিটকিনি তোলা হলো। কিন্তু নতুন করে নতুন কোনও কথা বলা হলো না। দীপ কতটা আতঙ্কে ছিল, সেটা জানালো না। নিতিও জানতে চাইল না। নিস্তব্ধ খোলা ছাদে দীপের দীর্ঘনিশ্বাস সে কথা আগেই জানিয়েছিল। নিতি তার অর্থ বুঝতে পেরেছে। ব্যক্ত করেনি।

মানুষের মন যখন খেতে চায় না, তখন শরীরও মনের সাথে একাট্টা হয়। মন খেতে চাইলে, শরীরও প্রবল ভাবে ক্ষুধার্ত হয়। দুজনেই দীর্ঘ সময় ধরে অভুক্ত। কিছু খেতে হবে। ফ্ল্যাটে আসার পর নিতি এই প্রথম হেসে উঠল। মৃদু, কিন্তু সে হাসির তাৎপর্য অনেক।

হাসিমুখে দীপকে বলল, রাতের রান্না আছে? দীপ জানাল, না। নিতি মুখে হাসির রেখা অক্ষুণ্ণ রেখে বলল, চলো, কোথায় কি কি রেখেছ দেখাবে চলো।

নিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। দীপ কি একটু ভাবল, তারপর বলল, চলো, দেখবে চলো।
দুজন একসাথে কিচেনে এলো। একে অপরের সহযোগী হয়ে ডিম ভাজল। ভুনা খিচুড়ি রাঁধল। সালাদ তৈরি হলো। কিচেনের কাজ শেষ হলে দুজন ধরাধরি করে খাবার ডাইনিংয়ে নিয়ে এলো। সম্পূর্ণ আগের নিতি, আগের দীপ, পাশাপাশি চেয়ার টেনে খেতে বসল। বিস্তর হাসাহাসি করল। এরপর ঘুমাতে গেল।

না, একসাথে নয়। একসাথে, একখাটে, ঘুমানোর কথা ছিল। কিন্তু সেটা হলো না। নিতি মাস্টারবেডের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে, ব্রাশ করে ঘরে এলো। মশারির বাকি দুই প্রান্ত হুকের সাথে আটকে দিল। লাইট বন্ধ করে ঘুমাতে যাবে এমন সময় দীপ এলো। দীপের বাম হাতে একটা মাথার বালিশ। ডান হাতে স্মার্টফোন। দীপকে দেখে নিতি বলে উঠল, তুমি এ ঘরে ঘুমাও? দীপ বলল, না, গেস্ট রুমে।
তাহলে এখানে এলে যে?
একসাথে ঘুমাব বলে।
না, আজ বরং থাক। তুমি গেস্ট রুমেই যাও।
কেন?
এমনি।

দীপ কোনও কথা বলল না। নিতির কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে উঠছিল। দুপুরের মতো। নিঃশব্দে ঘরে থেকে বের হলো দীপ। দীপের মুখে বিস্ময়। নিতির মুখে দৃঢ়তা। দীপ চলে যাবার পর নিতি লাইট বন্ধ করে দিল। খাটে এলো। কিন্তু সহসাই ঘুম এলো না। এমনভাবে এর আগে কোথাও থাকেনি। বাড়ি, আত্মীয় বাড়ি, মেস ও হোস্টেল। এই চতুর্ভূজ গণ্ডির মধ্যে নিয়তির বাঁধা জীবন তার। বাবা-মা কিংবা বন্ধু, কারো সাথেই এই চার প্রকার আবাসের বাইরে নিতির রাত্রিযাপন করতে হয়নি।

এটা পঞ্চম কোনও আবাসস্থল। না বাড়ি, না আত্মীয় বাড়ি, না মেস, না হোস্টেল। এটা হোটেল বা রিসোর্টও নয়। কি নাম এটার? এর কি কোনও নাম নেই? একটা নামহীন, পরিচয়হীন, ঘরে একা রাত কাটাবে নিতি? পুরাতন সংস্কারে মেয়েদের দুটো বাড়ি ছিল। বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি। এ ধারণা বহু আগে ভেঙে গেছে। এখন নিতির পরিচয়, সে নিতি। সে একজন মানুষ। অনেকদিন ধরে এই পরিচয়, শুধুমাত্র এই পরিচয়টুকু সে বহন করে আসছে। আজ দুপুর থেকে তার পূর্ব পরিচয়, পূর্ব অভিজ্ঞতা যেন এক লহমায় ভেসে যাচ্ছে। প্রবল স্রোতে। সে ঠেকাতে পারছে না। অসহায় হয়ে যাচ্ছে।

এই নিদারুণ অসহায়ত্ব আজ দুপুর থেকে তাকে পীড়া দিচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে, নিতি তুমি মেয়ে, তুমি প্রেমিকা। একবার মনে হচ্ছে, নিতি তুমি মানুষ। এই দুই সত্তা তাকে বিপরীত দিক থেকে টানছে। নিতি পীড়িত হচ্ছে। ব্যথিত হচ্ছে। তবু কিছুই স্থির করতে পারছে না। এমন হাজারো বিক্ষিপ্ত প্রশ্ন, প্রশ্নোত্তরের ক্লান্তিতে নিতি কখন ঘুমিয়ে পড়ল, তা সে নিজেও বুঝতে পারল না।

২৯ এপ্রিল ২০২০