নিতির গল্প

উপন্যাস ১৪

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১০, ২০২০

খাটে এসে বসার পর রাধার ভয় ভেঙে গেল। স্যারের মুখের দিকে চেয়ে আছে সে। স্যারকে সৌমকান্তির মতো মনে হচ্ছে। অনেক বড় মনের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। যা কখনোই হয়নি। আজ তাই হলো। স্যারের সাথে অনেক গল্প হলো। বিস্তর হাসাহাসি হলো। মুড়ি-চানাচুর সমেত কোল্ডড্রিংস আবার খাওয়া হলো। এর কিছুক্ষণ পর রাধার মাথা ঢুলে ঢুলে পড়তে থাকল।

রাধা স্যারকে নেশা জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল, স্যার, আমার ঘুম পাচ্ছে যে!
স্যার রাধার কথা শুনে চেয়ার থেকে উঠল। রাধার পাশে এসে বসলো। রাধার দিকে স্নেহসুলভ দৃষ্টি দিয়ে বলল, শরীর খারাপ লাগছে রাধা?
রাধা অসহায়ের মতো অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ।

অন্যদিকে দীর্ঘক্ষণ পর দীপের সম্বিত ফিরে এলো। ট্রাউজার ভেজা ভেজা লাগছে। দীপ এভাবে আর থাকতে পারছে না। টাওয়েলটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হতে থাকল। নিজেকে কেমন যেন ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। অনেকক্ষণ সাওয়ারের নিচে থেকে, ডিটারজেন্ট দিয়ে টিশার্ট-ট্রাউজার ধুয়ে, গায়ে সুগন্ধি সাবান মেখে, দীপ যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো, ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

নিতি পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাগরিবের আজান শুনে ঘুম ভাঙল। শান্ত মনে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এরপর ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে কিচেনে এলো। দীপ হট কফি পছন্দ করে। নিতি দুজনের জন্য কফি রেডি করে দীপের ঘরে এলো। দীপের ভেজা চুল, সদ্য স্নান করেছে দেখে নিতি বলে উঠল, কি ব্যাপার, এই অবেলায় স্নান করলে যে?

দীপ, কথাটার যেন কোনও গুরুত্বই নেয়, এমনভাবে বলে উঠল, এমনি।
নিতি বিস্মিত হয়ে ফিরতি প্রশ্ন করল, এমনি?
দীপ নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ।

কফিতে চুমুক দেবার পর এই গম্ভীর পরিবেশটা আর থাকল না। কফির ক্যাফেইন দুজনকে চাঙা করে দিল। দুজন দীপের ঘরেই বসে কফি পান করতে করতে বিস্তর ঠাট্টা-মশকরায় ডুব দিল। এদিকে একটা বড় ঝাঁকুনি খেয়ে রাধার সংজ্ঞা ফিরল। চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে। যেন বিশ মন পাথর চাপা পড়েছে শরীরে। শরীর নড়াতে পারছে না। অনেক কষ্টে চোখ মেলে চাইল।

যা দেখল তাতে আবার সংজ্ঞাহীন হয়ে গেল। আবার একটা ঝাঁকুনি। আবার চোখ মেলল। রাধা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অবিশ্বাস্য! রাধা বিস্ময়ে বলে উঠল, স্যার! স্যার রাধার গায়ের উপর। রাধার গায়ে কোনও পোশাক নেই। রাধার বাক রুদ্ধ হয়ে এল। গলা শুকিয়ে স্বর বন্ধ হয়ে গেল। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরতে থাকল। শরীরে বল নেই। উঠে বসার মতো কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। ঠোঁটের এক কোনা কেটে রক্ত ঝরছে। সাড়া শরীরে লালচে কামড়ের দাগ।

স্যারের চোখে চোখ পড়তে স্যার হি হি করে দাঁত বের করে নির্লজ্জের মতো বলে উঠল, কি রাধারাণী, ঘুম ভাঙল?
প্রচণ্ড ঘৃণায় রাধার গা গুলিয়ে উঠল। এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারল না। কোনও কথা বলার মতো অবস্থায় নেই সে। ঘরে লাইট জ্বলছে। জোরে ফ্যান চলছে। তবুও ঘামছে স্যার। রাধা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে।

স্যার ওপর থেকে নামল। একটা লুঙি টেনে পরে নিল। খাটের একপ্রান্তে বসল। রাধা খুব কষ্টে নিজেকে নড়াতে পারল। উঠে সোজা হয়ে বসল। আধ বোজা চোখে খাট হাতরে কাপড় খুঁজে পেল। কাপড় স্যারের সামনেই পরতে হলো। স্যারের অসভ্য বন্য ইতরের মতো দৃষ্টি। দুটি চোখ শকুনের দৃষ্টি দিয়ে রাধার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি। জগৎ-সংসারে এমন তুচ্ছ ঘটনা ঢের হয়। তার কোনও হেলদোল নেই।

রাধা কাপড় পরে একটিও কথা বলল না। বলতে পারল না। বলতে চাইলও না। কোনও কথা না বলে স্যারের ভগ্ন অট্টালিকা থেকে বের হলো। শুধু তার সম্মান নামক অতিক্ষুদ্র বস্তুটি, প্রাসাদের ইটের ভাঁজে ভাঁজে আটকা পরে অসহায় হয়ে বিলাপ করতে থাকল। রাধা যখন বাড়িতে পৌঁছাল তখন রাত আটটা। রাধার মা যে বাসায় কাজ করে সেখান থেকে এখনো আসেনি। বাবা-দাদা রাত দশটা-বারোটার আগে বাড়িতে আসতে পারে না। রাধা ঘরে ঢুকল। ফাঁকা নিস্তব্ধ ভাঙাচোরা ঘর। দৃঢ় অন্ধকারে নিজের হাতটিও দেখা যাচ্ছে না। খাটের উপর এসে রাধার শরীর লুটিয়ে পড়ল। জগৎ সংসারের সমস্ত অন্ধকার এসে রাধাকে পাহারা দিতে থাকল। চলবে

৯ মে ২০২০