নিতির গল্প

উপন্যাস ১৮

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১৪, ২০২০

রাধার মা আজ সন্ধ্যার আগেই বাড়ি চলে এসেছে। মেয়ে অসুস্থ। সারাদিন তার দুশ্চিন্তায় কেটেছে। রাধা আসলে হাত-মুখ ধুতে জল লাগবে। আবার যদি কলের হাতল ছুটে আসে! মা বিপদ বাড়াতে চায় না। রাধার জন্য জল তুলে রাখল। বাড়িতে কারেন্ট নেই। রাতে রান্না করতে অসুবিধা হয়। বেশিরভাগ দিন রাধাই রান্না করে। সন্ধ্যা হবার আগে। আজ মা রাতের রান্না করে রাখল। মায়ের রান্নাঘরে দুটো মাটির উনুন। প্রতিটা উনুনে হাঁড়ি বসানোর জন্য তিনটা করে ঝিক। কাঠ দেয়ার জন্য সমানে মুখ রাখা। রান্নাঘরের মাটির মেঝেয় গর্ত করে উনুন দুটো করা। পাটকাঠি-পলিথিনের চালের আড়ায় দুটো পাটের দড়ির সিকে টাঙানো। তাতে পুরান কালিপড়া কড়াই রেখে দেয়া। উনুনের সামনে কেরোসিনের ল্যাম্প রাখার জন্য উঁচু পোতা করে রাখা।

রান্না শেষ করে মা হারিকেনের কাচ মুছে ঠিকঠাক করে রাখছিল। এমন সময় রাধা এলো। মা রাধাকে দেখে শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, রাধা এলি? একটু জিড়িয়ে নে। ডাক্তার দেখিয়েছিস? ওষুধ... মায়ের অনেকগুলো প্রশ্ন। রাধা একে একে উত্তর দিল। সমস্তটা শুনে মা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। আবার নিজের কাজে মন দিল। রাধা চামড়ার স্যান্ডেল খুলে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে নিল। খুব সন্তর্পণে কলপাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। কলপাড়ের সামনের অংশে কয়েকটা পুরান ভাঙা ইট পাতা। সাড়ের বস্তা বিছানো হাতলের নিচের অংশে। রাধা তার উপর এসে দাঁড়াল। বহু ব্যবহারে ইট ক্ষয়ে গেছে। বালতি রাখার জায়গাটা একটু গর্ত হয়ে আছে। সামান্য জল জমে আছে সেখানে। কলের পাইপের নিচের অংশ দুইপাশে দুটো বাঁশের খুঁটো দিয়ে আটকানো। নাইলনের দাঁড়ি দিয়ে বাঁশের খুঁটি দুটো কলের পাইপের সাথে শক্ত করে বাঁধা।

জল চলে যাবার জন্য একটা মাটির নালা রয়েছে। অগভীর, কর্দমাক্ত। নালা দিয়ে পচা কাদার গন্ধ ভেসে আসছে। নালার শেষ প্রান্তে জল জমা রাখার একটা গর্ত। গর্তের চারপাশে সোলাকচুর দঙ্গল জন্মে গেছে। পচা জলের চারপাশে মশা গুনগুন শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। রাধা কলপাড়ে এসে ডান হাতে প্ল্যাস্টিকের মগ নিল। বালতি থেকে জল তুলল। মগে আয়রনের লাল-হলুদ দাগ জড়িয়ে আছে। কিছুটা অংশ মাটির সংস্পর্শে থেকে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। পায়ের পাতা দুটো একজায়গায় করে, পায়জামাটা বাম হাত দিয়ে এমন ভাবে উঁচু করে ধরল, যেন পায়ে জল দিলে সেটা ভিজে না যায়। রাধা তোলা জল দিয়ে পা ধুয়ে নিল। হাত-মুখ ধুয়ে নিল। কলপাড়ের কাজ শেষ হলে, পা টেনে টেনে ঘরে চলে গেল। বাইরে যাবার একটাই পোষাক ওর। সেটা খুলে একটা পুরান মলিন সেলোয়ার-কামিজ পরে নিল। পোষাকটার রঙ জ্বলে গেছে। দু-একটা ছিঁড়ে যাওয়া জায়গায় হাত দিয়ে সেলাই করা। এটা প্রায় তিন বছর আগে কেনা।

রাধার শরীর যথেষ্ট দুর্বল। ডাক্তার দেখাতে যাওয়া-আসায় যথেষ্ট ক্লান্ত। ঘরে গিয়ে খাটের উপর গা এলিয়ে দিল। চোখের পাতা বন্ধ করল। মা হারিকেনে কেরোসিন তেল ভরে, হালকা সলতে তুলে, হারিকেনটা জ্বালাল। হারিকেনের হাতল ভেঙে গেছে। হাতলের স্থানে লোহার তার জড়ান। সেটা ধরে হাতে হারিকেন নিয়ে মেয়ের ঘরে এল। খাটের উপর মেয়ের মাথার পাশে বসল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, কিছু খাবি? কিছু না খেলে তো ওষুধ খেতে পারবি নে? রাধা চোখ মেলে মাকে একটু দেখল। তারপর ক্ষীণ স্বরে বলল, পরে খাব মা। এখন ক্ষিদে নেই। মা আর কথা বাড়াল না। তার হাতের কাজ পরে রয়েছে। রাধা চোখ বুজলে মা মশারি টাঙিয়ে, খাটের চারপাশে মশারি গুজে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

ওদিকে রাখি বাড়ি যাবার পর মায়ের হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হলো। মা তার সন্তানের মুখ দেখে অনেক কিছু বুঝতে পারে। পার্বতী মজুমদার এতটা উদ্বিগ্ন হন না সচারাচর। আজ রাখির কথার মাঝে অনেক অসংগতি খেয়াল করলেন তিনি। স্পষ্ট বুঝতে পারলেন মেয়ে মিথ্যা বলছে। যে সাধারণত মিথ্যা বলে না, তার জন্য মিথ্যা বলা কঠিন। মায়ের কাছেও রাখির মিথ্যাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হলো না। সত্য স্বীকার করার কোন উপায়ও নেই তার কাছে। মা-মেয়ের বাদানুবাদ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, এক পর্যায়ে গভীর অভিমানে রূপ নিল। দুজনের কেউ রাতে খেতে পারল না। এ রাতটা এক প্রকার উৎকণ্ঠায় কাটল তার।

এদিকে নিতি অনেকক্ষণ শুয়ে থেকে হাঁটতে হাঁটতে দীপের ঘরে এলো। দীপ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ আগে নিতির ম্যাসেজ পড়েছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নিতি দীপের ঘরে এলে দীপের মনটা হঠাৎ বিক্ষুব্ধ হয়ে গেল। নিতির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তুমি আমার সাথে এমন ব্যবহার করছ কেন?

হঠাৎ এ ধরনের প্রশ্নে নিতি বিস্মিত হলো। সে বিস্ময় গোপন করে, দীপের চোখে চোখ রেখে, খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠল, তুমি কি জানতে চাচ্ছ? সেক্স করছি নে কেন সেটা? দীপ শান্ত অথচ স্পষ্ট করে বলল, হ্যাঁ। নিতি ঠোঁটের কোনায় একটু হাসল, তারপর বলল, আমি তো সম্পর্ক করতেই চাই। সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই। কিন্তু চোরের মতো চাই নে। দীপ ভ্রু কুঁচকালো, তারপর বিস্ময়ের ঘোর কাটলে বলল, এতে চৌর্যবৃত্তির কি আছে? নিতি বলল, আছে। তুমি আমার সাথে এখানে আছ, সেটা তোমার বাড়ি বলতে পারবে? মামার কাছে স্বীকার করতে পারবে? কতগুলো মাথামোটা মহল্লার মোড়ল আসলে তাদের সামনে দাঁড়াতে পারবে? পারবে না তো? দীপ, বিয়ে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সাহস। তোমার সাহস আছে আমাকে নিয়ে সবার সামনে দাঁড়ানোর?

দীপ কি বলবে ভেবে উঠতে পারল না। নিতি বলছে কি? এখনই বাবা-মাকে এসব বলা সম্ভব! তারা মানবে? দীপ নিতির কথায় বিস্মিত। নিতিকে বলল, এটা কীভাবে সম্ভব? নিতি দীপকে বলল, কেন সম্ভব নয়? তুমি আমাকে ভালোবাস। তুমি আমাকে চাও। আমিও তোমাকে ভালোবাসি। তবে কেন সম্ভব নয়? সত্য স্বীকার করা, সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, পারিবারিক রীতির বিরুদ্ধে যাওয়া যদি সম্ভব না হয়, তবে চোরের মতো আমারও সম্ভব নয়।

দীপ কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, তুমি নিজে বলতে পারবে? নিতি বলল, পারব। অবশ্যই পারব। কিন্তু এখনই পারব না। আমি স্বাবলম্বী নই। বাড়ির বিরুদ্ধে গেলে আমার পক্ষে চলা সম্ভব না। নিতির কথার প্রতিউত্তরে দীপ বলল, আমি কি স্বাবলম্বী? আমারও তো বাড়ির উপর নির্ভর করতে হয়। নিতি কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে উঠল, জানি, জানি বলেই বলছি। যেটা সম্ভব নয়, সেটা প্রত্যাশা করো না। দেখ, ফেসবুকে অনেক বড় বড় কথা লেখা যায়। নিজেকে উদার ঘোষণা করা যায়। কিন্তু সমাজের আচরণ বদলে ফেলা যায় না। আমরা যদি সমাজ পরিবর্তন করতে না পারি, তবে সমাজের মতোই আমাদের চলতে হবে।

দীপর কাছে নিতির এসব কথা অসহ্য মনে হতে লাগল। দীপ সজোরে প্রশ্ন করল, তবে আসলে কেন? এতই যখন নীতিবোধ, তখন এমন নির্জন ফ্ল্যাটে আমার সাথে থাকা কেন? নিতি, নীতি দিয়ে সমাজ চললেও আবেগ চলে না। এই যে এক ফ্ল্যাটে থাকা, দূরত্ব না রাখা, এটাও একটা বিপ্লব। আজ থেকে একশ বছর আগে, একশো কেন? পঁচিশ বছর আগেও কেউ এমন করতে পারেনি। আমি বলছি, আমরা না পারলেও, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের জানিয়ে ডেটে যাবে। সে সাহস তাদের থাকবে। সমাজ রাতারাতি বদলে যায় না। ধীরে ধীরে তার বদল হয়। চোখে সেটা বোঝা যায় না। অন্তর দিয়ে বুঝে নিতে হয়।

নিতি বুঝছে পারছে, যুক্তি তর্ক দিয়ে প্রেম হয় না। প্রেম আবেগ দিয়ে হয়। আবেগের কাছে মানুষের সমস্ত নীতি, সমস্ত ভয়, এক ফুৎকারে উড়ে যায়। তবে কি নিতি দীপকে ভালোবাসে না? দীপের মনে এ প্রশ্ন এসেছিল আগে, আজ নিতির মনেও আসল। প্রেমে ঔচিত্য চলে না। তবে এটা কি প্রেম নয়? এটা কি অবিশ্বাস! নিতি নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করছে। বারবার ভাবছে। বারবার নিজেকে নিজেই কিছু বলছে। বুঝ দিতে পারছে না। গতরাতে নিতি দীপকে প্রত্যাখ্যান করছিল। আজ রাতে আর পারল না। দীপ একদিকে তাকিয়ে ছিল। উদাস দৃষ্টি। নিতি আচমকা দীপের গলা জড়িয়ে ধরল। দু`ঠোঁট কামড়ে ধরল। উন্মাদিনীর মতো নিতির আচমকা অপ্রত্যাশিত আদরে দীপ বিহ্বল হয়ে গেল। মুহূর্তকাল নিজেকে ভাববার সময় দিল। তারপর সমস্ত ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে গেল দুই সঙ্গ লিপ্সা তরুণ তরুণী। তীব্র আকর্ষণের কাছে সব নীতি, নৈতিকতা, সমাজ, দর্শন মূল্যহীন হয়ে পড়ল।

সমস্ত জড়তা কেটে গেছে নিতির। প্রথম বসন্তের বাতাসের স্পর্শ যেমন শরীরে শিহরণ তোলে, দীপের স্পর্শও তেমনি শিহরণ তুলছে। সমস্ত অজানা কৌতূহল, সমস্ত না-দেখা তটরেখা, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে একে অপরের কাছাকাছি আসছে। জগতের সমস্ত সুখ নিতির অন্তরে এসে করাঘাত করছে। নিতি অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, জান, কী ফিলিংস! আর কিছু বলতে পারল না। সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত হৃদয় একাকার হয়ে গেল। জীবনে এমন অপূর্ব আনন্দ পাওয়া যেতে পারে, এটা এতদিন কল্পনার বাইরে ছিল। নিতি ডুব দিল। সমস্ত ব্যবধান ঘুচে গেল। নিজেকে আত্মসমর্পণ করল আবেগের কাছে। চলবে

১৩ মে ২০২০