নিতির গল্প

উপন্যাস ২০

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মে ১৬, ২০২০

ফোনে কান্নাকাটির মধ্যে মা অসংলগ্ন কথাবার্তায় যা বললেন, তা শুনে নিতি স্তব্ধ হয়ে মাটিতে বসে পড়ল। হঠাৎ তড়িতাহত হলে মানুষের যেমন হয়, তেমন নির্বাক হয়ে মুষড়ে পড়ল সে। দীপ পাশেই বসে ছিল। বুঝতে পারল ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। নিতির বাবা মারাত্মক আহত। স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রাক চাপা পড়েছেন। স্কুলের কাছেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। স্যারেরা সাথে সাথেই খবর পেয়েছিলেন। নিতিশ বাবুকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করেন। ভ্যানে মোহাম্মদপুর বাজারে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে মাইক্রোবাসে তুলেছেন। মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন।

এখনই মা বাড়ি রওনা দিতে বলছেন। তিনি মাগুরা যাচ্ছেন। পাশের বাসার বাসুদেব কাকা সাথে আছেন। নিতিশ বাবুর শ্বাসটা শুধু পড়ছে। ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। মায়ের কাছে বেশি টাকা নেই। মা উদভ্রান্তের মতো কান্নাকাটি করছেন। দীপ ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারল। কালবিলম্ব করল না, এয়ারলাইন্স অফিসে ফোন দিল। চড়া দামে দুটো টিকিট জোগাড় করল। নিতিকে শক্ত হতে বলে, চটপট ব্যাগ গুছিয়ে নিল। নিজের ও নিতির। বারংবার নিতিকে অভয় দিতে থাকল। বারবার নিতিকে বলতে থাকল, আমি আছি, তুমি ভয় পেয়ো না। বাবার কিছু হতে দেব না।

নিতি দীপের কথায় আশ্বস্ত হতে পারল না। আবার এই বিপদে, দীপকে ছাড়া পাশে কাউকে ভাবতেও পারল না। দুজন সাতদিন একত্রে থাকতে চেয়েছিল। নিয়তি তিনদিনের বেশি তাদেরকে এখানে রাখল না। মামা, দীপকে বাসার নিরাপত্তার জন্য থাকতে বলেছিলেন। দীপ বাসা অরক্ষিত রেখেই চলে যাচ্ছে। ওদের ভালোবাসার ফুল কেবল ফুটতে শুরু করেছিল। হঠাৎ দমকা ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। বাসার লাইট, ফ্যান, এসি সব বন্ধ আছে কিনা ভালো করে দেখে নিল। ভালোভাবে বাসা লক করল। মামার কাছে আরেক সেট চাবি আছে। চাবি নিয়ে চিন্তা করতে হলো না। নিচে সিকিউরিটি পয়েন্টে ফোন করে ওর যাবার কথা জানাল। বাসার উপর নজর রাখতে বলল। তিনদিন আগে দুজনে যেভাবে সদরদরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল, আজ আবার সেভাবেই বেরিয়ে গেল।

বাসা থেকে নেমে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতেই একটা সিএনজি পেয়ে গেল। সেটা নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে এল। অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইল। নিরাপত্তাকর্মী হাতের ইশারায় বাধা দিল। বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করল, স্যার, কোন এয়ারলাইনস? দীপ নাম বলতে, তারা `স্যার টিকিট প্লিজ` বলে উঠল। দীপ স্মার্টফোন থেকে টিকিটের এসএমএস দেখাল। ভেতরে প্রবেশ করল। ব্যাগ তুলে দিল স্ক্যানিং করার কনভেয়ার বেল্টে। ব্যাগ সংগ্রহ করে এয়ারলাইনসের কাউন্টারে এল। সেখান থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে বোডিং পাস সংগ্রহ করল। ওদের অটোমেটিক স্ক্যানার ও ম্যানুয়াল চেকিং হলো। জুতা, মানিব্যাগ, বেল্ট, মোবাইল আলাদা বাস্কেটে রেখে স্ক্যান করল। এরপর ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে থাকল। এয়ারক্রাফটে ওঠার বাসের জন্য ।

পুরোটা সময় নিতি যথাসম্ভব শান্ত থেকেছে। গ্রাম্য মেয়েদের মতো উচ্চস্বরে কাঁদেনি। তবে দু`চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত জল ঝরেছে। ওদিকে নিতিশ বাবুকে বহনকারী মাইক্রোবাস মাগুরা সদর হাসপাতালে পৌঁছাল। গাড়ির দরজা খুলে হেডস্যার রেজাউল সাহেব নামলেন। তাকে অনুসরণ করে আরিফ সাহেবও নেমে গেলেন। গাড়ির ভেতরে অন্য দুজন সহকারী শিক্ষক ও অফিসের পিওন বসে থাকলেন। নিতিশ বাবুর কাছে।

গাড়ি থেকে নেমে তারা এমার্জেন্সিতে যোগাযোগ করলেন। দ্রুত হাসপাতালের কর্মিরা স্ট্রেচার নিয়ে এল। তাকে এমার্জেন্সি বিভাগের গেটে নিয়ে গেল। রোগী গেটে আনতেই একটা মানুষের জটলা বেঁধে গেল। কৌতুহলী রোগী, রোগীর আত্মীয়স্বজন, ভবঘুরে, দালাল, রিকশা চালক, সবাই ভিড় করে দাঁড়াল। ভিড় ঠেলে রোগীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হলো। জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তার উঠে এসে তাকে দেখলেন। বুক পরীক্ষা করলেন। রক্তচাপ মাপলেন। রক্ত বন্ধ করার জন্য ব্যন্ডেজ বাঁধলেন। ওষুধ, ইনজেকশন কেনার একটা ব্যবস্থাপত্র ধরিয়ে দিলেন। এরপর স্যালাইন দিয়ে রোগীকে স্ট্রেচারেই রেখে দিলেন। এমার্জেন্সির সামনে উন্মুক্ত বারান্দায়। বারান্দায় মাছি ভনভন করছে। দেয়ালে পানের পিকের লালচে দাগ। কফের কালচে দাগ। গ্রিলে এক দঙ্গল ময়লা। চারপাশে কৌতূহলী মানুষের অসহ্য ভিড়। পাশের খোলা ড্রেন দিয়ে ভেসে আসছে কটু গন্ধ।

হাসপাতালের বেড বা কেবিন খালি নেই। এ মুহূর্তেই অর্থোপেডিক বিভাগে রোগীকে ট্র্যান্সফার করা যাচ্ছে না। রোগীর আত্মীয় চাইলে পেশেন্টকে অ্যাডমিশন করাবে। বেড পাবে না। আপাতত হাসপাতালের বারান্দায় থাকতে হবে। মাটিতে বিছানা পেতে। স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে নিলেন। তারপর কর্তব্যরত ডাক্তারকে, `অন্যত্র রেফার করা যাবে কিনা?` জানতে চাইলেন। ডাক্তার যশোরের কোনও ভালো হাসপাতালে যোগাযোগ করতে বললেন। নেট থেকে নাম্বার নিয়ে, আরিফ সাহেব কুইন্স হাসপাতালে যোগাযোগ করলেন। তারা নিতিশ বাবুকে যশোর নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেললেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া হলো। যখন যশোর নিয়ে যাবার জন্য রোগী জরুরি বিভাগে থেকে বের করা হচ্ছে, তখন নিতির মা কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে এসে পৌঁছলেন।

অ্যাক্সিডেন্টের প্রায় চার ঘণ্টা পর ওরা যশোর কুইন্স হাসপাতালে পৌঁছাল। এতক্ষণেও নিতিশ বাবুর জ্ঞান ফেরেনি। প্রয়োজনীয় টাকা জমা করে, যখন রোগী হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, তখন বিকেল হয়ে গেছে। দীপের ফ্লাইট যশোর ল্যান্ড করেছে। দীপের বন্ধুরা নিতিশ বাবু আসার আগেই হাসপাতালে পৌঁছে গেছে। তাদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। অন কলে তারা অর্থোপেডিক সার্জন, কার্ডিওলজিস্ট ও মেডিসিন স্পেশালিস্ট ডাক্তার ডেকে এনেছে। নিতিশ বাবুর ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ। এই গ্রুপের রক্তদাতা সংগ্রহ করে, ব্লাড কালেকশন শুরু করে দিয়েছে। নিতিশ বাবুর প্রকৃত ট্রিটমেন্ট শুরু হয়েছে।

দীপ-নিতি যখন যশোর পৌঁছাল। প্রায় একই সময়ে রিমিদের বহনকারী ট্রেন কমলাপুর স্টেশনে থামল। ট্রেনের কামরার গেটে যাত্রীদের জটলা। ভিড় একটু কমলে আগে রিমি নামল। রমেশ বাবু মেয়ের লাগেজ নামিয়ে তবে নামলেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা স্টেশনের গেটে এসে পৌঁছাল। একটা সিএনজি নিয়ে রামপুরা রওনা হল। পথে অসম্ভব ট্রাফিক জ্যাম। বাসার কাছে পৌঁছাতেই দু`ঘণ্টা লেগে গেল। রমেশ বাবু যখন বাসার গেটে পৌঁছালেন, তখন রাত আটটা।

বিকেল নাগাদ রাধার গায়ের ব্যথাটা কমতে শুরু করল। ওষুধের প্রভাবে ঠোঁটের কেটে যাওয়া জায়গাটা শুকিয়ে উঠছে। রাধার মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। একটা ঘেন্না, একটা বিষাদ, একটা পিশাচের হাসি, তাকে ভেতর থেকে দুর্বল করে তুলছে। এই মানসিক অসহায়ত্ব তাকে শারীরিক ভাবেও নির্জিব করে রাখছ। বাড়ির কারো সাথে কথা বলতে পারছে না। খেতে পারছে না। রাতে হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রাতের অন্ধকারে, শরীরের উপর কেউ একজন বসে আছে। এমন ভয়ে, আতঙ্কে, তার রাত কাটল।

দীপেন বাবু একদিনের মধ্যেই পাত্রের সন্ধান করে ফেললেন। আগামী শুক্রবার রাখিকে তারা দেখতে আসবে। ছেলে নিজে থাকবে। অভিভাবক সহ পাত্রের সাথে প্রায় দশ জন আসবেন। পাত্রি পছন্দ হলে বিয়ের পাকা কথা দিয়ে যাবেন। রাখি সারাদিন না খেয়ে ছিল। পাত্র ঠিক হবার পর মায়ের মনটা কেঁদে উঠল। পার্বতী দেবি রাখির রুমে গিয়ে রাখির গলা জড়িয়ে ধরলেন। কিছুক্ষণ কাঁদলেন। নানা কথা বলে মেয়েকে বোঝালেন। মায়ের কান্না দেখে, রাখির মনের বরফ গলতে শুরু করল। রাখি মায়ের সাথে খাবার টেবিলে এলো।

সন্ধ্যায় ফুল বডি এক্স-রে করে দেখা গেল, নিতিশ বাবুর ডান পা পুরোপুরি ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে। ব্যন্ডেজ করে বা রড বসিয়ে হবে না। হাঁটুর নিচ থেকে পা কেটে বাদ দিতে হবে। মাথায় চোট পেয়েছেন। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। ডানপাশের হাত ভেঙে গেছে। ব্যন্ডেজ করে ট্রিটমেন্ট করলে হাত ঠিক হবে। সকলের সিদ্ধান্তে রাতেই অপারেশন করা হলো। ট্রাকের চাকায় পিষে যাওয়া ডান পা, হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দেয়া হলো। স্কুলের হেডস্যার রেজাউল সাহেব ও আরিফ সাহেব পাশের একটা হোটেলে উঠলেন। দীপের আন্তরিকতায় তাদের গুরুভার কিছুটা লাঘব হলো। অন্যান্য স্যার ও স্কুলের পিওন অ্যাম্বুলেন্সের সাথে আগেই চলে গিয়েছিলেন। নিতির ভাই প্রতিবেশী বাসুদেব বাবুর বাড়ি আছেন। আগামীকাল সে মামার সাথে বাবাকে দেখতে আসবে।

সারারাত নিতি, নিতির মা, কেউ ঘুমাতে পারল না। নিতিদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে, রোগী কেবিনে ট্র্যান্সফার হবার পর, রাত একটার দিকে দীপ ওর বাসায় চলে গেল। সকালে আবার আসবে। ততক্ষণ নিতিদেরকে সাবধানে থাকতে বলল। কর্তব্যরত ডাক্তার, সিস্টারদের বারবার খেয়াল রাখতে বলে গেল। নিতির মা এই চরম বিপদে, তার পাশে সত্যিকারের সুহৃদ পেলেন। সমস্ত ঘটনা-দুর্ঘটনা ছাপিয়ে একটি দুশ্চিন্তা তাদের পেয়ে বসল। দুর্ঘটনার প্রায় পনের ঘণ্টা সময় পার হয়ে গেলেও নিতিশ বাবুর জ্ঞান ফিরছে না। ডাক্তাররাও সঠিক করে কিছু বলতে পারছেন না। একটা অজানা মৃত্যুভয়, রাতের অন্ধকারে তাদেরকে চারদিক থেকে চেপে ধরছে। উৎকণ্ঠায় তাদের গলা শুকিয়ে আসছে। বুক সময়ে সময়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

হাজার উৎকণ্ঠা থাকলেও প্রকৃতির খেয়ালে আঁধার কেটে আলো নামে। এ রাতও ভোর হলো। মোয়াজ্জেম `আল্লাহু আকবার` ধ্বনি তুলে ফজরের আজান দিলেন। মোরগ ডেকে উঠল গ্রামে গ্রামে। পূবের আকাশে রক্তিম সূর্য তার মুখ দেখাল। প্রকৃতিতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এলো। ঢাকায় রিমির প্রথম সকাল শুরু হলো। সকালে রমেশ বাবুর সাথে রিমি সিদ্ধেশ্বরী কলেজে এলো। অ্যাডমিশনের জন্য নির্ধারিত টাকা ব্যাংকে জমা দিল। বিএ পাস কোর্সে অ্যাডমিশন নিতে ফরম পূরণ করল। কলেজের আর যা যা প্রশাসনিক কার্যক্রম আছে, সেগুলো সম্পন্ন করল।

ক্যাম্পাসের প্রথম দিনেই শোভা নামে একটি মেয়ের সাথে ওর আলাপপরিচয় হয়ে গেল। শোভাও আজ অ্যাডমিশন করাতে এসেছে। একই সেমিস্টারে। একই বিষয়ে। শোভা ঢাকার মেয়ে। ঢাকাতেই বেড়ে উঠেছে। দেশের বাড়ি মানিকগঞ্জ। সেখানে অবশ্য কখনোই থাকে নি। দু`একবার বেড়াতে গেছে মাত্র। মডেলিং করে। বন্ধুরা সব বেসরকারি ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন করিয়েছে। বাবা অসুস্থ। টাকার ক্রাইসিস। তাই এখনে অ্যাডমিশন করাল। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। বাধ্য হয়ে। দুজন দুজনার মোবাইল নম্বর আদানপ্রদান করল। ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়ে গেল। রিমি ঢাকায় তার বন্ধু খুঁজে পেল। প্রথম সকালেই।

ওদিকে স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক সুমন বিশ্বাস আজ থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়েছিল। রেজাউল সাহেবরা যখন নিতিশ বাবুর ট্রিটমেন্টের কাজে যশোর অবস্থান করছেন। সুমন তখন মাগুরা থেকে গোয়ালন্দের বাসে উঠল। নিতিশ বাবুর এই দুর্ঘটনা তার অভিষ্ঠ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারল না। গত সপ্তাহে পৈত্রিক সম্পত্তির কিছু গাছ বেঁচেছিল। হাজার পঞ্চাশেক টাকা পেয়েছ। টাকাটার একটা বন্দবস্ত করবে।

দুপুরের পরপর সুমন বিশ্বাসের বহনকারী বাস গোয়ালন্দ বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাল। কালো প্যান্টের উপর খয়েরি রঙের শার্ট পরেছে। জামা ইন করা। কোমরে কালো রঙের বেল্ট। পায়ে কালো সু। অ্যাশ কালারের শর্ট মোজা। হাঁটার সময় গোড়ালি থেকে প্যান্ট সরে গেলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চুলে শ্যাম্পু করা। সিল্কি। খুব ছোট করে কাটা। অনেকটা সৈনিকের মতো। লম্বা, মেদহীন শরীর। দেখতে আকর্ষণীয়। সে বাস থেকে নেমে এদিক-ওদিক কয়েকবার তাকাল। একটা অল্পবয়স্ক রিক্সা চালক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। রিক্সা কাছে এলে `রেলস্টেশনে নিয়ে চল` বলে রিক্সায় চেপে বসল।

রিক্সা বাস স্ট্যান্ডের মধ্যে দিয়ে, বড় রাস্তা হয়ে, গলি রাস্তায় নামল। গলি রাস্তার মোড় থেকে বোডিং শুরু। যশোর বোডিং, গোয়ালন্দ বোডিং, পারভীন বোডিং, বোডিংয়ের কোন শেষ নেই। সুমন স্টেশনের কাছে এসে রিক্সা থেকে নামল। কোলের উপর একটা অফিস ব্যাগ ছিল। বেশ স্ফিত। কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। ডান হাত দিয়ে মানিব্যাগ বের করে, বাম হাতে ধরল। ধীরস্থির ভাবে। ডান হাত দিয়ে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে রিক্সা ভাড়া মেটাল। পাশের দোকান থেকে একটা বেনসন সিগারেট নিল। লাইটার দিয়ে সিগারেটটা ধরাল। দাম মেটাল। মানিব্যাগ আগের মতো প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখে দিল।

দু`পা হেঁটে এগিয়ে গেল। আশপাশের বোডিং থেকে `স্যার আমাদের এখানে আসেন। ভালো ব্যবস্থা আছে` বলে হাঁকডাক দিতে থাকল। সুমন কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে থাকল। রাজশাহী বোডিংয়ের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। ভালো করে চারপাশটা দেখে নিল। ভেতর থেকে `স্যার কতদিন পরে আসলেন। কেমন আছেন? ভেতরে এসে বসেন। রুম লাগবে? ভালো রুম রেডি আছে।` বলে সুমনকে প্রলুব্ধ করতে থাকল। সুমন কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল। সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছেলেটার মুখের উপর ছাড়ল। কয়েক মুহূর্তের জন্য ছেলেটার মুখ সাদা ধোঁয়ার আড়ালে অদৃশ্য হলো। ছেলেটা রাগ করল না। দাঁত বের করে ফেলফেল করে হাসতে থাকল।

সুমন সিগারেটের ফিল্টার বোডিংয়ের সামনের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, দুইশো দুই নম্বর রুমটা খালি আছে? ছেলেটা সহাস্যে বলল, আছে স্যার। সুমন ডানহাত এগিয়ে দিয়ে বলল, রুমের চাবিটা? সুমনের মুখে আত্মবিশ্বাস ও গাম্ভীর্য। ছেলেটা হাসিমুখে চাবিটা বের করে `স্যার চলেন, আমি রুম খুলে দিচ্ছি` বলে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এলো।

এ বোডিংটা দুইতলা ছাদের ঘর। অন্যান্য বোডিং টিনের দুইতলা বা টিনের চারচালা। অনেকগুলোতে ইটের দেয়াল। অনেকগুলো কাঠের ফ্রেম করা, টিনের বেড়া। এটা অপেক্ষাকৃত উন্নত। সুমন ছেলেটার সাথে সাথে সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে দু`তলায় উঠে এল। রুমের সামনে এসে দাঁড়াল। ছেলেটা রুমের তালা খুলল। লাইট জ্বালাল। ফ্যান চালাল। ভাঁজ করা বেডসিট পেতে দিল। বালিশের কভার লাগিয়ে দিল। অ্যারোসল স্প্রে করে `স্যার প্রয়োজন হলে ডাকবেন` বলে, রুমের দরজা বাইরে থেকে টেনে নিচে নেমে এলো।

এদিকে, গতকাল রাহেলা খালা টাকা দিয়ে গেছে, এটা রাধার দাদা জানতে পেরেছে। সকালে, বেলা করে ঘুম থেকে উঠে `রাধা টাকাগুলো দে` বলে রাধার সামনে এসে দাঁড়াল। রাধা `আমি টাকা কোথায় পাব?` বলতেই, রাজিব জোরে জোরে দাঁতে দাঁত পিষে `আমি টাকা কোথায় পাব? শুয়োরের বাচ্চা। রাহেলা টাকা দিয়ে যায় নি?` বলে চেঁচিয়ে উঠল। রাধাও গলায় জোর দিয়ে বলে উঠল, ও টাকা আমার লাগবে। আমি অসুস্থ। ওষুধ কিনব।

ভালোয় ভালোয় বলছি মাগী, টাকাটা দে। তা না হলে তোর একদিন কি আমার একদিন।
আমি টাকা দেবনা। তোর যা ইচ্ছা তুই করতে পারিস।
তবে রে মাগি। কত ধানে কত চাল, তোর আজ বের করছি। বেশ্যা মাগী, আমাকে টাকা দিবিনে? বলে রাধার চুলের মুঠি ধরে একটা হ্যাচকা টান দিল।
রাধা ‘মাগো, মেরে ফেলল গো’ বলে তারাস্বরে কেঁদে উঠল।

ওদের গণ্ডনগোল শুনে পাশের বাড়ির রাহেলা খালা ছুটে এল। সেও চেঁচিয়ে বলল, ছাড় হারামজাদা, মেয়েটাকে কি মেরে ফেলবি? রাহেলা খালার ধমকে রাজিব চুল ছেড়ে দিল। ভেতরে ভেতরে গো গো করতে থাকল। রাহেলা খালার ছেলে পুলিশ। একবার থানায় ফোন করে রাজিবকে ধরতে পুলিশ পাঠিয়েছিল। তারপর থেকে রাহেলা খালা এলেই রাজিব ঠাণ্ডা হয়। রাজিব রাধাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাহেলা খালার বুকে মুখ লুকিয়ে রাধা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

এদিকে, সকালে দীপ হাসপাতালে এলো। অভুক্ত, নির্ঘুম, নিতির মুখ দেখে শিউরে উঠল। কি চেহারা হয়েছে একদিনের মধ্যেই! নিজের মনেই নিজে ভাবল। নিতির চোখের কোনায় কালি পড়ে গেছে। ঠোঁট জোড়া শুকনো। মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। নির্জীব চেহারা। দীপ, নিতিশ বাবুর চিকিৎসার খোঁজ খবর নিল। একটু একটু জ্ঞান ফেরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন, বিকেল নাগাদ পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। নিতির ভাই, মামা, চলে এসেছে। সকলে জ্ঞান ফেরার আশায় অধীর অপেক্ষায় বসে আছে।

দীপ বাড়ি আসলেও রাখির সাথে কথা বলার সময় পায়নি। রাখি নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এত ঘটনার পরেও আয়ানের সাথে তার যোগাযোগ থেমে নেই। আজ সকালে ফোনে কথা বলছিল। হঠাৎ মা এসে সামনে দাঁড়াল। পার্বতী মজুমদার মেয়ের ফোনটা কেড়ে নিয়ে বললেন, বিয়ের পরে আবার ফোন পাবে। এ ক`দিন ফোন ব্যবহারের দরকার নেই।

কলটা ওপ্রন্ত থেকে তখনো কাটেনি। আয়ান সব শুনতে পেল। এখন কি করবে সে? নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হতে থাকল। অসম্ভব চঞ্চল হয়ে উঠল মন। জোরে শব্দ করে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দিল। চলবে

১৫ মে ২০২০