নিতির গল্প

উপন্যাস ২৭

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ০২, ২০২০

মানুষ অসুস্থ থাকলে স্বাভাবিক বোধ লুপ্ত পায়। অনেক সময় খুব বাস্তববাদী মানুষেরও চেতনা শূন্য হয়। তিন মাস ধরে নিতিশ বাবুর পিতৃত্ব চেতনাশূন্য ছিল। তিনি নিজের যন্ত্রণার মাঝে আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন। আজ নিতিকে কাছে ডাকলেন। পড়াশোনার ব্যপারে খোঁজখবর নিলেন। ঢাকা কবে যাবে সেটা জানতে চাইলেন। পড়াশোনার যে অনেক ক্ষতি হয়েছে, একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি তার সবই বুঝতে পারছেন। মেয়ের এত ক্ষতির জন্য একপ্রকার অপরাধবোধ কাজ করছে তার ভেতর। কথাবার্তায় সেটা বেশ প্রকাশ পেল।

নিতিশ বাবু এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন। স্নান, বাথরুম কোথাও অন্যের সাহায্যের দরকার হচ্ছে না। হেড স্যার রেজাউল সাহেবের আন্তরিকতায় এতদিন স্কুলে যেতে হয়নি। বেতন সময় মতো পেয়েছেন, তিন মাসের মেডিকেল লিভ নিয়েছেন। গতকাল সকালে ভ্যানে করে স্কুলে গিয়েছিলেন। এতদিন পর নিজের স্কুলটা নিজের কাছেই অচেনা লাগছিল। ছাত্র-শিক্ষক সকলেই হা করে নিতিশ বাবুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল। মানুষের অঙ্গহানি শুধু শারীরিক নয়, অনেকটা মানসিকও। প্রতি মুহূর্তে যদি মন বলে দেয় তোমার একটা পা নেই, তুমি পঙ্গু, তাহলে পা ছাড়া যতটা কাজ করার সামর্থ থাকে সেটাও মন থেকে হারিয়ে যায়। মানুষ মানসিক পঙ্গুত্বের কাছে হার স্বীকার করে।

নিতিশ বাবু এটা বুঝতে পেরে নিজের মনকে শক্ত করার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মেয়েটার বিয়ে দেয়া হয়নি। যদিও বিয়ের বয়স এখনও পেরিয়ে যায়নি, তবুও বিয়ে তো তাকেই দিতে হবে, আজ হোক বা দু`বছর পরে। ছেলেটা নিতান্ত বালক। এখন তিনি শক্ত না হলে সব ভেসে যাবে। তাকে যেকোনো মূল্যে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। শুনেছে আজকাল কৃত্রিম পা লাগানোর ব্যবস্থা আছে, সেটার চেষ্টা করে দেখতে হবে। নিতিশ বাবু নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন। এই তিন মাসের মধ্যে একবারও দীপের ফোন এলো না। বাবার অসুস্থতার সময়ে দীপ যে ভূমিকা রেখেছিল, তার জন্য একটা গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করতো। দীপের হঠাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা সেই কৃতজ্ঞতাবোধের জায়গা থেকে মনকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। বাষ্পীভূত একটা চাপা অভিমান ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়েছে।

নিতি বাবার অনুরোধে আবার ঢাকা চলে এলো। বাবার জন্য একটু কষ্ট হলেও তাকে তো আসতেই হতো। আবার পড়াশোনা শুরু করল। নতুনভাবে জীবনটা সাজাতে চাইল। সময় এগিয়ে গেল স্রোতের মতো।

রাধার এসএসসির রেজাল্ট ভালো হয়েছে। ভালো বললে কম বলা হবে, খুব ভালো হয়েছে। পাশের কলেজের শিক্ষকরা বাড়িতে এসেছিলেন। তাদের কলেজে ভর্তি হলে, ভর্তি, বই, বেতন, ফরমফিলাপ, কোনও ব্যপারেই কিছু দিতে হবে না জানিয়ে গিয়েছেন। ফরমফিলাপের কথাটা শোনার সময় রাধা শিউরে উঠেছিল। একটা দগদগে ক্ষত হয়ে মনের কোনায় রয়ে গেছে ব্যপারটা। তবুও ভুলতে হয়, ভুলতে না পারলে ভুলে থাকার অভিনয়টুকু করে যেতে হয়। নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়। জীবনটা অনেক বড়, অনেক বাধা-বিপত্তি পার করেই জীবনে এগিয়ে নিতে হয়। রাধা নতুন করে পড়াশোনা শুরু করল, নিজের সমস্ত চেষ্টা উজার করে দিয়ে।

রিমি সেলস গার্লের কাজ বেশিদিন করতে পারেনি। মাস দুই করার পরই ছেড়ে দিয়েছে। শোভার আগ্রহে নাটকের দলে যুক্ত হয়েছে। নিয়মিত শুটিং স্পটে যাচ্ছে। প্রযোজক সামান্য কিছু কিছু টাকা দিচ্ছে। এখনো বড় কোনও রোল পায়নি। নাটক দলের সহশিল্পীর খুব ছোট ছোট জায়গায় তাকে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে শোভার মাধ্যমে আদনান নামে একজন তরুণ পরিচালকের সাথে কথা হয়েছে। আগামীকাল বিকেলে তার সাথে দেখা হবে। চলবে