নিম্নমানে পাঠ্যবই ছাপা, ৬৭ ছাপাখানার ১৭ লাখ বই বাতিল

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৯, ২০২৫

ফর্মা মিসিং, ডাবল ফর্মা, পতাকা পরিবর্তন, আলট্রা ভার্নিশ না করা ও বাঁধাইয়ে ত্রুটিসহ বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে ৬৭ ছাপাখানার ১৭ লাখের বেশি ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিকের পাঠ্যবই বাতিল করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ইন্সপেকশন কোম্পানি।

বাতিল করা বইগুলো কাটিং মেশিন দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া এসব ছাপাখানার ২ হাজার ৭০০ টন নিম্নমানের কাগজ অনুমোদন না করে বাতিল করা হয়েছে। টেন্ডারের শর্তানুযায়ী, পাঠ্যবইয়ের কাগজ হতে হবে শতভাগ ভার্জিন পাল্পে তৈরি। কিন্তু এসব কাগজে ২০ শতাংশ ভার্জিন ও ৮০ শতাংশ রিসাইকেলড পাল্প ব্যবহার করা হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রি-ডিস্ট্রিবিউশন এজেন্ট (পিডিআই) ইনফিনিটি সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশনের (বিডি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজীম মুনির বলেন, “বিভিন্ন অনিয়ম ও ত্রুটির কারণে সব মিলিয়ে এবার প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ের আড়াই কোটি ফর্ম কাটা হয়েছে। অধিকাংশ ছাপাখানাই এই অনিয়মে জড়িত।”

মুনিরকে ম্যানেজ করতে না পেরে তাকে জীবননাশের হুমকি দিয়েছে কয়েকটি ছাপাখানার মালিক। নিম্নমানের কাগজকে ভালো মান করতে মুনিরকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করতে চেয়েছিল অর্ধ শতাধিক ছাপাখানার মালিক।

এর আগে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে অর্ধশতাধিক ছাপাখানার নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপানোর বিষয়টি ইন্সপেকশন কোম্পানির তদন্তে ধরা পড়ে। কিন্তু কারোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অতীতে টাকা দিয়ে নিম্নমানকে যে ভালো মান করা যায়, সম্প্রতি একটি ছাপাখানার মালিকের ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডে তা স্পষ্ট হয়েছে।

অডিও রেকর্ডে জনতা প্রেসের মালিক নজরুল ইসলাম কাজলকে বলতে শোনা যায়, “এক যুগ ধরে সব ছাপাখানা নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপিয়েছে, আমিও ছাপিয়েছি।”

তার কথার প্রতিফলন এবারও বাস্তবে দেখা গেছে। প্রাথমিকে ৬৭ ছাপাখানা নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপিয়ে এনসিটিবির হাতেনাতে ধরা খেয়েছে। মাধ্যমিকে এই সংখ্যা আরো বেশি হবে। অধিকাংশ ছাপাখানার পাঠ্যবইয়ের জিএসএম, ব্রাইটনেস, বাস্টিং ফ্যাক্টর, অপাসিটি কোনো কিছুই ঠিক নেই। বই দেখতে ঝাপসা, কাগজ খসখসে, ছাপা লেপ্টে গেছে।

আবার পাঠ্যবই কম দেওয়ার প্রবণতাও এবার ধরা পড়েছে। একটি ছাপাখানার প্রাথমিকের পাঠ্যবই পিডিআই করতে গিয়ে ‘সুইমিং পুল’ বিষয়টি ধরা পড়ে। সুইমিং পুল হলো—চারপাশে বই, মধ্যখানে ফাঁকা। বিষয়টি ঐ সময় ইন্সপেকশন কোম্পানি এনসিটিবির চেয়ারম্যান, সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) ও সচিবকে অবহিত করেছিল। বই কম দিতে গিয়ে এবার ধরা পড়া ছাপাখানার সংখ্যা ১০টি।

একটি ছাপাখানার প্রাক্-প্রাথমিকের ১১ হাজার খাতা বাঁধাইয়ে ত্রুটি ধরা পড়ে, যা কেটে ফেলা হয়। একই সঙ্গে ঐ কোম্পানির নিম্নমানের প্রায় ৭ হাজার পাঠ্যবই কাটা হয়। আরেকটি ছাপাখানা পাঠ্যবইয়ে জাতীয় পতাকার কালার পরিবর্তন করেছিল, যা এনসিটিবির সচিবের নজরে আসে। পরে ত্রুটিপূর্ণ বই বাতিল করে, নতুন করে ছাপিয়ে নেওয়া হয়।

১৩ অক্টোবর অ্যারিস্টোক্রটস সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের ১৩ মেট্রিক টন নিম্নমানের কাগজ বাতিল করে এনসিটিবির ইন্সপেকশন প্রতিষ্ঠান। এ কারণে ঐ ইন্সপেকশন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজীম মুনিরকে জীবননাশের হুমকি দেয় অ্যারিস্টোক্রটস সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম নজরুল ইসলাম।

পরদিন ১৪ অক্টোবর বিষয়টি লিখিতভাবে এনসিটিবির সদস্যকে (পাঠ্যপুস্তক) জানান মুনির। ১৫ অক্টোবর মোল্লা প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের চতুর্থ শ্রেণির ইসলাম শিক্ষা বইয়ের নিম্নমানের ৯ হাজার ফর্মা কাটা হয়। একই সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ের ৩ হাজার কপি কাটা হয়। একই দিন অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের নিম্নমানের ১ হাজার ৩০০ কপি এবং এম/এস নাহার প্রিন্টার্সের ৩০ হাজার ৪০০ কপি নিম্নমানের বই কেটে দেয় এনসিটিবির ইন্সপেকশন প্রতিষ্ঠান।

২৭ অক্টোবর প্রিয়াঙ্কা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশনের প্রাথমিক বিজ্ঞান বইয়ের ২৩ হাজার ফর্মা কেটে ফেলা হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) দরপত্রের শর্তানুযায়ী, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ির বইয়ে জিএসএম (কাগজের পুরুত্ব) ৮০, ব্রাইটনেস ৮৫, বাস্টিং ফ্যাক্টর ২০ ও অপাসিটি ৮৫ থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশই তা অনুসরণ করেনি। অনেকে বইয়ের কাভারে ইউভি (আলট্রা ভার্নিশ, মলাটের ওপরে পলিথিনের আবরণ) পর্যন্ত করেনি।

জানা গেছে, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক (প্রথম-পঞ্চম) শ্রেণি পর্যন্ত ৮ কোটি ৫৯ লাখ ২৪ হাজার ৮৫৩ কপি পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে শনিবার পর্যন্ত বই ডেলিভারি হয়েছে ৮ কোটি ৪০ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪৯ কপি। টাকার বিনিময়ে কাগজের মান ভালো দেওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুই ইন্সপেকশন কোম্পানির ল্যাব মেশিন এনসিটিবিতে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে সাইন্সল্যাব থেকে একজন ল্যাব স্পেশালিস্ট নিয়োগ দিয়েছে এনসিটিবি। তার পরও নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপানো বন্ধ হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, সর্ষের মধ্যে ভূত আছে। অর্থাৎ এনসিটিবির এক শ্রেণির কর্মকর্তা অনিয়মে জড়িত। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে ছাপাখানার অনিয়ম ধরা পড়লেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় খুবই কম। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুবুল হক পাটওয়ারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি ফোনে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

নিম্নমানের পাঠ্যবই যারা ছাপাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এনসিটিবিতে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান। তোফায়েল খান বলেন, “এবারও নিম্নমানের পাঠ্যবই সরবরাহ করা হচ্ছে বলে আমরা জেনেছি। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া এখন খুবই জরুরি।”

তিনি আরও বলেন, “২০২৫ শিক্ষাবর্ষে এনসিটিবির ৩২টি টিম সারা দেশ সফর করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। এখন শুনছি সেই তদন্ত প্রতিবেদন গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যারা অনিয়মে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে অনিয়ম বাড়তেই থাকবে।”