
নিরুদ্দেশ
পর্ব ৫
সজীব দেপ্রকাশিত : জানুয়ারি ২৭, ২০১৮
দোতারা কিংবা বাঁশির শব্দে এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙে না। আগের মতো আর কাকেরাও ডাকে না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চেখে পড়ে কালরাতে গুলি করে মারা হয়েছে এমন কোনো মানুষের শরীর শকুন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাচ্ছে। ধীরে ধীরে ড্রেনের কালচে রঙ লালচে হয়ে উঠছে। এইসব দেখে দেখে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর ভেতর এক ধরনের ট্রমা তৈরি হয়। যা তারা বেঁচে থাকা অব্দি বয়ে চলে।
কান্নায়, স্মুতিতে, কথায়, গানে তাদের ভাব আদান প্রদান চলে। এমনি এক ট্রমায় আক্রান্ত ইলিয়াস। ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের রাত হতে যার শুরু হয়। তাই সে আর যুদ্ধে যেতে পারে না। সারাদিন নিজের ঘরে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। কেবল তার মনে হয়, কিছু বললে কেউ হয়তো তাকে এখনি গুলি করে মেরে ফেলবে। মৃত্যুভীতি অহরহ তাকে বাঁচিয়ে রাখে অন্যপ্রান্তে, যেখানে তার ভাষা অন্য কেউ পড়তে পারে না। কিংবা সে যে পারে এ কথাও কেউ বলতে পারবে না। ইলিয়াসের শুধু মনে হয়, মায়ার হাত ধরে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু সে কথা মায়াকেও বলতে পারে না। তার ভাষা কেমন হবে এইটা বুঝে ফেলার আগে তার সব শব্দ হঠাৎ নাই হয়ে যায় তার মাথা থেকে। অথচ ঘরে শুয়ে শুয়ে এইসব শব্দগুলো সে সাজাতো। এরকম ভাবতে ভাবতে এক সময় ইলিয়াস ঘুমিয়ে পড়ে।
আজগর শেখ এসে চুপি দিয়ে দেখে যায় তার পুত্র ঘুমিয়েছে কীনা। এরপর অঅজগর মাথায় জিন্নাহ টুপিটা ভালো করে বসিয়ে ক্যাম্পে চলে আসে। সেখান থেকে কয়েকজন চ্যালাচামুণ্ডা আর তিনজন পাকিস্তানি আর্মি অফিসার নিয়ে ১৮ নং শশিমোহন বসাক লেনের দিকে এগিয়ে চলে। সবার অগ্রভাগে আজগর শেখ, তারপর তার চ্যালারা, এর পিছনে পাকিস্তানি জোয়ান কাঁধে রাইফেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
১৮ নং শশিমোহন বসাক লেনের বাড়ির কাছে এসে পৌঁছালে আজগর শেখ সবাইকে দু’হাত তুলে থামতে বলে। এক বিহারী বলে, ক্যায়া হুয়া আজগর?
কুচ নেহি।
সামজে চলো। আন্দারমে মুক্তি ফৌজবি...
ইয়ে বাত, বলে এক পাকিস্তানি অফিসার। তুম লৌক যাও ম্যায় দেখতাহু...
এরপর অঝোরে গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। এলাকার লোকজন প্রতিদিনের মতো গুলির শব্দে ঘুম ভাঙলেও অতটা আর আতংকিত হয় না। আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
লক্ষ্মিরানিকে জড়িয়ে ধরে সুরনাথ। এরই মধ্যে আজগর শেখ তার দলবল নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। লাথি মেরে এক বিহারী রাজাকার দরজা খুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু না পেরে আবারও এলোপাথারি গুলি চালায়। একটা গুলি এসে সুরনাথের পাজর ভেদ করে ঢুকে পড়ে। কিন্তু লক্ষ্মিরানিকে সেটা বুঝতে দেয় না। পাজর বেয়ে বেয়ে রক্ত বিছানার চাদরে ভাসিয়ে দিয়ে যায় আর ধীরে ধীরে সুরনাথের হাতের বাঁধন আলগা হতে থাকলে লক্ষ্মিরানি টের পায়, সুরনাথ আর নাই।
মায়াও ছুটে এসে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে। এরই মধ্যে রাজাকার হানাদার বাহিনী সাড়াশব্দ না পেয়ে গুলি করা বন্ধ করে।
আজগর শেখ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, আন্দারমে এক কচি ল্যাড়কি হে।
ক্যায়া?
ল্যাড়কি!
ইয়ে বাত! তো চালিয়ে আন্দারমে।
তারা সকলে মিলে দরজায় লাথি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে দরজা ভেঙে পড়ে। সকলে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সকলকে দেখে লক্ষ্মিরানি আর মায়া কী করবে বুঝতে না পেরে মায়া চিৎকার দেয়।
এক পাকিস্তানি অফিসার আঙুল তুলে চুপ করতে বলে। রাইফেল দিয়ে লক্ষ্মিরানির কপাল বরাবর গুলি করলে লক্ষ্মি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মায়া মাকে আর ধরে রাখতে পারে না।
আর্মি অফিসার বলে, ক্যাম্পে লিয়ে চ্যালো ল্যাড়কিকো।
কয়েকজন যুবক মায়াকে টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে। তিনজন মিলে যখন উঁচিয়ে মায়াকে নিয়ে যেতে থাকে, তখনি ঘটনাটি ঘটে। এমন ঘটনা কেউ কোনোদিন দেখেনি। বেঁচে থাকলেও হয়তো আর কেউ এমনটি দেখবে না। তিনজনের হাতের ফাঁক গলিয়ে মায়ার শরীর আকাশের দিকে উড়ে যেতে থাকে। সবাই অবাক হয়ে মায়ার উড়ে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে। তিনজন আর্মি অফিসার বাদে সকলে সুরা ইয়াসিন জোরে জোরে পড়তে থাকে। তিন আর্মি অফিসার রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করতে থাকে, ততক্ষণে মায়া অনেক দূরে চলে গেছে। সকলের নাগালের বাইরে। ছোটবেলা সকলে নানিদাদিমার কাছে পরির গল্প শুনলেও বাস্তবে তারা কখনও কোনো পরি দেখবে, এমনটা ভাবতে পারেনি। যদিও তাদের বিশ্বাস আছে জ্বীনে। তারা ধরে নিয়েছে, এটা আল্লাহর কোনো কুদরতি খেয়াল। কিন্তু মাইয়্যাতো বিধর্মী! তাইলে ক্যামনে সম্ভব? এসব ভাবনা তাদের মাথায় খেলতে থাকলে এক সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা আর মায়াকে দেখতে পায় না।
এই গল্প পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে, পাড়ায় মহল্লায় ছড়িয়ে যেতে থাকে। সবার মুখে মুখে যখন মায়ার পরি হয়ে উড়ে যাবার গল্প, তখন অনেক হিন্দু এমন কি মুসলমান মেয়েরাও আকাশে উড়ে যাবার জন্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু আর কোনো মেয়ে আকাশে উড়ে যেতে পারে না বলে, রাজাকার, পাক হানাদার, আলবদর আল শামসদের হাতে ধর্ষিত হতে থাকে লাখ লাখ মা-বোন। মায়ার উড়ে যাওয়া শুধু গল্প হয়ে যায় সবার মুখে মুখে।
তখন রাত পৌনে দুইটো বেজে গেছে। আমার চোখ ঘুমে ভেঙে আসছে। নিজের রুমে ফিরে রেডিওটা টেবিলের ওপর রেখে খাটে এসে শরীর এলিয়ে দেই। মাথার নিচে কোনও বালিশ নেই।
চলবে...