
চিত্র: রিফাত বিন সালাম
নীলকণ্ঠ
পর্ব ২
জয়িতা মৌসুমপ্রকাশিত : এপ্রিল ২১, ২০১৮
নীলার কেবল মনে হয়, দু-তিনদিন ধরে সে ঘুমিয়েছে সে। শংকর এসে বলে, কালরাতে কিছু একটা ঘটেছে, বেশ অদ্ভুত। নীলা তখন কালরাতের ঘটনা পুরোটা মনে করতে পারে না যদিও, তবু তার মনে পড়ে, ঝড়ের সময় একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল ওখানে, ছাদের ওপাশটায়। নীলা শংকরকে বলে, কি ঘটেছে অদ্ভুত? শংকর তখন মুখ কালো করে বলে, কালরাতে ঝড়ের বেগে বাড়ির একটা পুরোনো দরোজা ভেঙে গেছে। উত্তর দিকের একটা ঘরের দরোজা। নীলা বলে, হ্যাঁ। কালরাতে ঝড়ের বেগে ভীষণ শব্দ হচ্ছিল। বিচিত্র সব শব্দ। দরোজাটা পুরোনো, তাই হয়তো ভেঙে গেছে। শংকর তখন বলে, সে অন্য বিষয়, আপনি বুঝবেন না মা। নীলা উঠে বসে। শংকর তখন নিচের ঘরে চা করতে গেছে।
কালরাতের ব্যাপারটা নিছক ওরকম ভৌতিক কিছুই নয়। ঝড়ের বেগে এত শব্দ হচ্ছিলো , পাতার আওয়াজে হয়তো মনে হয়েছে- কেউ গান করছে এদিকে। আর ওই যে ছেলেটার অবয়ব সেও তার কল্পনা। শংকর চা নিয়ে এলে নীলা বলে- আজ বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত আপনি থাকুন, আমার বের হওয়া হচ্ছে না আর আজ। চলুন কোন দরোজা ভেঙ্গেছে দেখে আসি গিয়ে। শংকর বলে- মা, সাবধান! উত্তরের ঘরের যে দরোজাখানা ভেঙেছে , সেদিকে যাবেন না। নীলা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে- কেনো! মানে ওদিকটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বহু আগেই, ওদিকের ঘরগুলো ব্যবহার করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন পুরোহিত। কিন্তু কেনো ? শংকর মুখ কালো করে জানায়- সে অনেক কথা। এই বলে শংকর আবার চুপ হয়ে যায়। নীলা বলে- কাল রাতে আমি মনে হলো দেখলাম কিছু একটা ! শংকর তখন আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির বাড়ন্ত বেগ মেপে আরেকটা ঝড়ের আভাস বুঝতে চেষ্টা করে। মালিক কে একবার জানানো দরকার, ভাঙ্গা দরোজাখানার কথা। কিন্তু এই আবহাওয়াতে কেউ ঘর থেকেই বেরুতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বাড়ির একমাত্র ল্যান্ড ফোন নষ্ট। ওটা শংকর সকালেই একবার উঠিয়ে দেখেছে। চারিদিক কালো করে ঝড় নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে যেনো আকাশ।
শংকর নিচের ঘরে দুপুরের খাবার রাঁধতে যায়। নীলা তখন ভাবে সে নিজেই একবার দেখে আসতে পারে, ও ঘরটায় কি রয়েছে। চুপি চুপি সে উঠে উত্তরের ঘরটায় যায়, একটা দরোজা ভাঙ্গা , এদিকে পাশাপাশি দুটো ঘর। তার মধ্যে একতায় তালা দেয়া , অন্যটার দরোজা কাল রাতেই ভেঙ্গে গেছে। ঘরটায় ঢুকে সে , অন্ধকারে কিছু পুরোনো আসবাব দেখা যায়, ধুল জমা, বেশ পুরোনো সেসব। আর একটা ভাঙা হারমোনিয়াম পড়ে আছে, সেটা দেখতে বেশ অদ্ভুত, দেখে মনে হয়, বহু পুরোনো। হঠাত নীলার মনে হয়- এ ঘরটায় কেউ আছে , পাশ ফিরলেই হাঁটছে এদিক ওদিকে। নীলা তখন বেশ ভয় পেয়ে যায়। একরকম দৌড়ে বেরোয় সে ঘরটা থেকে। বেরুতেই দেখে শংকর দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ শক্ত। হঠাত শংকরকে দেখে নীলার বেশ অচেনা মনে হয়। অস্বস্তি হয়। শংকর ওর দিকে চেয়ে থাকে- ও ঘরে ঢুকবেন না, মা ! মালিকের নিষেধ আছে। আ-আমি ঢুকিনি, ও ঘর থেকে শব্দ আসছিলো , তাই- নীলার কথা শেষ হবার আগেই - শংকর তখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। দুপুরের খাবার নিয়ে শংকর উঠে আসে যখন- বাইরে তখন তুমুল ঝড় বৃষ্টি চলছে। নীলা কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই সে বলে যেতে থাকে- আরো ত্রিশ বছর আগে যুদ্ধের সময় এ ঘরটায় থাকতো মালিকের পরিবার। হিন্দু বলে আক্রমণের আশংকা বেশি ছিলো। সবাই পালিয়ে গেলেও মালিকের বাবা সুধীরনাথ পালিয়ে যাননি। আর যা হবার হলো , এক রাতে আক্রমণের সময় সবাই পালিয়ে গেলেও মালিকের ছোট কাকুকে ওই ছাদ থেকে ফেলে দেয় ওরা। শংকর খাবার না খেয়েই বিদেয় নেয় তারপর। যাবার সময় বলে যায় ও ঘরে ঢুকবেন না মা। ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও শংকর হন হন করে বেরিয়ে যায়। নীলা পুরো বাড়িটাতে একা বসে থাকে, এক যুগের নীরবতা নামে যেনো বাড়িটায় । এরপর সে রাতে যা ঘটে তা অকল্পনীয়। কোনো যুক্তিতে সেটা কেউ ব্যাখা করতে পারবে বলে মনে হয় না।