নীহার লিখনের `পিনাকী ধনুক` নিয়ে আমার কিছু কথা

কাজী নাসির মামুন

প্রকাশিত : অক্টোবর ০৩, ২০২০

নীহার লিখনের সাথে আমার চিন্তার দূরত্ব আছে। চৈতন্যের বিভিন্ন পসরা নিয়ে আমরা যখন আড্ডায় বসি তখন সকল বৈপরীত্য প্রাণবন্ত কথার মারপ্যাঁচে হারিয়ে যায়। কিন্তু বৈপরীত্য ঘোঁচে, এ কথা বলা যাবে না। এই বিপরীত ঐক্যই কবিতে কবিতে, লেখকে লেখকে তৈরি করে সম্পর্কের সোপান। বিভিন্ন অনুকূল কিংবা বৈরী চিন্তার ছুরি আমাদের পাশাপাশি থাকে। কবির কাজ প্রত্যাঘাত দেওয়া নয়, প্রতিহত করা। চিন্তাই হচ্ছে চিন্তাকে প্রতিহত করার ঢাল। কবি তাই ধারণ করেন। ধারণ করার অর্থ হলো বিপরীত চিন্তাকে স্বাগত জানানো। আর নিজের চিন্তাকে পরিচর্যা দিয়ে বিপরীত চিন্তার সামনে উপস্থাপন। যে-চিন্তার শক্তি বেশি, তা টিকে যাবে। দুর্বল চিন্তা হারাবে নিশ্চয়ই। কাজেই কবিকে সব কিছু দেখতে হয় নিরপেক্ষ দ্রষ্টার চোখ দিয়ে। নিজে সবকিছুতে নিযুক্ত হতে গেলে কবির নিরপেক্ষতা হারায়। ধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়।

শুরুতেই ভূমিকার বদলে এসব কথা বলে রাখবার প্রয়োজন বোধ করলাম। কেননা নীহার লিখন যাপিত সময়ের মধ্য দিয়ে নিজেকে আরও অভিজ্ঞ করে তুলবে। তার `পিনাকী ধনুক` পড়ে সেই অভিজ্ঞতার বহুলাংশ আঁচ করা গেল। তার দ্রষ্টা চোখ যদি আরও পরিপক্ক হয়, আমাদেরই লাভ। তাই অগ্রজের পক্ষ থেকে অনুজের প্রতি এটা আমার প্রত্যাশার বয়ান। কারও প্রত্যাশায় কারো জীবন গড়ে তোলার দায় হয়তো নেই। কিন্তু সম্পর্ক একটা অলিখিত অধিকার লালন করে। সেটা হয়তো ভালোবাসাও। সেই জায়গা থেকে বললাম কথাগুলো। কেননা আজকের সময় মুগ্ধতার নয়। বরং ক্রিটিক্যালি ধারণ করবার কালপরিক্রমায় আছি আমরা।

নীহার লিখন যাপনে অসম্ভব বোহেমিয়ান, সেই অর্থে আমাকে গৃহী বলা যায়। সে প্রচুর লিখতে পারে। আমার পরে শুরু করেও ইতিমধ্যেই সে আমার গ্রন্থসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। গ্রন্থসংখ্যা দিয়ে কারও শিল্পসত্তার গুরুত্ব নিরূপন সঠিক নয় হয়তো। কিন্তু বেশি লিখলে কিছু ট্র্যাশ ঝেঁড়ে ফেলা যায়। আমার মনে হয় নীহার লিখন সেই কাজটিই সম্পন্ন করছে। কিছুদিন আগে সে আমাকে `পিনাকী ধনুক` পড়তে দেয়। এটি গত বইমেলায় `বৈভব` থেকে প্রকাশিত তার একটি কাব্যগ্রন্থ। আরও একটি কাব্যগ্রন্থ গত মেলায় প্রকাশ করে সে। বইটির নাম `মনসিজ বাগানের শ্বেত`। কিন্তু আমার আলোচ্য গ্রন্থ `পিনাকি ধনুক`। এটি আমার স্বেচ্ছাকৃত আলোচনা।

একজন কবি আসলে কাউকেই ছাড়িয়ে যায় না। ছাড়িয়ে যায় নিজেকে। `পিনাকী ধনুক` পড়ে  নীহার লিখন সম্পর্কে এমন মনে হলো। পিতার প্রতি প্রেম, ব্রহ্মপুত্র নদের প্রতি আত্মার সংলগ্নতা কিংবা পড়শীর দিকে হৃদয়জ অনুভূতির বাইরে বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে এই গ্রন্থ বহুলাংশে দাঁড়াতে পেরেছে বলে মনে হলো আমার। ছান্দসিকতা কিংবা ছন্দের বাইরে পরিপক্ক আঙ্গিক নির্মাণের দিকে তার সতর্ক অবলোকন এই গ্রন্থে টের পাওয়া যায়। আজকের কবিতা কেবল স্ফূর্ত আবেগে গদ গদ হবে এমনটি ভাবা যায় না। প্রয়োজন নির্মিতির। কিছুটা আঙ্গিকের শাসন। এই দিকটায় নীহার লিখনের সুদৃষ্টি ছিল বলে মনে হয়। যদি ভাববস্তুর কথা বলি তবে দেখবো ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের মধ্যেই সীমিত থাকেনি তার কথামালা। এসেছে রাষ্ট্র প্রসঙ্গ, বন্ধুদের বিষয়, দার্শনিকতা, সামাজিক অবজারভেশন, রাজনীতি, প্রকৃতির ওপর প্রযুক্তির অভিঘাত, অভিমান, অনুশোচনা, প্রেম ও প্রেমহীনতার অনবদ্য অভিব্যক্তি। আর কিছু কবিতায় আছে গভীর প্রতীকিব্যঞ্জনা।

`পিনাকী ধনুক` অতিকথন ডিঙিয়ে একটা পরিমিতিবোধের মধ্যে ঋষিসুলভ ভারিক্কির দিকে পাঠককে আকৃষ্ট করবে বলে আমার ধারণা। যদি বলি এই জায়গায় নীহার লিখন নিজেকে ছাড়িয়েছে, তবে ভুল বলা হবে না। কেননা তুমুল বোহেমিয়ানিজমের অসতর্ক চাষবাস এ গ্রন্থের কোথাও পরিস্ফূট নয়। তবে মরা নদী যেভাবে রেখা ফেলে যায় তেমন কিছু অভিব্যক্তি তো অবশ্যই আছে:

‘নাসিক্য আর ত্বকপ্রধান জীবনের অভিমুখে দেখেছি
বৈকল্যই সুখের অবিসংবাদ`
কিংবা
`ঘর এক বিষণ্ণতার নাম, সেখানে আমরা থাকি, দু`পাটি ফুল আর পালিত খরগোশের ভীতু চোখের সীমায়`

বিষণ্ণ ঘর পেরিয়ে বৈকল্যের দিকে `সুখের অবিসংবাদ` যার বোহেমিয়ান জীবনের কামনার অন্তর্ভুক্ত, সে এই গ্রন্থে ফিরে আসে অন্য রকম ভালোবাসার শক্তি নিয়ে। সে বলতে চায় `শিশুর ঘুমে যে বিকাল শুয়ে থাকে`/`সেরকমই বোধ হয় ভালোবাসা নিরীহ সুন্দর।` তাই অভিযোগহীন তার দৃঢ় উচ্চারণ:

`ভালোবেসে পাইনি কিছুই, তবু রিক্ত লাগেনি কোনোদিন`

এই রিক্ত না-লাগা অনুভূতিই কবিতায় তাকে দিয়েছে ঋষির মনন। জীবনকে নানান এঙ্গেলে নিরীক্ষার পর মানুষ হয়তো হতে চায় স্থিতির পোষক। সেই স্থিতি আক্ষরিক অর্থে তার যাপনে পরিপুষ্ট হবে কিনা, বলা যায় না। কিন্তু কবিতায় পরিচর্যা পেলে জীবনবোধের নির্যাস পাঠককে তাড়িত করবে, এটা এক স্বাভাবিক বিশ্বাস। নীহার লিখনের `পিনাকী ধুনুক` পড়ে আমার সেই বিশ্বাসের হেরফের হয়নি। কিছু কিছু কবিতায় জীবন থেকে উৎসারিত দার্শনিক বোধ পাঠককে নাড়া দেওয়ার মতো। যা কখনো প্রতীক বা উপমা অথবা চিত্রকল্পে ধারণ করা। আবার কখনো সরাসরি ভাবব্যঞ্জনে খোলামেলা উঠে এসেছে। যেমন:

১.
সার্কাস ফেলে যাওয়া বেদির মতো
জোকারের সাততালি রঙের জামায়
কতটাই থাকে আর হাসির কোরক?
..................................................
পলেস্তারায় কোনো নাচঘর যদি
বেঁচে থাকে আজও
তুচ্ছ জীবন তবে কতটা বুঝেছে
মদ ও মন্দির?
..............................................
জানতে কি পেরেছি আমি?
এত যে তাসখন্দগুলো
তার আদৌ কি আছে কোনো মানে?
কতগুলো প্যালেস্টাইন থাকে?
মাহমুদ দারবিশ কতগুলো জানে?

২.
কালা কি আসে রাধার কুঞ্জে বান চলে গেলে?
................................................................
সব বিফলতাই একদিন হলুদ হয়ে যায় গৌরবে
জীবন নিয়ত মনে নিয়ে আসে হলুদ পাতার তুষ্টি সম্ভ্রম, যাকে ভাবা যেতে পারে পক্কতা, চলে যাওয়া মূলত কেন্দ্রের দিকে আসা।

৩.
মাংসের হরিণ চিরদিন মুছে যায় কস্তুরিতে

৪.
একটা কথাই বলি, দূরে চলে যাও
কাছে থেকে কিছুই দেখে না চোখ
.................................................
দূরে যাওয়া ছাড়া কে আর পেরেছে খুব কাছে যেতে

৫.
উড়ন্ত পাখির নিচে মানুষকে খুব পাথর মনে হয়

ব্যক্তি-মানসে সময়ের অভিঘাত উঠে এসেছে তার কিছু কবিতায়। আমরা যে ক্রমশ পারস্পরিক দূরত্বে অচেনা হয়ে যাচ্ছি `প্রাচীর` কবিতায় তা দৃশ্যমান। `মন্ত্রী` কবিতাটি শৈশব স্মৃতির আকর শুধু নয়, একটা শিশুতোষ গল্প। শিশুতোষ গল্প শুধু নয় ক্ষমতার নেতিবাচক আস্ফালনের বিরুদ্ধে এক নান্দনিক বিদ্রূপ। `নিয়ন্ত্রণ রেখা`কে পাশ কাটিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলবার আকুতি। `পুলিশ` কবিতাটিও প্রায় সেরকম। পড়তে গেলে সামান্য বিষাদ ছায়া ফেলে। চৈতন্য নিগূঢ় হয়ে ওঠে। পুলিশের বিপক্ষে নয়, তার প্রতি সমবেদনায়। হয়তো এই বেদনাও একটা অলিখিত বিদ্রূপ। রাষ্ট্রযন্ত্র সেটা না বুঝুক, তবু। পুলিশের ভয় দেখিয়ে মা আমাদের শিশুকালে ভাত খাওয়াতেন। সেই পুলিশের প্রতিই প্রশ্ন ছোড়ে নীহার লিখন:

ও পুলিশ, আপনার মা কেমন আছে!
আপনার কি শৈশবের কথা মনে পড়ে না আর!

`টাকা` কবিতায় একটা বাস্তব অবজারভেশন আছে। একটা নোট গুঁজে দিলে মানুষের জন্য কত কিছুই না চেয়ে দেয় একজন ভিখারি। অথচ নিজের জন্য চায় না কিছুই। হয়তো তার `ময়লা জামাটির রং কোনোদিন শাদা ছিল`। সে লিখেছে `চিরদিন দূরেই লাগে সংবিধান`। কিন্তু সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রের অনাচার কিংবা সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে তার বিদ্রূপ খুব রূঢ় হয়ে ওঠে না। তার অনুভূতি চৈতন্যে নাড়া দেয় কিন্তু দুর্মর আলোড়নে আন্দোলিত করে না। অথচ সে নিজেই বলে:

`দমিত হতে হতে একদিন মানুষও উঁকি দিতে চায় গন্তব্য নেই এমন কোথাও`
এই উঁকি দেওয়া আসলে গন্তব্যের দিকে ধাবমানতার আকুতি। সেই দিকে নীহার লিখনের কলম আরও উচ্চকিত হলে সময়ের সারবত্তা আরও স্পষ্ট উঠে আসতো বলে মনে করি। তার ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিপাত মায়ার আদলে পরিণতি পায়। এটি তার কবিতার স্বভাব দোষ অথবা মানবিক গুণ। কিন্তু শিল্পিত গুণের দিকে আরও এগিয়ে যেতে তাকে কবিতায় আরও একটু মায়া কাটাতে বলি। `মানুষ` নামক অপ্রয়োজনীয় একটি কবিতা সে এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছে। মানুষকে চেনানোর এই গতানুগতিক অভিব্যক্তি নতুন কিছু দেয় নি।

তার কবিতা মূলত শান্ত রস সমৃদ্ধ। `জারুল গাছ` কবিতাটি শান্তরসের চমৎকার উদাহরণ। আগ্রহী পাঠক নিজে পড়ে নেবেন আশা করি। দার্শনিকতার সকল ফল্গু প্রবাহিত হলেও সন্নিবেশিত কবি-হৃদয় কবিতার ছত্রেছত্রে বহমান। মগজ খাটানো কটমট চিন্তার যন্ত্রণা পোহাতে হয় না পাঠককে। টইটুম্বুর কবিত্ব বিভিন্ন ব্যঞ্জনে অভিসিক্ত করে আমাদের। একটা সাবলীল স্রোত আছে তার ভাষার। পাঠকের মনে সঞ্চারিত হবার ক্ষমতাসহ সেই ভাষা নিরীক্ষার বিপরীতে প্রচল গতিময়তা নিয়ে অগ্রসর। সর্বোপরি তার কবিতা মানবিকতার প্রতি আমাদের মনকে আবেগ মথিত করে। যার শিখরসূত্র প্রজ্ঞাময় হয়ে উঠবে একদা, সেই ইঙ্গিত বহন করে। `পিনাকী` মূলত মহাদেবের অন্য নাম। মহাদেবের ধনুক কতদূর গিয়েছিলো আমি জানি না। কিন্তু নীহার লিখন কবিতায় দূরগামী হবার অভিলাষ রাখে। `পিনাকী ধনুক` সেই প্রত্যাশায় তা দেবে, ওম ছড়াবে পাঠকের মনে, এমনটাই মনে হয় আমার।

লেখক: কবি

একুশে বইমেলা ২০১৮