
নেতাজির রাষ্ট্রভাবনা ও বর্তমান ভারত
পর্ব ১
ড. জয়ন্ত চৌধুরিপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৮
নেতাজি তিন অক্ষরের একটি নাম- একটি মন্ত্রের মতো, যা দেশপ্রেমিক হৃদয়ে ঝড় তোলে। মা ডাকের মতোই শিশু, যুবক ও বৃদ্ধরে আচ্ছন্ন করে এই ডাকটি। মহাবিশ্বের অনেক নক্ষত্রের ভিড়ে সূর্যের স্থান অনন্য। আলো আঁধারের জোয়ার-ভাটায় তিনি হারিয়ে যাননি। ভারতীয় উপমহাদেশে তাকে ঘিরে আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যম গুরুত্ব দিচ্ছে তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য প্রকাশ্যে আনার ব্যাপারে। কারণ তিনি সম্পূর্ণ জাতীয়বাদী হয়েও চিন্তাভাবনায় সর্বোপরি দেশের মুক্তি সাধনায় পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক। তার চোখে স্বাধীনতার অর্থ সর্বপ্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি।
কৈশোরে যখন হিমালয়ের টানে, সন্ন্যাসের আহ্বানে ভারতের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে বন্ধুকে নিয়ে সবার অগোচরে ঘুরে বেরিয়েছিলেন তখন প্রত্যক্ষ করেছিলেন জাতপাত দীর্ণ পরাধীন ভারতের রূপ। কাশী রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ ও শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম পার্ষদ ব্রহ্মানন্দের পরামর্শে বৃহত্তর মানবমুক্তির লক্ষ্যে সেবার তিনি ঘরে ফিরে এসেছিলেন। সুহৃদদের জানিয়েছিলেন অভিজ্ঞতার কথা। যার মূল ভাবনাই ছিল পরাধীনতা শুধু রাজনৈতিক দাসত্বের সৃষ্টি করে না, মানসিকভাবেও সংকীর্ণ করে তোলে। আইসিএস পরীক্ষার সাফল্যের পর বন্ধুকে লেখা পত্রে উল্লেখ করেছেন মান সম্মান যশ প্রতিপত্তি এসব তার জন্য নয়, সাগরের ঊর্মিমালার স্রোতে সংগ্রামময় জীবনই তার কাম্য।
স্বাধীনতাপিয়াসী সুভাষচন্দ্র আর এক সন্ন্যাসী যোদ্ধা মানবপ্রেমিক স্বামী বিবেকানন্দের মতো চিন্তা চেতনায় পোষণ করতেন। ১৯৩৭ সালে পাঞ্জাবের ডালহৌসি থেকে বন্ধুকে এক চিঠিতে লিখেছেন, ‘জীবন অন্তহীন সংঘাত। সমস্ত আবেগ জয় না করা পর্যন্ত কোনো শান্তি নেই। কিন্তু সংগ্রাম করতে করতে ধীরে ধীরে আনন্দ লাভ হয়, গভীর সন্তোষ ও আত্মবিশ্বাস আসে।’ সুভাষচন্দ্রের ‘তরুণের স্বপ্ন’, ‘ভারতের মুক্তির সংগ্রাম’ কিংবা অসমাপ্তআত্মজীবনী ‘ভারত পথিক’ বইগুলোর মধ্যে বিধৃত হয়ে আছে এক অসামান্য মনীষাদৃপ্ত বিপ্লবী হৃদয়ের ভাব ও ভাবনা। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতির প্রেক্ষিত এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ ভারতের স্বপ্ন সাধনের সংগ্রামময় জীবন দর্শনের পাশাপাশি আগামী পথ চলার অভিমুখ।
তিনি যখন বাংলার রাজনীতিতে, তিনি যখন সর্বভারতীয় রাজনীতির আঙিনায় দু’বারের নির্বাচিত জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি এবং পরবর্তী পর্যায়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে স্বীকৃত অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের রাষ্ট্র প্রধান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সুপ্রিম কমান্ডার, প্রতিটি ক্ষেত্রেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে পাওয়া গেছে ‘জনগণমন ভারত ভাগ্য বিধাতার’ প্রতিভূ রূপে। যদিও তার অখণ্ড ভারতভূমি ইতিহাসের নির্মম পরিহাসে অখণ্ড থাকেনি, তিনিও নির্মমভাবে উপেক্ষিত থেকেছেন, তবু তিনি কিছু মৌলিক ভাবনা-চিন্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন বিশ্বময় কর্মকাণ্ডের ব্যস্ততার মধ্যেও, যা আগামী দিনের পথের দিশারি হতে পারে। নানা বক্তৃতায় ও লেখায় তিনি আগামী ভারতের রূপরেখা তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন বারবার। তার শিক্ষা-পরিকল্পনা, নারী মুক্তি, অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, কৃষি ও শিল্পভাবনা, সাংস্কৃতিক ভাবনা, শিশু ও অসহায়দের ব্যাপারে পরিকল্পনা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের রূপরেখা, প্রতিরক্ষা, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্ক ও কর্তব্য প্রভৃতি বিষয়গুলো বর্তমান ভারতের প্রেক্ষিতে গবেষণা ও চর্চার দাবি রাখে।
সুভাষচন্দ্র শুধু ব্যক্তি নন, সঞ্চিত ঐতিহাসিক প্রয়োজনের যুগমূর্তি। নেতাজির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে ভারতবর্ষের মর্মবাণী। এই সহিষ্ণুতাই ভারতের সমাজধর্ম। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। বিরোধের মধ্যে সমন্বয়। এই হলো চিরন্তন ভারতের স্বধর্ম। এ স্বধর্মের সঙ্গে সংগতি রেখে নেতাজি ডাক দিয়েছেন। তিনি বৃটিশ পুলিশের লাঠির আঘাতে কলকাতার রাজপথে রক্তাক্ত হয়েছেন, ১১ বার কারারুদ্ধ হয়েছেন, হয়েছেন নির্বাসিত। অসরকারি রাষ্ট্রদূতের মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনসংযোগের পাশাপাশি স্বাধীনতার লক্ষ্যে ভারতের প্রকৃত চিত্র, তৎকালীণ বৃটিশ ভারতের অব্যবস্থা তুলে ধরেছেন নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও। তার বইয়ের পাণ্ডুলিপি বই প্রকাশের আগেই বৃটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। তার পক্ষে সম্ভব হয়নি কোনো প্রাসাদের বন্দি জীবন কাটানোর, অবসরে বই লেখার। তবু তিনি ভারতকে তার ‘ডিভাইন মাদার ল্যান্ড’কে মুক্ত করতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। যা একটা পরাধীন জাতির প্রতিনিধির পক্ষে কার্যত অসম্ভব ছিল। তার আন্তর্জাতিকতবাদের মূল তাই স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির ভাষণে হরিপুরায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু ভারতের জন্যই সংগ্রাম করছি না, সমগ্র মানবজাতির জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ভারতের স্বাধীনতার অর্থ মানবজাতির মুক্তি।’
বিদেশে বিশেষ করে কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পারস্য, আফগানিস্তান, মালয়, ইন্দোনেশিয়া, সিংহল প্রভৃতি দেশে ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বের কথা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। চেয়েছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভারতীয় সংস্কৃতি কেন্দ্র খোলা এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে একযোগে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির আদান-প্রদান। বিদেশে ভারতের প্রতি যত সহানুভূতিশীল, যত সহযোগী ও আগ্রহী করে তোলা যায় ততই ভারতের আন্তর্জাতিকতার কল্যাণ হবে বলে তিনি মনে করতেন। ১৯৩৫ সালে মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় ভারতীয় প্রচার কেমন হবে তা তিনি স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন, ১. ভারতের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার খণ্ডন। ২. ভারতের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে পৃথিবীকে জানানো। ৩. মানব জীবনের বিভিন্ন দিকে ভারত যে উন্নতি করেছে, জগৎবাসীকে তার পরিচয় দান। তার মতে, এই আন্তর্জাতিক প্রচারগুলোর উপায় হচ্ছে, ১. ভারতবাসী সমস্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেবে। ২. বিদেশি সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে ভারত সম্বন্ধে রচনা থাকবে। ৩. বিদেশি নানা ভাষায় ভারত সম্পর্কে বই প্রকাশ করতে হবে। ৪. ইউরোপ ও আমেরিকায় ভারতীয় সাহিত্যের একটি কেন্দ্রীয় পাঠাগার খুলতে হবে। ৫. আমাদের দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দিক নিয়ে প্রচারের জন্য উপযুক্ত ও শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়মিতভাবে বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ৬. বিদেশে ভারতীয় ছায়াচিত্রের প্রদর্শনী করতে হবে। ৭. ভারতের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্মিলিত সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ৮. ভারত ও বিদেশি পণ্ডিতদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে এবং বিদেশি পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে ভারতে। ৯. ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্যেও বিদেশে যুক্ত সংঘ গড়ে তোলা যেতে পারে। ১০. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ভারতের জন্য কাজ করছে তাদেরকে সাহায্য করতে হবে।
সুভাষচন্দ্রের এমন দিক-নির্দেশ আধুনিক বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্যই কমবেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক মতবাদ সম্পর্কে একদা নেতাজি বলেছিলেন, যে কোনো ‘রংস’ এর সমর্থকরা মনে করেন যে, সেই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে বিশ্বে স্বর্গরাজ্য নেমে আসবে, কিন্তু যতক্ষণ না আমরা মনুষ্যোচিত চরিত্রবল অর্জন করতে পারছি ততক্ষণ কোনো মতবাদই কার্যকর হতে পারে না। সুভাষচন্দ্র সেদিন যা বলেছিলেন তা আজ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ও বিশ্ব রাজনীতির দর্পণের সত্য বলে বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। তরুণ সুভাষচন্দ্র তার মথুরা ভাষণে (মে ১৯৩১) ডাক দিয়েছিলেন, ‘আমাদের সম্মিলিত জীবনের ভিত্তি হবে ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা ও প্রেম। .. মানুষের জন্য প্রেমানুভুতিতে উদ্দীপিত না হলে আমরা সকলের প্রতি ন্যায়নিষ্ঠ হতে পারবো না।
সব মানুষকে সমান বলে ভাবতে পারব না। স্বাধীনতার জন্য কষ্ট সহ্য করতে ও ত্যাগ করতে পারব না এবং সঠিক শৃঙ্খলার প্রবর্তন করতে পারব না। আজকের ভারতেও তার সেদিনের ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করা যায়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে তার ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ১৯৩১ সালে জামশেদপুরে টাটা আয়রন এন্ড স্টিল শ্রমিকদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে যে ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ অভাব-অভিযোগ ও দাবি তিনি উত্থাপন ও আলোচনা করেছিলেন, আজও যেকোনো মঙ্গলকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম সূচক হিসেবে সেগুলো পরিগণিত হতে পারে।
চলবে...
লেখক: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর ডক্টরেট, নেতাজি সম্পর্কিত অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থের প্রণেতা ও সম্পাদক, আলিপুর বার্তা, কলকাতা