নেতাজির রাষ্ট্রভাবনা ও বর্তমান ভারত

পর্ব ২

ড. জয়ন্ত চৌধুরি

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮

আজকের স্যোশাল মিডিয়ায় বা এসএমএস ভাষায় দেশজুড়ে ভাব আদান-প্রদানের অবাধ গতি লক্ষ্য করা যায়। সুভাষচন্দ্র বহু বছর আগে রোমান হরফে হিন্দি-উর্দুর মিশ্রণে হিন্দুস্থানি ভাষায় ভারতের ভাষা সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা ও নতুন ভারতে বিভিন্ন বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, এ নিয়ে ১৯২৮ সালে ‘ইন্ডিপেডেন্স লিগ অব ইন্ডিয়া’র বাংলা শাখার ইশতেহার তিনি লিখেছিলেন। সেই কর্মসূচিতে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র (শিল্প ও কৃষি), রাজনৈতিক গণতন্ত্র (পূর্ণ স্বাধীনতা), সামাজিক গণতন্ত্র (বর্ণপ্রথা, নারীমুক্তি, বিবাহ পৌরোহিত্য) ইত্যাদি বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯২৪ সালে তরুণ সুভাষচন্দ্র ‘আধ্যাত্মশক্তি’ পত্রিকার পরিচালনভার গ্রহণ করেন। সেখানে একটি সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন, আমাদের সমাজে নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। এক কথায় পুরুষ যে স্বাতন্ত্র্যের স্বাধীনতা ভোগ করছে, নারীকেও আমরা স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী দেখতে চাই।

আরেক সভায় তিনি বলেছিলেন, সমস্ত প্রাণ দিয়া কি আমরা জননী ও জন্মভূমিকে ভালোবাসি? জননীকে ভালোবাসার অর্থ শুধু নিজের প্রসূতিকে ভালোবাসা নয়, সমস্ত মাতৃজাতিকে ভালোবাসা। আজাদ হিন্দ সরকারের নানা প্রকাশনা ও বুলেটিনে এমন নানা ভাবনাচিন্তা লক্ষ্য করা গেছে। নারী মুক্তি ও শিক্ষার লক্ষ্যে তার চিন্তাভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিপ্লবী লীলা নাগ, লতিফা বসুসহ বহু নারী এগিয়ে এসেছিলেন নানা বিদ্যালয় ও সংগঠন স্থাপনের মাধ্যমে। আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রিপরিষদে ছিলেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাধন। ঝাসিরানী বিগ্রেড সম্ভবত পৃথিবীর যুদ্ধ-ইতিহাসে এক অনন্য নজির হয়ে থাকবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর যখন প্রথম মহিলারা সামরিক বাহিনীতে ঢোকার সুযোগ পেলেন, এর আগে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় রণাঙ্গনে সামরিক পোশাকে কাঁধে রাইফেল তুলে নিয়ে বুকের রক্তে মাতৃভূমির মুক্তি সংগ্রামে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শুধু নারী নয়, যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষ পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে তাদের অংশগ্রহণ ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ।

স্বাধীন ভারতের যোজনা আয়োগ সুভাষচন্দ্র পরিকল্পিত ন্যাশনাল প্লানিং কমিটির উত্তরসূরী হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে। পরাধীন দেশের ‘রাজবিদ্রোহী’ সুভাষচন্দ্র অনুভব করেছিলেন, ভারত তার স্বাধীনতা ফিরে পেলে দ্রুত জাতীয় পুনর্গঠনের কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে স্বাধীন ভারত তাকে স্বীকৃতি দিক আর নাই দিক, তার দেখানো পথেই এসেছে ভারতের জাতীয় সংগীত কিংবা বিভিন্ন সামরিক অসামরিক পুরস্কার প্রদানের রীতিনীতি। ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির পাশাপাশি ১৯৪০ সালের মে মাসে সুভাষচন্দ্রের বিবৃতিতে ‘ন্যাশনাল ইকনোমিক ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নতি অর্থাৎ জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি যা কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতির দ্বারাই সম্ভব, এমন ভাবনার ভিত্তিতেই ওই বোর্ড গড়ে ওঠে। অনেকগুলি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস ও পরিকল্পনা থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি। কৃষি উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপগুলির কথা বলা হয়েছে:
১. জমির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে মরামজা নদী ও খালের সংস্কার। কোথাও সেচের জল সরবরাহের জন্য, কোথাও বা জমা জল নিষ্কাশনের জন্য নতুন জলপথের সৃষ্টি, উপযুক্ত সার সরবরাহ, চাষের জমি এবং নানা প্রকার কৃষিজ উৎপাদনের উন্নতির জন্য প্রয়াস।
২. ক্ষেতের উৎপাদনের সর্বাধিক ফল যাতে কৃষক লাভ করে তার ব্যবস্থা করা।
৩. আইনের দ্বারা চাষের জমি আরও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া রদ করা। কারো অধিকারে বাড়তি জমি থাকলে তা নিম্নমানের জমির মালিকদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা করা।
৪. চাষের জন্য সরকারি ঋণদানের ব্যবস্থা করা।
৫. প্রত্যেক ইউনিয়ন বোর্ডের এলাকায় সমবায় সমিতি স্থাপন করা। এ সমিতিগুলি উন্নত ধরণের চাষের উপযোগ্য বীজ ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ ও সরবরাহ করবে।
৬. কৃষিজ উৎপাদন থেকে লব্ধ আয় যথা সম্ভব সঞ্চয় করবার জন্য কৃষিজীবিদের শিক্ষা দেয়া।
এ  সঞ্চয় চাষ না হলে বা নষ্ট হলে তাদের সাহাষ্য করবে। পরিবারের উপায়ী মানুষের কোনো দুর্ঘটনা হলে বা মৃত্যু হলে তার নিজের বা পরিবারের অন্য সকলের জীবনধারণের জন্য এই সঞ্চয় সহায়তা করবে। এমন সব বাস্তব ভাবনাচিন্তা পরাধীন দেশের মুক্তিকামী মানুষের চিন্তা-চেতনায় ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন সেই ছাত্র অবস্থা থেকেই। প্রেসিডেন্সি কলেজের তরুণ ছাত্রনেতা সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ অধ্যাপকের ভারত বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদে ক্লাস বয়কট ও ছাত্র ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন। ছাত্র সমাজের কাজে বৃটিশ বিরোধী ও দেশপ্রেমের এ বার্তা নিয়ে সফলভাবে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। যে সমস্ত ছাত্র বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের প্রথাগত পঠন-পাঠন ছাড়তে বাধ্য হয়, তাদের শিক্ষার জন্য দেশবন্ধু পরিকল্পিত জাতীয় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। শিক্ষকতা ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলে প্রয়োজনে ক্লাসরুমের টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করতেন বলে জানা যায় তার সহকর্মীদের স্মৃতিচারণায়। ঠিক যেমনটা জানা যায় ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকায় অফিসে কর্মক্লান্ত সুভাষ বহু সময় বাড়ি ফিরে যেতেন না। টেবিলে, বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিতেন। ১৯২৩ এর বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল অ্যামেনমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৯২৪ এ চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা পুরসভার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন। তখন সুভাষচন্দ্রও পুরসভার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। মেয়রের আহ্বানে এ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি প্রথম হিসাবে মাত্র ২৭ বছর বয়সে চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার পদে যোগ দেন। সেসময়কার  দিনে এই গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য মাসিক বেতন ছিল তিন হাজার। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু বেতন হিসাবে নিতেন মাত্র এক হাজার পাঁচশো টাকা। অর্ধেক টাকা তিনি কলকাতা পুরসভাকে দান করে দিতেন, যা আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে ভাবলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। সুভাষচন্দ্রের গৃহীত বেতনের টাকা থেকে তিনি সমাজসেবা ও দেশব্রতী কর্মীদের সাহায্য করতেন বলে জানা যায়। দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের পরিচালনায় কলকাতা পুরসভার কাজকর্মে নতুন যুগের সূচনা হয়।

অন্যদিকে গুরু শিষ্য মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘দক্ষিণ কলকাতা সেবক সমিতি’ ও অনাথ শিশুদের জন্য ‘দক্ষিণ কলকাতা সেবাশ্রম’। প্রথমটিতে পাঠাগারসহ দেশপ্রেমিক তরুণদের সমাজ উন্নয়নমূলক আলোচনার জায়গা অন্যটিতে অনাথ শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নৈতিক ও বৌদ্ধিক উন্নতির জন্য সুভাষচন্দ্রের ভাবনার প্রয়োগ ক্ষেত্র। জেল থেকে পাঠানো বন্দি সুভাষচন্দ্র একটি মর্মস্পর্শী চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তাকে অনেকে অভিযোগ করেন গুটিকয় অনাথ ছাত্রের জন্য তিনি অর্থ ও সময়ের অপচয় করছেন। তিনি স্পষ্টভাষায় লিখেছিলেন, জাতীয় কংগ্রেস তিনি ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু দক্ষিণ কলকাতা সেবাশ্রম ত্যাগ করা তার পক্ষে অসম্ভব। কারণ এমন দরিদ্রনারায়ণ সেবার সুযোগ কোথায় পাইব? ১৯২৪ এর ১ মার্চ সুভাষচন্দ্র ভাবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশানের সভাগৃহে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় দক্ষিণ কলকাতার অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রম গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৩২ সালে কলকাতা করপোরেশনের দেয়া ১৩ কাঠা জমিতে নিজস্ব গৃহ নির্মিত হলেও এর আগে বিভিন্ন ভাড়া বাড়িতে সুভাষচন্দ্রের স্বপ্নের অনাথ আশ্রম চলত। ১৯২৬ সালে ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) মান্দালয় জেল থেকে সহকর্মী ভূপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা হয়তো জানেন না যে, দক্ষিণ কলকাতা সেবাশ্রমের ত্রুটির জন্য আমি প্রধানত দায়ী। বাহিরে থাকিতে আমি ভালোরকম অর্গানাইজ করিতে পারি নাই। তারপর হঠাৎ আমার গ্রেপ্তার। যখন সেবাশ্রম কালীঘাটে ছিল, তখন বাড়িভাড়া ও সহকারী সম্পাদকের বেতন আমি নিজে দিতাম। শুধু বালকদের ভরণপোষণের খরচ সাধারণের চাদা হইতে নির্বাহ হইত।... আমার গ্রেপ্তারের পরা আমার দেয়া অংশ আমার দাদা (শরৎ বাবু) দিয়া আসিতেছেন।’ উল্লেখ্য জেল থেকে বসে সুভাষচন্দ্র আশ্রমের গ্রন্থাগারে কী কী বই রাখতে হবে তার বিস্তারিত তালিকা, তাদের পাঠ্যসূচি ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখতেন। নির্দেশ দিতেন আশ্রমের সহসম্পাদককে।

এশিয়ার প্রথম পুরসংবাদপত্র ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গ্যাজেট’ সুভাষচন্দ্রের মস্তিষ্ক প্রসূত। ১৯২৪ সালের ১৫ নভেম্বর এই গ্যাজেট প্রথম প্রকাশিত হয়। দরিদ্র মানুষের কল্যাণার্থে এই সময় পুরসভার যে সমস্ত কর্মসূচির ঘোষণা জানা যায় তার খবর পাওয়া যায় এক বছর পূর্তির বিশেষ গ্যাজেটের সংখ্যায়। জানা গেছে, মেয়রের প্রথম বক্তৃতায় যে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, দরিদ্রদের জন্য নিখরচায় চিকিৎসা, সস্তায় খাঁটি খাবার ও দুধ সরবরাহ, বস্তি এলাকায় উন্নততর পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা, দরিদ্রদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্প, সংযোজিত পুর এলাকার উন্নয়ন, যানবাহন ব্যবস্থার উন্নতি এবং খরচ কমিয়ে প্রশাসনের উন্নয়ন। আসলে দরিদ্র জনগণ ভারতীয় ঐতিহ্যে যাদের ‘দরিদ্র নারায়ণ’ বলা হয় তাদের কল্যাণেই যে পুরসভা পরিষেবার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, দেশবন্ধু তাদের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সে কথাটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে অক্টোবরে বিপ্লবীদের যোগসাজশের অভিযোগে বৃটিশ সরকার সুভাষচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করে সুদূর মান্দালয় জেলে দীর্ঘ সময় বন্দি করে রাখে। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ১৯২৭ সালে তিনি মুক্তি পান। ১৯২৫ সালের ১৬ জুন দেশবন্ধুর প্রয়াণের দুসংবাদ পান সুভাষচন্দ্র। পরবর্তীকালে কলকাতা পুরসভার মেয়র হয়েছেন। নির্বাচিত হয়েছেন অল্ডারম্যান হিসেবেও। কিন্তু পুরসভা পরিচালিনার অখণ্ড অবকাশ তিনি পাননি। ১৯৩১ সালের ২৬ জানুয়ারি মেয়র সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে মিছিলের উপর পুলিশের  লাঠিচালনা ও তার গ্রেপ্তার পুরসভার ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনা। কারারুদ্ধ সুভাষচন্দ্র বিভিন্ন সময় বারবার পুরসভার নানা প্রকল্পের পরিকল্পনা পাঠিয়েছেন সহকর্মীদের কাছে চিঠি মারফত। ১৯২৫ সালে তিনি মান্দালয় জেল থেকে এক বার্তায় লিখেছেন, ‘পৌর শাসনের সাফল্য নির্ভর করে জনগণের সচেতনতা এবং করদাতা ও পৌর শাসকদের সহযোগিতার উপর। আমার বিশ্বাস, এই গেজেট নাগরিকবৃন্দের সচেতনতা জাগ্রত করতে সাহায্য করবে এবং উভয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হবে।’ তিনি পরের বছরে গেজেটে কোন কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া উচিত এ নিয়ে চৌদ্দদফা কর্মসূচি ভাবনার কথা লিখেছেন, যার ব্যাপ্তি ও গভীরতা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পৌর সমাজতন্ত্র বা মিউনিসিপ্যাল সোশ্যালিজমের ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পুরসভা প্রকল্পের মধ্যে সুভাষচন্দ্র একদিকে যেমন রাস্তার আলো, মহামারি প্রতিরোধ, জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও হাসপাতালের উন্নতি; তেমনি তিনি দৃষ্টি দিতে চেয়েছেন বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, বস্তি উন্নয়ন, দরিদ্র মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ বিষয়ে। তিনি মোটর ভেইকলস বিভাগ ও পৌর রেল ব্যবস্থার পুনর্গঠন, দুধ সরবরাহ, বার্ধক্যগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য চিকিৎসালয় এবং সমাজের গভীর সমস্যা পতিতাবৃত্তি ও ভিক্ষাবৃত্তির সমস্যা নিয়েও তিনি ভাবনাচিন্তা করেছেন। অন্যদিকে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের স্বার্থে তিনি ভাবতে শুরু করেছেন রঙ্গমঞ্চ, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি, পৌর মিউজিয়াম ও গবেষণাগার নিয়ে। পৌর পরিষেবার এমন উদার পটভূমির পাশাপাশি জেলে বসেই পুর প্রশাসন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। ৪ ডিসেম্বর ১৯২৫ এক চিঠিতে তিনি মিউনিসিপ্যাল মার্কেটে খাদ্য অপচয় রোধ ও সংরক্ষণের উদ্দেশে হিমঘর প্রতিষ্ঠা ও বিদ্যাধরী নদী সংস্কারের নানা সম্ভাবনার বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। রাস্তায় গ্যাসের আলোর বিদ্যুতিকরণ, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন এবং বসন্ত রোগ প্রতিরোধের নানা ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানালেন তরুণ সুভাষচন্দ্র। বাবু কালচারে সমৃদ্ধ পুরনো কলকাতাতে খোলনলচে বদলে জনমুখি উন্নয়নমূলক ভাবনাচিন্তার বাস্তবায়নের পথে কলকাতা পুরসভা হেঁটেছিল সুভাষচন্দ্রের হাত ধরেই। ১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি আরেক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ‘বিশেষ পণ্যের জন্য একেকটি এলাকায় সেন্ট্রাল মার্কেট গড়ে তুলতে পারলে সাধারণ মানুষের কত উপকার হতে পারে।’ এরই সঙ্গে তিনি নানা অভিনব চিন্তার কথাও বলেছেন। যেমন তিনি চেয়েছিলেন গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ বা আদর্শ পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনের কাজ শুরু করতে। একই সঙ্গে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ্যসূচিতে তিনি পৌর প্রশাসনকে অর্ন্তভুক্তির কথা বলেছেন। আজ যখন ভারতজুড়ে স্বচ্ছ ভারত ভাবনার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, সেদিনের প্রায় ৩০ বছরের কারারুদ্ধ যুবক সুভাষচন্দ্রের ভাবনার প্রাসঙ্গিকতার অবকাশ রয়ে গেছে।

চলবে...

লেখক: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর ডক্টরেট, নেতাজি সম্পর্কিত অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থের প্রণেতা ও সম্পাদক, আলিপুর বার্তা, কলকাতা