ন্যায় প্রতিষ্ঠার কঠিন লড়াইটা একাই লড়তে হয়

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জানুয়ারি ০৪, ২০২৩

সক্রেটিসের লড়াইটা ছিল খুব কঠিন। সক্রেটিসের সে লড়াইটা সবার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। মাত্র একজন মানুষ একা গোটা একটা রাষ্ট্রের প্রচলিত চিন্তাকাঠামোর বিরুদ্ধে লড়ছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দু’হাজার পর তাই লিখেছিলেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...।

 

যারা নিজের মহৎ চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, সমাজের প্রতি নিজের `দায়বদ্ধ` একটা চেতনা লালন করেন, সমাজের বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে তাদের চিন্তার মিল হয় না। ফলে একটা সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও তাদের ছেড়ে চলে যায় বা তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। তখন সম্পূর্ণ একা লড়তে হয়, গোটা একটা রাষ্ট্র এবং সমাজের বিরুদ্ধে।

 

সক্রেটিসকে একইভাবে তার সময়ে একাই লড়তে হয়েছিল। লড়াইটা এত কঠিন ছিল যে, তাকে নিজহাতে বিষপান করে মৃত্যুদণ্ড মেনে নিতে হয়। কী ছিল তার অপরাধ? তিনি কিছুই করেননি, শুধুমাত্র নতুন চিন্তা করা ছাড়া। তিনি কাউকে আক্রমণ করেননি, তিনি নিজের মত প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। সেই মত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল বলেই, সমাজের কর্তাব্যক্তিরা তা মানতে পারল না।

 

কর্তাব্যক্তিরা ঠিকই বুঝল, সেই মত প্রচার হতে দিলে যুব সমাজের মধ্যে সক্রেটিসের প্রভাব বাড়বে। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাগুলো নড়বড়ে হয়ে যাবে তাতে। শাসকরা, ক্ষমতাবানরা ভয় পেয়েছিল সেজন্য। সক্রেটিস শুধুমাত্র প্রশ্ন তুলেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন মানুষের জ্ঞান নিয়ে। সেই সমাজে যারা নিজেদের বিজ্ঞ ভাবত, সমাজের নানা স্তরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, নিজেদের ইচ্ছাগুলো চাপিয়ে দিতে চাইতো, সক্রেটিস তাদের চিন্তাগুলোর বিভ্রান্তি নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা দান করেছিলেন মাত্র।

 

সক্রেটিস নিজেকে জ্ঞানী ভাবতেন না। তিনি বরং সত্যকে উপলদ্ধি করা বা জানার চেষ্টা করতেন। তিনি জানতেন, তিনি নিজে বিশেষ কিছু জানেন না। কারণ জ্ঞানের জগৎ বা জানার জগৎটা বৃহৎ। সেখানে একজন মানুষ খুব কমই জানার সুযোগ পায়। কিন্তু তিনি দেখতে পেলেন, তার চারপাশের মানুষরা কিছুই সঠিকভাবে জানে না, কিন্তু নিজেকে বিরাট পণ্ডিত ভাবে। নিজেদের জ্ঞানী ভেবে অহংকার করে।

 

সেই অবস্থাতেই এথেন্সের ডেলফি মন্দির একদিন এমন বাণী উচ্চারণ করলো যে, সক্রেটিস দ্বিধাগ্রস্থ হলেন নিজেকে নিয়ে। ঘটনাটা হলো, সেই সময়কার প্রথা হিসেবে ডেলফি মন্দির একদিন ঘোষণা করে বসলো, সক্রেটিস হচ্ছে এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। সক্রেটিস যখন এ খবর পান তখন তিনি নিজে তা বিশ্বাস করেননি। ফলে তিনি নিজে গিয়ে ডেলফি মন্দিরে উপস্থিত হলেন। মন্দিরের পুরোহিত তখন আগের মতোই দেবতাদের পক্ষে ঘোষণা করলেন, সক্রেটিস এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ।

 

সক্রেটিস তখন দ্বিধাগ্রস্থ। ডেলফি মন্দিরের পুরোহিত যা বলেছে তা কী করে সম্ভব হতে পারে! তিনি সবচেয়ে জ্ঞানী হলেন কী করে? তিনি তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞানের কিছুই জানেন না। তিনি তখন নিজের জ্ঞান যাচাই করার জন্য এথেন্সের বিজ্ঞ লোকদের দ্বারে দ্বারে গেলেন। তিনি তাদের কাছে নানা বিষয় জানতে চাইলেন। সকলেই বিজ্ঞের মতো তার প্রশ্নের জবাব দিল। সক্রেটিস সেইসব জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। সক্রেটিস দেখলেন, মানুষ সঠিকভাবে না জেনেই নির্ধিদ্বায় কত কথার জবাব দিয়ে দিচ্ছে। তিনি দেখলেন, সেইসব লোকরা কিছু যে জানে না, নিজেরা সেটাও জানে না।

 

সক্রেটিস তখন ডেলফি মন্দিরের ঘোষণাকে সত্যি বলে ধরে নিলেন। কারণ তিনি যে কিছুই জানেন না, নিজে অন্তত এইটুকু জানেন। ফলে সক্রেটিস মনে করলেন, তিনি বাকিদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী। সক্রেটিস যে জানেন না বা তিনি যে অজ্ঞ, সেইটুকু তো তিনি জানেন। বাকিরা সেইটুকু জানেন না। বাকিরা কিছু না জেনেও মনে করেন বহু কিছু জানেন। সক্রেটিস তাই পরবর্তীতে সকলকে বললেন, আগে নিজেকে জানো। নিজেকে চেনো।

 

সক্রেটিস জ্ঞানের সন্ধানে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলেন। তিনি সেসবের উত্তর পাবার চেষ্টা চালালেন। তিনি নিজে কাউকে কিছু শেখাতে গেলেন না। তিনি নিজের মতো করে নানান প্রশ্নের উত্তর পেতে চাইলেন। সকলকে বললেন, জ্ঞানের সন্ধান করতে। তিনি নিজে কাউকে জ্ঞান বিতরণ করলেন না। তিনি সকলের সঙ্গে সংলাপ চালালেন সত্য আবিষ্কারের জন্য। জ্ঞান অন্বেষণে সক্রেটিসের পদ্ধতি যুবকদের আকৃষ্ট করলো। কারণ জ্ঞান তিনি কখনো কারো উপর চাপিয়ে দিতেন না। সকলকে অনুসন্ধানের ভিতর দিয়ে সেখানে পৌঁছানোর কথা বলতেন। সেই পথটাই ছিল প্রশ্ন ও উত্তর আবার প্রশ্ন আবার উত্তর এই পদ্ধতিতে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া।

 

সেই পদ্ধতিতে `ন্যায়` সম্পর্কে নতুন সব ধারণা জন্মলাভ করতে থাকে যুবসমাজ। সমাজের বিজ্ঞ বা ক্ষমতাবানদের প্রতিষ্ঠিত আসন তাতে টলে যাবার উপক্রম হয়। কারণ বিজ্ঞরা এতদিন জ্ঞান দান করার নামে যা কিছু বলেছিল তা অসার প্রমাণিত হতে থাকে। ফলে ক্ষমতাবানরা সক্রেটিসকে ভয় দেখাতে থাকল, তিনি যেন প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুবকদের উল্টোপাল্টা কিছু না শেখান। সক্রেটিস ভয় পেলেন না। তিনি নিজের জ্ঞান অনুসন্ধানের পথ থেকে সরে দাঁড়ালেন না। তিনি কারো সঙ্গে বিরোধে গেলেন না। নিজের সত্য অনুসন্ধানের পথে অটল রইলেন। ফলে ক্ষমতাবানরা সক্রেটিসের বিরুদ্ধে সকলকে ক্ষেপিয়ে তুলতে আরম্ভ করলেন।

 

সক্রেটিসকে যে ডেলফি মন্দির একদিন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীর শিরোপা দিয়েছিল শাসকদের স্বার্থে তারাও সক্রেটিসকে সেদিন বর্জন করলেন। সক্রেটিস জানতেন, এতদিন জ্ঞানচর্চা যে পথে এগিয়েছে তাকে ধ্রুব বলে মনে করা হতো। জ্ঞানচর্চার জগতকে ধ্রুব হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ জ্ঞান কখনো কোথাও এসে থেমে যায় না। জ্ঞান সর্বদা জ্ঞানকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। জ্ঞানকে তাই খাঁচায় বন্দি করা যায় না। সক্রেটিসের লড়াইটা খুব বড় কিছু নয়। কিন্তু তাৎপর্য গভীর। কারণ সঠিক জ্ঞান লাভের পথে তা বাধা সৃষ্টি করে না। জ্ঞান সেখানে প্রবাহমান। কারো বিশ্বাসের জায়গায় এসে জ্ঞান সেখানে থেমে পড়ে না।

 

প্রচলিত ধ্যান-ধারণার প্রতি গভীর আস্থার কারণে অনেক তাই সক্রেটিসের জ্ঞান অনুসন্ধানের পথ বা পদ্ধতিটা বুঝতেই পারেনি। সক্রেটিস সেই সমাজে একাই নতুন এক জ্ঞানচর্চার পথ দেখাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠিতরা তা কিছুতেই মানতে রাজি নয়। বিরাট এক নগররাষ্ট্রের ভিতরে সক্রেটিস একা প্রাচীন চিন্তাপদ্ধতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সকলের ইচ্ছার বিপরীতে জ্ঞানলাভের নতুন পথের কথাই বলে যাচ্ছেন। তিনি কাউকে আক্রমণ করছেন না, কিন্তু তবুও বাকিরা তাঁর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। সক্রেটিস নিজের বিপদ জানেন, অথচ সত্যানুসন্ধান থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন না। সক্রেটিসকে সে কারণে আজকের দিনের মানুষরা সম্মান জানালেও, সেদিনের শিক্ষিত সমাজ তাকে সহ্য করতে পারেনি।

 

যুগে যুগেই এমন ঘটেছে। সমাজে যারা নতুন সত্য প্রচার করতে চেয়েছে বাকিরা হয় তাদের ভুল বুঝেছে, নাহলে তাদের প্রতিপক্ষ ভেবেছে। সত্যিকারের জ্ঞানীরা সেখানে কাজ করতে বাধা পেয়েছে। সবসময় দেখা গেছে, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধর, সমাজে যারা প্রতিষ্ঠিত তাদেরই পক্ষে বেশি মানুষ কথা বলেছে। যারা নতুন সত্যের পতাকা তুলে ধরেছে তাদের পক্ষে ছিল সামান্য মানুষ। সবাই তেল মাথায় তেল দিতে পছন্দ করে। নতুন সত্য উপলব্ধি করার, নতুন সত্যকে ধারণ করার বোধ বা সামর্থ বা সাহস সবার থাকে না।

 

যিনি নতুন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান, সহজে তিনি তাতে থেমে পড়েন না বা দমে যান না। নিজকালে তিনি সাফল্য না পেলেও, কয়েক যুগ বা কয়েক শতক পর সাফল্য পান। চার্বাক, সক্রেটিস, ব্রুনো, গ্যালিলিও সকলের ক্ষেত্রেই সেটা সত্যি। সক্রেটিস সাফল্য লাভ করেছিলেন তার মৃত্যুদণ্ডের পর। সক্রেটিসের শিষ্য প্লাটো সক্রেটিসকে অনুসরণ করে লেখেন `রিপাবলিক` বা গণরাজ্য গ্রন্থটি। সক্রেটিসের প্রতি গণতান্ত্রিক এথেন্স রাষ্ট্রে যে অন্যায় হয়েছিল, তা অবলোকন করেই প্লাটো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। কারণ তিনি দেখেছেন, এথেন্সের মতো গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র সক্রেটিসের মতো একজন জ্ঞানী মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারেনি। ফলে প্লাটো তার রচিত রিপাবলিক গ্রন্থে চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক শাসন নয়, জ্ঞানী মানুষদের শাসন। তিনি বিশ্বাস করতেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না যদি না তারা জ্ঞানী হয়।

 

প্লাটো চান শাসকরা হবে দার্শনিক। বিলাসিতা করা বা সংসার ধর্ম পালন করার সুযোগ থাকবে না তাদের। কারণ সন্তান থাকলেই শাসকরা সন্তানের জন্য সম্পদ বানাতে চাইবে, দুর্নীতিতে জড়াবে। শাসকরা প্রয়োজন মতো নারীর সঙ্গে যৌনমিলন করতে পারবে, কিন্তু সে নারী তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হবে না। সেই নারীর সন্তান হলে তা দায় নেবে রাষ্ট্র। শাসকের সন্তান বলে কিছু থাকবে না। প্লাটোর রচনার ভিতর দিয়ে সক্রেটিসের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয় পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ। সক্রেটিস আজ সকলের কাছে মহান একজন মানুষ, সম্মানিত। তিনি দু হাজার বছর ধরে সম্মানের আসনে রয়েছেন মানুষের অন্তরে। কিন্তু সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষদের হাতেই কিনা নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে। প্রতিষ্ঠিত মানুষদের পক্ষেই সেদিনকার সমাজের অগ্রগণ্যরা রায় দিয়েছিল। সক্রেটিসের মতো মহান মানুষের পক্ষ নেয়নি তারা।

 

বর্তমান সমাজ কি সেই সময়ের চেয়ে পাল্টেছে? না, একেবারেই না। এই আধুনিক যুগে এখনো বর্তমান সমাজে নতুন কথা যে মানুষটি বলবে, তার শত্রুর অভাব হবে না। কারণ সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন। প্রতিষ্ঠিতদের পক্ষে দাঁড়ানো লাভজনক। নতুন কথা যে বলবে, বর্তমান সমাজেও প্রতিষ্ঠিতদের পক্ষ নিয়ে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে রাতারাতি ত্যাগ করতে পারে। সম্পূর্ণ একা হয়ে যেতে পারে সে। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের উদ্দেশ্যেই সাহস জোগাতে গানটি লিখেছিলেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...। হেনরিক ইবসেন তাঁর রচিত "জনতার শত্রু" নাটকে দেখিয়েছেন যিনি ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ান তিনি কীভাবে একা হয়ে যান।

 

বর্তমান সমাজে যাঁরা ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা একাই লড়ছেন। যাঁদের জন্য লড়ছেন তাঁদেরকেও পাশে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং কখনো কখনো তাদের কাছ থেকেও জুটছে অসম্মান। কিন্তু তাই বলে কি সত্যের পক্ষের লড়াইটা থামিয়ে দেয়া চলে?

 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক