
পতঙ্গবিশারদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের আজ জন্মদিন
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : আগস্ট ০১, ২০২৫
পতঙ্গবিশারদ ও উদ্ভিদবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের আজ জন্মদিন। ১৮৯৫ সালের ১ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত লোনসিং নামক গ্রামে এক দরিদ্র কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য একজন গ্রাম্য পুরোহিত ও মাতা শশীমুখী দেবী একজন গৃহবধু ছিলেন। গোপালচন্দ্রের পাঁচ বছর বয়সে অম্বিকাচরণ মৃত্যুবরণ করলে দারিদ্র্যে মধ্যে তার শৈশব অতিবাহিত হয়।
বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষ করার পর গোপালচন্দ্র ১৯১৩ সালে কলেজে আইএ পড়ার জন্য ভর্তি হলেও অর্থের অভাবে তার পাঠ্যক্রম শেষ করা হয়ে ওঠেনি। এরপর তিনি একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন এবং গান রচনা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন হাতে লেখা পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন।
১৯১৮ সালে প্রবাসী পত্রিকায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কাজ করার সময় প্রবাসী পত্রিকায় জৈবদ্যুতি নামক তার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে তা জগদীশচন্দ্র বসুর নজরে আসে। জগদীশচন্দ্র তাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে মেরামতির কাজে নিযুক্ত করেন। এই প্রতিষ্ঠানে থেকেই তিনি জীববিদ্যার ওপর গবেষণা শুরু করেন।
১৯৩২ সালে প্রথম উদ্ভিদের জীবনের ওপর তার গবেষণা বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এরপর জৈব-আলোকবিদ্যার ওপর তার বিভিন্ন গবেষণা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও ধীরে ধীরে কীট পতঙ্গের ওপর তার আগ্রহ জন্ম নেয়। এই সময় তিনি আলোকচিত্রগ্রাহক হিসেবে দক্ষ হয়ে ওঠেন এবং পিঁপড়ে, মাকড়শা, ব্যাঙাচি, বাদুড় প্রভৃতি প্রাণীর আলোকচিত্র তুলতে শুরু করেন।
১৯৪০ সালে বোস ইসস্টিটিউটের পত্রিকায় তিনি দেখান যে, পিঁপড়ে ও মৌমাছির মতো সামাজিক কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে কিভাবে রাণী লার্ভার খাদ্যের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সঠিক ভাবে পরিবর্তন করে অন্য রাণী, কর্মী ও সৈনিক পতঙ্গ সৃষ্টি করেন। পিঁপড়ের জন্য স্বচ্ছ বাসা বানিয়ে চুপচাপ নিরীক্ষণ করে তিনি এই পর্যবেক্ষণ করেন। পতঙ্গদের প্রাকৃতিক বস্তুর ব্যবহারের ওপরও তার গবেষণা নিবদ্ধ হয়।
তিনি লক্ষ্য করেন, কিভাবে শিকারি বোলতা তাদের বাসার মুখ বন্ধ করার জন্য ছোট ছোট পাথরের টুকরো ব্যবহার করে থাকে। প্রজননকালে ঘুরঘুরে পোকা কি ভাবে শিকারিদের আক্রমণ থেকে তার ডিমগুলিকে রক্ষা করার জন্য পেছনের পা দিয়ে কাদার তৈরি গোলক নির্মাণ করে, তা তিনি পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়া ব্যাঙাচি থেকে পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিবর্তনের সময় কিছু ব্যাক্টেরিয়ার উপকারিতা সম্বন্ধেও তিনি গবেষণা করেন। ব্যাঙাচির ওপর পেনিসিলিন ওষুধ প্রয়োগ করে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেগুলি পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙে পরিবর্তিত হতে সক্ষম হয় না।
তার প্রায় বাইশটি গবেষণাপত্র ন্যাচারাল হিস্ট্রিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ সালে ভারতীয় সামজিক কীটপতঙ্গের ওপর তার গবেষণা সম্বন্ধে বক্তৃতা দেয়ার জন্য প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য স্টাডি অব সোশ্যাল ইন্সেক্টস নামক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি ডাক পান। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকার জন্য তাকে বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।
১৯৪৮ সালে গোপালচন্দ্র সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন। পুলিন বিহারী দাসের সঙ্গে তিনি অক্লান্ত ভাবে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কর্মকাণ্ডে শ্রম দেন। ১৯৫০ সালে তিনি জ্ঞান ও বিজ্ঞান নামক বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি ভারতকোষ নামক বাংলা ভাষার একটি বিশ্বকোষ রচনাতেও সহযোগিতা করেন।
বাংলার কীটপতঙ্গ নামক গ্রন্থটি রচনার জন্য ১৯৭৫ সালে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার জয় করেন। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তিনি করে দেখ নামক তিন খণ্ডের একটি গ্রন্থও রচনা করেন।
এ পর্যন্ত গোপালচন্দ্রের ১৬ প্রকাশিত বইয়ের নাম জানা যায়। এছাড়া তার বহু লেখা অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মরণ সংখ্যার তথ্যমতে তার লেখার সংখ্যা হাজার খানেকের মতো, যার সবকিছু এখন আর উদ্ধার করা সম্ভব নয়।
১৯৮১ সালের ৮ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর তিন মাস আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডি.এসসি. ডিগ্রি প্রদান করে। ২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে অবদানের জন্য গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার প্রচলন করেন।