পরিণতি

উপন্যাস ৩

সুলতানা পারভীন

প্রকাশিত : জুলাই ০৩, ২০১৮

আচমকা মনে হলো, দুনিয়াটা কেঁপে উঠল। নাহ্, তেমন কিছুই না, মোবাইলের ভাইব্রেশন! স্ক্রিনে আবার রেড অ্যালার্ট ফুটে উঠল। হ্যাঁ, নেহা, বীথি কই?
ভাইয়া, আপনি একটু বীথির বাসায় আসতে পারবেন এখন?
কী হয়েছে বীথির?
আপনি একটু আসেন, প্লিজ...
আসছি।

বাবার কেবিনের দিকে গেলাম। ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে বাবাকে। এখন ঘুমাচ্ছেন। নার্সকে বলে বীথির বাসার দিকে রওনা হলাম। বীথির বাসাটা হসপিটাল থেকে একটু দূরেই। তার উপরে ঢাকা শহরের জ্যাম তো আছেই। রাস্তার এত কোলাহল কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছি না। পাঁচ-ছ’দিন আগে বাড়িতে এসেছি। অফিসের ৯টা-৫টার কাজ থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে। বাবাও বারবার করে যেতে বলছিল বাড়িতে। মা-বাবা-বোনের ছোট্ট এই পরিবারটা রেখে ঢাকায় থাকতে আসলেই খুব বিরক্ত লাগে। কিন্ত অফিস শেষে বীথির হাসিমাখা চেহারা আর দিনশেষে বাড়ির সকলের সাথে কথা বললেই সমস্ত বিরক্তি-ক্লান্তি বদলে যায় অন্যরকম ভালোলাগায়।

কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ছিল একেবারে আলাদা। ক’দিন ধরেই মা আর বোনের সাথেই কথা হচ্ছিল, বাবাকে কল করলে খুব একটা কথা হচ্ছিল না। বাবা নাকি খুব ব্যস্ত। কী নিয়ে এত ব্যস্ত সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। এর মধ্যেই বাবা কল করে বলল বাড়ি যেতে। তাই চলে এলাম। তাছাড়া বাড়িতেও যাওয়া হয়নি অনেকদিন।

বাড়ি আসার পর বুঝতে পারলাম, বাবা কেমন একটা হয়ে গেছে। চোখ মুখ কেমন শুকনো শুকনো। আর্মিতে ছিলেন, রিটায়ার্ড করেছেন বছর দুয়েক হলো।  এই দুই বছরে বাবাকে এমন ভাবলেশহীন দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

আমার আর বাবার সর্ম্পকটা ভালোই। কিছু বলার হলে বাবাও খুব সাধারণভাবেই বলে দিতে পারেন। আর আমি বাবার যেকোনো কঠিন কথা সহজেই হজমও করে ফেলতে পারি। সেটা বকাঝকাই হোক, বা লাইফ নিয়ে বিশাল কোনো লেকচার। তাই অন্তত আমাকে না বলার কোনো কারণ মাথায় আসছে না। অথচ মনে হচ্ছে, বাবা ব্যাপারটা আমার কাছেই এড়িয়ে যাচ্ছেন।

কথাটা বাবা যখন বলল মোটামুটি একটা ধাক্কার মতোই খেলাম। আসলে বলল বললে ভুল হবে। জিজ্ঞেস করল, বীথির কথা। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল আমার বাবার প্রশ্নটা বুঝতে।

মেয়েটা কে আবির?
বা... বা?
বীথি মেয়েটা কে?
বাবা... বীথি। আমাদের কলেজেই পড়ে। এবার থার্ড ইয়ারে...
আমি তোর আর বীথির ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করছি। এইসব করে বেড়াস শহরে গিয়ে?
এইসব মানে কি বাবা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না...
তোকে শহরে আমি পড়তে পাঠিয়েছি? নাকি কোনো মেয়ের পিছনে ঘুরতে?
বাবা, আসলে আমি বলব বলব করে তোমাকে বীথির কথাটা বলতে পারিনি।
কী বলতি তুই? হ্যাঁ? এই মেয়ের সাথে তুই প্রেম করিস, সেটা?
বাবা... আমি...
চুপ থাক। এইসব মেয়েরা কেমন হয় জানিস? একেবারে সংসারটা তছনছ করে ছাড়বে...
বাবা, বীথি এমন মেয়েই না। তুমি একবার ওর সাথে কথা বললেই...
এখনি এই মেয়েটা তোর মাথাটা চিবিয়ে খেয়েছে। এখনই ওর জন্য আমার মুখের উপর কথা বলছিস, বিয়ে হলে তো আমাদের কোনো বনে জঙ্গলে ফেলে আসবি।
বাবা!

চুপ করে গেলাম শেষমেষ। এখন আমি যাই বলব সবটার দোষ গিয়ে পড়বে বীথির ঘাড়ে। এর চাইতে চুপ থাকাই ভালো। যতদিন বাড়ি ছিলাম, এসব নিয়ে বাবার সাথে কথা বলা হয়ে উঠেনি। বাবাও একসময় নরমাল হয়ে যায়। আর আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।

ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম, বীথির বাসার কাছেই চলে এসেছি।। হুটহাট বীথিকে দেখতে বাসার নিচে অনেকবার এসেছি। তবে বীথির হাজার অনুরোধেও বাসায় যাওয়া হয়নি কখনো। যাওয়াটা এভাবে হবে ভাবিও নি। তবে হঠাৎ একটু নারভাসও লাগছে। কী হয়েছে বীথির, কে জানে!

চলবে