
পাপিয়া জেরীনের গপ্পো সপ্পো
পর্ব ৩
প্রকাশিত : মে ০৪, ২০১৯
কে.কে. স্কুলের সামনে দিয়া আগায়ে গেলে একটা সরু রাস্তা, সেই পথ ধইরা আমরা আগায়ে যাইতেছি। একটা ছাতায় কুলাইতেছে না, তার উপর দমকা বাতাস। যে ঘরটার সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম সেইখানে খিচুড়ি রান্না হইতেছে, কঞ্চির বেড়া দিয়া ধুঁয়া বের হইতেছে। ভিজা পাতা দিয়া ঠিকঠাক চুলা জ্বলতেছে না, রান্ধুনি চুঙ্গায় ফু দিতেছে আর কাশতেছে। এই রান্ধুনি মাইয়ার নাম বেবী, আমাদের এলাকার বিল্লাল মিয়ার বোন। সে আমাদের দেইখা বিরক্ত হইলো, আমরাও অস্বস্তিতে পড়লাম।
আমি আর আমার ছোট খালা এই বাড়ির ভিতরে কোনোমতেই যাব না, এইটা মুন্সীগঞ্জের সবচাইতে বড় গোপন মাদকের আখড়া। অনেকক্ষণ দাঁড়ায়া আছি, বাতাসের তেজ বাড়তেছে— ছোটখালা হঠাৎ ছাতার ডান্ডি আমার হাতে ছাইড়া দিয়া একটা লোকের হাত ধইরা বসলো, মামুন ভাই! ভিতরে সবুজ আছে, ওরে একটু ডাইকা দেন। মামুন (সম্ভবত আমার খালুর নেশারু সঙ্গী) হুংকার দিয়া বললো, তোমরা এই বাড়িতে কেন? যাও, বাড়িত যাও।
আমার ছোটখালা তারপরেও দাঁড়ায়া রইলো, আমি একটু দূরে ছাতা নিয়া। বৃষ্টিতে তার শরীর চুপচুপা ভিজা। আশপাশের উৎসুক কিছু পুরুষ মানুষ তার দিকে আগ্রহ নিয়া তাকায়ে আছে। আমি ছাতা নিয়া তার দিকে আগায়া গেলাম। আমি আমার খালার দিকে তাকায়া আছি, সে হেচকি দিয়া কানতেছে।
সবুজ মামারে নানান নেশার আখড়া থিকা তুইলা আনতে আমরা এইরকম কয়েকটা বিপদজনক অভিযান চালাইছি। আরেকবার গেছিলাম বিখ্যাত কে.পি. ব্যানার্জীর বাড়ি। সেই বাড়ির সবাই থাকে কোলকাতায়, একজন দেখলাম বাড়ি পাহারা দেয়। চশমার এইদিক দিয়া লোকটার চোখ দুইটা মনে হয় ব্যাঙের চোখ, সামনের একটা দাঁতের কোনা ভাঙা। আমাদেরকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেইখা সে খুব দ্রুতপায়ে দোতালায় উইঠা গেল। আমরা দাঁড়ায়ে আছি, পাঁচমিনিট পর বিশ্বজিৎ মামা নামলো। আমি তাকায়ে আছি, সে কথা বলতেছে কিন্তু ঘন গোঁফের ঝালরে তার চিকন ঠোঁট দুইটা দেখা যাইতেছে না, গোঁফের লেয়ারটা হালকা দোল খাইতেছে। সে আমার খালারে হয়তো বাসায় ফিরা যাওয়ার কথা বলতেছিলো। আমি একটু দূরে, স্পষ্ট শুনতে পাইতেছিলাম না। উনি উপরে চইলা যাওয়ার পরেও আমরা দুইজন বইসা অপেক্ষা করলাম, কিন্তু লাভ হইলো না।
কোনো নেশার আড্ডা থিকাই আমরা সবুজ মামারে তুইলা আনতে পারি নাই কোনোদিন, সে একবারও বাইরে আইসা আমাদের সাথে দেখাও করে নাই। কিন্তু আমি বুঝতাম আমার খালু (তারে সবুজ মামাই ডাকতাম) ওইসব জায়গায় আছে, তার সুবাস টের পাইতাম। আমার ধারণা আমার খালাও সেইটা টের পাইতো।
সবুজ মামার শরীরে সবসময় নতুন টাকার গন্ধের মতো একটা সুবাস ছিল। সে ঢাকায় চইলা গেলেও তার রুমে দুইতিনদিন সেই সুবাসটা থাকতো। সবুজ মামা প্রথম যখন আমার খালারে স্বপ্নে দেখে, তখন আমার খালা ক্লাস সিক্সে পড়ে। স্বপ্নে খালা দুইটা ডাম্বেল হাতে নিয়া সবুজ মামার দিকে আগায়া আসতেছিল। স্বপ্নের বর্ণনা যখন শুনতেছিলাম তখন জানতাম না, ডাম্বেল মানে কী, মনে মনে নানান বস্তু চিন্তা কইরা নিতেছিলাম। ওই স্বপ্নটার পরই সবুজ মামা আমার খালার পিছু নেয়া শুরু করলো। ভোর ছয়টায় ছোটখালা প্রাইভেট পড়তে মলয় স্যারের বাড়ির দিকে রওনা দিতো, তাদের ব্যাচ ছিলো হয়তো সাতটায়। বাড়ির থিকা স্যারের বাসায় হাঁইটা যাইতে লাগতো আধাঘণ্টারও বেশি। সবুজ মামা ভোরে তার পিছ নিতো। সবুজ মামা কিছু চিঠি আমারে দিয়া পাঠাইতো, আমার খালারে সেইসব চিঠি পৌঁছায়া দিলে মাইর খাইতাম প্রথম প্রথম। ছোট খালাই মারতো, বলতো, যদি ওই বদমাইশটার চিঠি আর কোনোদিন আনস তাইলে আম্মার কাছে বিচার দিমু। এইকথা বইলা সে বারিন্দার কোনার রুমটাতে ঢুকতো। বারিন্দার ওই রুমটা ছিলো আমার খালার ড্রেসিংরুম কাম রিডিংরুম। আমি ছিলাম খালার ছায়সঙ্গী, কিন্তু ওই রুমটায় ঢুইকা সে ছিটকিনি দিলে আমি একা হইয়া যাইতাম। লোহার দরজায় ঠেস্ দিয়া দাঁড়ায়া অপেক্ষা করতাম। দরজার আংটার পাশে একটা ফুটা দিয়া দেখতাম, দেখতাম সে হয়তো সালোয়ার কামিজ চেঞ্জ করতেছে অথবা চিঠিগুলা একটা একটা কইরা পড়তেছে। আমি তখনও বুঝতাম না, যেই চিঠি আইনা দিলে সে এতো মারতো— আবার চুপেচাপে সেই চিঠি পইড়া সে এত খিলখিলায়ে হাসতো কেন! কী আছে সেই চিঠিতে!
সবুজ মামা আর খালার বিয়ার আগের কোনো স্মৃতি আর মনে নাই আমার। একটা রাত্রের কথা মনে আছে শুধু, একটা বিশাল ঘরে পালঙ্কের উপর আমার নানা-নানী ঘুমাইতো, আর আমি-আম্মু-ছোটখালা পাশেই আরেকটা খাটে শুইতাম— সেই রাত্রে খালা কোথাও নাই। বাড়ির সবাই ছটফট করতেছে, আমার সেঝো মামা গেছে থানায়। নানাভাই নামাজে দাঁড়ায়া আছে। আমার নানী কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার দিয়া উঠতেছে। আমি আবছা অন্ধকারে বারিন্দা দিয়া উত্তরের রুমটায় আগায়া গেলাম। সেইরুম তছনছ করা হইতেছে, কিন্তু ছোটোখালা কোথাও নাই।
আমার খুব খিদা লাগছিলো সেই রাত্রে, ভাতও টেবিলে দেয়া— কিন্তু কেউ খাইতেছিল না, বা খাইতে দিতেছিল না। আমার মিলন মামা চৌকাঠে বইসা কান্তেছিল (আজীবন তারে ক্ষুদ্র বিষয়ে চোখ ভাসাইতে দেখছি), আর বলতেছিল— এই রেডিওটা ছাইড়া মনিরে বুকে নিয়া ঘুম পাড়াইতাম, ও বুকের উপরই ঘুমাইতো আমার। আমিও অরে বুকে নিয়াই ঘুমায়া পড়তাম। একদিন ঘুম থিকা উইঠা দেখি মনি বুকের উপরে নাই। হঠাৎ দেখি সে সারা মেঝে জুইড়া ছোট ছোট পা ফালায়া নাচতেছে— মোমোর পুতুল মমির দেশের মেয়ে নেচে যায়...
এই কথা শুইনা সবাই ডুকরায়ে উঠলো। আমি তখনও কিছু বুঝতে পারতেছিলাম না ঘটনা আসলে কী। পরে অবশ্য জানতে পারছিলাম, আমার খালা সবুজ মামার সাথে চলে গেছে। বিয়ার পর এত সুখী আমি কাউরেই দেখি নাই জীবনে। এই যে, বিয়ার পরও যে আমরা নানান নেশার আখড়ায় সবুজ মামারে খুঁজতে যাইতাম সেইখানেও একধরনের আনন্দ কাজ করতো, এ্যাডভ্যাঞ্চারও। আমরা জানতাম আখড়ায় সবুজ মামা না দেখা করলেও সেইদিন বাসায় আাইসা দারুণ একটা নাটক করবে। দরজায় ছিটকিনি লাগায়ে আমার খালার পা ধইরা রাখবে, আমার খালা তারে জোরে জোরে পিঠে মারবে। আর সবুজ মামা নিচা হইয়া খালার পায়ে ঠোঁট ছোঁয়ায়ে রাখবে, নানার রূপে মানভঞ্জন করবে।
আমার সবুজ মামা অবশ্য বেশিদিন বাঁচে নাই। ভোক্যাল কর্ডের ক্যান্সারে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হইছিল। আমার খালার পরে দ্বিতীয় বিয়া হইছে, বর ডাক্তার। দুই সন্তান আছে তাদের। আমার খালা এই খালুর জন্যও বৃষ্টিতে ভিজে, রইদে পুড়ে... অপেক্ষা করে। কখনও আবার চিৎকার কইরা কান্দে। আমার এই খালুও বাড়িতে ফেরে, কিন্তু তার পায়ে চুমায়ে মানভঞ্জন আর হয় না।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী