
পেন্ডুলাম
পর্ব ১
শাহরুখ পিকলুপ্রকাশিত : জুলাই ০৪, ২০১৮
ঢাকার হোলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় জঙ্গী হামলার নৃশংসতার তিন মাস পর মতিঝিল কলোনির কাঞ্চি-গলির কাঁচা বাজারের রাস্তায় প্রত্যুষে একটা লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেলো। তখন অবশ্য সে এলাকা নীরব, সুনসান। ফজরের ওয়াক্তেই হাজির হওয়া এক দল তরকারিবিক্রেতা তা আবিষ্কার করলো। লাশটা ততোক্ষণে ঠান্ডা হ’য়ে গেছে, মৃত্যু হ’য়েছে আরো অনেক আগে, গভীর রাতে। পিঠে তিনটে গুলির ফুটো সহজেই দৃশ্যমান।
হন্থাকারী দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রায় অবসরের প্রান্তে পৌঁছানো এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। সে তার মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নিহতের মুখটা অনেকক্ষণ পরীক্ষা ক’রে মৃদু স্বরে বললেন, ‘শালা, বাইনচোদ! সারা জীবন তোরে কই কই খুঁঝছি, শেষটায় ঠিকই পাইসি’।আরো অনেক অস্রাব্য কিছু গালাগাল দিয়ে তিনি তার মোবাইলটা দিয়েই নয়াপল্টন মসজিদের এক্সট্রা-ইমামের বুকে একটা গুঁতো দিলেন। তার অধস্তন পুলিশেরা বুঝলো না যে এই গালাগালে, এই গুঁতোয় কতটা তিক্ততা ছিলো, কত স্মৃতি ছিলো, দুঃখ-বেদনার স্মৃতি- অকালে বন্ধু-সহকর্মী হারানোর ব্যথা।
নয়াপল্টন মসজিদের অবৈতনিক এক্সট্রা-ইমাম সাহেব দুপুরের প্রায় শেষে শান্তভাবে মসজিদে ঢুকে জোহরের নামাজ আদায় ক’রলো। আপাত শান্ত চেহারা দেখে বোঝার উপায় ছিলো না যে, তার সারা শরীরের ভিতর এক উত্তেজনার তরঙ্গ বয়ে চ’লেছে, ভিতরে ভিতরে হালকা কাঁপন সে অনুভব ক’রছে। কিছুক্ষণ আগেই ব্লগার আব্দুস সামাদের পুরানা পল্টনের বাড়িতে সে উপস্থিত ছিলো, আরো তিনজনের সাথে, বাকিরা সবাই যুবক, সে তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে। সঙ্গীদের সাথে ছিলো রামদা ও চাইনিজ কুড়াল।
পরপর কয়েকটা কোপের পরেও রক্তে ভেসে যাওয়া সেই ব্লগারের গোঙানির শব্দ হচ্ছিলো, যুবকেরা তখন কোপের দাগ আর রক্তের বন্যা দেখে বেশ হতভম্ব, কিছুটা দিশেহারা। এক্সট্রা-ইমাম তখন একজনের রামদাটা ছিনিয়ে সামাদের গর্দানে পাকা হাতের একটা কোপ দিতেই সব শেষ। ‘পালা’ বলে সে নিজে শান্তভাবে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুরানা পল্টন থেকে হেঁটে হেঁটে নয়াপল্টনে এসেছে।
সময়ের হিসাবে কিছুটা ভুল হওয়ায় সে তার মসজিদের জোহরের জামাতটা ধরতে পারেনি। ‘আপনি জামাতে শামিল হইলেন না?’ মসজিদের রেগুলার ইমাম রেজাউল হক তাকে প্রশ্ন করলে, সে বললো, ‘একটু কাজে গেছিলাম, ফিরতে দেরি হ’লো, জামাতটা ধরতে পারলাম না। জোহরের ওয়াক্ত তো যায়নি’।
‘তা ঠিক। আচ্ছা আসরের টাইমে আমি একটু কাজে যামু, আপনে নামাজটা পড়াইয়েন’।
‘আপনি নিশ্চিন্ত মনে যান, আমি ইমামতি করবো’। এই জন্যই সে এক্সট্রা-ইমাম।
আব্বাস-১
আব্বাসের জন্ম পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি, বরিশাল শহরের কাছাকাছি এক গ্রামে। সেখানের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে সে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে ইন্টারমিডিয়েট পড়া শুরু করেছে যখন তখন ‘একাত্তর’ এসে উপস্থিত। সে থাকতো তার মামার বাড়িতে, বরিশালের টাউনহলের কাছেই। যুদ্ধে সে যায়নি। আব্বাস তখন চারু মজুমদার আর শ্রেণি সংগ্রাম নিয়ে মত্ত। তার কলেজের এক বড় ভাই তাকে বললো যে, এ আমাদের যুদ্ধ না- নকশালবাড়ি তখন আব্বাসের প্রতিটা ধমনী ও শিরায় প্রবাহিত হ’চ্ছে।
বাহাত্তরে স্বাধীন দেশে সে নিজেকে পরাধীনই মনে ক’রলো, শ্রেণি সংগ্রাম শুরুই হয়নি, সে সর্বহারা পার্টি ও সিরাজ শিকদারের সন্ধানে তখন। খুঁজে সেই দলেরই আড্ডার সন্ধান সে পেলো, সেখানে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো নেতাদের কথা শোনে, সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন অভিযানের কথা শোনে, পুলোকিত হয়। সেই সব ঘটনার সত্য-মিথ্যা-অতিরঞ্জন সে ধরতে পারে না কিন্তু আঠার মতো লেগে থাকে।
ইতোমধ্যে চারু মজুমদারের মৃত্যু সংবাদ সে পেলো সেই আড্ডায়, সেখানে বেশ কিছু লেখা সংগ্রহ করলো, প’ড়ে সে আরো উজ্জীবিত হ’লো। তেয়াত্তরে টেনেটুনে দ্বিতীয় বিভাগে সে এইচএসসি পাশ ক’রলো, নামকাওয়াস্তে ব্রজমোহনেরই পাস কোর্সে বিএ-তে নাম লেখালো।
সেই বছরেরই শেষে সে পিরোজপুরের এক গ্রামে এক জোতদার নিধন অভিযানে দলের সঙ্গী হ’লো। সেখানে খুনোখুনি হ’লো, সে বর্শা বিধে দিলো জোতদারের এক লোকের পিঠে। আইনের চোখে সে খুনী সাব্যস্ত হ’লো কিন্তু ধরা পড়লো না। পালিয়ে চ’লে এলো ঢাকায় তার আরেক মামাবাড়িতে।
নয়াপল্টন মসজিদে একদিন ফজরের বেশ পরে কয়েকজন যুবকের সঙ্গে আলোচনা করছিলো এক্সট্রা-ইমাম সাহেব। যুবকদের সে আগেই চেনে, তাদের সঙ্গে আগেও অনেক দেন-দরবার হ’য়েছে তার। যুবকদের একজন তার টেলিফোনে এক্সট্রা-ইমাম সাহেবকে একটা লেখা প’ড়তে দিয়ে তাদের উত্তেজনার কারণ বোঝাতে চাইলো। লেখাটা ব্লগার আব্দুস সামাদের। লেখায় ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হ’য়েছে, তিনি ধীরে ধীরে পুরোটা প’ড়লেন, তারপর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আব্দুস সামাদ সম্বন্ধ্যে জানতে চাইলেন।
যুবকরা তাকে জানালো যে, আব্দুস সামাদ পেশায় সাংবাদিক, থাকে পুরানা পল্টনের এক ভাড়াবাড়িতে, সঙ্গে বৌ আর এক বাচ্চা, বৌ সকালে কাজে যায়, বাচ্চা, স্কুলে। সামাদ বেশ বেলা ক’রে, দুপুরের পরে পত্রিকা অফিসে বা অন্য কোন কাজে বের হয়।
‘তাহলে ঠিক দ্বিপরহরই মোক্ষম সময়’।
‘জ্বি, হুজুর’। ‘আচ্ছা।
তাহলে রবিবার বেলা এগারোটায় তোমরা ‘জিনিস’ নিয়ে এখানে হাজির হও, তবে আগে নিশ্চিত করবে যে সে বাসায় আছে,
থাকবে। একজন লুক-আউট রাখবে সকাল থেকে’।
‘জ্বি, হুজুর’।