প্লেটো: ইউরোপীয় দর্শনের নাকি মানব চিন্তারাজ্যের আদিপুরুষ

মিনহাজুল ইসলাম

প্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০২০

দর্শন বলতে ইউরোপীয় দর্শন আমরা বলে থাকি। অর্থাৎ এটার সাথে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা জড়িত এবং ইতিহাসকেও সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে ইতিহাস লেখা হয়। এটা আসলে খারাপ কিছু নয়। কারণ ইউরোপে মধ্যযুগ থেকেই একটা দীর্ঘ দর্শনচর্চার সিলসিলা চালু হয় এবং সেটা পোক্ত হয় আরও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির মাধ্যমে। ইউরোপীয় দর্শন বলতে আমি মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দর্শন চর্চাকে বুঝি। এখানে প্রতিষ্ঠান বলতে কোনো দালানকোঠার আদলে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ নয়। প্রতিষ্ঠান বলতে একটা কালচার অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের আদি অর্থ যেটা সংঘবদ্ধতা, সেটা বুঝি। সেটা মধ্যযুগের অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই মোটামুটি চালু হয়। পরবর্তীতে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের অর্থাৎ দালানকোঠার মধ্যে দিয় একটা বড় রূপ পায়। এখন ইউরোপীয় দর্শন বলতে যা বুঝায় বা ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস যারা লিখেছেন তার প্রায় সকলেই সক্রেটিস থেকে শুরু করেছেন। কেউ কেউ আলাদা করে প্রি-সক্রেটিস অর্থাৎ হেলেনিয় আমল থেকে শুরু করেছেন।

এখন সমস্যাটা হচ্ছে, ওই সময় না ছিল জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্ট, না ছিল আমরা রাষ্ট্র বা দেশ বলতে যা বুঝি, সেটার কনসেপ্ট। তখন ছিল নগরকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিংবা রাজ্যব্যবস্থা। আর তখন কালচার এত সংকীর্ণও ছিল না। আরবের লোকজনরা তখন সিরিয়াক আর্মেইক গ্রীক ভাষা পারতো। ওদিকে গ্রীসের লোকেরাও আরবি, ফার্সি ভাষা পারতো। তাহলে এই যে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস লিখতে গিয়ে গ্রীক দার্শনিক অর্থাৎ সক্রেটিস-প্লেটো অ্যারিস্টটল প্রমুখদেরকে ইউরোপীয় দর্শনের ভিত্তি কিংবা আদি পিতা হিসেবে যে প্রচার করা হয়, তার কারণ কি? এমনকি ‘গ্রীক দার্শনিক’ এই কনসেপ্টটাও কিন্তু এখনকার ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাসবিদদের ট্যাগ। কারণ এখনো নেটে সার্চ করলে দেখা যায়, প্লেটো একজন এথেনিয়ান দার্শনিক। কারণ ওই সময়কার কনসেপ্ট তো জাতিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক ছিল না। ‘জাত’ এর কনসেপ্ট বা এটার পলিটিক্স ছিল, কিন্তু সেটা এখনকার অর্থে নয়। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন নামের এক ইংরেজ চিন্তাবিদ ‘জাতি’ কনসেপ্টটার যে সিলসিলা বা ট্রাডিশন সেটার একটা ক্রিটিকাল আলাপ করেছেন।

আমাদের রবীবাবুও জাত কনসেপ্ট নিয়ে লিখেছেন। এখন সমস্যা হলো, যখন কোনো বিষয় বা টার্মকে একটা স্পেসিফিক হিস্টোরিকাল পরম্পরায় ব্যাখ্যা করা হয় তখন সেটা একটা ডিসকোর্সে পরিণত হয়। কিন্তু সেই ডিসকোর্সটা পরবর্তীতে অ্যাহিস্টোরিকাল হয়ে যায়। যেমন, প্লেটো কিংবা অ্যারিস্টটলরা ইউরোপীয় দার্শনিক ছিলেন, এটা অবশ্যই হিস্টোরি ব্যাসিসে ঠিক করছেন ইতিহাসবেত্তারা। কিন্তু আসলেই কি তারা ইউরোপীয় দার্শনিক বা গ্রীক দার্শনিক বা পাশ্চাত্য বিদ্যার আদিপিতা কিনা বা নাও হতে পারে, এই ধরনের ক্রিটিকাল আলাপের যে সুযোগ সেটা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ইতিহাস হয়ে যায় একমুখী এবং সরলীকরণ হয়, আর সেটা অ্যাহিস্টোরিকাল হয়ে যায়। ইতিহাসকে বুঝতে হলে ঐতিহাসিক থিসিস বা ওই সময়কার মামলা বা হাউকাউটা ধরতে হবে, এটা হেগেলের কথা। আবার ইতিহাসকে বর্তমান থিসিস বা বর্তমান যে চিন্তা মামলা চলে সেটা বেসিসেও বুঝতে হবে। তাহলে নতুন কিছু বের করা সম্ভব। কিন্ত আমার মনে হয়, সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলকে একটা বর্গে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রথম দিককার দার্শনিক বা আদিপিতা— এরকম দাবি করাতে দুটো সমস্যা আছে। একদিকে তাদেরকে ‘ইউরোপীয় দার্শনিকে চিন্তার আদিপিতা’ বলে সংকীর্ণ করা হয় তাদের চিন্তা কে, অন্যদিকে ইউরোপীয় দর্শন বলতে যা বোঝায় সেই দর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা হয় এবং বলা হয়, পৃথিবীতে প্রথম চিন্তা ও দর্শন ‘ইউরোপীয়’রাই করেছে। এখন চিন্তা বা জ্ঞানের বাতিটা কারা প্রথম দিকে জ্বলিয়েছিলেন, এটা বারবার দাবি করা একটা রাজনৈতিক দাবি বলে আমি মনে করি এবং যার ফলাফল ভালো নয়।

আমার মতে, প্রাচীন ভৌগলিক ও সংস্কৃতি যেমন ছিল, এখন তেমন সেটা নাই। প্রাচীন চিন্তা ও জ্ঞানের প্রকৃতি, বিস্তৃতি, প্রচার ও প্রসার আর এখনকারটার মধ্যে প্রচুর তফাৎ আছে। সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলকে এভাবে ইউরোপীয় দর্শনের আদিপুরুষ বলে জাহির করাটা চিন্তা বা জ্ঞানের দাবি নাকি রাজনৈতিক দাবি, সেটা ভেবে দেখার বিষয়। ইউরোপীয় দর্শন বলতে আমি কি বুঝি তা আমি ক্লিয়ার করেছি এবং সেটার সিলসিলা অর্থাৎ সেটার অরিজিনসটা ঠিক সক্রেটিস-প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলদের দের সময়, নাকি অন্য কোনো সভ্যতা বা জাত বা অন্য কোনো দর্শনপড়ার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির সময়ের আউটকাম— কোনটা?

আমার মতে, সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল ইউরোপীয় দর্শন বলতে যা বোঝায় সেই অর্থে ইউরোপীয় দার্শনিক নন। খোদ সক্রেটিস ধার্মিক দার্শনিক বললে অনেকে ক্ষেপে যায়, আমি বুঝি না সমস্যাটা কোথায়! প্লেটোকে ধর্মতত্ত্বের পিতা বললে অনেকে ক্ষেপে যায়। আমি বুঝি না কেন! সক্রেটিস ও প্লেটো দুজনই নৈতিকতা, মানবসত্তা, খোদা, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ন্যাচারল ল বলতে যা বোঝায় মানে প্রাকৃতিক আইন, সেটার সাথে ধর্মের যে আদি সম্পর্ক এবং প্রাকৃতিক আইনের রিসোর্স যে ধর্ম— এই চিন্তার চিন্তাবিদরা সক্রেটিস ও প্লেটো। ধর্ম কি, আইন কি, খোদার সাথে মানুষের সম্পর্ক, জ্ঞান কি, ভালোবাসা কি, বন্ধুত্ব কি, ইনসাফ কি, হক কি— এসব নিয়ে সক্রেটিস ও প্লেটো প্রচুর মাথা ঘামিয়েছেন। সক্রেটিস একেশ্বরবাদী ছিলেন, প্লেটোও ছিলেন। তাদের ধর্ম সম্পর্কে আমার ধারণা নাই। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব বলতে যা বুঝায় তার আদিপুরুষ সক্রেটিস ও প্লেটো, বিশেষ করে প্লেটো, নিঃসন্দেহে। আমি আমার মত যে সহিহ, এ দাবি করছি না। কারণ সহিহ মত ও পাণ্ডিত্য বলতে যা বোঝায় তার তালাশ এথেনিয়ান দুই গুরু শিষ্য জীবনভর খুঁজেছেন। এক্ষেত্রে তারা আমার এক প্রকার গুরু। কিন্তু আমার অভিযোগটা কলোনিয়াল জ্ঞানের বিরুদ্ধে। জ্ঞানের ও চিন্তার ভৌগলিকতার বেসিসে পার্থক্য করা ও ক্লাসিফাই করা গুরুত্বপূর্ণ আগেই বলেছি। কিন্তু সেই ক্লাসিফিকেশনটা যখন কোনো কিছু শ্রেষ্ঠ এবং অশ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য হাউকাউ জন্ম দেয় তখন সেটা বর্ণবাদের দিকে যায় বলে আমি মনে করি। এথেনিয়ান সেই চিন্তাবিদরা যারা সত্য চিন্তা করেছেন তারা সকল মানব জ্ঞান ও চিন্তার আদিপুরুষরূপে হাজির থাকেনই। তাদেরকে ইউরোপীয় দার্শনিক এবং ইউরোপীয় চিন্তার আদিপুরুষ রূপে হাজির করা ও প্রমাণ করার মধ্যে একটা রাজনীতি আছে, আমি সেটাই ভয় পাই।