পয়লা বৈশাখ বাঙালির নয়, ধনীদের উৎসব

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০২৩

মঙ্গল শোভাযাত্রা বা আনন্দ শোভাযাত্রা যাই করুক সেটাতে বাধা দেয়ার পক্ষে আমি নই। যদিও প্রথম দু’তিন বছর আমি আনন্দ শোভাযাত্রায় যোগ দেয়ার পর তাতে পরে আর কখনো যোগ দেইনি। বহুজন বলতে চান এটা হিন্দুয়ানি। যদি তাদের মতে এটা হিন্দুয়ানি হয় তবুও এটাকে বাধা দেয়ার কিছু যুক্তি নেই। মানুষের স্বাধীনতায় তা হস্তক্ষেপের শামিল। কারো কারো মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দুয়ানি মনে হওয়ায় তা বাতিল করতে হবে কেন? এই শোভাযাত্রার কারণে কি মুসলমানদের ধর্ম পালন করার মানুষের সংখ্যা কমে গেছে নাকি ধর্ম পালন করার সমস্যা হয়েছে? ইসলাম ধর্মের পবিত্র কুরানে স্পষ্ট করে বলা আছে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। বলা আছে, অকারণে ফ্যাসাদকারীরা মন্দ লোক। যদি এসব নিয়ে জটিলতা করা হয়, দিনে দিনে জটিলতা বাড়বে বই কমবে না।

 

পহেলা বৈশাখ বাংলার ঐতিহ্য, কথাটা সঠিক। কিন্তু শুধু বাংলার নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের ঐতিহ্য। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে যেদিন গুলি চলে সেদিনটা ছিল পহেলা বৈশাখ, সেখানে সেদিন পহেলা বৈশাখের মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। পহেলা বৈশাখ আসলে এশিয়ার অনেক দেশের ঐতিহ্য। থাইল্যান্ড, নেপাল, শ্রীলঙ্কা তো আছেই। কিন্তু পহেলা বৈশাখ ষাট বছর আগে কখনো বাঙালির উৎসব ছিল না। পহেলা বৈশাখ একদিকে ছিল বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং বাঙালি জমিদারদের উৎসব। রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহে তা অনেকটা ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হতো এবং সেখানে মুসলমান বাঙালি কৃষকদের অংশগ্রহণ খুব সম্মানজনক ছিল না। রবীন্দ্রনাথ নিজে সেই ব্যবস্থা বাতিল করেন। বাকি জমিদাররা তা করেননি। সব মিলিয়ে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম কৃষকের উৎসবের দিন নয় এটা। বরং এই দিন কৃষকরা জমিদারকে এই উৎসব পালনের জন্য একদিকে অর্থ জোগাতে বাধ্য ছিল, ভিন্ন দিকে কৃষকদেরকে জমিদারদের সকল খাজনা পরিশোধ করতে হতো আগের দিন। না করতে পারলে কৃষকদের ওপর চলতো জমিদারদের নির্যাতন। ফলে যারা এটাকে বাঙালির আবহমানকালের উৎসব বলতে চাচ্ছেন, ঠিক বলছেন না। কৃষকদের খাজনা পরিশোধের দিবস ছিল সেটা, উৎসবের নয়। সমাজের ধনীদের উৎসবকে বাঙালির উৎসব বলে প্রচার করাটা হবে এক ধরনের প্রহসন।

 

ষাট বছর ধরে যেভাবে প্রথম ঢাকাকে ঘিরে বাঙালি শিক্ষিতদের পহেলা উৎসব পালিত হচ্ছে তা ছিল অনেকটা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চরিত্রের। পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তা ছিল বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বাধিকারের লড়াই। সন্দেহ নেই তা অবশ্যই ভদ্রলোকদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। এখনো তাই আছে। বাঙালির সংস্কৃতি সেটাকে বলা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। একটি জাতির সংস্কৃতির প্রধান দিকটা হচ্ছে তার ভাষা। কারণ ভাষাই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে জাতির জীবনে টিকে থাকে। বাংলাদেশের যেসব বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে হরদম ইংরেজি ভাষার চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, যদি তারা পহেলা বৈশাখ পালনকে মনে করেন বাঙালির সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা, সেটা খুব হাস্যকর ঠেকবে। বাংলা ভাষার ধ্বংস সাধন করে বাঙালির সংস্কৃতি পালনের এই ভণ্ডামি গ্রহণযোগ্য নয়।

 

পহেলা বৈশাখ যতদিন না বাংলার বৃহত্তম জনগণ একই সুরে একই প্রাণে পালন করবে, ততদিন এটাকে বাঙালির উৎসব বলা যাবে না। দিনটাকে এশিয়ার আরও অনেক দেশের সঙ্গে মিলিয়ে শুধু বাংলার ঐতিহ্য বলা যাবে। কিছু ধনীদের উৎসব বাঙালির উৎসব হতে পারে না। কিছুতেই তা হাজার বছরের বাঙালির উৎসব নয়। সত্যি বলতে, শ্রেণি বিভক্ত সমাজে সব বাঙালির একরকম সংস্কৃতি থাকাই সম্ভব নয়। গুলশানের বাঙালি আর গ্রামের সাধারণ দরিদ্র বাঙালির সংস্কৃতি এক হবে কেমন করে?